Tuesday, November 27, 2012

সারপ্রাইজ কেকের অসমাপ্ত গল্প!

নভেম্বারের ৮ তারিখে আমার ওয়ালে  "আগামীকাল ওয়ালমার্টের সকলের জন্য পাঠাচ্ছি 'সারপ্রাইজ কেক"!! শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, শুক্রবারে ওয়ালমার্টের সকল সহকর্মীর ঊদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা কেক পাঠাবো। এরপর আরও দুই তিন শুক্রবার পার হয়ে গেছে, কেক পাঠানোর গল্প বলার সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। আজ ছবির এলবাম ঘাঁটতে গিয়ে সেদিনের সেই 'সারপ্রাইজ কেকের' ছবি দেখে মনে পড়ে গেলো, সারপ্রাইজ কেকের গল্পটি তো শেষ করা হয় নি! 

আমি বেকারী ম্যানেজার ডেবী'র কাছে কেকের অর্ডার দিয়ে চলে এসেছিলাম। পরেরদিন বৃহস্পতিবার আমার ডে অফ ছিল, শুক্রবার বেলা ১২ টায় ছিল আমার শিফট। পৌণে বারোটার দিকেই আমি ওয়ালমার্টে পৌঁছে যাই। আগের দিন উত্তম কুমারকে দিয়ে একখানা সুন্দর 'থ্যাঙ্কস কার্ড' তৈরী করিয়েছিলাম। সেই কার্ডটি সাথে করেই আমি সরাসরি বেকারী ডিপার্টমেন্টে চলে যাই। গিয়েই ডেবীর খোঁজ করি, ডেবী'কে না পেয়ে টিনার কাছে যাই। টিনা আমাকে জানায়, কেক প্রায় রেডী, ডেকোরেশান চলছে। মাথা উঁচু করে দেখি, একটি মেয়ে ধবধবে সাদা কেকের উপর হলুদ গোলাপ বসাচ্ছে। ওদের বলে আসলাম, কেক রেডী হয়ে গেলে আমাকে জানাতে, আমি কার্ডসহ কেক টি ব্রেক রুমে রাখবো। ওদের কাছ থেকে রিসিট নিয়ে ক্যাশ রেজিস্টারে গিয়ে দাম মিটিয়ে দিলাম। এরপর  আমি ক্লক ইন করে হাতের বই, ব্যাগ ভেতরে রাখতে গিয়ে দেখি, টি-রুমের টেবিলে বিরাট এক কেক সার্ভ করা আছে। কেউ কেউ কেক কেটে খাচ্ছেও।  কেক দেখে আমি ভীষন চমকে গেছি। কালচে বাদামী 'স্পাইডার ম্যান' কেক কোথা থেকে আসলো! জানতে পারলাম,  স্পাইডার ম্যানের নতুন ডিভিডি রিলিজ উপলক্ষে ওয়ালমার্ট কর্তৃপক্ষ সকলের জন্য কেকের ব্যবস্থা করেছে। আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেলো, একটু পরেই আসবে আমার তরফ থেকে কেক, কার এতো দায় পড়েছে, এক কেক শেষ হতে না হতেই আরেক কেক খাবে! 

মন খারাপ নিয়েই আমার সময়মতো আমি আমার ডিপার্টমেন্টে চলে গেলাম। ঘন্টা দুই পরেই ডেবী ( কোন কারণ ছাড়াই এই মহিলা আমাকে দারুণ ভালোবাসে) আমার ডিপার্টমেন্টে এসে সংবাদ দেয়, কেক রেডী। আমি আমার রেজিষ্টার ছেড়ে বের হতেই দেখি, ডেবীর দুই সহকর্মীর হাতে বিশাল সাইজের কেকের ট্রে ধরা। কেকের চেহারা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। আমার মুগ্ধতা ডেবীর ইশারায় ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি ওদের পিছু নিলাম, পৌঁছে গেলাম টি-ব্রেক রুমে। ওরা খুব যত্ন করে কেকটি সেই 'স্পাইডার ম্যান' কেকের পাশে বসিয়ে দিল। আমি থ্যাঙ্কস কার্ড কেকের পাশে রেখে উপস্থিত কর্মীদের ঊদ্দেশ্যে ছোট্ট করে বললাম, আমি যখন মায়ের মৃত্যুশোকে কাতর, আমার ওয়ালমার্ট বন্ধুরা আমার পাশে দাঁড়িয়ে যে ভালোবাসা, সহমর্মিতা দেখিয়েছে, তোমাদের সেই ভালোবাসার ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবো না, কিন্তু আমার পাশে থাকার জন্য তোমাদের সবাইকে ছোট্ট ধন্যবাদ জানাতে চাই। 

কেক ও কার্ড রেখে আমি কাজে ফিরে আসি। ঘন্টা দুই পরে গিয়ে দেখি, কেকের এক চতুর্থাংশ খাওয়া হয়েছে। পাশের কালচে খয়েরী কেকটাকে ইচ্ছে করছিল এক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেই। আরও পরে একজন একজন করে আমার কাছে আসতে লাগলো, আমাকে 'হাগ' করে দ্বিতীয়বার সহানুভূতি জানিয়ে গেল, সাথে এটা যোগ করতে ভুললো না, " এই কেকের আইডিয়া খুব ভালো হয়েছে, কেকটা দেখতে ভারী সুন্দর হয়েছে, আর খেতেও হয়েছে অতি চমৎকার"। নীতিগতভাবেই আমি কেক খাইনি, তবে কেকের চেহারা দেখেই বুঝেছি, এই কেক সুস্বাদু না হয়ে যায় না। এক ফাঁকে আমি আবার বেকারী ডিপার্টমেন্টে গিয়ে  ডেবী, টিনা আর ডেকোরেটার ভ্যালেরী'কে স্পেশ্যাল ধন্যবাদ দিয়ে এসেছি।

সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পর আমি লাঞ্চ ব্রেকে যাই ( ওয়ালমার্টে এক ঘন্টার ব্রেককে লাঞ্চ ব্রেক বলে, দিন বা রাত্রি কোন ম্যাটার করে না), এবার সত্যিকার অর্থেই বিস্মিত হই। কেকের এক চতুর্থাংশ অবশিষ্ট আছে, পাশে স্পাইডার ম্যান তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।  শুরুতে স্পাইডার ম্যানকে দেখে আমি মন খারাপ করেছিলাম, ভেবেছিলাম আমার সারপ্রাইজ কেক কেউ খাবে না। এখন স্পাইডার ম্যানকে মনে মনে স্যালুট করলাম। তার কালচে খয়েরী রঙের পাশে দুধসাদা সারপ্রাইজ কেককে দেখতে স্নো হোয়াইটের মত লাগছিল। এই জন্যই সকলে স্নো হোয়াইটের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। টি রুমে আমাকে সকলেই ধন্যবাদ জানাচ্ছিল। আমার মনে আর কোন দুঃখ ছিল না। মনে মনে ভাবছিলাম, আমার মা মানুষকে খাওয়াতে খুব পছন্দ করতেন, এই জন্যই বোধ হয় উনার ঊদ্দেশ্যে দেশে বা এখানে যখনই যা কিছু আয়োজন করেছি, সব সময় সফল হয়েছি।

পরের দিন আমি যখন কাজে গেছি, ফিলিস নামের এক সহকর্মী আমাকে জানালো, " রীটা, আমি কালকে ব্রেক রুমে এসে কেক পাই নি।  আমি রাত আটটায় টি ব্রেকে এসে দেখি কেক শেষ!  যাক গিয়ে, কেকটি নিশ্চয়ই খুব ভাল হয়েছিল, আমি জানতাম না, তুমি কেকটি পাঠিয়েছো। তবে তোমার শুভেচ্ছা কার্ডটি পড়েছি। কার্ড টি পড়ে আমি অভিভূত হয়েছি। খুবই চমৎকার কার্ড। শোন, একটা কথা বলি, তোমার মা, আমাদের সকলের মা,  নিজেকে কখনও একা ভাববেনা, তুমি একা নও, আমরা সকলেই তোমার পাশে আছি। মন খারাপ হলেই আমাদের কাছে চলে আসবে, আমরা গল্প করবো, নিজেদের ফিলিংস শেয়ার করবো।  তোমার চেহারা অনেক খারাপ হয়ে গেছে, স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে, এটা ভাল কথা না। সকলকেই একদিন পৃথিবী ছাড়তে হবে, তোমার কষ্ট বুঝি, মা-বাবা কতদূরে থাকে, মন  চাইলেও যেতে পারো না, কষ্টতো থাকবেই। তবুও তুমি অনেক লাকী, মায়ের মৃত্যুশয্যায় পাশে ছিলে, অনেকের সেই ভাগ্য হয় না, কাছে থেকেও হয় না।  চীয়ার আপ বেবী, উই আর উইদ ইউ, প্রমিস"!  

ফিলিস এ বছর ৬০ বছর পূর্ণ করবে, ক্যাশ রেজিস্টারে কাজ করে, ২০ বছর হয়ে গেলো, ওয়ালমার্টে চাকুরী করছে। ফিলিসের সাথে দেখা হয় টি-রুমে, আফ্রিকান-আমেরিকান এই মহিলাকে আমি দূর থেকে দেখি, তার গল্প বলার স্টাইল আমাকে মুগ্ধ করে, অতি ছোট জিনিস দেখেও সে বিস্মিত হয়, ফিলিস জানেনা, আমি তাকে কত পছন্দ করি, অথবা হয়তো জানে, নাহলে সে আমাকে অমন স্নেহ করতো না। ফিলিসের গল্প আরেক দিন বলবো, শুধু এতটুকুই বলি, ফিলিসের বয়স যখন ২০, তার বাম পাশের ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। বানদিকের ফুসফুস কেটে বাদ দিতে হয়েছে, ডানপাশের ফুসফুস নিয়েই ফিলিস বেঁচে আছে, এখন পর্যন্ত।

No comments:

Post a Comment