Thursday, October 31, 2013

ভুত উৎসব হ্যালুইন!!



 



 

ছোটবেলা থেকেই আমেরিকাকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে জেনে এসেছি। আমেরিকা মানেই আলো ঝলমলে দেশ, দিবা-রাত্রি চারদিকে শুধুই আলোর ছড়াছড়ি, কোথাও এতটুকু অন্ধকার নেই। অন্ধকার নেই, ভুতও নেই। আমি আবার ভুতে ভয় পাই, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই কম-বেশী ভুতে বিশ্বাস করে। ভুতে বিশ্বাস করে কারণ আমাদের দেশে দিন-রাতের অধিকাংশ সময়ই বিদ্যুত থাকেনা, রাতের বেলা দেশ থাকে অন্ধকারে ডুবে।অন্ধকারে তাই ভুতের কথা মনে আসে সবার আগে।

ভুত-প্রেত, জ্বীন-পরী নিয়েই আমাদের বসবাস। ভুত যেমন আছে, তেমনি ভুত বা জ্বীন তাড়ানোর ওঝাও আছে। তবে ছোটবেলায় আমেরিকাতে ভুত টুত নেই বলে যেমন ভাবতাম, সেটি আসলে ভুল। আমেরিকাতে ভুত-প্রেত আছে। এবং অবাক হলেও সত্যি যে এদেশে আমেরিকানদের অনেকের বাড়ীতেই ভুত থাকে। হ্যাঁ, ওরা ওরকমই বলে। এমনকি আমেরিকার প্রত্যেক স্টেটে কম করে হলেও ছয়-সাতখানা ‘ভুতের বাড়ী’ আছে যা দর্শনার্থীদের জন্য বছরের বারো মাস খোলা থাকে। মানুষজন খুব উৎসাহ নিয়ে সেইসব বাড়ীতে ভুত দেখতে যায়। অনেক মানুষ বিশ্বাস করে যে তাদের বাড়ীতেও ভুত বা অন্য কোন অশরীরি আত্মার উপস্থিতি আছে। তারা নাকি সেটা টের পায় প্রতি মুহূর্তে।

আমেরিকা অধিকাংশ বাড়ীতেই বেসমেন্ট থাকে। বেসমেন্ট হচ্ছে মাটিরে নীচে ঘর। ঘরের ভেতরে থেকে বুঝার উপায় নেই মাটির নীচে আছি নাকি মাটির উপরে আছি। কারন সব রুমগুলোই একইভাবে সাজানো থাকে। তবে ভুতেরা মনে হয় বুঝতে পারে মাটির নীচের ঘর আর মাটির উপরের ঘরের পার্থক্য। তাই বেশীর ভাগ সময় বেসমেন্টেই ভুতদেরকে পাওয়া যায়। মাটির নীচে নিরালায় নিভৃতে থাকতেই তাদের ভালো লাগে।

সিবিএস নিউজ থেকে কয়েক বছর আগে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল, জরিপে ৮০৮ জন প্রাপ্ত বয়স্ককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাদের ভুতে’ বিশ্বাস আছে কিনা।

শতকরা ৪৮% আমেরিকান ‘ভুতে’ বিশ্বাস করে এবং ৪৫% মনে করে ভুত বলে কিছু নেই। ভুত বিশ্বাসীদের মধ্যে মহিলা সদস্যই বেশী। প্রতি পাঁচ জনে একজন জীবনে অনেকবার ভুত দেখেছে বলে দাবী করে।

প্রতি বছর ‘হ্যালুইন’ নামে এক উৎসব হয়, যা ‘ভুত উৎসব’ হিসেবে পরিচিত। হ্যালুইন উৎসবে বাচ্চারা বিভিন্ন ধরণের কস্ট্যুম পড়ে ভুত-পেত্নী সেজে বাড়ী বাড়ী ঘুরে, সকলকে ভয় দেখায়, গৃহস্বামীর কাছ থেকে চকোলেট আদায় করে নেয়। মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই বিশ্বাস করে, ভুতের কস্ট্যুম পরিহিতদের মধ্যেই সত্যিকারের ভুতও থাকে।

এখানে আলাদা একটি টিভি চ্যানেল আছে যেখানে শুধুই ভুত সম্পর্কিত অনুষ্ঠান দেখানো হয়। তবে ভুত যেমন আছে তেমনি ‘ভুত শিকারীও’ আছে। তাদেরকে ‘ঘোস্ট হান্টার’ বলা হয়। ঘোস্ট হান্টারদের ঘোস্ট হান্টিং এর সমস্ত অভিযান ভিডিও করে দেখানো হয় ঐ চ্যানেলটিতে। যারা দেখে, তাদের পক্ষে ভুতে বিশ্বাস না করে উপায়ও নেই। কারন ঘোস্ট হান্টাররা নিজেরাই অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়, তারাও বলতে বাধ্য হয়, ভুতই হোক বা অন্য কিছুই হোক, জীবনের বাইরেও অন্য কিছু একটা রহস্য থেকেই যায়।

জরিপ চালিয়ে আরও জানা গেছে, ব্যক্তিগতভাবে ভুত দেখেছে এমন লোকের সংখ্যা ২২%। তবে ভুত দেখেনি কিনতু মৃত্যুর পরেও অন্য ভুবন আছে, যেখানে মৃত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়, এমনটা বিশ্বাস করে ৭৮% আমেরিকান। অনেকেই বিশ্বাস করে, তাদের পূর্ব পুরুষের মৃত আত্মারা প্রিয়জনকে ছেড়ে ওখানে থাকতে পারেনা বলেই অন্যভাবে, অন্যরূপে পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে আসে। মৃত আত্মাদের চলার গতি আলোর গতির কাছাকাছি বলেই তারা যখন যেখানে খুশী চলে যেতে পারে। আমেরিকানদের মধ্যে অনেকের ধারনা, ভুত মানেই খারাপ কিছু নয়, বেশীর ভাগ ভুতই নাকি ভালো। বেশীর ভাগ সময় তারা মানুষকে সাহায্য করতেই চায়। যারা ভুত ভয় পায়, ভুত তাদেরকে আরো বেশী করে ভয় দেখিয়ে মজা পায়।

আমেরিকাতে বেশীর ভাগ মানুষই ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই ভুতের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে। তারা ভুতকে জীবনের একটি অংশ হিসেবেই দেখে থাকে। কারন তাদের বিশ্বাস, মৃত্যুর পরে যে জগত আছে, সেই জগতের বাসিন্দাদেরকেই পৃথিবীর মানুষ ‘ভুত’ নামে অভিহিত করে থাকে। সবই মানুষের আজন্ম সংস্কার, আজন্ম বিশ্বাস। বিশ্বাসকে বিশ্বাস দিয়েই মানতে হয়। বিজ্ঞানের ক্ষমতা নেই এই বিশ্বাসকে পুরোপুরি ভেঙ্গে দেয়া বিজ্ঞান এখনও গবেষনা চালিয়েই যাচ্ছে ‘ভুত আছে কি নেই’ এর উপর। বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত প্রমান করতে পারেনি ‘ভুত বলে কিছু নেই’। মানুষের কঠিন বিশ্বাসের কাছে বিজ্ঞানও মাঝে মাঝে নাস্তানাবুদ হয়।

৩১শে অক্টোবর আমেরিকাসহ বিশ্বের নানাদেশে খুব উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে পালিত হবে ‘ভুত উৎসব’ হ্যালুইন। হ্যালুইনকে সরল বাংলায় ‘ভুত উৎসব’ বলাটাই সমীচীন। কারন বছরের এই দিনটি ঘিরে ছোট বড়, শিশু-বুড়োদের মধ্যে এক ধরনের শিশুতোষ আনন্দ-উত্তেজনা বিরাজ করে। হ্যালুইন উৎসবকে কুমড়ো ভুতএর উৎসব বললেও অত্যুক্তি হবেনা। কারণ এই সীজনে প্রচুর কুমড়ো পাওয়া যায় এবং হ্যালুইন উৎসবে ভুত বানানর কাজে এই কুমড়ো ব্যবহৃত হয়। অক্টোবার মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই শুরু হয় হ্যালুইন কস্টিউম এবং কুমড়ো কেনার পালা। কস্টিউম ছাড়াও বিপনী বিতান গুলোতে পাওয়া যায় ছোট বড় নানা সাইজের মিষ্টি কুমড়ো, খড় বিচালী দিয়ে তৈরী নানা চেহারার কাকতাড়ুয়া, কিম্ভূত কিমাকার চেহারার খড়-বিচালীর ভুত, নানা সাইজের কঙ্কালসহ এমনি হরেক রকমের জিনিস। মিষ্টি কুমড়োর সাইজ হয় আমাদের দেশে চাল রাখার মাটির জালার মত। এই মিষ্টি কুমড়োগুলোর ভেতর থেকে প্রথমে সমস্ত মাংস, বীচি বের করে ফেলা হয়, এরপর ছুরী দিয়ে কেটে কেটে বড় বড় গোল গোল ভুতুরে চোখ, নাক এবং আকর্ন বিস্তৃত হাসির অবয়ব দেয়া হয়, যা দেখে সত্যি সত্যি হাস্যময় অশরীরি মনে হয়।
হ্যালুইন সন্ধ্যায় সকলের বাড়ির মূল দরজার সামনে এই ‘ভুতুরে কুমড়োর’ ভেতরে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। দূর থেকে দেখেই বোঝা যায়, ঐ বাড়ির আঙিণায় সুখী ভুত বসে আছে। ভাল করে সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই ‘ভুতরূপী’ মানুষেরা যার যার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের হাতে থাকে ঝোলা, পরনে থাকে সাদা অথবা কালো আলখাল্লা জাতীয় পোষাক, মুখ ঢাকা থাকে ‘ভৌতিক মুখোশ’ দিয়ে। এই উৎসবে নিয়ম হলো, ভুতরূপী মানুষগুলো দল বেঁধে সকলের বাড়ীর দরজায় গিয়ে হাজির হয়ে নাঁকি সুরে বলবে ‘ ট্রিঁক অঁর ট্রিঁট’!! গৃহস্বামী ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে আগত অতিথিদের দেখে ভয় পেয়ে যান, অতিথিকে খুশী করার জন্য মুঠো মুঠো চকোলেট, নানা বর্ণের ক্যান্ডি দিয়ে ওদের ঝোলা ভর্তি করে দেন। গৃহকর্তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে ‘ভুত বাবাজীরা’ অত্যন্ত খুশী মনে বাড়ির সীমানা ত্যাগ করে বাইরে চলে আসেন।
হ্যালুইন অরিজিন্যালি শুরু হয়েছিল আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডএ। আইরিশ ও স্কটিশ লোকসাহিত্যে হ্যালুইনকে বলা হয়েছে সুপারন্যাচারাল এনকাউন্টারস হিসেবে। ঐ সময়ের মানুষের বিশ্বাস ছিল যে সামারের শেষ, শীতের শুরুতে হ্যালুইন সন্ধ্যায় সমস্ত মৃত আত্মীয়-স্বজনের আত্মারা নেমে আসে এই পৃথিবীর বুকে। অষ্টম শতাব্দীতে পোপ গ্রেগরী ১লা নভেম্বার কে অল সেইনটস ডে ঘোষণা করেন এবং আগের সন্ধ্যা মানে ৩১শে অক্টোবারকে অল- হ্যালোস-ইভ বা হ্যালুইন নামে অভিহিত করেন। মানুষের অন্ধ বিশ্বাস ছিল অল-হ্যালোস-ইভ-এ প্রেতাত্মারা নেমে আসে, তারা মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে,  আর তাই এই প্রেতাত্মাদেরকে প্রতিহত করার জন্য জীবিত স্বজনদের  সকলে একসাথে জড়ো হয়ে আগুন জ্বালিয়ে নানা ভঙ্গিতে নৃত্য করতো এবং মৃত স্বজনের রূপ ধরে আসা ভুতকে পালটা ভয় দেখাত। সেই বনফায়ার থেকেই জ্যাক-ও-লন্ঠন এর উৎপত্তি। আইরিশ ও স্কটিশরা  টারনিপ (শালগম) কে সুন্দর করে কেটে কেটে ভুতের মুখের অবয়ব(হাসি মুখ) দিয়ে লন্ঠন বানিয়ে সকলের বাড়ীর সীমানাতে জ্বালিয়ে রাখত যাতে করে প্রেতাত্মারা আলো দেখেই ভয়ে পালিয়ে যায়। অনেকে খড়-বিচালী দিয়ে কাক-তাড়ুয়া বানিয়ে সাজিয়ে রাখত একই ঊদ্দেশ্যে।
আইরিশ ইমিগ্র্যান্টরাই হ্যালুইনের প্রচলন করে এই উত্তর আমেরিকাতে। সময়ের স্রোতে হ্যালুইনের সূচনালগ্নের কুসংস্কার ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়ে পেয়েছে স্যেকুলার, শিশোতোষ আনন্দের নির্মল চেহারা। হ্যালুইনকে এখন শুধুই বাচ্চাদের আনন্দ উৎসব বললে ঠিক বলা হয়। সাথে যোগ হয়েছে আমেরিকান ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও সাফল্য। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয়, যেহেতু হ্যালুইনের সাথে আইরিশ ও স্কটিশদের ধর্মীয় অনুভূতি জড়িত, তাই ভুত-প্রেতের থিমটাও রাখা হয়েছে। বাচ্চারা ঐদিন যে কোন রকম অশরীরীর গেট-আপ নিয়ে সবাইকে ভয় দেখিয়ে আনন্দ পায়।  আবার এই ভুতদে খুশী করতেই চকোলেট, ক্যান্ডি দেয়া হয়। ট্রিক অর ট্রিট হচ্ছে বাচ্চাদের কাছে সবচেয়ে মজার খেলা। তারা হাঁউ মাঁউ করে বড়দের ভয় দেখাবে আর বড়রা ভয় পাওয়ার অভিনয় করবে, তখনই বাচ্চারা বলবে ট্রিক অর ট্রিট ( হয় আমাদের খুশী কর নয়তো ভয় দেখাবো)।বড়রা সাথে সাথে তাদের হাত ভরে চকোলেট দেবে, চকোলেট পেলেই ওরা খুশী হয়ে বিদায় নেবে।  মাত্র এক সন্ধ্যার জন্য বাবা মায়েরা কত ডলার খরচ করে তার কোন হিসেব নেই।

ওয়াল-মার্ট সুপার সেন্টারের একটি বিশাল অংশ জুড়ে ডিসপ্লে করা আছে নানারকম ভৌতিক কস্ট্যুম, কংকালের মুখোশ, স্পাইডারম্যান বা সুপারম্যানের কস্ট্যুম সহ কালো বিড়াল, কালো বাঘের নানারকম ভয়ংকর ভঙ্গীমায় তৈরী পোষাক এবং মুখোশ। মেয়েদের জন্য থাকে পরীর কস্ট্যুম, সিনডেরেলা, তুষার কন্যার কস্ট্যুম। আর বিক্রী হয় চকোলেট, ক্যান্ডি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকাতে সারা বছরে বিক্রীত ক্যান্ডির এক চতুর্থাংশ বিক্রী হয় হ্যালুইনের সময়।
আমি হ্যালুইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কি ধারণা তা জানার জন্য আমার কাজের জায়গাতে বিভিন্ন বয়সী সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম। যাদের জিজ্ঞেস করেছি, তাদের প্রায় সকলেই বলেছে তারা এর পেছনের ইতিহাস জানেনা, শুধু জানে যে বাচ্চারা ঐদিন একটু মজা করে ছেলেবেলাতে তারাও শুধুই ফান করতো ঐদিন, ব্যস এইটুকুই। লিওনার্দো নামে আমার এক সহকর্মী আছে সে বলেছে , দেখো, একসময় যারা ধর্মে বিশ্বাস করতোনা, তারা ঈশ্বরের উপাসণাকে চ্যালেঞ্জ করে ঘোস্ট উপাসনার মত করে এই হ্যালুইন উদযাপন করা শুরু করে। তারা এমনও বলতো যে ঐরাতে সকল ভুত-প্রেত পৃথিবীতে নেমে আসে, তারা তাদের প্রিয়জনদের দেখতে আসে। ঈশ্বর বলে কিছু নেই, মৃত্যুর পরে সবাই ভুত হয়ে যায়। এই ধরনের প্রচারণাতে সমাজের অনেকের বিশ্বাসে আঘাত লাগতে থাকে, কিনতু আমেরিকাতে যেহেতু কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যায়না, তাই সমাজে কোন রকম অসন্তোষ সৃষ্টির আগেই বানিজ্যিক কোম্পাণীগুলো এই ভুতভাবনাকে অন্যভাবে পরিবেশন করতে শুরু করে। তারা এই ফসল কাটার সময়টাকে বেছে নেয় হ্যালুইন উদযাপনের জন্য। এই উপলক্ষে এত এত মিষ্টি কুমড়া বিক্রী করে কৃষকের লাভ হয়, এত কস্ট্যুম, এত মুখোশ, এত রাশি রাশি চকোলেট, ক্যান্ডি বাজারজাত করে ব্যবসায়িক কোম্পাণীগুলো লাভবান হয়। আর মানুষ খুব সহজেই এই উপলক্ষটাকে বাচ্চাদের জন্য ফান হিসেবে গ্রহন করে। আর এভাবেই সেই মুষ্টিমেয় কিছু ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের উদ্দেশ্য বিফলে যায়।
রয় নামে আরেক সহকর্মী বলল, এটা কিছুইনা, শুধুই বিজনেস। আমেরিকাতে সব কিছুর পেছনে থাকে বিজনেস। এই সময়টা হচ্ছে ফসল কাটার মরশুম, এর পরেই শীত চলে আসবে। সকলে ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে আরেকবার ফূর্তি করার উপলক্ষ্য এটা। তবে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য একটা গল্প চালু আছে। গল্পটা হলো, এক সৈনিককে যুদ্ধের মাঠে তার শত্রু তরবারীর আঘাতে ধড় থেকে মাথা কেটে ফেলে দেয়। এরপর থেকে ঐ মুন্ডুহীন সৈনিক ভুত হয়ে রাতের বেলা ঐ পথ দিয়ে কাউকে যেতে দেখলেই তাকে মেরে ফেলতে শুরু করে। এতে করে লোকজন মুন্ডুহীন সৈনিকের মুখোমুখি না হয়ে ঘুরপথে যেতে শুরু করে। তাই মুন্ডুহীন সৈনিক বুদ্ধি করে ফসলের মাঠ থেকে এই সময়ের ফসল মিষ্টি কুমড়া দিয়ে তার মাথা বানিয়ে ঘাড়ে বসিয়ে দিয়ে আবার শুরু করে হত্যাযজ্ঞ রয় আর বাকীটুকু জানেনা, তাই আমি গল্পটা শেষ করে দিলাম এভাবে, কুমড়োমাথা ভুতকে খুশী করার জন্য গ্রামবাসী ঠিক করে যে তাকে তার প্রিয় মিষ্টি খেতে দিলেই সে এই অত্যাচার বন্ধ করবে। আর সেই থেকেই তাকে মিষ্টি খেতে দেয়া হয় এবং সে খুব খুশী হয়ে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করে দেয় আর এভাবেই নিশ্চয় মিষ্টি, চকোলেট, পামপকিন কেক, পামপকিন পাই এর বিজনেস রমরমা হয়ে উঠে। আর বিস্বাদু মিষ্টি কুমড়োগুলিকে হাস্যমুখ ভুত বানিয়ে বিক্রী করে দেয়া হয়। আমার এই শেষাংশটুকু রয়ের খুব পছন্দ হয়।
তবে অনেকে এই ফেস্টিভ্যালটাকে পছন্দ করেনা। কেউ কেউ মনে করে এইসব হচ্ছে কুসংস্কার, কেউ কেউ ভাবে পয়সার অপচয়, অনেকে ঐদিন সন্ধ্যায় ঘর বন্ধ করে অন্য কোথাও চলে যায়, যাতে বাচ্চাদের চকোলেট না দিতে হয়, কিছু পয়সাতো বাঁচে। আবার শাহীনের মত শিশু দরদী ছেলে প্যাকেট ভর্তি চকোলেট নিয়ে ২৫ মাইল রাস্তা ড্রাইভ করে আমাদের বাড়ী এসে আমার ছোট মেয়েকে চকোলেট দিয়ে যায়। ইদানীং অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের একা একা চকোলেট হান্টিং বা ট্রিক অর ট্রিট এ বের হতে দেননা। কারণ দিনকাল এদেশেও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যে কোন সময় বাচ্চা কিডন্যাপ হয়ে যেতে পারে, শত্রুতা করে কেউ খাবারের সাথে বি্ষ মিশিয়ে দিতে পারে বলে তাদের ভয়। আবার কেউ কেউ ট্রিক অর ট্রিট এর উছিলায় এসে ঘরে ঢুকে ডাকাতিও করে যেতে পারে। সময় এখানেও খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
যে যাই বলুক, আমি হ্যালুইনের সাথে আমাদের দেশের কিছু পরবের মিল খুঁজে পেয়েছি প্রথমতঃ হিন্দুদের দীপাবলী বা দিওয়ালীর সাথেতো মিল আছেই, আরো মিল আছে হেমন্তের শেষ ও শীতের শুরুতে ফসল কাটার উৎসব, গ্রামদেশে খড় দিয়ে তৈরী শীতের বুড়ো পোড়ানো উৎসবের সাথে। আমরা চকোলেট ক্যান্ডি দেইনা, ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস বানানো হয়, এভাবেই শীতকে বরণ করা হয় অথবা শীতের শুরুতে ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে একটু আনন্দ ফূর্তি করা্র উপলক্ষ তৈরী করা হয়। ভালো লাগে ভেবে যে পৃথিবীর দুই প্রান্তে থেকেও সংস্কৃতির কিছু কিছু জায়গাতে এখনও কত মিল যা মনে করিয়ে দেয়, মানব সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে মানুষের ভাবনাগুলো স্থান-কাল নির্বিশেষে একভাবে, এক নিশানায় কাজ করেছে।


No comments:

Post a Comment