একটানা ছয়দিন অফিস শেষে আজ পেলাম
কাঙ্ক্ষিত অফ ডে! অফ ডে মানে দারুণ ব্যাপার। মনে হয় দিনটি হবে শুধুই আমার, যা মন
চাইবে তাই করবো। যদি ইচ্ছে করে তাহলে বেলা এগারোটায় ঘুম থেকে উঠবো, যদি ইচ্ছে করে
তাহলে হয়তো ঘুম থেকে জাগবো, তবে উঠবোনা। এমন কত ধরণের ইচ্ছে যে করে। ইচ্ছে তো
ইচ্ছে, বাস্তবে যা হওয়ার নয়, সেটাই ইচ্ছে হয়ে প্রকাশ পায়। আগে ইচ্ছে করতো, ছুটির
দিনে শুধুই ঘুরে বেড়াই, কারো বাড়িতে নয়, সুন্দর কোন জায়গা, লেকের পাড় অথবা তেমনই
কিছু একটা। ঝুড়িতে খাবার থাকবে, মাঠে চাদর বিছিয়ে আমি আর আমার স্বামী পাশাপাশি বসে
ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে ঢেলে খাব আর গল্প করবো, ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজবে, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’, আর সেই বড়
আকাশের নীচে ছোট্ট মিথীলা দৌড়ে বেড়াবে, মাঝে মাঝে আমাদের কাছাকাছি এসে দেখে যাবে,
আমরা আছি, ওকে রেখে কোথাও যাইনি।
অনেক আগে, ’৯০-’৯৫ সালের দিকে, যখন ঢাকাতে থাকতাম, স্বামী উত্তম কুমার ছিল
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আর আমি ছিলাম স্বেচ্ছাগৃহী, সেই সময়গুলোর
কথা ভাবি, সপ্তাহের ছয় দিন, দুই মেয়ে মৌটুসী ও মিশাকে নিয়েই কাটিয়ে দিতাম সারা
দিন, সারা বেলা। সুন্দর এবং সুখী গৃহকোণ বললে যে ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে, তেমনই
এক সময় ছিল আমাদের। আমার এবং আমাদের দুই মেয়ের চাহিদা এবং ইচ্ছেগুলো ছিল খুব ছোট
ছোট। ফলে অধ্যাপক স্বামীকে খুব একটা বেগ পোহাতে হতোনা আমাদের ইচ্ছে পূরণ করতে
গিয়ে। তবে আমার একটু বেগ পোহাতে হতো অধ্যাপককে রাজী করাতে। আমি তো সারা সপ্তাহ
ঘরেই থাকতাম, তাই বুঝতেই পারতামনা, ছয় দিন বাইরে কাটিয়ে আসার পর সবার মন ঘরের
পানেই ছুটে, উত্তম কুমারেরও খুব ইচ্ছে করতো ছুটির দিনটা আরামে শুয়ে-বসে কাটিয়ে
দিতে। অথচ আমার ইচ্ছে করতো, প্রতি শুক্রবার, ছুটির দিনে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতে।
খুব বেশী দূর তো নয়, কাছে-পিঠে
আত্মীয়-স্বজনের বাড়ী। বেচারা স্বামী হয়তো সস্তা দামের সোফাটায় আরাম করে বসে
পত্রিকা পড়ছে অথবা কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে, অমনি আমার মাথার ভেতরের
পোকাগুলো নড়েচড়ে উঠতো। নিজের ইচ্ছে হয়েছে, এমনভাবে ইচ্ছেটাকে প্রকাশ করতামনা, মেয়েদের
খুব শখ হয়েছে জ্যেঠুর বাড়ী যাওয়ার, মেয়েদের খুব শখ হয়েছে বড়মামার বাড়ী যাওয়ার,
মেয়েদের খুব শখ হয়েছে বাণিজ্যমেলা দেখার, ঠিক এভাবে ইচ্ছেগুলোকে জায়গা বরাবর পেশ
করে দিতাম। কাজ হতো, মেয়েদের বাবা আবার ভীষন কন্যাভক্ত ছিলেন, কন্যা জন্মাবার আগে
থেকেই কন্যা ভক্ত পিতা উনি। বাল্মিকী মুনি যেমন রাম না জন্মাতেই ‘রামায়ন’ রচেছিলেন, আমার স্বামীটি বিয়ের আগেই ‘মৌটুসীনামা’ লিখেছিলেন।
মৌটুসী আমাদের প্রথম সন্তান। বিয়ের পর,
প্রতিটি স্বামী-স্ত্রীর মত আমরাও ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বপ্ন দেখতাম, জ্যোতিষীদের
গননা অনুযায়ী আমি জানতাম, আমাদের প্রথম সন্তান হবে ছেলে, আর আমার স্বামী নিজের
মনেই জানতেন, যার সাথেই বিয়ে হোক, তাদের প্রথম সন্তান হবে ‘মেয়ে’, উনি আমার চেয়ে একধাপ এগিয়ে ভবিষ্যত কন্যাটির জন্য নামও
ঠিক
করে রেখেছিলেন, ‘মৌটুসী’। দু’জনের ইচ্ছেগুলো
পরস্পরের মধ্যে জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর মৌটুসীর মুখখানা দেখার আগে পর্যন্ত দু’জনের ইচ্ছেগুলো একধরণের নীরব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, দেখা যাক, কার
ইচ্ছে পূরণ হয়! ভাগ্যবানদের ভাগ্য নিয়ে চ্যালেঞ্জ করতে নেই, ভাগ্যবানদের বৌ ভাগ্য
ভাল হয়, ভাগ্যবানদের কন্যাভাগ্য ভাল হয়, ভাগ্যবানদের একটার বদলে তিনটে কন্যা হয়,
এভাবেই আমি আমার স্বামীর সাথে রসিকতা করতাম।
আমার উত্তম কুমার মেয়েদের যে কোন আবদার
হাসিমুখে মেনে নিত। ফলে প্রায় প্রতি শুক্রবার আমি মেয়েদেরকে উস্কে দিতাম, ‘যা, বাবাকে বল, আজকে আমরা জ্যেঠুর বাসায় বেড়াতে যেতে চাই’। সমস্যা হতো মৌটুসীকে নিয়ে, এই মেয়ের কোন বায়নাক্কা ছিলনা, তাই আবদারের ভাষাও
জানা ছিলনা। সুবিধা হয়েছে মিশা জন্মাবার পর। এই কুট্টি থাকতেই মিশা বাইরের খোলা
আকাশ ভালোবাসতো, রোগা মেয়ে ছিল, অসুখে ভুগতো, কান্নাকাটি করলে একটু ঘরের বাইরে
নিয়ে গেলেই চুপ হয়ে যেত। মনে পড়ে, যখন হাতীরপুল ভুতের গলিতে থাকতাম, কোথাও থেকে
ফিরে আসার সময় রিক্সা বা বেবী ট্যাক্সী যখনই হাতীর পুলের গলি দিয়ে ঢুকে যেতো, এক
বছর বয়সী মিশা কোলের উপর গা মোচরাত আর ‘না না’ আওয়াজ করতো। আর আমি উত্তমকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতাম, ইস! এই মেয়েটা একেবারে একটা
বেড়ানী হয়েছে। সারা সপ্তাহ ঘরে থাকেতো, তাই বেড়াতে পারলে খুশী। বলেই ছোট্ট মিশাকে
ঊদ্দেশ্য করে বলতাম, “ মিশা, সোনা, এমন করেনা, আজ বাসায় চলো, আবার আগামী শুক্রবার
বেড়াতে যাব। তখন বনানী যাব, বড়মামার বাড়ী”। উত্তম সবই
বুঝতো, জ্ঞানী মানুষ, চোখের ইশারাই যথেষ্ট। মুচকী হাসতো, হাসুক, ধরা পড়ে গিয়েও ধরা
না পড়ার ভাণ করতাম।
এরপর সারা জীবনে অনেক বেড়িয়েছি।
মেলবোর্ণে যখন ছিলাম, প্রতি উইকএন্ডে আমরা ট্রেনে চেপে কতদূর চলে যেতাম। সমুদ্র
আমার প্রিয়, মিশারও প্রিয়। মিশা খুব জেদী মেয়ে, বাপ সোহাগী, ছোটবেলায় বলতো,
দিদিসোনা মায়ের পেটে ছিল, আমি বাবার পিঠে ছিলাম। সেই মিশার আবদার অগ্রাহ্য করার
কোন ক্ষমতাই ছিলনা ওর বাবার। ছোটবেলায় খুব অসুস্থ থাকতো বলেই মিশার প্রতি আমাদের
সবারই প্রশ্রয়সূচক দূর্বলতা আছে। মেলবোর্ণ থেকে ফিরে ঢাকায় ছিলাম চার বছর, আমার
জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এই চার বছর আমি ছিলাম আমার ইচ্ছার অধীন। যা ইচ্ছে হতো, সেটাই
করতাম। তখন আর উইকএন্ডের আশায় অথবা উত্তম কুমারের অপেক্ষায় থাকতামনা। চাকরীর
সুবাদে অফিস থেকে ফুলটাইম ‘পাজেরো জীপ’ পেয়েছিলাম, পাজেরো জীপ ছিল আমার এবং মিশার ইচ্ছাধীন। কত যে বেড়িয়েছি, ভাল
লাগছেনা, মিশা চল, আশুলিয়া ঘুরে আসি, অথবা মিশা চল, গুলশানের বাড়ীগুলো দেখে আসি।
ঘন্টা দুই ঘুরে ফেরার পথে উত্তমকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে বাড়ী ফিরতাম। ইচ্ছে হয়েছে
দূরে কোথাও যেতে, দুই চারজন প্রিয় মানুষকে সঙ্গী করে চলে গেলাম টাঙ্গাইল,
বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর দাঁড়িয়ে, দোতলা বাসে উঠে সেতু ঘুরে আবার ঢাকা ফিরে আসতাম।
একবার ইচ্ছে হয়েছিল, ঢাকা বঙ্গবন্ধু
স্টেডিয়ামে বসে ক্রিকেট খেলা দেখবো। ‘উঠলো বাই তো কটক
যাই অবস্থা’ আমার। অস্ট্রেলিয়া বনাম ইন্ডিয়া খেলার টিকেট কাটিয়েছি,
আমার খুব প্রিয় কয়েকজনকে নিয়ে স্টেডিয়ামের সাধারণ গ্যালারীতে বসে পুরো খেলা উপভোগ
করে রাত বারোটায় বাড়ী ফিরেছি। কী দারুণ অভিজ্ঞতা, সাধারণ দর্শক গ্যালারীতে, সাধারণ
দর্শক হয়ে, সবার সাথে গলা ফাটিয়ে ‘শচীন শচীন’ করার মধ্যে যে কী আনন্দ ছিল, তা যে না জানে, তাকে জানানো যাবেনা।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। যাযাবর জীবনের
অবসান হয়েছে, ব্যাঙ্ক থেকে ডলার ঋণ করে ছোট্ট একটা বাড়ী কেনা হয়েছে, সেই বাড়ীর
পেছনের ফাঁকা জায়গায় শখের বাগান করা হয়েছে। সেখানে নানা জাতের সব্জী চাষ করার
চেষ্টা করছি, কিছু হয়, কিছু হয়না। এখানে আমাদের গাড়ী আছে, কিন্তু গাড়ীচালক
ক্লান্ত। আমার ইচ্ছের সঙ্গী মিশা নিজেই এখন একা একা দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়,
বায়নাক্কাহীন মৌটুসী ঘুরে বেড়ায় আমেরিকার নামী-দামী স্থান, ছোট মিথীলাকে নিয়ে আমার
আর কোথাও যাওয়া হয়না। আমার সেই যাযাবর ইচ্ছেগুলোও কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, সেই যাযাবর
ইচ্ছের জায়গাটুকু দখল করে নিয়েছে কম্পিউটার কী-বোর্ড! সুযোগ একটু পেলেই হয়,
সারাক্ষণ চলে খটাখট খটাখট।
তারপরেও খুব মাঝে মধ্যে পুরানো ইচ্ছেগুলো
মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। অফিসে ছুটি চাই, নিজের মনে পরিকল্পনা করি, ছুটি পেয়েই দূরে
কোথাও চলে যাব। সমুদ্র আমার অতি প্রিয়, কতবার যে সমুদ্রের কাছে গিয়েছি, সাঁতার
জানিনা, সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কা খেয়ে এদিক থেকে সেদিকে চলে গেছি, আহা, কী আনন্দ!
বুঝি, এই যাযাবর ইচ্ছেটা পেয়েছি দিদিমা ও মায়ের কাছ থেকে। আমার আগেই এই দুই নারী
যাযাবর ইচ্ছে নিয়ে পৃথিবীতে কিছুদিন কাটিয়ে গেছেন। উনারাও ছিলেন ইচ্ছে স্বাধীন,
স্বামীরা উনাদের সঙ্গী হতেন না ঠিকই, কিন্তু তাঁদের ইচ্ছেগুলোকে বাধা দিতেননা। ঠিক
আমিও পেয়েছি তেমনই একজনকে, যিনি যাযাবর জীবনে ক্লান্ত হয়ে ইদানিং আমার সাথে আর পা
ফেলেন না, তবে একসময় পা ফেলেছেন, আমার ইচ্ছেগুলোও ডানা মেলেছিল। এখনও আমার অনেক
কিছু করতে ইচ্ছে করে, তবে বাস্তবে নয়, কল্পনায়!
No comments:
Post a Comment