Wednesday, June 19, 2013

মিঠু'স কেমিস্ট্রি ল্যাব

এখন এখানে সামার ভ্যাকেশান চলছে। সামার ভ্যাকেশান ঠিকই, গরমও প্রচন্ড, তবে আম, কাঁঠাল খাওয়ার কোন উপায় নেই, এমনকি শীতল পাটি বিছিয়ে দুপুরে ঘুমাবো, সেই ব্যাপারও নেই। রাম নেই তাই রাম রাজত্ব নেই, মিসিসিপিতে বাঙ্গালী নেই, তাই আম, কা৬ঠাল, শীতল পাটির ব্যাপার নেই। তার উপর আমাকে ওয়ালমার্টের বারোমেসে সেন্টারে চাকরী করতে হয়, উত্তম কুমারকে ভার্সিটিতে সামার ক্লাস নিতে হয়, ছোট মিথীলাকে বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটাতে হয়। এইসব বিলাসিতা করবোই বা কখন!

ইদানিং আমার সংসারের রেগুলার রুটিনে বেশ কিছু উলট-পালট হয়ে গেছে। তবে ঘরের রুটিন উলট-পালট হয়ে গেলেও সংসারের কোন কিছুই আমার নজর এড়িয়ে যায়না। খেয়াল করেছি, ইদানিং উত্তম কুমার লাঞ্চ ব্রেকে বাড়ী আসেনা, আগে আসতো, যখন আমি দুপুরের জন্য পরোটা, লুচী, হাতে গড়া আটার রুটি, সব্জী, চীজ ফিলড ওমলেট,  চিঁড়ের পোলাও, মিঠু'স স্পেশ্যাল নুডুলস বানিয়ে রাখতাম। এখন আমি আর আগের মত সময় পাইনা, তাছাড়া ইদানিং খুব স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে গেছি বলে কিছুদিন স্যালাড, ফলমূল, ভুষি মেশানো আটার রুটি বানিয়েছি, এগুলো আবার  উত্তমের দুই চক্ষের বিষ। স্বাস্থ্য সম্মত খাবার এড়াতে সে লাঞ্চ ব্রেকে বাড়ী আসা বাদ দিয়েছে, সে প্রায়ই দেখি  নিজে নিজে চিকেন গ্রীল করে, চিকেন কিমা দিয়ে ডাল রান্না করে, ভুট্টা গ্রীল করে, দোকান থেকে নানা জাতের রকমারী স্ন্যাক্স কিনে নিয়ে আসে। পুরো শাহীখানা বানিয়ে ফেলেছে আমার কিচেনকে ( কিচেনকে আমি আমার কেমিস্ট্রি ল্যাব বলি) , এই নবাবী খাবারগুলো প্যাকেট করে সাথে নিয়ে যায়। কিছুই আমার নজর এড়ায়না। আমি নাটাইয়ের সূতা ছাড়ছি, দেবো একদিন হ্যাঁচকা টান। বোকাট্টা করে দেবো ঘুড়ি! আমার এত সুন্দর করে গড়ে তোলা কেমিস্ট্রি ল্যাবকে কোনভাবেই নবাব বাড়ীর হেঁশেল বানাতে দেবোনা।

বেশীদিন আগের কথা নয়, সপ্তাহ তিনেক আগে আমাদের বন্ধু শুভাষীষ'দা এবং উনার স্ত্রী রঞ্জনা এসেছিল। কথায় কথায় বললাম, আমাদের বাগান ভাগ্য ভাল না, গাছ তো বড় হয়ইনা, ফসল ফলবার আগেই কাঠবেড়ালী এসে গাছের গোড়া কেটে দিয়ে যায়। একথা শোনার সাথে সাথেই বাগান বিশেষজ্ঞ রঞ্জনা বললো, " ন্যাপথালিন কিনে নিয়ে আসো, বাগানের চারপাশে বা ঘরের চার পাশে ন্যাপথালিন ছড়িয়ে দিলে কাঠবেড়ালীও আসেনা, সাপও আসবেনা। ওরা জানে, আমার সাপ ফোবিয়া আছে। এই প্রাণীটির নাম মুখে বলতে পারিনা, ছড়া ছবির বইয়ে ছবিও দেখতে পারিনা, পরিবারের সকলে যখন টিভি দেখে, তখন এই প্রাণীটির দৃশ্য এলে আমাকে বলতে থাকে, " চোখ বন্ধ করো, চোখ বন্ধ করো"। কাজেই রঞ্জনা যখন পরামর্শটি দিল, পরের দিনই আমি ওয়ালমার্টে গিয়ে এক কেজি ন্যাপথালিন কিনে নিয়ে এলাম।

সেদিন কোন এক কারণে আমার গাড়ীটি অকেজো হয়েছিল বলে উত্তম কুমার আমাকে ওয়ালমার্ট থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। আসার পথে আমি বলি,
-এই শোন, ন্যাপথালিন এক কেজিতে কিছু হবেনা, আরেক কেজি আনবো, বাড়ীর চারদিকে ছড়িয়ে দেবো। কাঠবেড়ালী আসুক কি না আসুক, ঐ প্রাণীটার আসা বন্ধ করতে হবে।
সে বলে, ন্যাপথালিন দিলে সাপ আসা বন্ধ হয় কে বললো?
-এই, প্রাণীটার নাম বলবেনা, আসা বন্ধ হবে, রঞ্জনা বলেছে, কারন ন্যাপথালিনে 'কার্বলিক এসিড' আছে। এইজন্য আসবেনা।
-ন্যাপথালিনে কার্বলিক এসিড আছে? বলো কী, কেমিস্ট্রিতে ডিগ্রী নিয়ে বলছো, ন্যাপথালিনে 'কার্বলিক এসিড' আছে?
-হ্যাঁ, কার্বলিক এসিডের গন্ধ আছে ন্যাপথালিনের মধ্যে।
-হায় হায় রে! আমি কই যাব রে! ন্যাপথালিনের মধ্যে কার্বলিক এসিডের গন্ধ পায় রে, কেমিস্ট্রির কী দশা! তুমি কী ন্যাপথালিনের স্ট্রাকচার জানো?
-না, এখন ন্যাপথালিনের স্ট্রাকচার মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনা, শুধু জানি, বেনজিন এর স্ট্রাকচার। এটুকু মনে রাখলেই যথেষ্ট। তাছাড়া হুবহু মিল হতে হবে কেন? কার্বলিক এসিড বা ন্যাপথালিন, দুইটাই অ্যারোমেটিক কম্পাউন্ড, কাজেই কোন না কোনভাবে যোগসূত্র আছে।
-ভাল, খুব ভাল, কই যাব, কেমিস্ট্রির কী অবস্থা, কে বলবে এই মহিলা কেমিস্ট্রিতে অনার্স, মাস্টার্স করেছে।

-সবাই বলবে আমি  কেমিস্ট্রিতে পাশ করেছি, প্রশ্ন করার আগেই বলে দেবো, পাশ করার ২৫ বছর পরেও, এখনও মনে আছে ওয়াটার, মিথেন, মিথিলিন, ইথেন, ইথিলিন, ইথানল, মিথানল, ফেনল, সালফিউরিক এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, বেনজিন, (হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন), ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, সিঙ্গল বন্ড, ডাবল বন্ড, ট্রিপল বন্ড~~~~~~ আরও বলবো? শুনতে চাও?

-মাফ চাই।
-মাফ করবোনা, তুমি কেমিস্ট্রির জাহাজ হইতে পারো, আমি তো কেমিস্ট্রির 'ডিঙ্গি নাও' হইতে পারি, পারিনা?

-চুপ থাকেন, ন্যাপথালিনকে বলছেন কার্বলিক এসিড, এইটাই আগে হজম করি, নতুন করে কেমিস্ট্রি শিখতে হবে দেখছি।


আমাদের এই ঝগড়া থেমে গেলো গাড়ী বাড়ির গ্যারাজে ঢুকার সাথে সাথে। এবার আমার পালা। গাড়ী থেকে নামতে নামতে বললাম,
-তোমার ল্যাব হচ্ছে ইউনিভার্সিটিতে, গবেষনাই করো আর শিক্ষকতাই করো, পায়ে হেঁটে  টেংরিয়ে টেংরিয়ে ডিপার্টমেন্টে যেতে  হয়, আর আমার ল্যাব আমার নিজের বাড়ীতে। কোথাও যাওয়া লাগেনা, যখন যা এক্সপেরিমেন্ট করতে মন চায়, অ্যাপ্রনটা শুধু গলায় ঝুলায় নিলেই চলে, ইদানিং অ্যাপ্রনও ঝুলাইতে হয়না, চোখের আন্দাজ, আর অভিজ্ঞতা এত বেশী হয়ে গেছে, তাহলে কে বড় কেমিস্ট?

-সারাক্ষণ ফেসবুকে বসে না থেকে মাঝে মাঝে কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতা উল্টিও!
-কোন দরকার নাই, অনার্স-মাস্টার্সে যা শিখছি, সেগুলো দিয়ে হাতে কলমে কাজ করছি, এই জন্যই এখন এত বড় বড় কথা বলতেছো। হুহ! আছিলা তো রোগা পটকা, কোন ল্যাবরেটরীর ভাত খেয়ে এমন উত্তম কুমার চেহারা বানিয়েছো, শুনি! 'মিঠু'স কেমিস্ট্রি ল্যাব' ই তো ভরসা।

-আমি এখন নিজেই রান্না করতে জানি, আপনার চেয়ে ভালই জানি।
- কথায় বলে, গাঙ পার হইলে মাঝি শালা। এখন তো বলবেই এই কথা। চিকেন গ্রীল মাস্টার খেতাব পেয়েছো, তা জানতে চাই, চিকেন ম্যারিনেট করা কার কাছে শিখেছো, শুনি! বেগুন দিয়ে করলা ভাজতে শিখেছো, কার কাছ থেকে, শুনি?

-আমি নিজে নিজেই শিখেছি।
-ঠিক আছে, নিজে নিজে শিখলেও তো ঐ কেমিস্ট্রির জ্ঞানকেই কাজে লাগিয়েছো। তা আমিও তো আমার কেমিস্ট্রি জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে 'মিঠু'স কেমিস্ট্রি ল্যাব' প্রতিষ্ঠা করেছি, যেখান থেকে প্রস্তুত হওয়া খাদ্য সামগ্রীর গুণে আজ তোমরা এত পটর পটর করতে শিখেছো।


এরপর নিজের মনে মনেই কিছুক্ষণ গজ গজ করলাম। কোন কুক্ষণে যে কেমিস্ট্রি পড়তে গেছিলাম। আমার পছন্দের বিষয় ছিল সাহিত্য এবং সংগীত। কেমিস্ট্রি না পড়ে যদি বাংলা সাহিত্য পড়তাম, এতদিনে আমার লেখা উপন্যাস/গল্প স্কুল কলেজে পাঠ্য হয়ে যেত, ( আমি এভাবেই স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নই যদি দেখবো, তবে কেন একেবারে উঁচুমাপের স্বপ্ন দেখবোনা)। ম্যাট্রিক পরীক্ষার কয়েক মাস আগে আমার এক শিক্ষক, কনক কান্তি পন্ডিত, আমাকে খুব স্নেহ করতেন, কুমিল্লা 'বার্ডে' চাকরী নিয়ে চলে যাওয়ার আগে আমার উপর বিরক্ত হয়ে ( লেখাপড়ায় ফাঁকী দিতাম)  বলেছিলেন, " তুমি তো ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, তাইনা? কেমিস্ট্রিতে ফেল করবে তুমি, এই আমি বলে দিলাম"। স্যারের মুখের উপর কিছু বলিনি, ম্যাট্রিকে কেমিস্ট্রিতে ৯০ পেয়ে উনাকে চিঠিতে সেটা জানিয়েছি। এখানেই থামিনি, শুধুমাত্র স্যারের উপর জেদ করে কেমিস্ট্রি অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম। কেমিস্ট্রি মজার সাবজেক্ট, কিন্তু আমার মত ফাঁকীবাজের জন্য বিরক্তিকর এক সাবজেক্ট। তবুও তো ভালভাবেই পাশ করেছি। স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করেও সময়মত অনার্স, মাস্টার্স কমপ্লীট করেছি, একেবারে তো ফেলনা কথা নয়! অনেক বছর পর কনক কান্তি স্যার পর্যন্ত আমার কাছে স্বীকার করেছেন যে জেদ বটে আমার!

সেদিন উত্তমের সাথে কেমিস্ট্রি নিয়ে তর্কাতর্কির পর ব্যাপারটি নিয়ে সীরিয়াসলী ভেবেছি, আসলেই কী আমি কেমিস্ট্রি পড়ে ভুল করেছি! আমি যখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি, তখন আমার বিয়ে হয়ে যায় কেমিস্ট্রির জাহাজের সাথে। বিয়ের পর আমি অনার্স, মাস্টার্স শেষ করি, এবং  সংসারে ছোট্ট মৌটুসীকে নিয়ে খেলা করি। মৌটুসীকে পেয়ে আমার চাকরী-বাকরী করার কথা মনেই হতোনা। কিন্তু বাবা মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দিতেন,
" এত যত্ন করে তোরে লেখাপড়া শিখাইলাম, আর তুই এইভাবে জীবনটারে শেষ করতেছস?"
-মুখে মুখে তর্ক করা আমার স্বভাব, সাথে সাথে বলে দিতাম, " শেষ করছি কই? এই যে মেয়েকে মানুষ করছি"।
-মেয়ে মানুষ করতে কেমিস্ট্রি পাশ করার দরকার হয়না, তোর মায় তো কেমিস্ট্রি পাশ করে নাই, ঠিকই তো তোগোরে মানুষ করছে।
-হ, মায় সারাদিন স্কুলে কাটাইতো, আমরা কেউ মা'রে একেবারে কাছে থেকে পাই নাই, সেই দুঃখ মনের মধ্যে আছে, ঐজন্য ঠিক করছি, আমার মেয়েরে আমার কাছে রাখবো।

-মারে, চাকরী কইরাও মেয়ে মানুষ করতে পারবি, বি সি এস দে, প্রফেসারী করবি, মেয়ে মানুষ করবি, কেমিস্ট্রির মত সাবজেক্টে পড়লি, এখন রান্না ঘরে হাঁড়ি ঠেলে জীবন পার করবি?
-বাবা, বি সি এস দিলেও শেষ পর্যন্ত চাকরী পামুনা। আমি ভাইবা দিতে ডরাই, ভাইবা বোর্ডে পরীক্ষকরা আমার চেহারা দেখলেই  উলটা পালটা  কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে,  ভয়ে হাত পা ঘামতে থাকে। তাছাড়া, মৌটুসীর বাবা তো কিছু বলেনা, তোমরা কেন এমন করো?
-তোদের ভালর জন্যই এমন করি। মেধা কাজে লাগা, রান্না তো সবাই করে, আমাদের ঘরের গীতার মা'ও রানতে পারে, রান্নাটা এমন কিছু আহামরী ব্যাপারনা।
-বাবা, আমার কাছে রান্না আহামরী ব্যাপার। হুমায়ুন আহমেদ বলছে, ভাল রান্না খাইয়ে যে কোন পুরুষের মন জয় করা যায়। তাছাড়া, আমার বরটা সারা জীবন এখানে সেখানে থেকে লেখাপড়া করছে, কোনদিন সংসারের ভাত পায় নাই, আমি তার বউ, আমার তো দায়িত্ব তাকে সারা জীবন ভাল ভাল রান্না করে খাওয়ানো।

বাবা বলেন, এই কথা কইয়া দিলি তুই আটকাইয়া। আমি ত অবশ্যই চাই জামাই বাবাজীরে লইয়া সুখে শান্তিতে সংসার কর, তোর যদি মনে হয় প্রফেসারী করতে গেলেও সুখে ভাটা পড়বো, আমি ত বাবা হইয়া সেইটা বলতে পারিনা। তবে অবসরে কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতা উল্টাইস, চর্চা রাখিস, ভবিষ্যতে প্রয়োজনে যাতে না ঠেকস।


আমার সেই প্রয়োজন বা সুযোগ, কোনোটাই আর আসেনি।  আমার আরও বেশ কিছু শুভাকাংক্ষী আমাকে বি সি এস পরীক্ষা দিতে বলতো, উত্তম কুমারের বৌদি, হলিক্রস কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, কেমিস্ট্রি টিচারের অসুস্থতাজনিত কারণে আমাকে কলেজে দেড় মাস লীভ ভ্যাকেন্সীতে অধ্যাপনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তখন দ্বিতীয় মেয়ে মিশা খুব ছোট। মৌটুসীর চার বছরের ছোট মিশা, জন্মের পর থেকেই মিশা ছিল খুব অসুস্থ, আমি পক্ষীমাতার মত আগলে রাখতাম দুই মেয়েকে। তখন বুঝতে পারতাম, অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে, আমার একটা চাকরীর প্রয়োজন ছিল। বড়দা আমাকে সব সময় নরম স্বরে বুঝাতো, বড়দার অনুরোধে বি সি এস পরীক্ষা দিলাম, লিখিত পরীক্ষা নিয়ে আমার কখনওই চিন্তা ছিলনা, আমি ভাইবা দিতে ভয় পেতাম। বি সি এস পরীক্ষার ভাইবা এগিয়ে এলো, এর মধ্যে মিশা আবার প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লো। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ভাইবা দেবোনা। বড়দা আমার বাসায় এসে কত কাকুতি মিনতি করলো, আমি বললাম, আমি চাকরী করলে আমার মেয়েরা বাঁচবেনা। এমন কথা বললে কে আর এগোবে! তারপরেও বড়দা লেগেছিল আমার পেছনে, যদি একবার পাঠাতে পারে ভাইবা বোর্ডে। আমি যাইনি।

এত কিছু যে হচ্ছিল আমাকে নিয়ে, আমার উত্তম কুমার কিন্তু কখনও বলেনি কেমিস্ট্রি অনার্স, মাস্টার্স শেষ করতেই হবে, চাকরী করতেই হবে! আমার বাবার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতেই আমি অনার্স, মাস্টার্স শেষ করেছিলাম। এরফলে একটাই লাভ হয়েছে, ভাইয়েরা বিশেষ করে আমার মেজদা, কথায় কথায় খোঁটা দিত, " তোর লজ্জা করেনা, কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স তুই, এমন একজন জ্ঞানী মানুষের স্ত্রী হয়ে ঘরে বসে আছস" অথবা যদি কিছু নিয়ে তর্কাতর্কি হতো, মেজদা বলতো, 'তোর কথা বার্তা শুনলে তো মনে হয়না তুই কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করছস"। আমি হেসেই উড়িয়ে দিতাম। বলতাম, কেমিস্ট্রি পড়েছি বলে গান গাইবোনা, নাচবোনা, হাসবোনা, এমন কথা কোথায় শুনেছো? আমার ইচ্ছা হয়েছে, আমি চাকরী করবোনা, আমার ইচ্ছা হয়েছে, দুই মেয়েকে নিয়ে পুতুল খেলবো, তোমরাও আসতে পার এই খেলায়।
এরপর সংসারে মন দিয়েছি, মেয়েদেরকে একেবারে হাতে-পিঠে করে বড় করেছি। একসময় যখন মেয়েরা ভাল রেজাল্ট করতে শুরু করলো, বাবাকে বলেছি,  " বাবা, দেখো, আমার কেমিস্ট্রি জ্ঞান আমি কোথায় অ্যাপ্লাই করছি। মেয়েগুলোকে মানুষ করতে গিয়ে কেমিস্ট্রি কাজে লাগছে।"
বাবা বলতেন, " তুই যা বুঝাবি, তাই বুঝবো। ঠিক আছে, মেয়ে মানুষ কর, কিন্তু চর্চা রাখিস, বলা তো যায়না, কখন কাজে লাগবে। মেয়েদের জীবন, পায়ের নীচে মাটি শক্ত রাখা দরকার"।

মেয়েরা বড় হয়েছে, উত্তমের পায়ের নীচে মাটি শক্ত হয়েছে, বিয়ের পরেই জেনেছি, আমার উত্তমের ছোটবেলা থেকেই বাইরে বাইরে কেটেছে, (গ্রামে ভাল স্কুল-কলেজ ছিলনা বলে) মনে হয়েছে, আহারে! আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্নীয়-স্বজন মিলে কত আনন্দে জীবন কাটিয়েছি, আমার উত্তম এগুলো কিছুই পায়নি, আমি চেষ্টা করবো জীবনের না-পাওয়া অংশটুকু পুষিয়ে দিতে, তাই চেষ্টা করেওছি, সংসার জীবনের আনন্দ  সে পূর্ণমাত্রায় পেয়েছে,  রান্না-বান্নায় আমার বরাবর উৎসাহ, হুমায়ুন আহমেদের সেই উক্তিটিকে কাজে লাগিয়েছি, ফল পেয়েছি। উত্তম আমার বশে থেকেছে সারা জীবন।

সেই উত্তম এত বছর বাদে আমাকে কেমিস্ট্রি ডিগ্রী নিয়ে খোঁটা দিল??? অনেক ভেবে চিন্তে বের করলাম কারণ, ফেসবুকে বসে থাকি বলে বাবুর গোসা হয়েছে, আমি যে স্বাস্থ্যগত দিক চিন্তা করে আগের মত চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খাবার রান্না করিনা, সেটা সে বুঝতে পারেনি, ভেবেছে ফেসবুকে ব্যস্ত থাকি বলে রাঁধিনা। সেইজন্য সে নিজে নিজেই রান্না শুরু করে দিয়েছে। লাঞ্চ ব্রেকেও নিজের বানানো খাবার নিয়ে যায়, আমার টনক নড়েছে। আরে! আমার উত্তম তো দেখি বশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটা তো ভালো লক্ষ্মণ নয়। আমাকে আবার কেমিস্ট্রি ল্যাব চালু করতে হবে।

গতকাল জিজ্ঞেস করলাম, " কাল তোমার লাঞ্চ ব্রেক কখন?"
-আমার আবার লাঞ্চ ব্রেক কী? ১টা থেকে ল্যাব শুরু হয়।
-থীওরী ক্লাস শেষ হয় কখন?
-১২টায়।
-তুমি লাঞ্চ খেতে বাসায় এসো।
-নাহ! ১২টা থেকে ১টা , এই এক ঘন্টার জন্য আসবো, খাবার রেডী হতে হতে ল্যাব শুরু হয়ে যাবে।
-বললাম তো, ১২টার সময় আসবে, ১টা বাজার আগেই তুমি ল্যবে ঢুকে যেতে পারবে।

উত্তম কুমার এসেছিল, সোয়া বারোটায়। এর মধ্যেই আমি স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে কম তেলে পরোটা ভেজেছি, চীজ পুর দিয়ে ডিম ওমলেট ভাজা হয়েছে ( ওমলেট অবশ্য মিথীলার হেল্প নিয়েছি), আলু ফুলকপি ভাজা ছিল, এগুলো দিয়ে খেতে দিয়েছি, ওমা! দেখি উত্তম রেফ্রিজারেটার খুলে আরেকটা বাটি বের করেছে, বলে, " চিকেন কিমা দিয়ে ডাল রেঁধেছিলাম সেদিন, পরোটা দিয়ে খেতে ভাল লাগবে, খাই"। আহারে! মনটা হঠাৎ করে মায়ায় ভরে গেলো, বাবা নেই, মা নেই, দিদিরা কেউ বেঁচে নেই, আমি আর তিনটি মেয়েই আছি তার একান্ত আপনার জন হয়ে! বললাম, " খাও, ডাল দিয়েও খাও, ডিম খাও, ফুলকপি ভাজাও খাও"। খেয়েদেয়ে দিব্বি বাবু ১টা বাজার আগেই আবার ডিপার্টমেন্টে চলে গেল।  এরপর থেকে সে আমাকে আর কেমিস্ট্রি ডিগ্রী নিয়ে খোঁটা দিবে বলে মনে হয়না!



No comments:

Post a Comment