Wednesday, February 20, 2013

THUMBS UP FOR MITHILA!!!

THUMBS  UP  FOR  MITHILA!!

আজ সকালে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, 

উফ!! মাঝে মাঝে কী বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়!! আমার গাড়ী চালানোর দৌড় হচ্ছে বাড়ী থেকে ওয়ালমার্ট, ওয়ালমার্ট থেকে বাড়ী, মাত্র ১০মিনিটের মামলা। আর আজ সকালে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে হাইওয়ে দিয়ে গাড়ী চালিয়ে মিথীলাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে!! এটা একটা কথা হলো? আমাকে গাড়ী চালাতেই দেয়া হয় না আবার পেছন থেকে মন্তব্যও করা হয়, অ্যাকসিডেন্ট করি কিনা!!
মেয়ের সায়েন্স ফেয়ার কম্পিটিশানের ব্যাপার, রিজিওনে যাচ্ছে, তাই মুখ বুজে সব সহ্য করে মেয়েকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে এলাম। এমনই কপাল, মেয়েও দেখি স্কুলের কাছাকাছি হতেই বলে, " মা, ভাল করে দ্যাখো, ফেরার সময় কিন্তু ঐ যে ঐ লেইন ধরে আসতে হবে। ভুল করো না কিন্তু"। দিছি একটা ধমক, " ঐ মাইয়া, চুপ থাক"! 
 
স্ট্যাটাসের দুটি অংশ আছে। প্রথম অংশটি বেশ কৌতুকপূর্ণ, ওখানে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, ড্রাইভার হিসেবে আমার পারদর্শিতা কতখানি। আর দ্বিতীয় অংশটি অপূর্ণ রয়ে গেছে। মিথীলার আজ 'সায়েন্স ফেয়ার অ্যাট রিজিওন' ছিল। স্কুল থেকে ওদেরকে বাসে করে নিয়ে গেছিল স্টেট ইউনিভার্সিটিতে, সে জন্যই আমি ওকে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করেছি। এবার পুরো গল্প বলি।


মিথীলা  যখন ক্লাস টু'তে পড়তো, তখন থেকেই স্কুলের সায়েন্স ফেয়ারে অংশগ্রহণ করতো। নিয়মানুযায়ী স্কুলে ফার্স্ট হলে প্রোজেক্ট নিয়ে রিজিওনে যেত। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত রিজিওনে গিয়েই প্রতিযোগীতা শেষ হতো। সেভেন থেকে শুরু হয়েছে, রিজিওন টু স্টেট।  গত বছর মিথীলা রিজিওনে ফার্স্ট হয়ে স্টেটে গিয়ে সেকেন্ড হয়েছিল। ক্লাস এইট পর্যন্ত স্টেটে গিয়েই প্রতিযোগীতা শেষ হয়। ক্লাস নাই টু  টুয়েলভ  স্টেটে ফার্স্ট হয়ে সরাসরি  ন্যাশনালে যায়,  সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল। এভাবেই এদেশে স্কুল লেভেলে সায়েন্স কম্পিটিশান হয়ে থাকে।

আমার মিথীলাকে নিয়ে অতদূর ভাবি না। ও আমাদের খেলার পুতুল, ও আমাদের নিঃসংগ জীবনে একমাত্র আনন্দ। ওর উপস্থিতিটুকুই আমাদের কাছে বিশাল পাওয়া মনে হয়। তাই ওকে পড়ালেখা, গান-বাজনা, খেলা ধূলা, কোন কিছু নিয়েই চাপ দেই না। ওকে ওর মত করেই বড় হতে দিচ্ছি। তবে আমার মধ্যে 'টিকটিকি' স্বভাব আছে, মাঝে মাঝে গোয়েন্দাগিরি করি। খবর নেই, কী বই পড়ছে, কী মুভী দেখছে, কাদের সাথে বন্ধুত্ব হচ্ছে, হালকা রসিকতার সুরেই আসল তথ্য জেনে নেই। মিথীলা খুবই সরল মনের একটি মেয়ে, আমার চাতুরী ধরতে পারে না। তাছাড়া আমেরিকায় বাচ্চারা মিছে কথা বলেও না। দুই বছর বয়স থেকে মিথীলা এই দেশে আছে, তাই আমেরিকান কৃষ্টি তো কিছু শিখবেই।

মিথীলা এখন ক্লাস এইটে পড়ে। আগেই বলেছি, ওর লেখা পড়ার খোঁজ আমি নেই না। অবশ্য নিলেও কতদূর কী করতে পারতাম জানিনা। এদেশের লেখাপড়ার কায়দা কানুন আমি বুঝি কম। তাছাড়া এখন আমার বয়স হচ্ছে, নিজের মত করে থাকতে বেশী ভাল লাগে। দুই মেয়ে মোটামুটি মানুষ হয়ে গেছে, ছোটটাও মানুষ হয়ে যাবে, এমনই একটা নিশ্চিন্ত ভাব নিয়ে আমি দিন কাটাই। মাঝে মাঝে মিথীলাকে ডেকে অযথা হম্বী তম্বী করি, 

"অ্যাই মেয়ে, তুমি কী ভাবো যে আমি তোমার কোন খবর রাখিনা? সব খবর রাখি। আমার কিন্তু তিনটি চোখ, তিন নাম্বার চোখ লুকিয়ে রাখি, সেই চোখ দিয়ে তোমাদের কান্ডকীর্তি দেখি। কাজেই সাবধানে চলবে"। ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট। 
প্রায়ই দেখি মিথীলা এই প্রোজেক্ট, সেই প্রোজেক্ট নিয়ে বাসায় আসে। ওর তো খেলার সঙ্গী নেই, গল্পের বই ওর বড় সঙ্গী। প্রচুর বই পড়ে, আমি থাকি ওয়ালমার্টে, ওর পাপা থাকে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, ওর দিকে কেউ নজর দেয়ার নেই। তাই ও পাঁচ মিনিটের কাজ এক ঘন্টা সময় নিয়ে করে। ওর রুমের চারদিকে কাগজ, পোস্টার ছড়ানো থাকে, জিজ্ঞেস করলেই বলে রিডিং প্রজেক্ট, হিস্ট্রি প্রজেক্ট সহ এমনই আরও হ্যানা ত্যানা প্রজেক্টের গল্প শুনি। হুমকী দেই, 

" অই মাইয়া, এত সব প্রজেক্টের মধ্যে 'বাংলা প্রজেক্ট' এর কী খবর?"  সাথে সাথে চুপসে যায়। মাঝে মাঝে অযথাই ধমক দেই, বাংলা বই থেকে এক প্যারা পড়তে দেই। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে যায়, যুক্তাক্ষরে গিয়ে ঢোঁক গিলতে শুরু করে, আমিও ছদ্ম রাগে আরও জোরে ধমক দেই, ওমা, সাথে সাথে শুদ্ধ উচ্চারণে পড়ে যায়।  মিথীলাকে নিয়ে দারুণ মজার খেলা এটা। মিথীলা খুব একটা আবদার করে না। ওর মধ্যে এমন একটা কোমল ভাব আছে যা ওকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। আমাদের বন্ধুস্থানীয়রাও মিথীলাকে খুব আদর করে। এভাবেই একা একা থেকেও মিথীলা সকলের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয় না। সেই মিথীলা কখন যেন বড় হয়ে গেছে। বড় তো অবশ্যই হয়েছে, ক্লাস এইটে পড়ে! কিন্তু আমরা ওকে বড় ভাবি না। এখনও ওকে বাবলু' গুবলু' সুঙ্কু মুঙ্কু' কত নামে ডাকি।

 মিথীলা যে বড় হয়ে গেছে, তার একটা প্রমান অবশ্য পেয়েছি, গত মাসে। আমি এর আগেও খেয়াল করেছি, মিথীলা খুব অন্তর্মুখী, স্কুলে ওর অনেক সুনাম, অথচ আমি কিছুই জানিনা। মিথীলা কখন কী পুরস্কার পায়, সেই খবরও রাখি না। ও নিজেও কিছু বলে না। দৈবক্রমে যদি আমি জেনে ফেলি, তখন অবাক হয়ে বলি, 

" মিথীলা, তুমি এমন ভাল একটা খবর আমাকে জানাও নি? ও বুঝেছি, আমাকে তুমি সংসারে বাতিল মাল ভেবেছো, তাই না? আমি তোমার কোন খোঁজ নিতে পারি না বলে আমাকে আর কিছুই জানাও না"। সাথে সাথে ও বলে, " আরে! এটা তো কিছুই না। সবাই পায় এমন পুরস্কার, আমি একটু বেশী পাই, কিন্তু তোমাকে বলতে ভুলে যাই। পাপাকে বলি তো"।
আমি বলি, " তা তো বলবেই পাপা কে, পাপা তোমার খোঁজ রাখে, আমি রাখি না"

হাসতে হাসতে জবাব, " তোমরা দুজনের কেউই খোঁজ রাখো না। আমি যে সায়েন্স ফেয়ারে ফার্স্ট হয়েছি স্কুলে, নেক্সট মান্থে রিজিওনাল এ যাব, তোমরা তো জানোও না"।

-অ্যাঁ!!! তুই স্কুলে ফার্স্ট হয়েছিস, তোদের সায়েন্স ফেয়ার কম্পিটিশান কবে হলো?  তোর কী টপিক ছিল?

-হি হি হি হি!!! মা, গত সপ্তাহে হয়েছে কম্পিটিশান। আমার টপিক ছিল, "  Cooking  With  Curcumin"। তুমি হলুদের গুঁড়া দিয়ে যে রান্না করো, সেই হলুদ নিয়েই কাজ করেছি। তবে প্লীজ, এখন আবার জানতে চেও না, কী কী করেছি, এখন বলতে ইচ্ছে করবে না। তবে পরে তোমাকে বুঝিয়ে বলবো"।


মিথীলার কথায় বিরাট ধাক্কা খেলাম। আমি থাকি আমার লেখার জগত নিয়ে, ওর পাপা অবশ্য ওকে একটু হেল্প করে, তবে ওর পাপার বক্তব্য হচ্ছে, 


" এই মেয়ে বেশী মাতব্বর। সব কিছুই সে  আগে আগে  বুঝে।  কোন কথা শুনতে চায় না, নিজের মতের বাইরে যাবেই না।"

ওর পাপা যখন এমন কথা বলে, তখন আমার মাতৃত্ব জেগে উঠে। এক 'ধাপকী' দেই, " এমন করে বলো কেন? ও যদি নিজে নিজে বুঝে সব কিছু করতে পারে, ক্ষতি কি? আমরা কী ওকে সময় দেই? ওতো কখনও অভিযোগ করে না। ওকে কক্ষনও বকবে না"

'ইশ! নিজের কথা ভাবেন, আপনি কী করেন অতটুকু মেয়ের সাথে? এই কান ছিঁড়ে ফেলব, চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো, এগুলি কে বলে? আমি বলি?"

-আমি এগুলো বলি, ওকে তটস্থ রাখার জন্য, লাগাম আমার হাতে রাখার জন্য, আমি বলি বলেই তো তুমি কিছু বলবে না। তুমি শুধুই আদর ভালোবাসা দেখাবে।"

পাপা আর মায়ের তর্কাতর্কির মাঝে ঢুকে পড়ে মিথীলা। দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে বলতে থাকে, " ওকে ,ওকে! তোমরা এবার ঝগড়া থামাও, তোমরা কেউই আমাকে বকো না তো, দুজনেই আদর করো। ব্যস, এবার মা আবার লেখালেখি করো, পাপা গিয়ে টিভি দেখো"।


সাতদিন আগে মিথীলা আমাকে বললো, " মা , সামনের মঙ্গলবার আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতে পারবে?"

-না, আমি অত সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারবো না। সামনের মঙ্গলবার কী উপলক্ষ্য?

-আমার সায়েন্স ফেয়ার, রিজিওনালে যেতে হবে।

-স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তোমাকে কে নিয়ে যাবে? প্রত্যেকবার কেন আমাদেরকে নিয়ে যেতে হবে? স্কুল থেকে কেন ব্যবস্থা করে না? তোমার স্কুলটা দেখতেই বিশাল, কোন কাজের না।

-আহা! মা, না জেনেই খালি বকাবকি করছো কেন? স্কুল বাসেই যাব। পাপার তো সকাল আটটায় ক্লাস, তাই পাপা আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না, তোমাকেই নিতে হবে।

-আমার ঘুম ভাঙ্গলে যাব ( মনে মনে অবশ্য ঘাবড়ে যাচ্ছিলাম, ওর স্কুলে যেতে হয় হাইওয়ে দিয়ে, একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ী একবার বামে, একবার ডানে, একেবারে ভেজাল)।

গতকাল মেয়ের বাপ সরাসরি সমন জারি করেছেন, " কাল তুমি ওকে নিয়ে যাবে। সোয়া সাতটায় বের হলেই হবে"
মিথীলা বলে, " এত সকালে কেন যাব? আমাদের বাস ছাড়বে আটটার সময়"।

-এত সকালে যাবে, কারণ তখন রাস্তা ফাঁকা থাকে। তোমার মা চালাবে গাড়ি, অ্যাকসিডেন্ট না জানি হয়!

-আমাকে নিয়ে যদি অ্যাকসিডেন্টের ভয় থাকে, তাহলে তুমিই তো নিয়ে গেলে পারো।

-আরে না! আমার ক্লাস আছে।

-তাহলে আর এত আলগা চিন্তা দেখিয়ে লাভ কি?


আজ সকাল সাতটার আগেই মিথীলা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। আমার দুই চোখের পাতা ঘুমে ভারী হয়ে আছে। কাহাতক সহ্য হয়, একবার ইচ্ছে হলো মিথীলাকে বলি, " মা রে, যা না, তোর পাপাকে বলনা, তোকে দিয়ে আসতে। বলা আর হলো না, বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমেই বাসী ঘর-দোর ঝাঁট দিয়ে মেয়েকে নিয়ে রওনা হলাম। একফাঁকে মিথীলা বললো, 

" মা, আমার জন্য ঠাকুরের কাছে একটু প্রে করতো"

-চুপ থাক, নিজের প্রে নিজেকে করতে হয়। কালকে সারাদিন তুমি ল্যাপটপে মুভী দেখেছো, আর এখন আমাকে বলছো তোমার জন্য প্রে করতে। খেয়ে দেয়ে কাজ নাই আমার। চল, রওনা দেই। 

গাড়ীতে উঠেছি, মিথীলা আগেই তার প্রোজেক্ট বোর্ড থেকে শুরু করে ডিস্পলে টেবিল, চাদর, ফোল্ডিং চেয়ার সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। ওকে বলেছি পেছনের সীটে বসতে। বলা তো যায় না, অন্য গাড়ী ধাক্কা দিলে মেয়েটা মাঝের সীটে থাকলে ব্যথা কম পাবে। আমি মাত্র গাড়ী স্টার্ট দিয়েছি, মিথীলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে,

"মা, আমার ভয় করছে!"

-কী???? আমি গাড়ী চালাবো বলে ভয় করছে?
-নাহ, আমার মনে হচ্ছে পাপাকে কতগুলো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিল, এখন ভুলে গেছি। কিন্তু জাজ জিজ্ঞেস করলে যদি না পারি!

-কেমনটা লাগে এই মাইয়া নিয়া, বলেই ওর পাপাকে হাতের ইশারায় ডাকলাম। সাথে সাথে মেয়ে বলে উঠলো, মা , দেরী হয়ে যাচ্ছে, থাক লাগবে না।

-মিথীলা শোন, তোর একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।  তোরে বলছিলাম, ২১শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে বাংলা পড়া গড়গড়িয়ে পড়তে শিখতে, তুই সেইটা করিস নাই, ভগবান রাগ করেছে মায়ের কথা শুনিস নাই বলে। এই জন্যই তোর মাথা থেকে সব মুছে গেছে। ভালো হয়েছে, পুরস্কার না পেলেই ঠিক হবে। ফাজিল মেয়ে, কাল সারাদিন মুভী দেখার সময় মনে ছিল না?

দুই মিনিট পরেই স্বর শান্ত করে বললাম, ঠিক আছে, মনে মনে ভাবতে থাকো, যখন মনে পড়বে, কাগজে লিখে নাও, পাপাকে ফোন করে উত্তর জেনে নিও। অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কম্পিটিশানে জিতলে ভাল, না জিতলেও হায় হায় করার কিছু নেই। তবে তোমার একটা শিক্ষা হওয়ার দরকার ছিল। আর শোন, আমাকে দেখিয়ে দিবি, কোথায় গিয়ে টার্ণ নিতে হবে।

_মা, তুমি চালাও, আমি দেখিয়ে দেব। হ্যাঁ মনে পরেছে প্রশ্ন, দাঁড়াও পাপাকে ফোন করি। 

পাপাকে ফোন করে দেখি একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে, আমি গাড়ী চালাবো কি, মনে হচ্ছিল হাতের কাছে পেলে ওকে দুই গালে দুই চড় দিতাম। আমার স্বভাব কোত্থেকে পেল? কত সাহসী মেয়ে ছিল ও, আজ দেখি একেবারে আমার মত নার্ভাস হয়ে গেছে, কেমন টা লাগে! শুনি পাপাকে বলছে, 

"পাপা, এখন রাখি। মা'কে দেখাতে হবে কোথায় টার্ন নিতে হবে। পরে আবার ফোন করবো। মা, ঐ যে ওখানে টার্ন নাও।

-অ্যাই, তুই আমার সাথে কথা বলবি না, মায়ের সাথে বেয়াদবী করছিস বলেই এখন শেষ মুহূর্তে সব ভুলে গেছস।

-আরে, তুমি চালাও গাড়ী। আর দেখে রাখো, ফেরার সময় ঐ লেইন ধরে ফিরবে।

-চুপ থাক মাইয়া, মাতব্বরী করতে হবে না।

-মা, আরেকবার তো তুমি রাস্তা ভুল করে অন্যদিকে চলে গেছিলে।

-ও হো, ঠিক বলেছিস তো। আবার দেখা, কোন লেইন?

-হি হি হি! ঐ যে, অন্য গাড়ী যাচ্ছে, দেখে রাখো। ভয়ের কিছু নেই। আমাকে নামিয়ে দিয়ে ঠিক মত চলে যেও।


মিথীলাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে এসেছি। ওকে ফোন করেছি, লাইনে পাই নি, ভয়েস মেসেজ রেখেছি, " মিথীলা, বাবলু, চিন্তা করো না। ভালভাবে প্রজেক্ট প্রেজেন্ট করতে পারলেই হলো। টেনশান করো না, সব মনে পড়বে। উইশ ইউ গুড লাক"।

আমি ওয়ালমার্টে চলে গেছি। মাথার থেকে মিথীলা প্রসংগ বাদ। মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। তিন বছর আগেও ওর সাথে আমি আর ওর পাপা যেতাম, সারাদিন ইউনিভার্সিটি কলেসিয়ামে কাটিয়েছি, পুরস্কার বিতরণী দেরী হলে ওর বাবার তাড়াহুড়োতে পুরস্কার না  নিয়েই চলে এসেছি। পরে স্কুল থেকে মেডেল সংগ্রহ করেছে। ক্লাস সিক্সে থাকার সময় একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান পর্যন্ত বসে থেকেও কোন লাভ হয় নি। মিথীলা কোন প্লেস পায় নি। মেয়ের মন খারাপ দেখে আমরা অনেক সান্ত্বনা দিয়েছি। সাতদিন পর শিক্ষাবোর্ড থেকে একটি মেইল পাঠিয়েছে, খামের ভেতর যুগ্ম ফার্স্টের মেডেল আর ক্ষমা চাহিয়া পত্র।

বিকেলে মিথীলাকে ফোনে পেলাম। বললো, এখন প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশান হবে। জিজ্ঞেস করলাম, " তোমারটা কেমন হলো? সব ভালোভাবে বলতে পেরেছ? কয়জন জাজ এসেছিল?

" মনে হয়, ভালো হয়েছে। দুইজন জাজ এসেছিল। একজন ছিল ইন্ডিয়ান, আরেকজন আমেরিকান'।

-তাই?? ইন্ডিয়ান হলে তো মজা, হলুদের ব্যাপার সে ভালো বুঝবে। তা ওরা কী কিছু কমেন্ট করেছে, যা থেকে বুঝা যাবে যে ওরা তোমার কথায় সন্তুষ্ট"

-হা হা হা , আমেরিকান জাজ বেশী প্রশ্ন করে নি।

-এই রে! প্রশ্ন না করা ভালো কথা না। তার মানে ওদের কাছে ভালো লাগে নি।

-আরে না, জাজ বলেছে, আমি নাকি এত ভালোভাবে এক্সপ্লেইন করেছি যে তার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আর ইন্ডিয়ান জাজ ক্রিটিসাইজ করেছে।

-অ্যাঁ!! শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়ানটায় তোরে ক্রিটিসাইজ করলো, তা কী বললো?

-কী কী ভুল থাকবে?

-কী, ভুল থাকবে মানে? তোর প্রোজেক্টে ভুল আছে বলেছে? তাহলে কী তুই ভুলভাল লিখছস নাকি?

-আহ মা!!!!! সে বলেছে, আমি যে পিনাট অয়েলে কাজ করেছি, সেটা ছাড়াও যেন অন্য সলভেন্ট ইউজ করি। নাহলে রেজাল্টে ভুল আসতে পারে। আমি তখন বলেছি, আমি তো এটার উপর কাজ চালিয়ে যাব, তোমার সাজেশান মনে থাকবে। ফলো করবো"

-মিথীলা, তুই এত গুছিয়ে কথা বলতে পারিস?

-ইংলিশে হলে বলতে পারি। বাংলায় একটু উলটাপালটা হয়।

আচ্ছা, তোর প্রজেক্টটা কী রে?

-মা, হলুদের মধ্যে কারকিউমিন নামের যে কেমিক্যাল আছে, সেটা আমাদের দেহে কী কাজ করে। এখন বলতে পারবো না। পরে কথা বলবো।

-শোন, মনে হচ্ছে তুই এবার পুরস্কার পাবি না, আগেই বলে দেই, মন খারাপ করিস না। নেক্সট টাইম ভালো করবি।

-আমার মনে হয় পুরস্কার পেতেও পারি।

-ফার্স্ট না হলে আমার কাছে পুরস্কারের দাম নাই, আমি আগেই বলে দিলাম।

-ফার্স্টই হবো।


সন্ধ্যার সময় ফোন করে মিথীলাকে পাই না, বাসায় ওর বাবার কাছে ফোন করে জানলাম, মেয়ে নাকি বলেছে, বাসায় ফিরে সারপ্রাইজ দিবে। তাহলে তো মনে হয় ফার্স্ট হয়েছে, তাই না? -হতে পারে।

এবার পেয়ে গেলাম ওকে ফোনে। মিথীলা, কী খবর?

বাসায় এসে বলবো। পুরস্কার পেয়েছি, তবে কী পুরস্কার তা বাসায় এসে বলবো।

-মারে, আমি তো বাসায় ফিরবো রাত ৯টার পরে, এতক্ষণ আমি না জেনে থাকবো, আর তোর পাপা আগেভাগে জেনে ফেলবে।

-আচ্ছা একটা বলি, আমার ক্যাটাগরীতে ফার্স্ট হয়েছি। আর কিছু বলবো না।

একটা বলি মানে, কয়টা পুরস্কার পেয়েছিস?

মিথীলা ফোন রেখে দিয়েছে, এত পাজী।  রাত আটটার দিকে মিশা ফোন করেছে আমাকে। বললাম, মিথীলা তো সায়েন্স ফেয়ার রিজিওনালে এবারও ফার্স্ট হয়েছে।

-হ্যাঁ শুনেছি তো, ওতো 'বেস্ট অফ দ্য ফেয়ার' ট্রফি পেয়েছে। 

-অ্যাঁ কী বলো!! তাই নাকি?

-কেন, তুমি জানো না?

-আমাকে নাকি সারপ্রাইজ দিবে।
-তাহলে আমি আর বলছি না। বাসায় গিয়ে সারপ্রাইজড হও।

কাজ থেকে ফেরার সময় চট করে মিথিলার জন্য 'ব্লুবেরী মাফিন' আর 'পিকান পাই' কিনে নিলাম। মিথীলা মিষ্টি জাতীয় খাবার খুব ভালোবাসে। ইদানিং আমার ঘরে হেলদি ডায়েট প্রোগ্রাম চলছে বলে এগুলো আর কেনা হয় না। আমি ভাবতেই পারছিলাম না, এই পুচকী মেয়ে একা একা এতদূর কিভাবে এগিয়ে গেলো।  নিজে নিজে পোস্টার রেডী করা, কম্পিউটারে টাইপ করা, প্রিন্ট করা, পেস্ট করা থেকে শুরু করে সব একা করেছে।  ওর পাপা নিজের ল্যাবে নিয়ে গিয়ে প্রোডাক্ট অ্যানালিসিসের সময় হেল্প করেছে, এটা করতেই হবে। অতটুকু বাচ্চার হাতে কেমিস্ট্রি ল্যাব ছেড়ে দেয়া যাবে না বলেই পাশে থেকেছে। আর আমি তো আজকেই জানলাম, ওর প্রজেক্টের নাম। 

কেমিস্ট্রি খুবই কমপিটিটিভ ক্যাটাগরী, সেখানে ফার্স্ট হয়েছে ভালো কথা, 'বেস্ট অব দ্য ফেয়ার' ট্রফি পেয়েছে আমাদের মিথীলা, মায়ের কথা খুব মনে হচ্ছিল। মিথীলা আমার তিন নাম্বার মেয়ে, ওর জন্মের পর আমি খুব কেঁদেছিলাম। তখন মা বলেছিল, 

" তোর এই মেয়েই তোকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যাবে। ভগবানের দান, এমন হেলা অশ্রদ্ধা করতে নাই। তোর তিন মেয়ে তিন রত্ন হবে বলে দিলাম"।

মা, তুমি কী উপর থেকে সব দেখতে পাচ্ছ? মা, আমার শরীর কাঁপছে। মা, আজকেও ওর বাবা আর আমি ওর উপর বিরক্ত হয়েছি। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছি, মেয়েটা বেশী মাতব্বরী করে। কারো কথা শুনবে না, নিজে যেটা ভালো মনে করবে, সেটাই করবে। মা, এখন তো দেখছি, ও আমাদের সবার থেকে অনেক বেশী ভাল বুঝে! 

বাড়ী ফিরতেই মিথীলা খুব হাসতে হাসতে আমার কাছে ওর ট্রফী, মেডেল এবং আরেকটি 'টপ টেন পার্সেন্ট' সার্টিফিকেট নিয়ে এলো। আমি মুহূর্তটিকে ধরে রাখতে চাইলাম, ওর পাপাকে ডাকলাম  আনন্দময় মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দী করে রাখার জন্য। ওর পাপা বিনা বাক্য ব্যয় করেই কতগুলো 'ঝাপসা' ছবি তুলে দিল। ছবির দিকে তাকাতেই আমি আর মিথীলা দুজনেই হেসে গড়িয়ে পড়ি। আমার মিথীলা এর চেয়ে হাজার গুণ বেশী ভাল ছবি তোলে। যাই হোকম মিথীলার কাছে জেনে নিলাম ওর স্টেট ফেয়ারের তারিখ। এবার আর ওকে একা যেতে দেবো না, আমরাও সাথে যাব।


'

এ যেন আমার কাছে মরুর বুকে বৃষ্টি!


ব্যক্তিগত আনন্দের খবর শেয়ার করি। আমি তো গণজাগরণ আন্দোলনের সাথে নিজেকে মানসিকভাবে জড়িয়ে ফেলেছি। সংসারের দিকে তাকানোর ফুরসত পাইনা, মিথীলার মুখটাও ভাল করে দেখার সুযোগ হয় না। মিথীলার লেখাপড়ার খোঁজ নেইনা, কেমন এক উদভ্রান্তির মধ্যে সময় কাটে আমার। সেই উদভ্রান্ত মার্কা জীবনে মিথীলা নিয়ে এসেছে প্রাপ্তি সংবাদ।

গত সপ্তাহে মিথীলা গিয়েছিল স্টেট ( মিসিসিপির সব স্কুল) সায়েন্স ফেয়ারে, ফিরেছে 'থার্ড' হয়ে। মিথীলার সাফল্য নিয়ে 'কাব্য' রচনা করা হয়নি।

আজ মিথীলা ওর বন্ধুর বাবার গাড়ীতে চড়ে গিয়েছিল টেনেসী রাজ্যের মেমফিস শহরে। ওয়ার্ল্ড হিস্টোরী ইন্টারস্টেট ( ছয়টি স্টেটের ৩০ জন প্রতিযোগী) কমপিটিশানে। ফিরেছে 'প্রথম পাঁচজনে'র একজন হয়ে। [এখানে কোন পজিশান দেয়া হয়নি কাউকেই]

নেক্সট জুনে ইন্টারস্টেট থেকে দশ জন যাচ্ছে ন্যাশনাল কম্পটিশানে, ভেন্যু আটলান্টা। মিথীলার কাছে জিজ্ঞেস করে জানলাম, দশজনের আটজন এসেছে বিল ক্লিন্টনের রাজ্য 'আরকানসা' থেকে আর বাকী দু'জন গরীব রাজ্য মিসিসিপি থেকে, দুজনের একজন হচ্ছে বাংলা মায়ের সন্তান **মিথীলা**! হিপ হিপ হুররে!!!!!!

* মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজকের এত বড় কম্পিটিশানের আদ্যোপান্ত শুনলাম মিনিট পনের আগে, মিথীলার গলায় মেডেল ঝুলছিল, মেডেলের গায়ে লেখা ছিল 'হিস্টোরী' জাতীয় কিছু শব্দ। থাক, মিথীলা তার মা'কে খুব ভালোবাসে, ও জানে, ওর মায়ের মাথাটা এখন একটু উলট পালট হয়ে আছে*
Like · · Promote ·




No comments:

Post a Comment