Friday, August 24, 2012

তিন প্রজন্মের চোখে বঙ্গবন্ধু







আমার বাবার বয়স ৮৫ বছর। অথচ বয়স এখনও উনাকে কাবু করতে পারেনি। শারীরিকভাবে কিছুটা দূর্বল হলেও চিন্তা চেতনায় যে কোন তরুনকেও হার মানাতে পারেন। চোখে মোটা লেন্সের চশমা এঁটে এখনও নানা বিষয়ের উপর পড়াশোনা চালিয়ে যান। রাজনৈতিক বিষয় হলেতো কোন কথাই নেই।  আমরাও মোটামুটি রাজনীতি সচেতন এবং সচেতনতাটুকু উনার কাছ থেকেই এসেছে। এই বয়সেও বাবা নেহেরু, ইন্দিরা, বংগবন্ধু পড়ে অবসর সময় কাটান। রাজনীতি বলতে উনি বঙ্গবন্ধুকে বুঝেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির অন্ধভক্ত। উনার মত বঙ্গবন্ধুভক্ত আমার জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। বাবা কোনভাবেই মানতে রাজী নন যে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনায় কোন ভুল থাকতে পারে উনার মতে, রাষ্ট্র পরিচালনায় দুই একটা ভুল হলেও তাঁর গৌরব ম্লান হওয়ার মত ভুল উনি কখনওই করেননি। এই বিশ্বাসে অটল থেকেই উনি  পঁচাত্তর পরবর্তী দুঃসহ সময়টাতেও জোর গলায় সারা পাড়া কাঁপিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করতেন।  এমন বঙ্গবন্ধুভক্ত পিতার সন্তান হওয়াতেই বোধ হয় বঙ্গবন্ধুপ্রীতি আমার মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে।

দ্বিতীয় প্রজন্মে বঙ্গবন্ধুঃ

আমার জীবনে বংগবন্ধুর অস্তিত্ব অন্য সকলের চেয়ে আলাদা। বঙ্গবন্ধুকে আমি সামনা সামনি দেখেছি, মাথায় উনার স্নেহস্পর্শ পেয়েছি। বংগবন্ধু শব্দটি আমার জীবনের প্রেরণাস্বরূপ, সৌভাগ্যের প্রতীক। বঙ্গবন্ধুকে আমি সামনা সামনি দেখেছিলাম '৭৫ এর মাঝামাঝি সময়ে।  আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট দাউদ খান এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে। উনাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু চাঁদপুর বেড়াতে গেছিলেন। প্রেসিডেন্টের সেই সফর উপলক্ষ্যে নারায়নগঞ্জের পাগলা ফেরিঘাট রঙ বেরঙের তিনকোনা পতাকায় সাজানো হয়েছিল। আশেপাশের স্কুলগুলো থেকে ব্লুবার্ড, গার্লস গাইড, স্কাউটদের সাথে কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রীদেরকেও আনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর অতিথিকে  দাঁড়িয়ে থেকে সম্বর্ধণা জানানোর জন্য। মেধাবী ছাত্রী হিসেবে আমিও সুযোগ পেয়েছিলাম সকলের সাথে দাঁড়ানোর। এখনও যেমন করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা  জাতীয় পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদেরকে সম্বর্ধণা দেয়ার জন্য, আমরাও সেদিন দাঁড়িয়েছিলাম ঘন্টার পর ঘন্টা। তবে আমার মনে কোন আক্ষেপ ছিলনা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম বলে। আমি অপেক্ষা করছিলাম স্বপ্নের মানুষটিকে দেখার জন্য, যাঁর কথা আমার বাবার মুখে প্রতিদিন একবার করে শুনতাম।
সেদিন ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন ছিল। বংগবন্ধু উনার অতিথিকে নিয়ে যখন আমাদের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, কি মনে করে একটু থেমে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, " কি রে দুপুরে কিছু খাইছস"আমি অভিভুত হয়ে গেছিলাম। বঙ্গবন্ধু  আমার মাথায় হাত রেখেছেন, আমি ধন্য হয়ে গেছি।
'৮২ সালের শেষের দিকে আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলামবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখা  থেকে হাতে লেখা ভর্তি গাইড বই বের করা হয়েছিল। তারই একটা আমিও পেয়েছিলাম। গাইড বইয়ের শেষের পাতায় 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' লেখা ছিল। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল আমার মনমতো হয়নি বলে খুবই আপসেট ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনের মত সাবজেক্টে চান্স পাইনি। সামনে একটাই সুযোগ, জাহাঙ্গীরনগরে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হতেই হবে। আমি গাইড  বইয়ের 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'  শ্লোগানটির দিকে তাকাতাম, মনে মনে আওড়াতাম, "বঙ্গবন্ধুর নামে গাইড বই পড়ছি, আমাকে এখানে চান্স পেতেই হবে'  ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে মেধা তালিকায় প্রথম তিনজনের মধ্যে স্থাণ পেয়েছিলাম।
আমি আগে কখনওই পত্রপত্রিকায় লেখালিখি করিনি। কিনতু গত বছরের  আগস্ট মাসেই বন্ধু পীর হাবীবুরহমানের অনুপ্রেরনায় বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় একটি লেখা পাঠিয়েছিলামজীবনের প্রথম লেখাটি ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধুকে দেখার স্মৃতি থেকে লিখেছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখাটি ছাপা হয়েছিল খুব সম্ভব ১৮ই আগস্টের বাংলাদেশ প্রতিদিনের ‘খোলা কলমে  এরপর  থেকে আমি নিয়মিত লিখছি। আমার এই লেখকসত্তা বিকাশের সূচনাতে বঙ্গবন্ধুই আছেন ‘শুভ সূচনা’ প্রতীক হয়ে।

 তৃতীয় প্রজন্মে বঙ্গবন্ধুঃ

৯৪ সালের ১৫ ই আগস্টের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নাম্বার বাড়ীটি 'বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর' হিসেবে জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা (মাননীয় প্রধান মন্ত্রী) ও শেখ রেহানা একমত হয়ে জাতির পিতার স্মৃতিবহুল বাড়ীটি জাতির জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তানের মত কাজ করেছেন। দেশের জনগন এই দু'বোনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে আজীবন।
৯৪ সালের এক বিকেলে পারিবারিক বন্ধু শিখা বৌদির সাথে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর দেখতে। সাথে নিয়ে গেলাম ৭ বছরের মেয়ে  মৌটুসী(ঋত্বিকা)কে। ছোটবেলা থেকেই মৌটুসী খুব ধীর-স্থির  স্বভাবের, সব সময় নিজস্ব ভাবনার জগতেই থাকে। ৯৪ সালে আমার মেয়ে ঢাকা ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ত। ওকে সাথে নিয়ে ৩২ নাম্বার বাড়ীতে পৌঁছে শুরুতেই আমি কেমন যেনো আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। বাড়িটির প্রতিটি ধূলিকনাতেও যেনো বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম। প্রতিটি রুম ঘুরে দেখি আর চোখের জলে ভাসি।
মৌটুসী আমার হাত ধরে ধরে হাঁটে আর দেয়ালের প্রতিটি ক্যাপশা পড়ে। হঠাৎ করেই ও আমাকে প্রশ্ন করে, " মামণি, শেখ রাসেলতো অনেক ছোট ছিল, আমার সমান ছিল। ওকে মেরে ফেলেছে কেনো"র এমন প্রশ্নে আমি অবাক না হলেও আমাদের কাছাকাছি দর্শণার্থীরা অবাক হয়েছিল। এক ভদ্রলোক বলেই ফেললেন, " তোমার যতটুকু বুদ্ধি আছে, অতটুকু বুদ্ধিও যদি ঐ জানোয়ারদের থাকতো তাহলে শেখ রাসেলকে মারতোনা"। আরেক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, " এত ছোট বাচ্চাকে সাথে না আনলেই ভালো করতেন। বাচ্চাটার মনে একটা খারাপ দাগ কেটে গেলো"। আমি শুধু বলতে পারলাম, " আমার মেয়ে খারাপ ভালো চিনেই বড় হোক, এটাই আমি চাই"।
বঙ্গবন্ধু যাদুঘর উন্মুক্ত হওয়ার পরে বেশ কিছুদিন দর্শণার্থীদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য বিরাট বড় বাঁধানো খাতা রাখা হয়েছিল। যাদুঘর প্রদক্ষীণ শেষে ঐ খাতায় অনেককেই লিখতে দেখলাম। এই শোকপুরী ঘুরে দেখে ছোট্ট মৌটুসী কী বুঝলো তা পরখ করে দেখার জন্য ওকে বললাম, " মামনি,  বঙ্গবন্ধু যাদুঘর ঘুরে দেখে সবাই নিজেদের মতামত ঐ খাতায় লিখছে,  আমি চাই তুমিও তোমার মতামত এই খাতায় লিখে যাও। তোমার লেখা এই খাতায় থাকবে সারাজীবন"। মৌটুসী খুব সুন্দর করে গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, " শেখ রাসেলতো ছোট ছিল, ওকে মেরেছে কেন"? নীচে ওর বয়স, স্কুলের নাম লিখে দিয়ে চলে এলো।
পরের দিন মৌটুসীর লেখা সেই ছোট্ট কমেন্টটি দৈনিক আজকের কাগজেবঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর’ ফলোআপের শিরোনাম হয়ে গেল '৯৪ সালে দৈনিক 'আজকের কাগজ' খুবই জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল। বহুল প্রচারিত দৈনিকে " ছোট্ট ঋত্বিকার প্রশ্ন, শেখ রাসেলতো ছোট ছিল, ওকে মেরেছে কেনো"শিরোনামে বিরাট বক্স নিউজ হয়েছে দেখে আমি যারপরনেই খুশী হয়েছিলাম। সংবাদটির দিকে তাকিয়ে আমার একটাই অনুভূতি হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু আমার অস্তিত্বে মিশে আছে। ছোটবেলা বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধণা জানাতে শত শত ছেলে মেয়ের সাথে আমিও উপস্থিত হয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু সবাইকে বাদ দিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে জানতে চেয়েছিলেন, দুপুরে কিছু খেয়েছি কিনা! আর এবার কতজনেই মন্তব্য খাতায় মন্তব্য লিখেছে, সবারটা বাদ দিয়ে শুধু মৌটুসীর মন্তব্যটাই এতবড় সংবাদের ক্যাপশান হয়ে গেলো!এরপরে মৌটুসী অনেক বড় হয়েছে,  বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এখন ও অনেক কিছু জানে, বঙ্গবন্ধুর কথা উঠলেই  এখনও  মৌটুসীর মানসপটে সেদিনের স্মৃতি ভেসে উঠে।
আমার দ্বিতীয় মেয়ে মিশা ছোটবেলা থেকেই বিদেশের মাটিতে বড় হচ্ছে। দেশ সম্পর্কে ওর কতটুকু ধারণা আছে সেটা আমার জানা ছিলনা। ওর কলেজ স্কলারশীপ ইন্টারভিউতে আফ্রিকান এক প্রফেসার ওকে আচমকাই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। আমাকে অবাক করে দিয়ে মিশা উত্তরে বলেছিল, “ খুব সংক্ষেপে বলি, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা। বাঙ্গালী জাতির মুক্তির জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। যদিও কিছু বিশ্বাসঘাতকের হাতে উনাকে জীবন দিতে হয়েছে, তারপরেও উনিই বাঙ্গালী জাতির মুক্তিদূত”। প্রফেসার খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন মিশার উত্তর শুনে। আমি নিজেও অভিভূত হয়েছি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মিশার দৃষ্টিভংগী দেখে।
১২ বছরের মেয়ে মিথীলা জন্মের পর থেকেই আমেরিকাতে বড় হচ্ছে। দুই বছর আগে মিথীলাকে নিয়ে ৩২ নাম্বারের বাড়ীতে গেছিলাম। ঊদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে চেনানো। সেদিনের দেখায় মিথীলা কতটুকু চিনেছিল তা পরখ করে দেখার সুযোগ হয়নি এতোদিন। এ বছর দেশে গিয়ে মিথীলাকে নিয়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে গেছিলাম। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার মুখেই তিনকোনা ডিজাইনের একটি স্থাপত্য শোভা পাচ্ছে যার প্রথমটিতে বংগবন্ধুর মুখচ্ছবি খোদাই করে অংকিত আছে। কিছু না ভেবেই আমি মিথীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, " মিথীলা বলতো এটা কার ছবি"?
মিথীলার জবাবঃ "শেখ মুজিবুর রহমান"।
আমিঃ " নামের আগে বংগবন্ধু বলতে হয়। তুমি কি জানো উনি কে ছিলেন"?
মিথীলাঃ " ঐ যে ফ্রীডম ফাইটের লীডার, মানে মেইন লীডার ছিল"।
আমি ভেতরে ভেতরে খুশীতে ফুটতে শুরু করেছি। আরেক ধাপ এগিয়ে প্রশ্ন করলাম, " আচ্ছা একটু বুঝিয়ে বলো, ধরো আমেরিকার কোন লীডারের সাথে বংগবন্ধুকে তুলনা করা যায়"?
মিথীলার চটপট উত্তরঃ মার্টিন লুথার কিং"।
আমি খুবই খুশী হয়েছি আমাদের তৃতীয় প্রজন্মের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্যটি সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে পেরেছে দেখে। আমেরিকার জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠা বারো বছরের মিথীলার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে জানা খুবই কঠিন ব্যাপার। তারপরেও দুই বছর আগে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ ঘুরে ফিরে দেখে মিথীলা যে পাঠটুকু নিয়েছে, আমি চমৎকৃত না হয়ে পারিনি। ওকে বললাম, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার যেমনি করে নিপীড়িত কালো জনগোষ্ঠির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, একইভাবেই বংগবন্ধুও পরাধীন বাঙ্গালী জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। দুজনের সংগ্রামই সফল হয়েছে। কালো জনগোষ্ঠী যেমনি করে আমেরিকায় বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সমান অধিকার পেয়েছে, বাঙ্গালীও নিজের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছে। এরপর মিথীলাই যোগ করে দিল, “ কিনতু দুজনকেই খারাপ লোকেরা মেরে ফেলেছে”। আমি ওর সাথে একমত হলাম, “ অবশ্যই ওরা খারাপ লোক ছিল, সেজন্যই নিজেদের নেতাকে হত্যা করতে পেরেছে। ভালো লোক হলে এটা করতে পারতোনা”।  






বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আমাদের ঘরে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ শোনা নিষিদ্ধ ছিল

রুমানার সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছিল তিন বছর আগে।, মিসিসিপিতে। বাংলাদেশের মেয়ে রুমানা মিসিসিপি স্টেট ইউনিভারসিটিতে উচ্চশিক্ষা নিতে এসেছিল। এবছর রুমানার বিয়েতে গিয়ে ওর বড় ফুফুর সাথে পরিচয় হয়।। মাঝবয়সী ভদ্রমহিলাকে দেখলেই খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হয়। রুমানার বাবা-মায়ের সাথে আগেই আমার পরিচয় ছিল। আমাকে ফুফুর সাথে পরিচয় করানো হয় এই বলে, “ ইনিই সেই লেখিকা, যিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারন করে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় লিখেছিলেন”। নতুন পরিচয়ে এমন ভূমিকা শুনে আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমাকে লজ্জা পেতে দেখে রুমানার ফুফু বললেন, “ লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার লেখাটি আমি পড়েছিলাম। ভালো লেগেছে। আপনি বঙ্গবন্ধুর  স্পর্শ পেয়েছেন, লেখার ক্ষমতা আছে বলে লিখেছেন। আমিতো কত কিছুই লিখতে পারতাম, কিনতু কিকছুই লিখে গেলামনা। বঙ্গবন্ধু অমনই ছিলেন, সবার জন্য মায়া। আমাকে দেখলেই বলতেন, “ মাগো, বিয়ার পরও পড়াশুনা করবা। পড়াশুনা ছাড়বা না”।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ আপা আপনি বঙ্গবন্ধুকে এতবার দেখলেন কিভাবে”?
উনি বললেন, “ বঙ্গবন্ধু কতবার আমাদের বাড়ীতে আসছে! আমার আব্বা পাকিস্তান আমল থেকেই তিনবারের এমপি। নোয়াখালিতে আসলে বঙ্গবন্ধু আমাদের বাড়ীতে আসতেন”।
বললাম, “ আরে! আপনারা তো দেখি দারুন ভাগ্যবান। রুমানার আব্বু তো কিছুই বলেননি”।
উনি বললেন, “ আমরা কখনও কোথাও আমাদের গল্প করিনা। আমার ভাই আজ কত কিছুই করতে পারতো বাবার পরিচয় ভাঙ্গাইয়া, বঙ্গবন্ধুর পরিচয় দিয়া, কিনতু আমরা এসবের কিছুই করি নাই”।
রুমানার ফুফুকে দেখে আমার মনটা ভরে গেছে। ভদ্রমহিলার ছেলেমেয়েরা সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে। পুরো পরিবারটি দারুন সংস্কৃতিমনা। এখনও পরম শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারন করে আছেন, কোন ঢাক ঢোল পিটাননা, অথচ বঙ্গবন্ধুকে কত কাছে থেকে এঁরা দেখেছেন।

বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারন করে আছেন আরেকজন, আমার বাবা। বঙ্গবন্ধুর এমন একনিষ্ঠ ভক্ত আমি দ্বিতীয়টি আর দেখিনি। আমাদের ছোটবেলা থেকেই ছকে বাঁধা কিছু নিয়ম চালু ছিল। যেমন সকাল সাতটা বাজলে ‘বাংলাদেশ বেতার ঢাকা’ স্টেশান অন হয়ে যেত, সকালের খবর শোনার জন্য। সকাল সাতটার খবর আরম্ভ হলেই আমি ঘুম থেকে উঠতাম। বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করা হলো, বাংলাদেশ বেতারে সকাল সাতটার খবর প্রচারের বদলে “ আমি মেজর ডালিম বলছি-----শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে” প্রচারিত হতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার বাবা বেশ কিছুক্ষন হতভম্ব হয়েছিলেন। এক সময় রেডিও বন্ধ করে দেন। এরপর ‘বাংলাদেশ বেতার’ পালটে ‘রেডিও পাকিস্তানে’র আদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা হলো, কিনতু আমাদের ঘরে ঢাকা স্টেশান আর অন করাই গেলোনা। যেদিন রেডিও বাংলাদেশ বদলে আবার ‘বাংলাদেশ বেতার’ চালু হলো, আমার বাবা ঢাকা স্টেশানে আবার সকাল সাতটার সংবাদ শুনতে আরম্ভ করলেন।

বংগবন্ধুর মৃত্যুর পরে অনেকদিন, অনেক বছর, এমনকি এখনও অনেককেই বলতে শুনি, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দেশের কেউ কাঁদেনি। এমন কথা শুনলে সব সময়ই আমি আসর ছেড়ে উঠে যাই। অরুচীকর কোন কখা্র মধ্যে আমি থাকিনা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে কেউ কাঁদেনি শুনলেই আমার মনে পড়ে যায় সেদিনের সকালের কথা।

নারায়নগঞ্জে শহরে আমরা থাকতাম। নারায়নগঞ্জ শহরের যে পাড়াতে আমরা থাকতাম, সেই পাড়াটি একসময় হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। আমরা যে বাড়ীতে ভাড়া থাকতাম, সে বাড়ীর মালিক ছিলেন হাজী সাহেব। হাজী সাহেবের ১৮ ঘর ভাড়াটিয়ার মধ্যে একঘর মাত্র মুসলিম পরিবার ছিল। বাকী সবাই হিন্দু। তবে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়া হলেও আমাদের পাড়ায় হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক ছিল পরম আত্মীয়ের মত। আমাদের বাড়ীওয়ালা ও সেই একঘর মুসলিম ভাড়াটের সাথে আমাদের নিত্যদিন একসাথে উঠাবসা সম্পর্ক ছিল। মুসলিম ভাড়াটে চাচা ছিলেন পেশায় ডাক্তার। উনার বাড়ীতে উনারই দূর সম্পর্কের আত্মীয় থাকতো, যাকে আমরা সবাই ‘জামাল ভাই’ বলে ডাকতাম।

আমাদের ঐ বাড়ীর ভাড়াটিয়াদের রুটিনমাফিক একটি কাজ ছিল, তা হলো সকাল সাড়ে ছয়টা বাজলে সব মহিলারা সাপ্লাইয়ের জল নেওয়ার জন্য কলতলায় হাজির হতো। সেই কলতলা থেকে রাস্তা দেখা যেত। ১৫ই আগস্টের সকালে সব মাসীমারা কলতলায় বসে  পালা করে কলসী, বালতিতে সাপ্লাইয়ের জল ভরছিল। হঠাৎ করেই রাস্তা থেকে আমার মেজদা চীৎকার করে ‘ সবাই শোন, বঙ্গবন্ধুকে মাইরা ফেলছে’ বলতে বলতে দৌড়ে আসছিল। মেজদার বয়স ১৪ পূর্ণ হয়নি, সতীশ স্যারের কাছে গ্রুপে পড়তে গিয়ে এমন খবর শুনে পড়া ফেলে দৌড়ে বাড়ী চলে এসেছে।
মেজদা খুবই হাঁফাচ্ছিল। মেজদার মুখ থেকে এমন খবর শুনে কেউ বিশ্বাস করেনি। মহিলাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হতেই পাশের ঘরে রেডিও অন করে “আমি মেজর ডালিম বলছি” শোনা গেল। আমি তখন বেশ ছোট। ঘোষণার অনেক কথাই মনে নেই শুধু ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’ ছাড়া। ততক্ষণে সবার বাড়ীতে রেডিও অন হলো, ভাবখানা এমন যেনো একেক রেডিওতে একেক রকম ঘোষণা আসবে। এক ঘন্টার মধ্যে সমস্ত আমলাপাড়া স্তব্ধ হয়ে গেলো। এমনকি কাকের কা কা পর্যন্ত শোনা গেলোনা।

ঘরে আমার বাবা শুধু একটা কথাই বলছিলেন, “ এইটা কী হইল, কী সব্বনাশ হইয়া গেলো। এইটা কয় কি, পুরা পরিবাররে মাইরা ফালাইছে! মানুষ কেমনে এমুন জালিম হইতে পারে”! আমার কেবলই দুই তিন মাস আগের কথা মনে পড়ছিল। বংগবন্ধু আমার মাথায় হাত রেখেছিলেন। এইবার আমার মা কথা বললেন। মা হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। মানুষের চরিত্র ভালো বুঝতেন। আমাদের সবাইকে মা আস্তে কথা বলতে বললেন। উনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, এতো বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, এর জের যে কারো উপর আসতে পারে। বিশেষ করে আমার বাবা নীচু স্বরে কখনও কথা বলতে পারেননা, উনি অনেক রাগী এবং ডিসিপ্লিন্ড স্বভাবের মানুষ। উলটা পালটা কিছু দেখলে পাড়ার ছেলে ছোকরাদেরও শাসন করতে ছাড়তেন না। মায়ের ভয় ধরে গেল, এখন এমনই একটা অরাজকতা শুরু হতে পারে, যার সুযোগ নিতে পারে অন্য যে কেউ। মায়ের কথায় আমরা সবাই মুখে তালা আঁটলাম, আর বাবা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলো।

সেদিন বিকেলবেলাতেই ঐ ডাক্তার চাচার আত্মীয় ‘জামাল ভাই’ দুই হাতে করে চারটা মুরগী নিয়ে এসেছিল বাজার থেকে। আমাদের সকলের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলছিল, “ আজকে মুরগী জবাই হবে”। জামাল ভাই জানতেও পারেনি, তার দিকে সকলে কেমন ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল।
আমাদের ঘরে রেডিও বন্ধ হয়ে গেলেও পাশের বাড়ীতে রেডিও চলতো। খান আতাউর রহমান তখন অতি উচ্ছ্বাসে একটি গান রচনা করে নিজেই তাতে সুর বসিয়ে কোরাসে গাইয়েছিলেন। গানটির কথা আমার মনে নেই, শুধু “নিপীড়িত জনতা, কোথায় সে নিপীড়িত জনতা” কথাটুকু মনে আছে। গানটির মূল বাণী ছিল, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দেশ এক মহাবিপদের থেকে মুক্ত হলো, জনগনের জয় হলো। যেই ঘরে রেডিও বাজতো, সেই ঘরের মেসো ছিলেন খুবই অমায়িক, কথা বলতেন শুদ্ধ বাংলায়। উনাকে কখনও মুখ খারাপ করতে শুনিনি। একদিন ঐ মেসো “কোথায় সে নিপীড়িত জনতা’ বলার সাথে সাথে জোরে জোরে বলে উঠেছিল, “নিপীড়িত জনতা আমার বগলের তলে”। সারা বাড়ীর মানুষ সেদিন শুনেছিল মেসোর কথা। কী যে রাগে ফাটছিলেন উনি, সেই ছবি এখনও আমার মনে ভাসে।

আর আমার বাবার প্রতিবাদ ছিল অন্যরকম। আমাদের বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ বেতার পালটে রেডিও বাংলাদেশ করা হইছে। যতদিন রেডিও বাংলাদেশ থাকবো, ততদিন আমার ঘরে ঢাকা স্টেশান কেউ চালাইতে পারবা না”। ৯১ সালের আগে কোন ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যায় নাই”। ঐ জামাল ভাইয়ের সাথে আমাদের কথা বলতে মানা করে দিছিলেন।  বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরেই আমাদের পাড়ার পরিবেশ আস্তে আস্তে পালটাতে শুরু করে। চেনা মানুষকেও অচেনা লাগতো। পারস্পরিক বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধেও যেনো টান ধরতে থাকে। এতকিছুর পরেও আমার বাবার গলার জোর কমেনি। অমন দুঃসহ সময়ের মধ্যেও বাবা ঠিকই বংগবন্ধুর খুনীদের ঊদ্দেশ্যে বাতাসে হুঙ্কার ছুঁড়ে দিতেন। খুনীরা না শুনুক এই খুনকে যারা সমর্থণ করেছে তারা শুনেছে আমার বাবার হুঙ্কার। বাবার ধারনা, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে যারা খুশী হয়েছে, তারাতো জানবে এখনও আমলাপাড়ার একটি ঘরে নির্ভয় প্রতিবাদী কন্ঠ এখনও গর্জে উঠে।



No comments:

Post a Comment