Thursday, June 14, 2012

পঁচিশ মিনিটের বাসযাত্রায়!

কলকাতা বেড়াতে এসেছি ছয় দিনের জন্য। সাথে নিয়ে এসেছি মেয়ে মিশাকে। কারন একমাত্র মিশা যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। যেমন কলকাতাতে এখন দারুণ গরম। এই গরমে কোন প্রয়োজন ছাড়া আমার অন্য মেয়েরা বাইরে বের হবেনা, কিনতু মিশা ব্যতিক্রম। তাই মিশাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছি।

গতকাল গিয়েছিলাম জোড়াসাঁকো। আজ যাচ্ছি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও গড়ের মাঠ। সকালবেলাতে মাসীর বাড়ী থেকে রওনা দিয়েছি। মাসীর বাড়ী থেকে ২৩৭ নাম্বার বাসে চড়ে বাগুইহাটি যাওয়ার কথা। বাগুইহাটিতে থাকে আমার কাকীমা। কাকাত ভাই দীপকে তুলে নেওয়ার কথা। দীপ ডকুমেন্টারী ফিল্ম তৈরী করে। ওকে সাথে নিয়ে গেলে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে বলেই ওর কাছে এসেছি। বাসে উঠেই দুটি খালি সীট পেয়েছি। যাত্রা শুভ ধরে নিয়েছি। কারন কলকাতার বাসে বাঁ ট্রেনে উঠে বসার সীট পাওয়ার কথা ভাবাই যায়না। বাসে উঠে মা আর মেয়ে বসতেই বাসটা ছেড়ে দিয়েছে। দেড় মিনিট বাদেই একটি স্টপে বাস থেমেছে, এক ঝাঁক মানুষ সাথে সাথেই বাসে উঠে গেছে। আমার ঘাড়ের উপর এসে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন। এসবই আমার চেনা দৃশ্য। হঠাৎ করেই নারীকন্ঠে এক আর্তনাদ শুনলাম, " ওরে বাবারে! দিয়েছে, দিয়েছেরে!! আমার চোখটা গেলে ফেলেছে। ও মাগো! গেলুমরে গেলুমরে! পাশ থেকে মেয়েটির স্বামী একটি রুমাল এগিয়ে দিল, " একটু গরম স্যাঁক দাওতো,   স্যাঁক দাও। ব্যথা কমে যাবে'খন।"। বউটি স্বামীর দিকে ফিরেও তাকালোনা।

আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাতেই দেখতে পেলাম মেয়েটিকে। কম বয়সী এক বউ, একহাতে বাম চোখটিকে চেপে ধরে চেঁচিয়েই চলেছে। মেয়েটি দেখতে খারাপ না, পরনে ছিল হালকা গোলাপী রঙের সূতীর শাড়ী। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে পড়েছে শাড়ীটিকে। দেখে মায়া লাগল। কিনতু মেয়েটি যেমন করে উঃ আঃ করছিল, আমার কাছে একটু অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছিল। ের মধ্যেই মেয়েটি ঘাড় ঘুড়িয়ে আসল কালপ্রিটের দিকে তাকিয়েই মুখ ঝামটে উঠলো, " বাসে উঠে হাতটাকে একটু সামলে চলতে পারেননা? যত্তসব বেয়াক্কেলে লোক এসে জুটেছে। আমার চোখটাকে গেলেই ফেলেছেরে! এমনিতেই গরমে আমার মাথাটা ভারী হয়ে আচে, তাঁর উপর অমন গুঁতো! উঃ আঃ " এভাবে চলছিল। লক্ষ্য করলাম 'কালপ্রিট' টি শান্তশিষ্ট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোষাকে এক ভদ্রলোক। বউটির আক্রমনে ভদ্রলোক মুখটি আড়াল করে সরে গেলো।

পরের স্টপেজে আরও কিছু যাত্রী উঠলো। তাদের মধ্যে জীনস ও টপস পরা এক তরুনী ছিল। মেয়েটি বললো, " আমাকে একটু ভেতরে যেতে দিন।' বলেই যেই না মেয়েটি ভেতরের দিকে ঢুকতে লাগলো, সেই বউটি চেঁচিয়ে উঠলো, " একটু থামুননা, অত ঠেলা ধাক্কা করার কি হয়েচে! আমি বুঝি ব্যথায় মরে যাচ্চি"। জীনস পরা মেয়েটি জবাবে বললো, " আমিতো আগে থেকেই বলে নিয়েছি। অত চেঁচামেচি করার কি হলো। আমিতো ইনফর্ম করেছি'। ধ্যাতানি খেয়ে বউটি এই বেলা আর কিছু বললোনা।  ের মধ্যেই বউয়ের স্বামীটি বসার জন্য একটি সীট পেয়ে যেতেই বসে পড়ে বউকে ডাকলো, " ওগো, তোমার হাতের ব্যাগটা আমাকে দিয়ে দাও। শুনছো, ব্যাগটা আমাকে দাও"। বউটা এবারেও ফিরে তাকালোনা। আমার মনে হলো, আজ সকালেই বউটির সাথে তাঁর স্বামীর খুব একচোট হয়েছে। স্বামী বেচারা তাঁর কাফফারা দিয়ে চলেছে।

আমার উপর দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের চাপ বাড়ছিল। আমি আমার মেয়ের উপর ঝুঁকে পড়ছিলাম। মেয়ে আবার আমাকে ধমকাচ্ছিল, " এই গরমের মধ্যে তুমি আমার উপর হেলে পড়ছো কেন"?। বললাম, " বউটা আমার উপর পড়ছে। এমনিতেই বউটা ক্যাঁ কোঁ করছে, এখন যদি আমি ওকে সরতে বলি, আবার আমার উপর ক্ষেপে যাবে। থাক, একটুক্ষন সয়ে যাওয়া ভালো"। বলে শেষ করতেই আমার পেছনের সীট থেকে এক কর্কশ কন্ঠের চীৎকার শুনলাম। কর্কশ কন্ঠ বলছিল,"  এই তোমার কান্ডটা কি শুনি? তকন থেকে ফোন বেজে চলেচে, ফোন ধরার নাম নেই? কি করচিলে শুনি! তোমাকে বলেচিলুম ফোনে টাকা ভরতে। ভরেচিলে? কত ভরেচো শুনি! ৫০ টাকা ভরতে বলেছি, আর তুমি খচ্চর দিয়েচো তিরিস টাকা। কেনো তিরিস দিলে? শালা সয়তান কোতাকার! এই রেকে দিচ্ছি ফোন" বলেই ফোন অফ করে দিল।

আমার স্টপেজ কাছে চলে আসতেই ভাই দীপ আমাকে ফোন করে জানতে চাইলো, আমরা কোথায় আছি। আমি এখানের কিছুই চিনিনা। আরেক ভাই টুংকা বাসে তুলে দিয়ে বলেছিল, জোড়া মন্দিরের সামনে নামতে। আমি কিছু বলতে পারছিলামনা বলে দীপ জিজ্ঞেস করলো, " তোমার আশেপাশে কি দেখছো বলো"। বাসটা থেমেছিল একটি ময়লা আবর্জনার বিশাল এলাকার পাশ ঘেঁষে। আমি বললাম, "আমার পাশে ময়লা আবর্জনা দেখতে পাচ্ছি'। এটা শুনেই মিশা এক ধমক দিলো, " এটা একটা কথা হলো? ময়লা আবর্জনা দেখছি বলছো কেনো? বলো বিগ বাজার ছাড়িয়ে জোড়া মন্দিরের কাছে এসেছি"। আমি বলার আগেই বাস জোড়া মন্দিরের কছে চলে এলো, কন্ডাক্টর খুব যত্ন করে আমাদের মা মেয়েকে স্টপে নামিয়ে দিলো। বাস থেকে নেমেই পেয়ে গেলাম দীপকে। দীপের সাথে রওনা দিলাম।

No comments:

Post a Comment