Monday, October 7, 2013

“আগুনপোড়া হৃদয়”



আগুনপোড়া হৃদয়

দুই বছর আগের কথা, ফেসবুকে আমি একেবারেই নবাগত। বন্ধু লিস্টে তেমন কেউ ছিলনা, মেজো মেয়ে মিশা আমাকে ফেবু একাউন্ট খুলে দিয়েছিল, মাকে খুশী করার জন্য নিজের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ পাঠিয়েছিল যেন ওরা আমাকে ওদের সাথে অ্যাড করে নেয়। মিশার বন্ধুরা মিঠু আন্টিকে বন্ধু হিসেবে অ্যাড করেছিল। মিশার বন্ধুদের মধ্যে কেউই বাংলাভাষী ছিলনা, তাই আমার ফ্রেন্ড লিস্টে ওদের উপস্থিতি থাকা আর না থাকা সমান কথা ছিল। 
আমি তখন স্ট্যাটাস লিখতাম, বাধাধরা নিয়মে নয়, যা মনে আসতো, তাই লিখতাম। পাঠক ছিলনা, নিজের কয়েকজন বন্ধু সেখানে লাইক দিত। তেমনই এক পাথর সময়ে বাবর নামে এক ছেলে আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করি। ছেলেটি এত চমৎকার ইংলিশে ইনবক্স মেসেজ পাঠাতো যে আমি পড়ে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। ওর মেসেজের উত্তর পাঠাতাম। আমাকে ম্যাডাম সম্বোধণ করতো, কিছুতেই দিদি, বৌদি, মাসী বা খালা, বা আন্টি বলতোনা।

বাবরের মেসেজগুলো ছিল দার্শনিক টাইপের। একদিন ও আমাকে জানালো, ওর কিছু নিজস্ব কষ্টের কথা আমার সাথে শেয়ার করতে চায়। বললাম, অবশ্যই শেয়ার করতে পারো। তুমি যা কিছু বলতে চাও, খোলামনে বলো, আমি কাজ থেকে ফিরে তা পড়বো এবং উত্তর পাঠাবো। কাজ থেকে ফিরে বাবরের মেসেজ পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ও লিখেছিল, ওরা দুই ভাই, সাধারণ মধ্যবিত্তের সংসারে নানা রকম টানাপোড়েণের মধ্যে বড় হয়েছে। ক্যারিয়ার গড়বার সময়ে ওদের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বাবাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকগণ জবাব দিয়ে দিয়েছে, বলেছে দেশে চিকিৎসা নেই, বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করালেও খুব বেশী হলে মাস ছয়েক রুগী বাঁচবে, এরপর মৃত্যু অবধারিত। একজন ডাক্তার নয়, ডাক্তারদের বোর্ড বসিয়েই এই সিদ্ধান্তে তাঁরা উপনীত হয়েছিলেন। বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করাতে খরচ হবে প্রায় বারো লাখ টাকা। ওদের বাবা একটি মাত্র জমি কিনে রেখেছিলেন, যার মূল্যমান ছিল পাঁচ/ছয় লাখ টাকা। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব সকলে বাবরের উপর সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার ছেড়ে দিয়েছিল। ২৫ বছরের যুবকের সামনে তখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, সে তার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, বাবার মৃত্যু কোনভাবেই কাম্য নয়, অথচ বাবার মৃত্যু উপস্থিত, জমি বিক্রী করে ছয় লাখ টাকা পাওয়া যাবে, বাকী ছয় লাখ টাকা কর্জ করতে হবে, তবেই বাবাকে আরও ছয় মাস বাঁচিয়ে রাখা যাবে।

বাবরের ছোট ভাই তখনও সাবালক হয়নি, বাবরের মা সাধারণ গৃহবধূ, বাবরের নিজস্ব কোন আয় রোজগার ছিলনা, তাই বাবর জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে বাবাকে দেশে রেখেই চিকিৎসা করিয়েছিল। যে কয়দিন বাবা হাসপাতালের বেডে শুয়েছিলেন, বাবর তার বাবার পাশেই বসে থেকেছে, বাবার বেডের নীচেই কম্বল পেতে রাতে শুয়ে থেকেছে। এক রাতে ছোট্ট একটু আওয়াজ শুনেই বাবরের ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাকিয়ে দেখে, তার বাবা খুব কষ্ট করে বেড সাইড টেবল থেকে জলের গ্লাস নিতে চেষ্টা করছেন, বাবর তার বাবাকে মৃদু তিরষ্কার করে কেন তিনি ছেলেকে ডেকে দিলেননা! বাবা বলেন, তুমি সারাদিন আমার পেছনে খেটে যাচ্ছ, তোমার একটু বিশ্রাম দরকার, কেমন অসহায়ের মত ঘুমাচ্ছিলে, তাই তোমাকে আর জাগাতে ইচ্ছে করেনি
বাবার এই কথাটুকু বাবরের মনে শক্তিশেলের আঘাত হানে, মৃত্যুপথযাত্রী বাবা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও ছেলের ক্লান্তির কথা ভাবছেন, আর পাষন্ড ছেলে টাকার চিন্তা করে বাবাকে বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করালোনা। কিন্তু ততদিনে বাবার জীবন প্রদীপ নিভে এসেছে, এক সময় বাবা মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়েছেন, কিন্তু ছেলের হৃদয়ে সারা জনমের জন্য দাগ কেটে দিয়ে গেছেন।

এরপর বাবর মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক দেশে চাকুরী নিয়ে এসেছে, প্রচুর অর্থ সমাগম ঘটেছে, গ্রামের বাড়ীতে বিধবা মায়ের জন্য প্রাসাদ তুলে দিয়েছে, ছোট ভাইকে মিডল ইস্টে নিয়ে এসেছে, মাকে সোনার থালায় ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, সবই হয়েছে কিন্তু মন থেকে সেদিনের সেই গ্লানিবোধ মুছতে পারেনি। ওর মন ভালো থাকেনা, কষ্টের কথাটুকু কারো সাথে শেয়ার করতে পারেনা, কি মনে করে যেন আমাকে ওর খুব বিশ্বস্ত মনে হয়েছে, খুব কাছের কেউ মনে হয়েছে, কষ্ট আর চেপে রাখতে পারছিলনা বলেই আমার কাছে কষ্টের কথাগুলো বলে জানতে চেয়েছে, আমি কি সেদিন পিতৃ হন্তারকের ভূমিকা পালন করেছিলাম?

বাবরের মেসেজ পড়ে আমি এতটুকু সময় ব্যয় করিনি, উত্তর দিয়েছিলাম, বাবর, তুমি যা করেছো, বাবার ভালোর জন্য করেছো। তোমার বাবা জমিখানি কিনেছিলেন উনার স্ত্রী আর দুই পুত্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এই জমিটুকুই ছিল উনার একমাত্র সম্বল, উনার অহংকার। উনি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন, খুব বেশীদিন উনি বাঁচবেননা, কারণ মৃত্যুরোগ রুগীকে নানাভাবে জানিয়ে দেয়, তার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। উনি যদি জানতেন যে উনার কষ্টের সঞ্চয় বিক্রী করা হয়েছে নিষ্ফল চিকিৎসার জন্য, এতে করে উনার মৃত্যু সহজ হতোনা, আরও কঠিন হতো, এক বুক হতাশা নিয়ে উনি পৃথিবী ছাড়তেন। উনি তো জানতেননা যে ডাক্তাররা বলেছেন বিদেশের চিকিৎসায় উনি আরও ছয়মাস বাঁচবেন। কাজেই উনি যেটা জেনে গেছেন যে উনার বড় ছেলেটি রাত-দিন উনার পাশে থেকে সেবা করেছে, জলের গ্লাসে টুং করে আওয়াজ হতেই ছেলে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠেছে, বাবাকে শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে, এটিই সত্যি হয়ে আছে। উনি তখনই বুঝে গেছেন, উনার অবর্তমানে বাবর তার মা আর ছোট ভাইকে আগলে রাখবে। উনি সেই দোয়া করে গেছেন বলেই আজ তুমি জীবনে সাকসেসফুল হয়েছো। কাজেই মন থেকে সমস্ত গ্লানি দূর করে দাও।


প্রায় এক বছর হয়ে গেল, বাবর আমাকে আর মেসেজ পাঠায়না, ওর ধারণা হয়েছে, আমি বুঝি এখন আর সেদিনের আমি নেই, আমার প্রচুর বন্ধু, আমি তাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকি। তাই বাবর আমাকে বিরক্ত করতে চায়না।

আমি সেদিন ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি, বাবরের মত অগ্নিপরীক্ষায় একদিন আমাকেও বসতে হবে, পরীক্ষা শেষে আগুনপোড়া হৃদয় নিয়ে বাকী জীবন কাটাতে হবে।

গত বছর জুন মাসের ৮ তারিখে আমার মেয়ে মৌটুসীর বিয়ে হয়েছে, আমার শ্বশুর-শাশুড়ী গত হয়েছেন অনেক বছর আগে, আমার তিন মেয়ে দাদু-দিদার আদরে বড় হয়েছে, তাই দাদু-দিদার উপস্থিতিতে মেয়ের বিয়ে দেবো বলে বাংলাদেশে বিয়ের আয়োজন করেছিলাম। আমার মা ্নাতনী বিয়ের সকল মাঙ্গলিক কাজ নিজে হাতে করেছেন, নাতনীকে শ্বশুরবাড়ীতে পাঠিয়েছেন, আমাকেও বিদায় জানিয়েছেন। তবে এবারের বিদায়পর্বটা ছিল অন্যরকম। প্রতিবার বিদায়ের দুই দিন আগেই মা ঢাকা আমার অস্থায়ী বাসায় চলে আসতেন, বাজার থেকে বড় বড় ট্যাংরা মাছ আনাতেন, বেগুণ, ধনেপাত্‌ ডালের বড়ি দিয়ে মাছের ঝোল রান্না করতেন, মেয়েকে আর মেয়ে জামাইকে আর না, আর না করে খাওয়াতেন, গাড়ীতে উঠার আগ মুহূর্তে কেঁদে দিয়ে বলতেন, এইবারই আমার সাথে তোর শেষ দেখা, পরেরবার আর আমাকে দেখবিনা। 
এ বছর আর সেটা ঘটেনি, গতবছর মা আমার অস্থায়ী বাসায় আসবে বলেও আসেননি, শরীর খারাপ লাগে বলেছেন, আমরা সবাই বিশ্বাস করতাম, পৃথিবীর সবার বাবা-মা মরে গেলেও আমাদের বাবা-মা বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল, এতটাই সুস্থ-সমর্থ তাঁরা ছিলেন। মায়ের শরীর খারাপ শুনেছি, তাই বলে মা শেষ মুহূর্ত্তে আমার বাসায় আসার প্রোগ্রাম বাতিল করে দি্লেন? খুব অভিমান হয়েছে আমার মনে, আমিও আর মাকে ফোন করিনি, কথাও বলিনি। শেষ মুহূর্তে জানতে পেরেছি, মায়ের ইউটেরাসে প্রবলেম, ডাক্তার ইমিডিয়েটলী ইউটেরাসের বায়োপসী করাতে চেয়েছেন। ফোন পেয়ে পড়ি-মরি করে ২২শে জুলাইয়ের সকালে গাড়ী নিয়ে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে মাকে নিয়ে সরাসরি স্কয়্যার হাসপাতালে চলে এসেছি। 
আমি মাকে হসপিটালে এনেছিলাম, যাতে নিজে উপস্থিত থেকে স্কয়্যার হাসপাতালের মত অত্যাধুনিক হাসপাতালের প্যাথলজীতে ইউটেরাসের টিস্যু দিয়ে যেতে পারি, এবং সঠিক বায়োপসী রিপোর্ট পাওয়ার পর সঠিক চিকিৎসা করাতে পারি। একটাই সমস্যা ছিল, আমার হাতে সময় ছিলনা, সেই রাতেই আমার আমেরিকাগামী ফ্লাইট। 
ডাক্তারকে আমার সমস্যার কথা বলে অনুরোধ করলাম, নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে নারায়ণগঞ্জের ডাক্তারের রিপোর্টের ভিত্তিতেই যেন মায়ের ইউটেরাসের টিস্যু কালেকশান করে বায়োপসীর জন্য পাঠানো হয়, সাথে এও বললাম, আমি আমেরিকা চলে গেলে আমার ভাইদের পক্ষে সম্ভব হবেনা মায়ের সাথে এই মেয়েলী সমস্যা নিয়ে কথা বলতে। এইসব ব্যাপারে আমাদের মা খুবই লাজুক ছিলেন, ভাইয়েরাও এইসব ব্যাপারে তেমন কিছু জানেনা, ছেলেবৌ আছে, তারপরেও মেয়ের কাছে যতখানি ফ্রী হওয়া যায়, ছেলের বৌদের কাছে তো আর ততখানি ফ্রী হওয়া যায়না।

ডাক্তার আমার কথা মানলেননা, উনি মায়ের দেহের আরও সাত সতেরো ইনভেসটিগেশান দিলেন এবং বলে দিলেন, বায়োপসী করার আগে ইউটেরাস ফেলে দিতে হবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, আমি একবার বললামও, ম্যাম, বায়োপসী না করিয়েই যদি ইউটেরাস রিমুভ করা হয়, এবং বাই চান্স যদি ধরা পড়ে যে ইউটেরাস ক্যানসারাস, তাহলে তো ক্যানসার সারা দেহে ছড়িয়ে যাবে। অপারেশানের আগে যদি বায়োপসীটুকু করিয়ে দিতেন----

আমি হচ্ছি সাধারণ এক মানুষ, জ্ঞান-গম্যি কম, ডাক্তারী বিদ্যাও জানা নেই, আমার কথার মূল্য কি? ডাক্তার সাহেবা আমার কথার মূল্য দিলেননা, মাকে নিয়ে সারাদিন পার করে দিলাম হাসপাতালের বিভিন্ন ফ্লোরে। বার বার দৌড়াদৌড়িতে মা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, সাথে ছিল মিত্রা, আমার ছোটমাসীর মেয়ে, মিত্রা না থাকলে সেদিন আমাকেই হয়তো হাসপাতালে ভর্তি করতে হতো।

*** সেদিনই বোধ হয় আমার মন প্রথম টের পেলো, মা বাঁচবেনা। কেন এমন মনে হলো, জানিনা। তখনও তো মায়ের অসুখ সম্পর্কে নিশ্চিত হইনি! হালকা সবুজ জমিন, জরিপাড় তাঁতের শাড়ী পরণে, সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ, হাসপাতালের করিডোরের অপেক্ষমান চেয়ারে বসে মা শূণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উল্টোদিকের দেয়ালে। ছবিটা আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে, মাকে সেদিন কি অসহায় দেখা যাচ্ছিল! এই ছবি দেখেই আমার মনে হয়েছে, মা আর বাঁচবেনা।***

মাকে শেষ বিদায় দিলাম গুলিস্তানের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। আমার মেজদা আগে থেকেই ওখানে দাঁড়িয়েছিল, ক্লান্ত দেহ টেনে টেনে মা ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলেন, আমার দিকে তাকালেনও না, আমিও তাকালামনা মায়ের মুখের দিকে, দুজনেই বুঝে গেছি, এ দেখাই শেষ দেখা। সারাদিনের পরিশ্রমে আমি ব্যর্থ, শেষ চেষ্টা দিয়েও পারলামনা মায়ের ইউটেরাইন টিস্যু দিয়ে আসতে। আমি ব্যর্থ, এই প্রথম আমি ব্যর্থ হলাম, মাকে সারাদিনে এত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে যে মা তিতিবিরক্ত হয়ে গেছিলেন আমার উপর। মায়ের ধারণা হয়েছে, আমি অযথাই মাকে কষ্ট দিয়েছি। আসলেই সত্যি, অযথাই কষ্ট দিয়েছি। নারায়ণগঞ্জের ডাক্তারের পরামর্শমত যদি ঢাকার নাম না জানা প্যাথলজীতে ইউটেরাইন টিস্যু পৌঁছে দেয়া হতো বায়োপসী করার জন্য, তাহলেই আমাদের মা আরও কিছু দিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকতো। আমার ছোট ভাইটা প্রস্তুত ছিল, সকালে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে মায়ের দেহ থেকে ডাক্তার টিস্যু সংগ্রহ করতেন, ছোট ভাইয়ের কাছে তা দিতেন, ভাই সেটি ঢাকা নিয়ে এসে প্যাথলজীতে পৌঁছে দিত। রিপোর্টে ক্যানসার ধরা পড়তো, হয়তো আমরা বিশ্বাস করতামনা, দ্বিতীয়বারে অন্য কোন প্যাথলজী থেকে টেস্ট করাতাম, হয়তো আবারও ক্যানসার ধরা পড়তো, এরপর আমরা ভেবে দেখতাম, মায়ের চিকিৎসা কীভাবে করা যায়। প্রয়োজনে ইন্ডিয়া নিয়ে যেতাম, অপারেশান না করিয়েই যতটুকু চিকিৎসা সম্ভব, করানো হতো, মা তো কিছুদিন বেঁচে থাকতেন। আমার বেশী মাতব্বরীর জন্যই বায়োপসী ছাড়াই মায়ের ইউটেরাস অপারেশান করা হলো, মায়ের মৃত্যু তরান্বিত হলো। এবং আমার আশংকাই সত্যি হলো, ক্যানসার সারা দেহে ছড়িয়ে গেলো, ১০ই আগস্ট মায়ের দেহে অস্ত্রোপচার হলো, ১লা অক্টোবার মুমূর্ষু অবস্থায় মাকে আবার হসপিটালে ভর্তি করানো হলো।

আমি মাত্র দুই মাস আগেই দেশে ১০ সপ্তাহ ছুটিয়ে কাটিয়ে, কাজে জয়েন করেছি, আর কোন ছুটি অবশিষ্ট ছিলনা, ম্যানেজারের কাছে কেঁদে কেটে মাত্র দুই সপ্তাহ ছুটি নিয়ে আবার দেশে গিয়ে পৌঁছেছি। আশা ছিল, মাকে নিজের হাতে যত্ন করবো, আমি জানি, কিভাবে রুগীর সেবা করতে হয়, আগেই শুনেছি মা কিছুই খেতে পারেনা, যা খায়, তাই বমি হয়ে যাচ্ছে, রক্তে লবনের পরিমান কমে যাচ্ছে, রক্তে পুষ্টিও যাচ্ছেনা, দেশে যাওয়ার সময় তাই মায়ের জন্য ফর্টিফায়েড মিল্ক কিনেছি, ফোনে মাকে বলেছি, " মা, আরেকটু অপেক্ষা করো, তোমার জন্য ব্যালেন্সড মিল্ক নিয়ে আসছি, ওটা খেলে তোমার দেহে বল ফিরে আসবে।" মা'কে জিজ্ঞেস করেছি মা, আমি আসি? মায়ের মন, একবার ভাবে কত টাকা পয়সা খরচ হয়েছে মেয়ের বিয়েতে, আবার আসতে গেলে আরও টাকা খসে যাবে। তাই আমতা আমতা করে বলে, কি হইব আইসা? কত টাকা খরচ, মিথীলা ছোট, জীবেনেরও তো বয়স হইছে, তুই আইলে ওদের কে দেখবে? আবার বলে, দ্যাখ, ভাল করে চিন্তা করে, আসবি কিনা। আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার কি করা উচিত? সে বলে, তোমার যাওয়া উচিত। বললাম, অনেক খরচ, সে বলে, রাখো তো খরচ, যখন যেটা প্রয়োজন, সেটাই আগে করা উচিত

আমি প্লেনে উঠলাম আমেরিকান ২রা অক্টোবারের দুপুরে, প্লেনে যখন বসে আছি, আমার স্বামী ফোন করে বললেন, " শোন, একটা মোটামুটি সুখবর আছে, মায়ের পেট যেভাবে ফুলে যাচ্ছিল, সেটা নাকি থেমে আছে, আমি ওদেরকে বলেছি, তুমি যাওয়ার পর অপেরেশান হবে"। আমি বললাম, " কেন, প্রয়োজন হলে তো আগেই অপারেশান করে ফেলতে পারে"। আমার স্বামী আগেই বুঝেছিলেন, মা বাঁচবেনা, আমাকে বললেন, " এত বড় একটা অপারেশান, বলা তো যায়না, কি হবে, তার চেয়ে এই ভাল, তুমি যাও, তোমাকে উনি দেখুক, তারপর অপারেশান হোক"। 
আমি ঢাকা পৌঁছালাম ৪ তারিখের সকালে, এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হসপিটালে যেতে চেয়েছি, আমাকে যিনি আনতে গিয়েছিলেন, সেই অঞ্জন'দা বললেন, " গতকাল মাসীমার অপারেশান হয়ে গেছে, উনি এখন আইসিইউ তে আছেন"। এই কথা শুনে আমি কেমন যেন বোধহীন হয়ে গেলাম, আমার মাথায় আর কোন কিছুই কাজ করছিলনা, এরপর থেকে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত কোন এক যান্ত্রিক নিয়মে আমি দিন পার করেছি। ৩ তারিখ মায়ের অপারেশান হয়েছে, কারণ ডাক্তাররা ধরতেই পারছিলেননা, মায়ের পেট কেন প্রতি দুই ঘন্টায় এক সেন্টিমিটার করে ফুলে যাচ্ছে। মেজদা অনুরোধ করেছিল, অপারেশানের তারিখ এক দিন পিছিয়ে দিতে, যেন আমি পৌঁছে মাকে দেখতে পাই। মা বলেছিল, আজকেই অপারেশান হোক, মিঠুর ভাগ্যে থাকলে আমার সাথে দেখা হবে। মাকে যখন ওটিতে নেয়া হয়, আমার দুই ভাই, মেজো বৌদি, মামী আর মামাত ভাই অপু পাশে ছিল। মামী বলেছিল, দিদি, একটুও ভয় পাইয়েন না, অপারেশান হইলেই আপনি ভাল হয়ে যাবেন। মা নাকি কেঁদে দিয়েছিল, বলেছিল, যাইতেছি, যদি ফিরে আসি, তোমাদের সাথে দেখা হবে, নাহলে আমাকে তোমরা সবাই ক্ষমা করে দিও। মামী শুধু বলতে পেরেছিল, এইটা কি কন দিদি, আপনি কেন ক্ষমা চাইবেন, আমরা ক্ষমা চাই আপনার কাছে----ট্রলীতে করে মা চলে গেলেন ওটিতে।

আমি যখন আইসিইউতে গেলাম, জানালা দিয়ে বেডে শোয়া যাঁকে দেখলাম, উনি আমার মা নয়, একজন জবুথবু, অসহায় মানুষ, কি ছোট্ট এক শরীর, আমার মাথাটা ঘুরিয়ে গেলো, কি কঠিন পরীক্ষা, মায়ের এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী, বেশী ভাল করতে চেয়েছিলাম, আমার কারণেই মায়ের এই অবস্থা। মায়ের জন্য কতকিছু এনেছি, মা জানতেই পারলোনা। যতবার দেশে আসি, আসার আগে মাকে জিজ্ঞেস করি, মা, কি আনবো? মা প্রথমে বলে, কিচ্ছু আনতে হবেনা, তুই ঠিকমত আয়। প্রত্যেকবার রাজ্যের জিনিস লইয়া স্যুটকেস টানতে টানতে আইয়ছ, দরকার হইলে দেশ থেকেই জিনিস কিনে দিবি"। এই কথা বলতো ঠিকই, এরপর থেকে শুরু হতো একটু একটু করে ফরমায়েশ, মিঠু, তেমন কিছু আনিসনা, কয়টা নোকপালিশ আনিস, কয়টা লিপস্টিক আনিস, জনসন বেবী লোশান আনিস, কিসমিস আনিস, দারচিনির গুঁড়া আনিস, ওহ ভাল কথা, সাবান আনিস, সাথে টুথপেস্ট” এইভাবে লিস্ট বড় হতো। আমরা সবাই হাসাহাসি করতাম, মায়ের নিজের জন্য একটা সূতাও আনতে বলতোনা, যা কিছু, তার সবই দান ধ্যান করার জন্য। সেই মা নীরব নিথর হয়ে বেডের মধ্যে ছোট্ট দেহ নিয়ে পড়ে আছে, আমাকে জিজ্ঞেস করবেনা আমি কি এনেছি, এতো আমার মা নয়, অন্য কেউ, অন্য কেউ, আমার মা নয়। অনেক বড় শ্বাস টেনে রুমের ভেতর ঢুকে মায়ের কাছে গেলাম, আমার শরীর শক্ত হয়ে গেল, ভাঙ্গবোনা আমি, ডাকলাম, মা, মা

সারা শরীরে নল লাগানো, মুখের ভেতর দুই নল, নাকের ভেতর দুই নল, দুই হাতে সুঁচ ফোটানো, এই আমার মা, এই আমার মা, এও কি সম্ভব? আমার মায়ের ৭৫ বছরের জীবনে আমি যে কটা দিন মা'কে দেখেছি, মাইগ্রেনের ব্যথা ছাড়া মা'কে কখনও বিছানা নিতে দেখিনি। তখনও জানিনা, মায়ের পেট ওপেন করে দেখা গেছে, পরিপাক তন্ত্রের পুরোটাই পেঁচিয়ে গেছে, একটার সাথে আরেকটা জোড়া লেগে গেছে, ডাক্তার অনেকটা কেটে বাদ দিয়েছে, কিডনী কোলাপসড, সবকিছু ওভাবেই রেখে ডাক্তার পেট সেলাই করে দিয়েছে, গলার কাছে নতুন করে ফুটো করে কৃত্রিম খাদ্যনালী তৈরী করে দিয়েছে, আরও কি কি করেছে জানিনা, শুধু জানি, এই অবস্থাতেও মায়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে। ওটিতে যাওয়ার আগে মা জানতো, পরের দিন সকালে আমি এসে পৌঁছাবো, জীবনে এই প্রথম আমি একা বের হয়েছি, মা জানে, আমি একা চলতে ভয় পাই, অপারেশানের দিন সকালেই আমার ভাগ্নী অদিতি টুম্পাকে বলেছে, টুম্পা শোন, তোমার মামী এলে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবে, ঘন্টা দুই বিশ্রাম করতে দিবে, খেতে দিবে, তারপর এখানে নিয়ে আসবে

আমার মা ডাক শোনার অপেক্ষায়ই বোধ হয় মা ছিল, এমন চমকে উঠেছে, দুই চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়েই কেঁদে দিয়েছে। আমার মা সহজে কাঁদেনা, এই জল কোথা থেকে এলো, মা এভাবে কেন কাঁদছে, মা কি বুঝতে পেরেছে যে তাঁর মেয়েটা কষ্টে কষ্টে মরে যাচ্ছে। মায়ের শরীর কাঁপছে, আমি ভয় পেয়ে গেছি, এই বুঝি নার্স আমাকে বের করে দিবে। নার্স মেয়েটা বলছে, এই জন্যই আইসিইউতে কাউরে আসতে দেয়না। রুগীর শরীর আরও খারাও করবে। আমি নিজেকে শক্ত রেখেছি, এটি আমি খুব ভাল পারি, কারো সামনে ভাঙ্গিনা, আড়ালে গিয়ে ভেঙ্গে পড়ি। মায়ের মাথায় হাত পৌঁছাচ্ছেনা, হাতের সামনেই লোহার রডে সব যন্ত্রপাতি ঝুলছে, মাকে লাইফ সেভিং মেশিনে রাখা হয়েছে, আমি যদি কাছে যাই, নাড়াচাড়া লেগে যদি লাইফ সেভিং মেশিনের নল খুলে যায়, তাহলে তো মা মরেই যাবে। এই ভয়ে দূর থেকে হাত বাড়িয়ে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, মা, কেঁদোনা, তুমি কাঁদলে শরীর খারাপ করবে, ডাক্তার তাহলে আমার উপর রাগ করবে, আমাকে বের করে দিবে। তোমার অপারেশান খুব ভালো হয়েছে, তুমি ভাল হয়ে যাবে। বাচ্চা মেয়ের মত মা কান্না বন্ধ করে দিল, মাথা কাত করে আচ্ছা বলল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মা, জল খাবে? কি গভীর আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকালো। গত কয়টি দিন মা একটু জলের জন্য অনেক কেঁদেছে, ডাক্তারের কাছে নাকি দুই হাত জড়ো করে বলেছে, " আমাকে একটু জল খাওয়ার অনুমতি দিন", জল দিলেই মা বমি করবে, কষ্ট বেড়ে যাবে বলে ভয়ের চোটে কেউ মা'কে জল দেয়নি।
নার্সকে বললাম, আমাকে একটু জল এনে দিতে পারেন? নার্স বলে, রুগীর মুখে কিছুই দেয়া যাবেনা। বললাম, প্লীজ, একটু জল এনে দিন, এক ফোঁটা জল দেবো, মায়ের খুব তৃষ্ণা ছিল, একটু জলের জন্য মা অনেক কেঁদেছে, তখনও ডাক্তারের ভয়ে কেউ মায়ের মুখে দুই ফোঁটা জল দিতে পারেনি। এখন আমি দেবো। নার্স খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলো, বলে, দিলেও লাভ নেই, পানি তো উনার পেটে যাবেনা। বললাম, পেটে যাওয়ার জন্য তো আমি জল খাওয়াবোনা, একটু জিভ ভেজাবো। নার্স বলে, ওহ বুঝছি, আপনে কি গঙ্গাজল দিতে চাইতেছেন? নার্স মেয়েটির সারল্য আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল, মা সব শুনতে পাচ্ছে, আমি যে মায়ের মুখে কেন জল দিতে চাইছি এই গাধা মেয়ে সব বলে দিল। একটু কঠিন স্বরে বললাম, গঙ্গাজল খাওয়াবো কেন, মায়ের মুখটা শুকিয়ে গেছে, আপনি মিনারেল ওয়াটার আনেন, দুই ফোঁটা জল দিয়ে মায়ের জিভটা ভিজিয়ে দেবো

নার্স ডাক্তারের কাছে গিয়ে কি বলেছে কে জানে, ডাক্তার অনুমতি দিয়েছে। আমি আঙ্গুল ডুবিয়ে মায়ের জিভে ফোঁটা ফোঁটা জল দিলাম, নার্স বলেছে, জল নাকি বেরিয়ে আসবে। কিন্তু জল বের হয়ে আসেনি, মা জিভ নেড়ে জলটুকু গ্রহণ করেছেন। মাত্র দশ মিনিট সময় আমাকে থাকতে দিয়েছে। বেরিয়ে আসার আগে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, মা, আমি তো বাইরের থেকে এসেছি, আমি থাকলে ইনফেকশান হতে পারে, সেইজন্য ডাক্তার আমাকে এখন চলে যেতে বলেছে, আমি কোথাও যাবনা, বারান্দায় বসে থাকবো, তুমি ভয় পেয়োনা, আমি আর মেজদা কাছেই আছি, তুমি একা নেই, আমরা আছি। ঠিক আছে? মা খুব শান্তিতে মাথা নাড়িয়ে ঘুমিয়ে গেলেন।
৫ তারিখ ছিল মায়ের জন্মদিন, সকালে মাকে হ্যাপী উইশ করেছি, মা তখনও আমাদের সাথে খুব ভালভাবে রেসপন্স করেছে। বিকেলের দিকে আমি একা মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছি। মায়ের চোখ বন্ধ, মুখের ভেতর দুই নল ঢোকানো আছে, মুখ ঈষৎ হাঁ করা। মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি, মা মুখ খুলে হাসছে, আমার শরীর অবশ হয়ে এলো, তার মানে মা এখন স্বপ্ন দেখছে, দেহের এই অবস্থাতেও মা স্বপ্ন দেখছে, এমন স্পষ্ট হাসি, মা কি দেখে হাসছে? মা কি স্বপ্নে তাঁর বাবা কে দেখছে? তাঁর মাকে দেখছে? নাকি ভগবানকে দেখছে? মা কি দেখে এভাবে হাসছে!! হাসি শেষ, মা আবার স্বাভাবিকভাবে ঘুমাচ্ছে। সইতে পারলামনা, মায়ের বেড ধরে নীচু হয়ে বসে পড়লাম, নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম, আমার হাতের কাঁপুনীতে মায়ের বেড কাঁপছে, তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলাম।

৪, ৫, ৬ তারিখ পর্যন্ত দুই বেলাতেই মায়ের সাথে দশ মিনিট করে সময় কাটিয়েছি, কোন উন্নতি নেই, কিডনি পুরাপুরি অকেজো, তরুণ ডাক্তারদের অনেকেই আমাকে বলেছে, মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে, আমাদের উচিত, মাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়া। কীভাবে মুক্তি? লাইফ সাপোর্ট খুলে দিলেই মুক্তি। লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়া মানেই মায়ের মৃত্যু। মা তো মরতে চাননি, মাস খানেক আগেও আমার সাথে কথা হয়েছে, বলেছিলাম, মা, তুমি মৌটুসীর বিয়ে দিলা, মিশা তোমার এত আদরের নাতনী, ওর বিয়া দিবানা? তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাও মা। মা তখনও বলেছে, মিশা আমারে একটা ফোন দিয়া খোঁজ লয়না, আমি দিমু মিশার বিয়া। মিশাকে বলতেই মিশা পড়িমরি করে দিদাকে ফোন দিয়েছে, হড়বড় করে বলেছে তার হাজার ব্যস্ততার কথা, দিদা নাকি বুঝতে পেরেছে নাতনী অনেক ব্যস্ত। মিশাকে বলেছে, তোমার মা তো বলেছে, তোমার বিয়েটা পর্যন্ত থাকতে। তুমি ভাল ছেলে বিয়ে করলে আমি থাকবো, সাহেব বিয়ে করলে তো আমার দরকার হবেনা। সেই মাকে লাইফ সাপোর্ট খুলে দেবো? ডাক্তারদের সাথে অনেক কথা হয়েছে, তারা সকলেই বলেছে, এখন মায়ের কষ্ট শুধু বাড়ছেই, একজন ডাক্তার বলল, তাঁর বাবা এই হসপিটালেই ছিলেন, ক্যান্সারের পেশেন্ট, ছেলে ডাক্তার বলেই বাবাকে লাইফ সাপোর্টে রাখেনি, মৃত্যু তরান্বিত করে বাবাকে প্রচন্ড কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছে।

৬ তারিখে মায়ের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এলো, খুব বড় করে তাকাচ্ছিল, যেন খুব জোর করে দেখতে চাইছে। বুঝতে পারলাম, মায়ের সকল ইন্দ্রিয় গুলো অকেজো হয়ে আসছে, তাই দৃষ্টি শক্তিও ক্ষীণ হয়ে আসছে। এই দৃষ্টিকেই পুরানো দিনের মানুষেরা ভয় পেত, ভাবতো রুগী তার মৃত আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে পাচ্ছে, তাই অমন চোখ বড় করে তাকাচ্ছে। সেদিন বিকেলের দিকে আমি একা মায়ের পাশে দাঁড়ানো, কি মনে হতেই মায়ের পায়ের পাতা দুটো ধরলাম, অনেক কালের চেনা পা, চেনা আঙ্গুল, হাতের নখ, পায়ের নখ, সবই আমার চেনা, মায়ের পায়ের পাতায় একটু চাপ দিলাম, পা কেঁপে উঠলো, আমি পায়ের পাতা একটু একটু করে টিপে দিতে শুরু করলাম, জিজ্ঞেস করলাম, " মা, আরাম লাগছে?" মা আমার দিকে তাকালো, মাথা নাড়িয়ে বলল, "হ্যাঁ"। আমার যাওয়ার সময় হলো, দশ মিনিট শেষ, কিসের আইসিইউ, এখানে রুগীকে শুধুই যান্ত্রিক চিকিৎসা দেয়া হয়, মানসিক শান্তি তো দেয়া হয়না। যে মুহূর্তে মা বলল, পায়ের পাতা টিপুনিতে কিছুটা আরাম লাগছে, সেই মুহূর্তেই আমাকে চলে যেতে বলা হলো।
আমার বড়দা, অর্থাৎ মায়ের প্রথম সন্তান, যাকে কোলে নিয়ে মা প্রথম মা হয়েছিলেন, সেই ছেলে এসে পৌঁছাবে ৮ তারিখ সকালে, মায়ের ছোট বোন, আমার ছোট মাসী, যে পাশে থাকলে মায়ের শেষ সময়টুকু অনেক বেশী আরামের হতো, গত একমাস ধরে তাকে বেড রেস্টে থাকতে হয়েছে বলে সে সুনামগঞ্জ থেকে আসতে পারেনি, ডাক্তারের কাছ থেকে কাকুতি-মিনতি করে বিশেষ ব্যবস্থায় ছোট মাসী আসছে ৮ তারিখ সকালে। আমরা ভাবছি, মায়ের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। আমার ভাইয়েরা কোনভাবেই মায়ের লাইফ সাপোর্ট খোলার বিষয়ে মতামত দিবেনা, মরে গেলেওনা। টাকা খরচ হয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে, তবুও বলবেনা, এই বুড়ি মাকে এভাবে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি?

আজরাইলের ভূমিকায় আমি নামলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, বড়দা আর ছোট মাসী এসে মাকে দেখবে, এরপরই মায়ের লাইফ সাপোর্ট মেশিন খুলে দেয়া হবে। কাগজে সাইন করবো আমি। মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি, আমি ভাল করে খেয়াল করেছি, মায়ের দেহে ফিট করা ক্যাথেটার একেবারেই শুকনো, এক ফোঁটা ইউরিন বের হচ্ছেনা, মাকে শুধু স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে, নিউট্রিশান দেয়া হচ্ছেনা, খেয়াল করলাম, মায়ের শরীর নড়েনা, শুধু হাতের আঙ্গুল নড়ে, দুই দিন আগেও দৃষ্টি স্বচ্ছ ছিল, জ্ঞান টনটনে ছিল, এর সবই কমে গেছে, প্রতিদিন আইসিইউর ভাড়া গুণতে হচ্ছে ৫০,০০০ টাকা, বাকী টেস্টের খরচ তো আছেই। কি টেস্ট করা হয়, তাও জানিনা, কিডনি ফেইলড, ডায়ালিসিস করলেও নাকি ত্রিশ দিনের বেশী বাঁচবেনা, সেটাও লাইফ সাপোর্টের উপর, ডাক্তারের কাছেই জেনেছি, মায়ের আর কোন চিকিৎসা হচ্ছেনা, হসপিটালের পলিসি অনুযায়ী লাইফ সাপোর্টে যতক্ষণ রুগী বেঁচে থাকে, ততক্ষণ বাঁচিয়ে রাখা হবে। এভাবে ঠিক কতদিন মা বেঁচে থাকবে, তা ডাক্তাররা বলতে পারেনা। আর বাঁচিয়ে রাখলেও মাকে নাকি ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। কারণ ক্যান্সারের যন্ত্রণা নাকি মরণ যন্ত্রণার চেয়েও অনেক বেশী ভয়ংকর। আমার ভাইয়েরা কেউই টাকার চাষ করেনা, সৎ পথে আয় করা টাকা ডিমও পাড়েনা, তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েরা এখনও অনেক ছোট, সহায় সম্পত্তিও নেই যে বিক্রী করবে, কেউ একজনকে তো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। 
কঠিন সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিলাম, তবে শত হলেও আমি তো মানুষ, একেবারে অমানবিকতা দেখাই কি করে! ডাক্তারদের কাছে হাত জোড় করলাম, বললাম, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মায়ের লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়ার। আমার একটা অনুরোধ, আমার মায়ের জন্য একটা কেবিনের ব্যবস্থা করুন, আমি আমাদের সকল আপনার জনকে খবর দেই, লাইফ সাপোর্ট খুলে মাকে কেবিনে দিন, আমরা সবাই মায়ের চারপাশে ঘিরে থাকবো, আমাদের মা আমাদের মাঝে থেকে হাসিমুখে বিদায় নিবেন, শত যন্ত্রনার মধ্যেও মা যদি চোখ খুলে একটিবার দেখেন, তাঁর প্রিয়জনেরা তাঁকে ঘিরে আছে, মা তখন নিশ্চিন্তে স্বর্গের দিকে পা বাড়াবেন। বিশ্বাস করেন, মা মৃত্যুকে ভয় পেতোনা, মা শুধু একা থাকাকে ভয় পায়। এইটুকু দয়া করেন, প্লীজ প্লীজ, আমার অনুরোধ, এইটুকু দয়া করেন। ডাক্তার ছেলেগুলো ভীষণ বিব্রত বোধ করে, বলে, আপনার কষ্ট বুঝতে পারছি, কিন্তু হসপিটালের পলিসিতে নেই, লাইফ সাপোর্ট খুলে দিলে রুগীকে আমাদের হসপিটালে রাখতে পারবোনা। এক কাজ করেন, অন্য কোন হাসপাতালে ব্যবস্থা করেন, সেখানে নাহয় মাকে নিয়ে গেলেন

আমার মনে হলো, কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর, এ কেমন পলিসি? এক দিকে বলে রুগীকে কষ্ট দিবেননা, আরেকদিকে বলে এই রুগী নিয়ে অন্য হাসপাতালে যান। এক হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া রুগী অন্য হাসপাতাল নিবে কেন? তাছাড়া রুগীর আত্মীয়স্বজনের মাঝে থেকে রুগী শেষ নিঃশ্বাস ফেলবে, এর চেয়ে মানবিক আর কি হতে পারে? লাইফ সাপোর্ট খুলে অক্সিজেন দিয়ে রুগীকে কম কষ্টে চলে যেতে দেয়া বেশী মানবিক নাকি রুগীর শোকগ্রস্ত পরিবারকে মৃত্যুপথযাত্রী রুগী নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করা বেশী মানবিক? দুঃখে অভিমানে সিদ্ধান্ত নিলাম, মাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বাসায় চলে যাব। মৃত্যু তো হবেই, আমাদের কোলে থেকেই মায়ের মৃত্যু হোক। মায়ের কাছে মনে মনে প্রার্থণা করলাম, মা তুমি চেয়েছো বলে আমি পৃথিবীর আলো দেখেছি, আজ আমি চাইছি বলেই তোমাকে এই জাগতিক কষ্ট থেকে মুক্তি দিচ্ছি, যদি ভুল কিছু করে থাকি, আমাকে ক্ষমা করে দিবে।

৮ তারিখ সকালে বড়দা আর মাসী এলো, আইসিইউতে মায়ের কাছে গেল, বড়দা মা বলে ডাকলো, মাসী ডাকলো দিদি বলে। দুইজনের বেশী যেতে দেয়না, তাই আমি আজরাইল বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। বড় ছেলের ডাক শুনে মা গভীর সমুদ্র থেকে জেগে উঠেন, সন্তানের বয়সী ছোট বোনের দিদি ডাক শুনে তাকান, দুই প্রিয় মানুষকে দেখেই মা কেঁদে ফেলেন, বড়দার মন খুব নরম, প্লেন থেকে নেমেই মাকে এই অবস্থায় দেখবে ধারণাই করেনি, মাত্র এক মাস আগেই মাসীর দেহে বিরাট অপারেশান হয়েছে, নিজের দেহেই অপারেশানের যন্ত্রণা, তার মায়ের মত দিদিকে এভাবে দেখবে, ধারণাও করেনি, দুই জনেই নাকি মায়ের পাশে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মা বোধ হয় তখনই বুঝে যায়, শেষ সময় উপস্থিত।

আমি সব দিক থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম, সংসারে আমার কথার মূল্য আছে, কীভাবে এই মূল্য অর্জণ করেছি জানিনা, আমি যেহেতু বলেছি, মাকে লাইফ সাপোর্ট খুলে দেবো, এর উপর দিয়ে কেউ কোন কথা বলেনি। মামীর বাসা থেকে গঙ্গাজল নিয়ে এসেছিলাম, জানি, আমার মা সাক্ষাত ভগবতী, গঙ্গাজলের দরকার নেই, তবু ধর্মীয় সংস্কার বলে কথা, বড়দার হাত দিয়ে প্রথম গঙ্গাজল দিয়েছি, এরপর মেজদার হাতে, আমার ছোটভাইটা নারায়ণগঞ্জে ওর বাচ্চা দুটি আর বাবাকে সামাল দিচ্ছিল, ও আসতে পারেনি, আগের দিন এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে গেছে, আমার মায়ের কোলপোঁছা ছেলে, মা-বাবাকে এতকাল মাথায় করে রেখেছে, মা বিনে কিছুই বুঝতোনা, সেই মা চলে যাচ্ছে, আমি মাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিচ্ছি, ও সহ্য করতে পারছিলনা, বাসাতেই চুপ করে বসেছিল। আমি মায়ের মুখে জল দিলাম, দুই দিন আগেই বুঝেছিলাম, মায়ের জলতৃষ্ণা কমে এসেছে। প্রথম দুই দিন খুব আগ্রহ করে জলের ফোঁটাগুলো খেয়েছিল, এরপর আর সেই আগ্রহ ছিলনা। অথবা এমনও হতে পারে, আরও বড় কোন সরোবরের ছবি মা ঘুমের মধ্যেই দেখেছে, পৃথিবীর জলে আর রুচী ছিলনা। তবুও জল দেই। মা জিভ নাড়েনা, তাড়াহুড়োয় একটা ফোঁটা ঠোঁটের পাশে পড়লো, আমি বিষন্ন মনে তাকিয়ে আছি, মা ত গঙ্গাজল নিচ্ছেননা, হঠাৎ দেখি, মা জিভটা বের করে ঠোঁটে আটকে থাকা জলের ফোঁটাটুকু চেটে নিলেন। আমি কি যে খুশী হয়েছি, কি যে শান্তি পেয়েছি, আইসিইউ'র এই মুহূর্তটিও আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে।

বেলা এগারোটার দিকে আমি সমস্ত কাগজে সাইন করলাম, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে সাইন করছিলাম, তার পাশেই মায়ের রুম, জানালা দিয়ে মা'কে দেখা যায়, আমি মায়ের দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়ালাম যেন মা তাঁর মেয়ের এই অপকর্ম দেখতে না পায়। নিজেকে 'মহাপাপী, চোর' মনে হচ্ছিল। চুরী করে একজনের জীবন শেষ করে দিচ্ছি, স্বেচ্ছায় মায়ের লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে যাচ্ছি, উইটনেস ছিল আমার সর্বসময়ের সঙ্গী ভাগ্নী অদিতি টুম্পা। 
শেষ চেষ্টা হিসেবে বড়দা সিনিয়র ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিল, মাকে বাঁচানোর আর কোন পথ খোলা আছে কিনা। ডাক্তার বলেছেন, ডায়ালিসিস করলে হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচবেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জুনিয়র ডাক্তার না পেরে বাধ্য হয়ে বলেই ফেললো, এই পেশেন্ট ডায়ালিসিসের ধকল সইতে পারবেনা, উনার দেহে আর এতটুকু শক্তিও অবশিষ্ট নেই, উনি লাইফ সাপোর্ট ছাড়া কয়েক ঘন্টার বেশী বাঁচবেননা। সিনিয়র ডাক্তার আর কিছু বললেননা। চলে গেলেন, জুনিয়র ডাক্তাররা আবারও আমাকে বলল, যা করছি, মায়ের ভাল হচ্ছে, নাহলে মাকে আরও অনেক বেশী কষ্ট দেয়া হবে। অনেকেই বলে, ডাক্তারদের কোন অনুভূতি থাকেনা, কথাটি ঠিক নয়, ডাক্তাররাও অনেক অনুভূতিশীল হয়, মাকে আইসিইউতে রেখে দিলে ওদের তো কোন আপত্তি ছিলনা, কিন্তু মায়ের প্রতি আমাদের এই আবেগ আর কান্না দেখেই ওরা সত্যি কথাটি বলে দিয়েছে, পর পর কয়েকদিন ওরা আমাকে বুঝিয়েছে, মাকে আর ধরে রাখা ঠিক নয়। হাসপাতালের পলিসিতে যদি থাকতো, তাহলে আমি নিশ্চিত, ওরা মায়ের জন্য একটা কেবিন তৈরী করে দিত, ডাক্তার ছেলেগুলোকে ঐ মুহূর্তে নিষ্ঠুর মনে হলেও যখন আমি সুস্থির হয়েছি, সেই ডাক্তার ছেলেগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করেছি, ওদের মঙ্গল কামনা করেছি।

সেদিন ছিল সোমবার, বড়দা এক জুনিয়র ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই যে আমরা মায়ের লাইফ সাপোর্ট খুলে দিচ্ছি, কাজটা কতটা অমানবিক হচ্ছে? ডাক্তার বলল, অবশ্যই অমানবিক কাজ এটা, তবে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে যতদিন বাঁচিয়ে রাখবেন, সেটি হবে বহুগুণে অমানবিক। ক্যান্সার রোগের যন্ত্রণা যে কি, তা কেউ জানেনা। বড়দা বলল, লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়ার সাথে সাথেই কি রুগী মারা যায়? ডাক্তার বলে, না, চার পাঁচ ঘন্টা থাকে। আসলে এটি আল্লাহর ইচ্ছা, রুগী টের পায়না, অক্সিজেনের পরিমান কমে আসতে থাকে, রুগীর ব্রেন সেলগুলো অকেজো হতে থাকে, রুগীর ফিলিংস হয় অনেকটা ঘুমিয়ে থাকার মত, ঘুমের মধ্যেই রুগী এক সময় চলে যায়

নারায়ণগঞ্জে আসতে গেলে যা ট্র্যাফিক জ্যাম হয়, সেদিন কোন জ্যাম ছিলনা। আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মাকে প্রিয় শহর নারায়ণগঞ্জে জীবিত অবস্থায় নিয়ে যাব, সকালে মাকে বলেওছিলাম, মা, এইখানে তো তোমাকে একা একা থাকতে হয়, আমাদের কাউকে ঢুকতে দেয়না, সেইজন্য ঠিক করেছি, তোমাকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাব, নারায়ণগঞ্জের ক্লিনিকেই তোমাকে ভর্তি করবো, আজকেই আমরা যাব। মা শুনেছে, কি বুঝেছে জানিনা। ভয়ে ভয়ে ছিলাম, মা'কে শেষ পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় নারায়ণগঞ্জে নিতে পারবো তো? যাত্রাবাড়ীর ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়লে তো চার ঘন্টা লেগে যাবে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছাতে, তখন কি হবে? অক্সিজেনের অভাবে মা মরে যাবে!! মাত্র দেড় ঘন্টায় আমরা নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে গেলাম।

নারায়ণগঞ্জের এক ক্লিনিকে মিথ্যে তথ্য দিয়ে ভর্তি করালাম। নারায়ণগঞ্জ আমার মায়ের প্রাণের শহর, তিন বছর বয়সে এই শহরে মা এসেছেন, ৭৫ বছর বয়সে এই শহরের একটি ক্লিনিকে মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একটা জিনিস খেয়াল করেছি, আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে মা ছিলেন ঠিকই, কিন্তু মায়ের চেহারাতে ছিল স্পষ্ট যন্ত্রণার ছাপ, একদিন মুখের নলগুলোকে মা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছিলেন, হাত দুটো বাঁধা ছিল বলে হাত দিয়ে টানতে পারছিলেননা। অথচ ক্লিনিকের বেডে দেয়ার সাথে সাথে মায়ের চেহারা থেকে যন্ত্রণার ছাপ মুছে যেতে থাকে। ডাক্তারের কথাই ঠিক, ঈশ্বরের কৃপা, ব্রেন সেলগুলো অকেজো হতে থাকে বলেই অনুভূতিও কমে যেতে থাকে, তাই ব্যথা বেদনা আর বোধ করেনা। হসপিটালের বেডে ছিল মা একা, নারায়ণগঞ্জের ক্লিনিকে আমার বাবা, ভাই, মাসী, পিসী, মামী, দাদা, মেজদি, বৌদি, মায়ের নাতি, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, পাড়া-প্রতিবেশীদের সকলেই এসে উপস্থিত হয়। মা বোধ হয় সব টের পাচ্ছিল, কি পরম শান্তিতে চোখ বুজেছিল, একা থাকতে মায়ের ভয় ছিল, আমি চেয়েছিলাম মা সবার মাঝে থেকে বিদায় নিবে, সেটিই ঘটেছে।

৮ই অক্টোবার, সোমবার বিকেল চারটার সময় আমরা নারায়ণগঞ্জ ক্লিনিকে পৌঁছেছি, মায়ের ভ্রাতৃবধূসম প্রতিবেশী নমিতা মামী আর তাঁর ছেলে সুমন, দৌড়ঝাঁপ করে ক্লিনিকের এই বেড যোগাড় করেছিল, নাহলে মা'কে নিয়ে কি করতাম জানিনা। একবার মনে হয়, সীট যোগাড় নাহলে ভালো হয়তো, মা'কে নিয়ে নিজের বিছানায় শোয়ায়ে দিতে পারতাম। সেদিন অক্সিজেন যোগাড় করতেও অনেক কষ্ট হয়েছিল, তবুও যোগাড় হয়েছে, মানুষে ভর্তী হয়ে গেছিল ক্লিনিকের রুম, ক্লিনিকের ইনচার্জ আমাদের সবাইকে ধমকাচ্ছিল এত ভীড় করেছি বলে। আমরা জানতাম অন্যায় করছি, তবুও সবাই চুপ করে মাকে ঘিরে বসেছিলাম। 

***চারদিকে কেমন এক উৎসব উৎসব ভাব, অপেক্ষার উৎসব, আমাদের সবার মাঝে থেকে একজন চলে যাচ্ছে, কখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত হয়, তার অপেক্ষা।***

এর মধ্যেই কেউ কেউ খেয়াল করে, আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি, আমার ভ্রাতৃসম সুমন আর নন্দাদা, কোথা থেকে যেন খাবার কিনে নিয়ে আসে, আমাদেরকে খুব জোরাজুরি করে কিছু মুখে দেয়ার জন্য। আমি পারিনি কিছু মুখে দিতে, আমি কিছু মুখে দিতে পারিনি, খারাপ লাগছিল, ওদের সকলের কষ্টের পয়সা, ওরা কেউই সচ্ছল নয়, কিন্তু ভালোবাসার টানে ওরা প্রবাসী ভাই বোনের জন্য দামী ফল, দামী বিস্কুট নিয়ে এসেছে, আমি তো কিছুই খেতে পারছিলামনা, কাঁদতেও পারছিলামনা, মায়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কি শান্তিতে মা ঘুমাচ্ছে, গত পাঁচ দিনে মায়ের মুখের সেই যন্ত্রনা আর নেই, আমার খুব ভাল লাগছিল, আমি মাকে জীবিত অবস্থায় বাবা আর ছোট ভাইয়ের কাছে এনে পৌঁছে দিতে পেরেছি। সেই শান্তিতেই আমি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আমাকে কালঘুমে পেয়েছিল, পাশের বেডে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম। হঠাৎ কিছু একটা অনুভূতি হলো, মনে হলো, কোথায় যেন হট্টগোল হচ্ছে, আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম, দেখি, আমার মামী, ছোটমাসী, বড়দা, বাবা, মেজদা, মেজবৌদি সহ আর সবাই মায়ের মুখের উপর ভীড় করে আছে। আমি হাউ মাউ করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মায়ের কাছে গেলাম। মা একটা শ্বাস নিল, সবাই বলছে, ঘড়ি দেখ, ঘড়ি দেখ। মানে, মা চলে গেল, আমি তাকিয়েই আছি মায়ের মুখের দিকে, এক মিনিটের মধ্যে গলা থেকে ছোট একটি শ্বাস বের হলো, অনেকটা খুব ছোট্ট করে ঢেঁকুর তোলার মত, মায়ের আত্মা বেরিয়ে যেতে দেখলাম।

10 comments:

  1. প্রকৃতির কাছে মানুষ বড়োই অসহায়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. রীতা রায় মিঠুOctober 12, 2013 at 12:33 PM

      চরম সত্যি!

      Delete
  2. আপনি খুব অন্তর দিয়ে আপনার মায়ের মৃত্যু উপলব্দি করেছেন। আপনার লেখাটা খুব সুন্দর হয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কঠিন উপলব্ধি!

      Delete
  3. What a presentation! Witnessing death is not easy - that too of the person who brought us in this world - however the way you have placed the chronology and emotion together makes this reading a wonderful experience, almost for everyone because at any point of our life most of us pass through the similar experience. I am one of those unfortunate persons who could not be physically present during the last moments of my both parents. I was on phone with my nephew for hours during the time when my father passed away - it was almost like a running commentary that narrated each and every steps, from final bathing to the final prayer, as well as to the graveyard in Mirpur intellectual graveyard. Tears were flowing non-stop for the person who shouldered each and every responsibility to groom me up; from a remote village of Menendigonj to Barisal BM College, to Dhaka University and up to the University of Toronto in Canada. It's time for me to count days for the same fate, sitting at a distance of thousand of miles from my birthplace, in Calgary Canada. This counting is equally painful and these days the moments of my both parents' departure come alive in my mind many a times every single day.
    Miuthudi, thank you for projecting the important moment of your life in a lively manner; thank you again and God bless us all wherever we are.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thank you for being there, always with me!

      Delete
  4. নিদারুণ কষ্টটা কি সুন্দর করে লিখলে...মৃত্যুকে ভয় হচ্ছে খুব...

    ReplyDelete
  5. I wish I can understand the script and share the feelings. We wish you all the best di! _Binu

    ReplyDelete
    Replies
    1. Binu, it was all about the experience I had, during my Mom's last breath! Pray for me, I am not well at all!

      Delete