Sunday, November 18, 2012

প্রিয় মৌটুসী

মামনি,
বছর ঘুরে চলে এলো ১৮ই নভেম্বার, তোমার শুভ জন্মদিন। কততম জন্মদিন, বলো তো! আমার হিসেবে মিলছে না। বার বার চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে ঢাকা ইবনে সিনা ক্লিনিকের সেই সন্ধ্যার দৃশ্য। মঙ্গলবার ছিল, বিকেল সাড়ে তিনটায় আমাকে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে গেল, কেউ পাশে ছিল না। ডাক্তারের নির্দেশে তোমার বাবা গেছিলেন নীচে ফার্মেসীতে, তোমার দিদা, মানে আমার মা কেবিনে গেলেন আমার জন্য কিছু একটা নিয়ে আসতে। এই ফাঁকেই আমাকে নার্সেরা ধরে নিয়ে গেল ওটিতে। সেই মুহূর্তে আমার মনে 'মা' হওয়ার  কোন আবেগ ছিল না,  মনে হচ্ছিল, আমাকে ওরা সবাই মিলে এমনভাবে নিয়ে গেছিল, যে বার বার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমার শেষ যাত্রা। আর ফিরবো না। অথচ গর্ভকালীন নয়টি মাস কত কিছুই কল্পনা করতাম! আমি তো জানতাম, আমার একটি ছেলে হবে, নানাজনে আমাকে দেখে তেমন কথাই বলতো।

সন্ধ্যাবেলা আমার যখন প্রকৃত জ্ঞান ফিরে আসে, আমার কানে ওঁয়াও ওঁয়াও  কান্নার শব্দ আসছিল। সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা, গলাতে ব্যথা, হাতে স্যালাইনের সুঁই ফোটানো ছিল, সেই ব্যথা, ব্যথায় অস্থির আমি চোখ মেলে তাকাতেই তোমার বাবা আমাকে বললো, " আমাদের  একটা কুটুকুটু মেয়ে হয়েছে। নাম রাখা নিয়ে আর ভাবতে হবেনা, মৌটুসীই থেকে গেল। আমি চেতন-অচেতনের মাঝে থেকেও একটু অবাক হয়েছিলাম। মেয়ে হয়েছে বলছে কেন, আমার তো ছেলে হওয়ার কথা ছিল। কেউ হাত দেখতে জানে শুনলেই আমি হাত সামনে মেলে ধরতাম, তারাই বলেছিল, আমার প্রথম সন্তান হবে ছেলে। তোমার নিশ্চয়ই হাসি পাচ্ছে, কেমিস্ট্রি অনার্সের ছাত্রীও কী রকম ভাগ্য গননায় বিশ্বাস করে বসে থাকে! আমি এরকমই, সব কথা বিশ্বাস করি, সবাইকে বিশ্বাস করি। যে কথা বলছিলাম, মাথা ঘুরিয়ে দেখি, পাশের বেডে আমার মা ছোট্ট একটা বিড়াল ছানাকে নিয়ে বসে আছে। বিড়াল ছানার গায়ের রঙ দেখলাম ধবধবে সাদা, সরু সরু হাত -পা নাড়ছে, আর কাঁদছে। আমার মায়ের প্রথম নাতণী, মা'কে কখনও বাচ্চা-কাচ্চা কোলে নিতে দেখিনি, তুমিই প্রথম ভাগ্যবতী, যে আমার মায়ের কোলে চড়েছো। কান্না থামাতে পারছিলনা বলে 'কমলা' নামের একজন নার্স এসে মায়ের কোল থেকে তোমাকে নিয়ে তোয়ালে, কাঁথা দিয়ে খুব দক্ষতার সাথে তোমাকে পেঁচিয়ে দিতেই তোমার কান্না থেমে গেছিল। ডাক্তারের পরামর্শে তোমার জন্য 'এস ২০' নামে ইনফ্যান্ট মিল্ক আনা হয়েছিল, তোমার বাবা, তোমার বড়মামা একটু পর পর দুধ গুলে আমার মায়ের কাছে নিয়ে আসে, আমার মা চামচ দিয়ে তোমাকে একটু একটু করে দিলেই তুমি তা মুখ থেকে ফেলে দিচ্ছিলে। তোমার দিদা বলেছিল, " হুম! তেজ আছে তো দেখি। আসলে হওয়ার কথা ছিল ছেলে, হইছে মেয়ে, কিনতু ছেলেদের জেদ লইয়া জন্মাইছে তোর মাইয়া"। আমি ছেলের প্রত্যাশায় ছিলাম, মায়ের মুখে তোমার নিন্দা শুনে সাথে সাথে বলেছিলাম, " ভাল হইছে তেজ হইছে, তুমি খাওয়াতে পার না, সেইটা দেখনা, শুধু শুধু ওর দোষ দিতেছ"। হা হা হা হা ! দেখো, এই হচ্ছে মা আর সন্তানের সম্পর্ক।

মামনি, তোমার মৌটুসী নাম তোমার বাবা অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন।  কানাডাতে থাকার সময় বোধ হয় কোথাও কারো নাম মৌটুসী শুনেছে, তখন থেকেই নাকি সে জানতো, তার প্রথম সন্তান হবে মেয়ে, এবং মেয়ের নাম হবে মৌটুসী। আমি যখন ছেলের স্বপ্নে বিভোর, সে কিনতু আমার কথায় কোন মন্তব্য করতোনা। এবার বুঝে দেখো, বাবার হৃদয়ের কোথায় তুমি বসে আছো। তোমার বাবার আরও দুই একটা কথা বলি, তোমার যখন দুই বছর বয়স, তোমাকে কোলে নিয়ে তোমার বাবা হাঁটছিল আর কথা বলছিল। কথা আর কি, ওই সব 'কিনু মিনু, কাটুস পুটুস টাইপ' কথা। তা এক সময় একটি গাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তোমাকে বললো, " মামনি, এই গাছটাতে কী নেই, বলোতো"? তুমি তখন কম কথা বলতে, কিনতু যাই বলতে, স্পস্ট করে বলতে। তুমি বলেছিলে, " পাতা নেই, পাতা নেই"। আমার এখনও গায়ে কাটা দিচ্ছে। তোমার বাবা এবং আমি তোমার জবাব শুনে টাসকি লেগে গেছিলাম। সত্যিই গাছে একটিও পাতা ছিল না, তোমার বাবা বলেছিল, " আমার মামনি  টা তো অনেক বুদ্ধিমতী হয়েছে, ওতো অনেক বড় বিজ্ঞানী হবে"। আমি তো জানতামই তুমি বড় হয়ে অনেক বড় কিছু হবে। তোমাকে আমি কত যত্ন করে ছড়া শেখাতাম, আড়াই বছর বয়সেই তুমি অনেক কিছু শিখে ফেলেছিলে। আসলে প্রথম সন্তান নিয়ে সব মা আদিখ্যেতা করে, আমিও এর বাইরে ছিলাম না। তোমাকে নিয়ে দাদুর বাড়ী যেতাম, ওখানে তোমার মামারা, দাদু, দিদা সবাই মিলে তোমাকে ঘিরে থাকতো। তুমি ছিলে আমার বাধ্যগত, আমি যদি বলতাম, এখানে সারাদিন বসে থাকো, তুমি তাই করতে। মামারা ডাকলে বলতে, " মামনি বলেছে এখানে বসে থাকতে"। তোমার মেজোমামা বলতো, " মায়ের চামচা হইছে"। হা হা হা হা !! তোমার হয়তো কিছুই মনে পড়ে না। আমার বাবাকে বলেছিলাম, " বাবা আমার মেয়ে দেখবা ঢাকা বোর্ডে ম্যাট্রিকে ফার্স্ট হইব"। বাবা বলেছিল, " এত আগ বাড়াইয়া কথা না কইয়া মেয়েরে যত্ন কইরা বড় করিস"। আমার মা বোধ হয় টের পেয়েছিল, ছেলে হয় নি বলে আমার আশা ভং হয়েছে। মা বারবার বলতো, " এমন লক্ষ্মী মেয়ে হইলে, পাঁচটা মেয়ে হইলেও বাপ মায়ের চিন্তা নাই"। তুমি ছিলে দিদার কলিজার টুকরা। কোনদিন তোমাকে একটা ধমক দেয় নি দিদা।

তুমি আসলেই অনেক লক্ষ্মী একটা মেয়ে হয়েছ, কেউ জানেনা, কাউকে বলিনি, আমার সৌভাগ্যের কথা। আমি যেমন চেয়েছিলাম, তুমি তেমনই হয়েছ। আমি তো শুধু একাডেমিক দিক নিয়ে ভাবতাম, তাই তুমি একাডেমিক দিক দিয়ে আমাদের অনেক শান্তি দিয়েছ। একটা টাকা খরচ করতে হয়নি তোমার পেছনে। দেশে থাকতে করেছি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো অর্থ পিশাচ, ওরা ছাত্র ছাত্রীকে স্কলারশীপ দেয়ার কথা ভাবতে পারেনা। অস্ট্রেলিয়াতে যখন ক্লাস থ্রীতে ভর্তি হয়েছিলে, তোমার কী মনে পড়ে, ক্লাস টিচার আমাকে বলেছিল, " তোমার মেয়ে অন্যরকম, সব সময় কোন একটা চিন্তায় ডুবে থাকে। দেখলেই মনে হয়, ও স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। ওর চোখগুলো দেখেই বুঝা যায়, ও আলাদা"। আমি খুব গর্ব বোধ করেছিলাম, আমি তো জানতাম, তুমি একটু আলাদা। তুমি মায়ের কথা হুবহু মেনে চলো, মায়ের তো আনন্দ হবেই। তোমার বাবার শখ হয়েছিল, তোমাকে আর্ট ক্লাসে ভর্তি করবে। চার বছর বয়সে তোমাকে ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলের আর্ট ক্লাসে দিয়েছিলাম। তৃতীয়দিনে গিয়ে দেখি টীচার একটু বড় বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত, তুমি বেঞ্চের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছ। আমার এমন রাগ উঠেছে, সেই যে তোমাকে নিয়ে এলাম, আর পাঠালাম না। কিনতু মনের ভেতর খচখচানি ছিল, আহারে, মেয়ের বাবার কত শখ ছিল। তোমাকে আমি সব সময় এই কথা বলতাম, তোমাকে আরেকটা কথা বলেছিলাম। তোমার বাবার খুব শখ, তার একতা মেয়ে ডাক্তারী পড়ুক। তোমার ছোট দুই বোন থাকার পরেও আমি তোমাকেই বলেছিলাম কথাটা। একদিন দেখি, তুমি স্কুল থেকে দারুন সুন্দর পেইন্টিং হাতে করে বাড়ী ফিরেছ। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় এসে ক্লাস টেনে ভর্তি হয়েছিলে। আমেরিকাতে স্কুলে কত প্রাচুর্য্য, রঙ, তুলি, ক্যানভাস, সব ফ্রী। তুমি সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছো। মাত্র দুই বছরে তুমি এমন সব পেইন্টিং করেছো, যা অনেকে চার বছর আর্ট কলেজে পড়েও করেনা। তোমার আর্ট কত কম্পিটিশানে পাঠিয়েছো এবং অবধারিতভাবে সেগুলো ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। তোমার একটা আর্ট , আমেরিকার ন্যাশনাল পর্যায়ের কম্পিটিশানে গেছিল এবং সেকেন্ড পজিশান পেয়েছে। এরপর থেকে দেখি তুমি সব কিছুতেই তুলির টানে ডিজাইন করে রাখতে ভালোবাসতে। ঘরের টেলিফোনটাও বাদ পড়েনি। সায়েন্স কমপিটিশান, সোশাল স্টাডিজ কমপিটিশান, বক্তৃতা কমপিটিশান, কতকিছুতেই অংশগ্রহণ করেছো, সব কিছুতেই প্রথম স্থান। এত বেশী  'ট্রফি' আর সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছো যে সবগুলো এখন আমার এটিকের ছাদে বস্তায় ভরে রেখে দিতে হয়েছে। কী করবো, একটা দুটা হলে মূল্য বুঝা যায়, এত এত পুরস্কার রাখার জায়গা কোথায়!

স্কুল গ্র্যাজুয়েশান করলে 'আউটস্ট্যান্ডিং' রেজাল্টসহ, কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে টপ স্কোর থাকার পরেও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কোন স্কলারশীপ পেলেনা, কারন আমাদের ভিসা স্ট্যাটাস ছিল এইচ ফোর, কিছুই বুঝিনা আমেরিকার নিয়ম। আমার মাথা গরম হয়ে গেছিল, আমার মেয়ের এমন দূর্দান্ত রেজাল্ট নিয়েও মেয়ে স্কলারশীপ না পেলে মেয়েকে পড়াবো কিভাবে, এই চিন্তায় অস্থির হয়েছিলাম। তুমি কিনতু একটুও বিচলিত হওনি, ভার্জিনিয়া প্রাইভেট কলেজে একটা সুযোগ পেলে। স্কলারশীপ পেতে হলে ইন্টারভিউ দিতে হবে, দুই দিনব্যাপী ইন্টারভিউ, আমেরিকার কত স্টেট থেকে মেয়েরা এসেছে, এত লম্বা লম্বা, ফর্সা সব মেয়ের সামনে তোমাকে ছোট্ট একটা বাচ্চার মত লাগছিল। তোমার কি মনে আছে, তুমি আমার হাতের ডিজাইন করা লম্বা ঝুলওয়ালা লাল জামা পড়ে ইন্টারভিউ দিতে গেছিলে। তিনদিন পরেই ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট বাসায় ফোন করলো, আমি ছিলাম বাসায়, ফোন ধরে আমি আর কথা কিছুই বুঝিনা। কী বলে, তোমার নাম বলছে, ফুল স্কলারশীপ পেয়েছো বলছে, মাত্র পাঁচজন পেয়েছে, তাদের মধ্যে তুমি একজন। কথা স্পস্ট, অথচ আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কেঁদে ফেলেছিলাম, প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম, প্রেসিডেন্ট বুঝতে পেরেছিল, আমার খুশীর পরিমান, বলেছিল, তুমি খুব লাকী মাম।

আবার আউটস্ট্যান্ডিং রেজাল্ট করে আন্ডারগ্র্যাড কম্পলীট করলে, ডাক্তারী পড়ার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সবই ঠিকমত করলে, ইন্টারভিউ দিলে, শেষ পর্যন্ত আমাদের মিসিসিপি স্টেটে এসে ভর্তি হলে। এখান থেকেই শুরু হলো আমার বিপর্যয়। আমি মনে প্রাণে চেয়েছিলাম, তুমি যেন মিসিসিপিতে পড়ো, আর তুমি চার বছর আমাদের থেকে দূরে থেকে অনেক বেশী স্বাবলম্বী হয়ে গেছিলে। আরও বড় কোন শহরে যেতে চেয়েছিলে, কিনতু মায়ের আকাঙ্ক্ষার কাছে আর সব কিছু ম্লান হয়ে গেছে। সেই ১৬ বছর বয়সে আমাদের কাছছাড়া তুমি, কত কেঁদেছি, জীবনের বাস্তবতায় ক্ষত বিক্ষত হয়েছি, আবার ভেবেছি, বাবাকে বলেছিলাম, মৌটুসী ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করবে, আমেরিকাতে স্ট্যান্ড করাতে পারলেই আমার কথা ঠিক থাকবে। কিনতু তুমি মিসিসিপিতে এসেই মন খারাপ করে ফেললে। ভার্জিনিয়া থেকে মিসিসিপিতে এলে, তোমার মত বয়সী ছেলে মেয়েদের খারাপ লাগবেই, তার উপর আবার ডাক্তারী পড়ার মত কঠিন একটা বিষয় নিয়ে থাকতে হবে। তুমি ধীরে ধীরে ডিপ্রেসড হতে শুরু করলে। তুমি ছিলে বিনয়ী, শান্ত, স্পষ্টভাষী, সেই তুমিই হয়ে গেলে অসহিষ্ণু, মলিন। আগে কত আর্ট করতে, নাচ করতে, ভার্জিনিয়াতে থাকতে কত কালচার‌্যাল প্রোগ্রাম অর্গ্যানাইজ করেছো, কত রকম সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছো, সেই মেয়েটি মিসিসিপির আবহাওয়াতে এসে থমকে গেল! আমি কত কেঁদেছি তোমার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে। অথচ মিসিসিপি মেডিক্যাল কলেজে তুমি পেয়েছিলে 'ফুল স্কলারশীপ"। আমেরিকার মত দেশে ডাক্তারী পড়তে গেলে সকলকেই ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে পড়তে হয়, সেখানে তুমি পেয়েছিলে ফুল স্কলারশীপ।

তুমি একদিন আমাকে ফোন করেছিলে, তোমার গলার আওয়াজ শুনেই আমি বলেছিলাম, " মামনি, তোমার গলার আওয়াজ এমন শোনা যাচ্ছে কেনো? কী হয়েছে?" তুমি কেঁদে ফেলেছিলে, বলেছিলে " মামনি, আমার এখানে একটুও ভাল লাগেনা, আমি কিছুই পড়তে পারিনা, বই নিয়ে বসে থাকি, কিছুই পড়িনা। আজকে একটা পরীক্ষায় ফেল করেছি"। আমি খুবই শকড হয়েছিলাম কিনতু তোমাকে বুঝতে দেইনি। আমি তোমাকে খুব নরমভাবে বুঝিয়েছিলাম, ডাক্তারী পরীক্ষায় পাশ মার্ক হচ্ছে ৭০, তুমি পেয়েছো ৬৮। আরও পরীক্ষা আছে, কোন চিন্তা করোনা, সেগুলো দিয়ে কভার করে ফেলো। তুমি তো একা ফেল করোনি, আরও অনেকে করেছে, ডাক্তারী যারা পড়তে যায়, তারা সকলেই মেধাবী, তোমাদের হাতে মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করে, তোমাদেরতো ভালোভাবে শিখতে হবেই। প্রথম প্রথম একটু আধটু ফেল করার ব্যবস্থা হয়তো এরাই করে রাখে।  এক পরীক্ষায় ফেল করেছো, ভালোই হয়েছে, পাশ করার জন্য আরও অনেক বেশী পড়বে, তাহলে অনেক বেশী শিখবে। আমার কথা শুনে তোমার কান্না থেমেছে। কিনতু তোমার বাবা যখন শুনেছে, তুমি কেঁদেছো, তোমাকে ফোন করলো, মনে আছে তোমার? তোমার বাবা ফোনের উপরেই কী কান্না! আমি অবাক হয়ে গেছিলাম, তুমিও অবাক হয়ে গেছিলে। তোমার বাবাকে আমি একবার মাত্র কাঁদতে দেখেছিলাম, তোমার তিন বছর বয়সে একবার খুব অসুস্থ হয়েছিলে, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল তোমার শরীর, তোমার বাবা তোমার শিয়রে বসে নীরবে কাঁদছিলেন। সেবার আমি শক্তহাতে হাল ধরেছিলাম, ডাক্তারের পরামর্শে সব কাজ ফেলে রেখে তোমাকে ড্রপারে করে এক ফোঁটা দুধ, এক ফোঁটা জল, এক বিন্দু মধু দিয়ে যাচ্ছিলাম। পাঁচ ঘন্টা পর তুমি উঠে বসেছিলে। এত বছর পরে আবার তোমার বাবা কাঁদতেই জিজ্ঞেস করলাম, কান্নার কারন, সে বললো, পড়ালেখা জীবনের সব নয়। মরে গিয়েও পড়তে হবে, এটা আমি মানিনা। মামণি যেন সুইসাইড টাইড না করে বসে। এই বয়সে এত চাপ সহ্য করতে পারেন অনেকেই। তোমার বাবার কথা শুনে আমি তোমাকে আড়ালে বুঝিয়েছিলাম, তুমিও আমার কথা বুঝতে পেরেছিলে। আরেকদিনের কথা বলি, তোমাদের কলেজের সামার ভ্যাকেশান চলছিল, তুমি রয়ে গেছিলে তোমার এপার্টমেন্টে। আমি তোমাকে ফোন করি, ফোন করি, কেউ ফোন ধরে না। সকাল থেকে ফোন শুরু করেছি, দুপুর দুইটায় যখন ফোন ধরছিলে না, আমার টেনশান শুরু হয়ে গেল। তোমার বাবা কে বললাম, " মামনি ফোন ধরেনা কেন? মনের দুঃখে কিছু করে ফেলেনি তো! এমনও তো হতে পারে, ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে একা ঘরে, কেউ তো জানবেও না। শীগগীর চলো, আমরা যাই, অন্তঃত মেয়েটাকে উদ্ধার করি"। মামনি তুমি বুঝতে পারছো, এত সুন্দর করে আমি কথাগুলো বলিনি। আরও ভয়াবহ করেই বলেছি। তোমার বাবা আমাদের নিয়ে গাড়ী ছুটিয়েছে, একঘন্টা চলার পর তুমি ফোন ব্যাল করে বললে, একটা সেমিনার ছিল, ফোন সাথে নাওনি। তোমাকে বকবো কী? তুমি যে বেঁচে আছ, এটা জেনেই আমরা খুশী। এই হলাম আমি। তোমার অবশ্য এখন আরও অনেক কথাই মনে পড়বে, তুমি যখন ভার্জিনিয়া হলিন্স ইউনিভার্সিটিতে ছিলে, প্রতিদিন পাঁচবার ফোন করতাম তোমাকে। আর আমি এত ফোন করি বলেই বোধ হয় তুমি নিজে থেকে আমাকে ফোন করতে না। একদিন রাতে ফোন করে তোমাকে না পেয়ে তোমাদের অফিসে ফোন করেছি, সেখানে কেউ ধরেনা, কি করে যেন আর কারো ফোন নাম্বার যোগার করে তাকে ফোন করেছি রাত দুইটায়। সে বলেছে তুমি কোন একটা প্রোগ্রামে আছ, ফিরতে রাত হবে। হা হা হা ! এমন পাগলামী কত করেছি, তাইনা? কেন করেছি? আমার এত দামী একটা মেয়ে, এত আদরের সন্তান আমার, আমি চিন্তা করবো না তো কে করবে?

আরেকবার তুমি যেদিন বললে, তুমি ডাক্তারী পড়তে চাও না, অন্য কিছু পড়বে, সেদিন আমি তোমাকে বলেছিলাম, " ঠিক আছে, ডাক্তারী পড়তে হবে না।" তুমি বাসা থেকে গাড়ী চালিয়ে তিন ঘন্টা ড্রাইভ করে হোস্টেলে যাবে, আমি তোমার দিকে ফিরেও তাকালাম না। কী যে কষ্ট পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল আমার সকল স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। কারন , তুমি খুব স্পষ্টভাবে কথা বলো, তোমার কথাবার্তায় কখনও কোন অস্বচ্ছতা থাকেনা। তুমি যখন বলেছ, পড়া ছেড়ে দিবে, তাহলে তা তুমি করবেই। চার ঘন্টা পরে তুমি আমাকে ফোন করেছিলে, " মামনি, আমি ঠিক করেছি, ডাক্তারী পড়া শেষ করবো। আর কখনও পড়া ছেড়ে দেয়ার কথা বলবো না। তুমি মন খারাপ করো না, বাবিকেও বলো, আমাকে নিয়ে চিন্তা না করতে"। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, জানতে চাইলাম, হঠাৎ মত পরিবর্তন কেন? তুমি বলেছিলে, " তুমি ঠিকই বলেছ, কোন কিছুই সহজ না, ডাক্তারী পড়া ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু পড়বো, সেটাও যদি ভালো না লাগে, তাহলে তো সবই যাবে। তার চেয়ে ডাক্তারী পড়া শেষ করি"। তোমার সেদিনের কথা শুনে আমি আবার কেঁদেছি, আনন্দে, আমার মৌটুসীর মন থেকে সব দ্বিধা চলে গেছে, ও যখন বলেছে, পড়া শেষ করবে, তাহলে তা হবেই হবে। তুমি তা করেছো। খুব ভালোভাবেই করেছো। কত বড় শহরে তুমি এখন রেসিডেন্সী করতে গেছো। এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

এই বছর তোমার কাছে আরেকটি কারনে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চাই। সেটা হচ্ছে, তোমার বিয়েটা দেশে আয়োজন করিয়েছো বলে। মামনি, আমি সব সময় বলতাম, আমার মেয়েদের বিয়ে বাংলাদেশে হবে। কথাটি তোমার অবচেতণ মনে ছিল। যখন তোমার বিয়ের কথা হচ্ছে, তখন তোমার বাবা মিসিসিপিতেই তা আয়োজন করতে চেয়েছে। এখন আমার একটু বয়স হয়েছে, তোমার বাবার কথার উপর বেশী কথা বলিনা, কারন তোমার বাবা তো কখনও খারাপ কিছু বলেনা। আমেরিকা থেকে দেশে গিয়ে মেয়ে বিয়ের আয়োজন করার মত শক্তি বা ক্ষমতা তোমার বাবার ছিল না। কিনতু তুমি বার বার বলেছিলে, বিয়ে করলে দেশে গিয়ে সবার মাঝে করতে চাও। আমি মনে মনে খুশী হয়েছিলাম এবং চাইছিলাম তুমি তোমার কথায় স্থির থাকো। তা তুমি ছিলে, তুমি বলেছিলে, দেশে গিয়ে বিয়ের আয়োজন না করলে তুমি মিসিসিপিতে কোন আনুষ্ঠানিকতা করতে দিবেনা। বলেছিলে, মিসিসিপিতে তুমি শুধু রেজিস্ট্রেশান করেই বিয়ে সেরে ফেলবে। মনীশ নামের যে চমৎকার ছেলেটিকে তুমি খুঁজে পেয়েছো, এই ছেলে তো শুরুতেই তোমার বশ হয়ে আছে। তুমি যদি বলেছো, বাংলাদেশে বিয়ে হবে, মনীশও বলে , ঠিক ঠিক। তুমি যদি বলেছো, আমেরিকাতে বিয়ে হলে কোন অনুষ্ঠান হবেনা, মনীশও বলে, হাঁ হাঁ ঠিক ঠিক। হা হা হা হা!! মামনি, তুমি ভাল ছেলে পেয়েছো।

তোমার বাবার কাছে তোমার আব্দারই শেষ কথা। তোমার বাবা দেশেই বিয়ের ব্যবস্থা করলেন, তোমার দিদা, দাদু, মামারাসহ সকল আত্মীয়স্বজন এসেছিল। তোমার দিদা শুধুমাত্র তোমার বিয়েতে যেন কোন বাধা না পরে, সেইজন্য নিজের দেহের যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখেছিল। আমার মা কোনদিন কারো বিয়ের আসরে থাকেনি, এই প্রথম তোমার বিয়ে একেবারে আসরে থেকে, তোমার সাতপাঁকে ঘোরা থেকে শুরু করে প্রতিটি মাঙ্গলিক কাজ নিজে থেকে করেছে। মামনি, কথাগুলো লিখতে গিয়ে আমার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। তোমার বিয়ের পরে সবাই চলে আসলাম, আমার মা ডাক্তারের কাছে গেলেন, ক্যানসার ধরা পড়লো, মা'কে জানানো হয়নি, অপারেশান হলো, অপারেশানের পর মা খুশী, মিশাকে বললো, ওর বিয়েতেও থাকবে, ততদিনে ক্যান্সার সারা দেহে ছড়িয়ে গিয়ে মাত্র দুই মাসের ভেতর মা মারা গেলেন। কিনতু তোমাকে দিয়ে গেলেন শ্রেষ্ঠ উপহার। একমাত্র তোমার বিয়েতে দিদা কে পেলে, আর কারো বিয়েতে দিদা থাকবেনা। দিদা শুধু তোমার হয়ে থাকলো। তোমাকে কখনও বকেনি, কারো কোন অসুবিধা হলেই তোমাকে জিজ্ঞেস করতো কী করতে হবে, তোমার চিকিৎসা সেবা পায়নি ঠিকই, কিনতু তুমি ডাক্তারী পাশ করার পর কী যে খুশী হয়েছে। দিদা কত গরীব দুঃখীকে সাহায্য করতো, দিদার মৃত্যুর পর দুনিয়ার মানুষ এসেছে দিদাকে দেখতে। প্রত্যেকেই বলেছে, দিদার কাছ থেকে কে কত সাহায্য পেয়েছে। আমার বুক ভরে গেছে, এমন মায়ের মেয়ে হিসেবে।

মামনি, তুমিও আমার মনের আশা পূর্ণ করেছো। যখন যে বলেছি, মাথায় রেখেছো, তা কাজে করে দেখিয়েছো। তোমার কি মনে আছে, আমি বলেছিলাম, রোজগার যখন করবে, দুইজন গরীব ছেলেমেয়েকে পড়ার খরচ দিবে! চুক্তি করে নিবে, তোমার টাকায় পড়ালেখা করে যে মানুষ হবে, সে যেনো তার সাহায্যের হাত আরেক জনের দিকে বাড়িয়ে দেয়, তা হোক নিজের পরিবার অথবা অন্য কেউ! আমার মা করে গেছেন পরের উপকার, আমি কতটুকু করতে পারছি জানিনা, বাকীটুকু তুমি করো। তুমিতো নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করো, তাহলে দিদার পদাঙ্ক অনুসরণ করো, দিদার আত্মা শান্তি পাবে। শুভ স্পেশ্যাল জন্মদিন মামনি। মনীশকে নিয়ে তোমার প্রথম জন্মদিন এটা, অবশ্যই স্পেশ্যাল!!

3 comments:

  1. Very sensitive and heart filling writing. Yes, as Boro Mama (Uncle),I always feel proud of my nieces, specially Moutushi. She fulfilled our all dreams. I hope she will live long and will do something so that people can remember her for hundreds of years. Happy Birthday to you, Mamoni.

    ReplyDelete
  2. Great blog Mithu di :) Tomar meyera bheeshon lucky tomar moto Ma peye :)

    ReplyDelete
  3. Ashadharon shundor akta lekha. -Tisa Bolci

    ReplyDelete