Thursday, February 14, 2013

ব্যাঙের ছাতা সমাচার!

আজ দুপুরের খাওয়ার মেন্যু হচ্ছে ভেজিটেবল নুডলস! আমার কিচেন লিস্টে সেটাই দেখিয়েছে, বৃহস্পতিবার লাঞ্চ মেন্যুতে ভেজিটেবল নুডুলস, একটি আপেল ও একটি কমলা। নুডুলসে ডিম দেই, তবে ডিমকে ভেজিটেবলের মধ্যেই রেখেছি। বেলা সাড়ে বারোটার সময় কিচেনে ঢুকেছি নুডুলস রান্না করবো বলে। নুডুলস রান্না করতে কতক্ষণই বা লাগে! বড় জোর পনের মিনিট। সাধারণতঃ আমার ছুটির দিনে নুডুলস রান্না করতে হলে ঘন্টা পার করে দেই। চিকেন 'থ করতে হয়, চিংড়ি মাছ পরিষ্কার করতে হয়, ঝামেলা তো কম না! তা আজকেও আমার ছুটি ছিল, কিন্তু সমস্যা হয়েছে, আজ আবার সরস্বতী পূজা। পূজার দিনে মাছ বা মাংস খেতে নেই, তাই নুডুলসে চিংড়ি বা চিকেন দেয়া যাবে না। সেটাও খুব একটা চিন্তার ব্যাপার হতো না যদি রেফ্রিজারেটার খুলে সব্জী শূণ্য চেম্বার না দেখতাম। সত্যিই এমন সব্জী শূণ্য রেফ্রিজারেটার দেখে আমি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেছি। একবার এ ড্রয়ার টানি, আরেকবার ও ড্রয়ার টানি, শেষ পর্যন্ত একটি ফোমের বাক্সে সাত আটটি 'মাশরুম' পড়ে আছে দেখলাম। মাশরুমের চেহারা খুব করুণ। দুধ সাদা রঙের পরিবর্তে গাঢ় বাদামী বর্ণ ধারণ করেছে। অন্য সময় এই মাশরুমের জায়গা হতো ট্র্যাশ ক্যানে। কিন্তু আজ বিধি বাম! গাজর, বাঁধাকপি নেই, এমনকি ফ্রোজেন মিক্সড ভেজিটেবলের একটা প্যাকেটও নেই। ডীপ ফ্রীজার চেক করা হয়ে গেছে, ফ্রোজেন ব্রকলীর একটা প্যাকেট পেয়েছি। কী আর করা, বাদামী  বর্ণের ভেজা মাশরুম আর ফ্রোজেন ব্রকলী দিয়েই নুডুলস রান্না করে ফেললাম।

নুডুলস খেতে কেমন হয়েছে জানার উপায় নেই। বিকেলবেলা সরস্বতী পূজো করবো বলে একটু দুধ সিরীয়াল দিয়েই লাঞ্চ শেষ করেছি। তবে রান্নার পর নুডুলসের যা চেহারা হয়েছে, ঝরঝরে নুডুলসের ফাঁকে ফাঁকে কালো মাশরুমের টুকরো দেখা যাচ্ছে! অবশ্য সবুজ ব্রকলী থাকাতে কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে টকটকে লাল রঙা চিলি সস মিশিয়ে দিয়েছি। খেতে হয়তো খুব একটা খারাপ লাগবে না। আফসোস হচ্ছে, মাশরুমগুলো অনেক দাম দিয়ে কিনেছিলাম, ফ্রীজের ড্রয়ারে থেকে এমন কুৎসিত আকার ধারণ করেছে, খুব খারাপ লাগছিল।


মাশরুম আমাদের পরিবারে সবার প্রিয়। পরিবার বলতে আমার নিজের পরিবারের কথা বুঝিয়েছি। স্বামী-স্ত্রী, তিন কন্যার পরিবারে মাশরুম অতি পছন্দের একটি নাম। মাশরুমের সাথে আমার পরিচয় টিভি প্রোগ্রামের মাধ্যমে। অনেক আগে বিটিভিতে শাইখ সিরাজের উপস্থাপণায় 'মাটি ও মানুষ' নামে যে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল, সেই অনুষ্ঠানেই মাশরুমের চাষ দেখিয়েছিল। এখন হয়তো সারা দেশেই মাশরুম পাওয়া যায়, তবে তখন পাওয়া যেত না। তখন 'আগোরা' নামের দোকানটিও চালু হয় নি। '৯৫ সালে তো অস্ট্রেলিয়া চলে গেলাম। সেখানের বাজারে 'মাশরুম' দেখলাম প্রথম, একেবারে চাক্ষুসভাবে দেখা যাকে বলে। ধবধবে দুধসাদা বড় বড় মাশরুম দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেছিল। একবারও মনে পড়ে নি, ছোটবেলায় ইঁটের ফাঁক ফোঁকর থেকে গজিয়ে ওঠা 'ব্যাঙের ছাতা'র কথা! ইস! পাড়া গাঁয়ের উঠোনের সর্বত্র দেখা যেত 'ব্যাঙের ছাতা' গজিয়ে আছে। মা আর ঠাকুমা আগেই সাবধান করে দিত, ভুলেও যেন ঐ ব্যাঙের ছাতায় পা না লাগাই। ব্যাঙের ছাতায় পা লাগলে উপায় থাকে  না, পা চুলকে লাল হয়ে ফুলে যায়, ভীষণ ব্যথা হয়। আঞ্চলিক ভাষায় একে বলে 'পায়ে লাল লাগা'। আমার ভাইদের পায়ে প্রায়ই 'লাল লাগতো'। তখন তো কথায় কথায় অ্যান্টি হিস্টামিন খাওয়ার কথা ভাবা হতো না, তাই পায়ের যন্ত্রণা কমতে সময় লাগতো। এই সব ছোট ছোট ধারণা নিয়েই আমরা বড় হয়েছি। তাই 'ব্যাঙের ছাতার' আধুনিক নাম মাশরুম, সেটা জানতে সময় লেগেছে। আর সত্যিকারের মাশরুমের চেহারা যে 'ব্যাঙের ছাতার' মত নয়, সেটাও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে গিয়ে দেখেছি। যে তিন বছর অস্ট্রেলিয়া ছিলাম, ইচ্ছেমত মাশরুম খেয়েছি।



২০০১ সালের মার্চ মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার উত্তম কুমারের সাথে দুবাই বেড়াতে গেছিলাম, তিন দিনের জন্য। ব্যক্তিগত ভ্রমণ ছিল না ওটা, ওষুধ শিল্প মালিক সমিতি থেকে আয়োজিত এক সফর ছিল ওটা। আমার উত্তম তার কর্মস্থল থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিল ঐ ট্যুরে। ঐ সময়টাতে উত্তম খুব রোম্যান্টিক ছিল, তার বৌটা শুধু বেড়াতে ভালোবাসে বলে বৌকে নিয়ে অনেক বেড়িয়েছে। দুবাই যাওয়ার সুযোগ আসাতে সে নিজের টাকায় আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছে। নিজের টাকায় বৌ নিয়ে যাবে, এটাতে সমিতির আপত্তি করার কিছু ছিল না। তাছাড়া সমিতির দলনেতা নিজেই তার স্ত্রী, পুত্র,  স্ত্রীর বাজারের ব্যাগ বহনকারী একজনকে সাথে নিয়ে গেছিল।


দুবাই গিয়ে তিনদিন থেকেছিলাম, অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে, অনেক কিছু শিখেছি। ভাল দেখেছি, মন্দ দেখেছি। এক রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশী যুবক সালামকে কাজ করতে দেখেছি, রাস্তার ধারে বাড়ীঘরের ঝুল বারান্দা  থেকে শাড়ী, লুঙ্গী  ঝুলতেও দেখেছি। তিন দিনে  চরম ধনীদের চেহারা দেখলাম,  দুই একজন ধনীর মানসিক ক্ষুদ্রতা দেখলাম। মাশরুম নিয়ে লিখতে চাইছিলাম,  মাশরুমের কথা আনতে গিয়ে কিছু কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা চলে আসতে চাইছে। ডিজিটাল ক্যামেরা আর ক্রেডিট কার্ড দেখলাম দুবাইয়ের শপিং সেন্টারে গিয়ে। এখন আমার ঘরে চারটা পাঁচটা ডিজিট্যাল ক্যামেরা গড়াগড়ি খায়, আর তখন দলের এক সদস্যের হাতে ডিজিট্যাল ক্যামেরা দেখে আমার উত্তমকে খুব আগ্রহী হতে দেখেছি। ক্যামেরার দাম জিজ্ঞেস করতেই সেই সদস্য ভদ্রলোক জানালেন, ৫০০ ইউএস ডলার!  উত্তম বলেছিল, সে একখানা ডিজিট্যাল ক্যামেরা কিনতে চায়, তবে দাম শুনে ওখানেই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখে। আমি তখনও ডলারকে টাকায় কনভার্ট করা রপ্ত করিনি। ধরেই নিয়েছি, ওগুলো বড়লোকের শখ।  দুবাইয়ের স্বর্ণ বাজার পৃথিবী বিখ্যাত। শপিং কম্পলেক্সে গিয়ে চোখে শুধু সোনালী ঝলক দেখছিলাম। এত বড় শপিং কম্পলেক্সের পুরোটাই যেনো সোনায় মোড়ানো। স্বর্ণালংকারের প্রতি নারীর দূর্বলতা চিরকালের! দুবাই এসে স্বর্ণালংকার না কিনে দেশে ফেরত গেলে মানুষের কাছে মুখ দেখাবো কী করে! সেই ভয়ে আমিও টুকিটাকী গয়না কিনেছি, উত্তম বলেছিল, একবার যখন দুবাই আসা হয়েছে, বেশ কিছু গয়না কিনে ফেলার জন্য। আমি নারী হলেও স্বর্ণালঙ্কারের প্রতি আমার কখনওই কোন দূর্বলতা ছিল না। তাছাড়া এমনিতেই আমার এয়ার টিকিটের জন্য উত্তমকে ৫০,০০০ টাকা গুণতে হয়েছে! চোখের পর্দা আমার খুব ভারী, একবার বন্ধ হলে আর খুলতেই পারি না। দুই দিন বেশ ভালোই কেটেছে। দুবাইয়ে তখন কোন উৎসব চলছিল। একজিবেশান ছিল, ওয়াটার স্ক্রীণে মুভী দেখলাম, নতুন অভিজ্ঞতা! ব্রেকফাস্ট খাই হোটেলের ডাইনিং হলে, সবার জন্য ফ্রী ব্রেকফাস্ট, এটাও নতুন অভিজ্ঞতা। হোটেলে ব্রেকফাস্ট ফ্রী। দুপুরে আর রাতে স্বামী -স্ত্রী নিজেদের মত করে ঘুরেছি আর খাওয়া দাওয়া করেছি।

তৃতীয় দিনে আমাদের দেশে ফেরার পালা। আর তৃতীয় দিনেই ওষুধ শিল্প সমিতি টীমের বোধ হয় দুবাইয়ের ওষুধ শিল্প সমিতির সাথে মূল এবং গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল। সকাল বেলাতেই আমাকে প্রেসিডেন্টের বউয়ের জিম্মায় দিয়ে উত্তম কুমার ওদের সাথে বেরিয়ে গেল। উত্তমের বোধ হয় জানা ছিল না, লাঞ্চের আগে ফেরা হবে নাকি সন্ধ্যায় ফেরা হবে। আমাকে বলেছিল, ভাবীর সাথে গিয়ে শপিং করতে , দুপুরে নাকি  সবাইকে নিয়ে নৌভ্রমণের প্রোগ্রাম আছে!  ভাবীও বললেন, দুপুরে ওরা ফিরে আসবে। তাই আমি খুশী মনে ভাবীর সাথে বেড়িয়ে পড়লাম। ভাবীর সাথে তিন দিনে আমার আলাপ ভালই হয়েছে। বগুড়া বা রংপুরের মেয়ে উনি। খুব জাঁদরেল চেহারা, বিরাট বড়লোকের মেয়ে, উনার স্বামী বোধ হয় ভাবীর বাবার ফার্মাসিউটিক্যালের মালিকানা পেয়েছেন। ভাবীর ব্যবহারে সব সময় মালিক সুলভ আচরণ দেখেছি। উনার স্বামীর দীর্ঘ দেহ স্ত্রীর সামনে কিছুটা ঝুঁকে থাকতে দেখেছি। ভাবীর সাথে আসা ছেলেকে দেখেছি মায়ের আঁচল ধরে ঘুরতে।

ভাবীর বাজারের ব্যাগ বহণকারীকে প্রথমবার দেখে মনে হয়নি যে সে বাজারের ব্যাগ বহণ করার জন্য এসেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, এই লোকও বোধ হয় কোন ছোটখাটো ফার্মাসিউটিক্যালের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছে। ভুল ভেঙ্গেছে শাড়ীর মার্কেটে গিয়ে। সঙ্গে আসা লোকটির নাম ছিল কামাল। আমি কামালকে 'ভাই' বলে সম্বোধণ করেছি। দুবাই শাড়ীর মার্কেটে যাওয়ার সময় দুই মহিলার সাথে কামাল ভাইকে আসতে দেখে মনে মনে একটু সাহস পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের মেয়ে হিসেবে একজন পুরুষ সঙ্গী ছাড়া অজানা অচেনা জায়গায় ঘোরাফেরা করতে ভয় লাগারই কথা। কামাল ভাই আমাদের সাথে একই অটোতে উঠেছিল। মার্কেটে নেমে কামাল ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, " আপনি আজকের ট্যুরে গেলেন না যে!" সে আমতা আমতা করে বললো, " স্যার বলেছে, আমাকে ম্যাডামের সাথে থাকতে"। এরপর শুরু হলো শাড়ী কেনার বহর। আমি যদি কিনি একটা, ভাবী কিনে পাঁচটা। কিনে আর কামাল ভাইকে ডেকে বলে, " এই কামাল মিয়া, ধরেন, শাড়ী ব্যাগে ভরেন"। ততক্ষণে আমি বুঝে গেছি গ্রুপে কামাল ভাইয়ের ভূমিকা কি।


শাড়ী কেনা শেষ হতেই ভাবী গিয়ে ঢুকলো কাঁচা বাজারের দোকানে। আমিও ঢুকলাম। ঘুরে ঘুরে দেখছি, হঠাৎ চোখ পড়লো এক জায়গায় প্যাকেটে থাকা মাশরুমের দিকে। এত বড় বড় ধবধবে সাদা মাশরুম আমি অস্ট্রেলিয়াতেও দেখিনি। কোথাও দেখিনি। ভাবী যেন কী কী কিনছে, আমি চট করে ছয় বাক্স মাশরুম কিনে ফেললাম। আমি জানি, মাশরুম দেখে আমার দুই মেয়ে খুশীতে নেচে উঠবে। ভাবী আমার মাশরুম কেনা দেখে নাক মুখ কুঁচকে বললেন,

" বৌদি, আপনি দুবাই এসে এই  ব্যাঙের ছাতা কিনছেন ব্যাগ ভরে? এত ভালোবাসেন"?

আমি তো হীরে জহরতের সন্ধান পেয়েছি এমন ভাব করে বললাম, " ভাবী, এতক্ষণে আমার মনে হচ্ছে, আমি খুব ভালো কিছু খুঁজে পেলাম"।

-মাগো! আমি মরে গেলেও এই ব্যাঙের ছাতা খাব না। আমি দুবাই এসেছি গোল্ড কিনতে। কিনলাম বৌদি, ত্রিশ ভরির গয়না কিনে ফেলছি। ক্রেডিট কার্ড সাথে নিয়েই আসছিলাম, আমার সাহেব তো এখনও জানে না, ক্রেডিট কার্ডের বিল পেলে কাউ কাউ করবে। বৌদি, আপনি গেছিলেন গোল্ড মার্কেটে?"

-হ্যাঁ গেছিলাম, কিনেছি অল্প স্বল্প, আমার তো গোল্ডের প্রতি কোন নেশা নেই, আমি ম্যাচিং গয়না বেশী পছন্দ করি। মাটির গয়না, অক্সিডাইজড গয়না, সূতা, কড়ি, স্টোনের গয়না বেশী পছন্দ আমার"।

-না, বৌদি, মেয়েদের গোল্ড কেনা উচিত। হাতের সম্বল।

-ঠিক আছে, নেক্সট টাইম কিনবো। চলেন এবার হোটেলে ফিরে যাই।





শাড়ী  আর মাশরুম কেনা হয়ে গেলে আমরা আবার হোটেলে ফিরে গেলাম। ততক্ষণে বেলা বেড়েছে, ক্ষিদে পেয়েছে। ভাবীর ছেলেটা হোটেলেই ছিল, তার তো ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। ভাবী তার আজ্ঞাবহকে জিজ্ঞেস করলেন,

" অই কামাল মিয়া, তোমার স্যার কী বলে গেছে? তারা আসবে কখন? আমাদের লাঞ্চের কিছু ব্যবস্থা করে গেছে?"

কামাল মিয়া বললো, " ম্যাডাম, আমি তো কিছু জানিনা।"

ছেলের ঘ্যানঘ্যানানীতে বিরক্ত হয়ে ভাবী বললেন, " বৌদি চলেন তো, আমরা হোটেলের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে ফেলি। উনারা কই কই ঘুরছে ঘুরুক, আর কতক্ষণ বসে থাকবো।


এখানে ভাবীই আমার মালিক, উনার জিম্মায় আমাকে রেখে গেছে উত্তম কুমার। তাছাড়া ভাবী দুবাই আরও অনেকবার এসেছে, উনারা নিজেরাই একটি ফার্মাসিউটিক্যালের মালিক। ধনী মানুষের কথার মধ্যে সব সময় কমান্ডিং ভাব থাকে। ধনী বলেই তারা চারিপাশের সবকিছুই নিজেদের কন্ট্রোলে রাখার কায়দা জানে। সেই কায়দা দিয়েই ভাবীও আমাকে বগলদাবা করে হোটেলের রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। রেস্টুরেন্ট ফাঁকা ছিল, একটা টেবিল দখল করে বসে পড়েছি। ভাবী, তার ছেলে, আমি আর কামাল ভাই। আমাদেরকে টেবিলে বসতে দেখেই রেস্টুরেন্টের কর্মচারী এগিয়ে এলেন, সে কী বাঙ্গালী নাকি কেরালার মানুষ বুঝার উপায় ছিল না। ইংলিশেই খাবারের অর্ডার দিচ্ছিলাম। কর্মচারী নিজের পরিচয় দিলেন বাংলাদেশের ছেলে বলে, নাম সালাম। আমাদেরকে কাছে পেয়ে খুব খুশী। আমি শুধু ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন কারী নিয়েছি, ভাবীর ছেলে নিয়েছে চার আইটেম, ভাবী তিন আইটেম, কামাল মিয়া আমার মতই দুই আইটেম। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই ভাবী সালামকে বললেন, বিল উনার স্বামীর নামে করতে। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল ভাবীর সিদ্ধান্ত শুনে। আমি সবিনয়ে বললাম, " ভাবী, আমার কাছে টাকা আছে, আমিই দিয়ে দেই বিল?"

-রাখেন তো, উনাদের উচিত ছিল, আমরা দুইজন মহিলা রয়ে গেছি, সাথে আমার ছেলে, কামাল মিয়া, সবার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে যাওয়া। আপনার ভাই এই দলের হেড, উনার নামেই বিল করেছি। উনারা আনন্দ ফূর্তি করতেছে আর আমরা এইখানে পেট শুকিয়ে বসে থাকবো, তা কি সম্ভব?"




বিকেলের দিকে উনারা ফিরে এসেছেন। উত্তম আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, দুপুরে কী খেলাম। ঘটনা বললাম, শুনে উত্তম বললেন, " তুমি বিল দিয়ে দিলেই ভালো করতে। থাক! ভাবী যা ভালো বুঝেছে তাই করেছে। তুমি তো একা ছিলে, উনারা তো তিন জন ছিল। কাজেই অসুবিধা নেই। চল, এবার গুছিয়ে নিতে হবে। আর এক ঘন্টার মধ্যে বের হতে হবে।"

আমি আগেই সব কিছু গুছিয়ে রেখেছিলাম। বললাম, " আমাদেরকে নিয়ে নৌভ্রমণে যাবে বলেছিলে। বাদ হয়ে গেল?"

-" আরে! এদের কর্ম কান্ড বুঝিও না। সবাইকে নিয়ে যাবে বলেই তো জানতাম। এত দূরে চলে গেছি, আমি একবার '---' ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি দেখি আর বেশী উৎসাহ দেখালেন না।"

-উনাদের তো উচিত ছিল, ফোন করে জানিয়ে দেয়া।


সব মালামাল গোছগাছ করে হোটেলের লাউঞ্জে এসে জড়ো হয়েছি সবাই। বিশাল দেহ নিয়ে দলপতিও এসেছেন। ভাবী তখনও এসে পৌঁছাতে পারেন নি। দলপতিকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। দলের একজন জানতে চাইলো, " ভাবী কোথায় '---' ভাই?

দলপতি জবাবে বললেন, " আরে! ভাবী আসবে, দেরী হবে। দুপুরে হোটেলের রেস্টুরেন্টে বসে ইচ্ছেমত খেয়েছে, বিছানা ছাড়তে সময় লাগছে।"

-আমি হেসে বললাম, '---' ভাই, ঠিক বললেন না, ভাবী খুবই অল্প খেয়েছেন, আসলে আজকে অনেক হেঁটেছেন, সেইজন্যই বোধ হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

আমাকে অবাক করে দিয়ে দলপতি বললেন, " খাইছেন তো আপনারা, বিলটা তো আমার নামে করছেন। চাইর জন মানুষের খাওয়ার বিল আমার নামে কইরা বইসা রইছে। হোটেলে ফিরা আসতেই রেস্টুরেন্ট থিকা আমার কাছে বিল পাঠায় দিছে। বিল দেইখা আমার মেজাজ গরম হইয়া গেছে"।

আমার মনে হচ্ছিল, ধরণী দ্বিধা হও, আমার বাড়ীতে কত মানুষ খায়, আমাদের সাথে কেউ  বেড়াতে বের হলে তার পুরো দিনকে আনন্দময় করে তুলতে আমি আর আমার উত্তম, দুজনেই হাত খুলে খরচ করি। আর এই লোকটা এতগুলো ভদ্রলোকের সামনে খাওয়া নিয়ে এমন খোঁটা দিচ্ছে!!! বললাম, " আমিই খাওয়ার বিল দিতে চেয়েছিলাম, ভাবীই আমাকে আটকালো। বললো, আপনারা আমাদের কথা ভাবেন নি, আমরা আপনাদের সাথে এসেছি, এখানে কাউকে চিনিনা, বাইরে কোথায় গিয়ে খাব তাও জানিনা। ভাবী অনেকটা রাগ করেই বোধ হয় আপনার নামে বিল করেছে। বললে এখনও আমি বিল দিয়ে দিতে পারি।"

- খুব গম্ভীর স্বরে বললেন, নাহ, আর দরকার নেই। আমি বিল শোধ করে দিয়ে আসছি।


বাকী সময় আমার মনটা খারাপ হয়ে ছিল। রাত আটটায় এয়ারপোর্টে যাওয়ার বাসে চড়লাম।





No comments:

Post a Comment