Wednesday, January 23, 2013

গেরস্ত সংবাদ (২)

 আমার উত্তম কুমারের সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিনটি যদি স্মরণ করি, এখনও চোখের সামনে দেখতে পাই ' আমেরিকা ফেরত আধুনিক রাজকুমার' কে। প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, মেদহীন ছিপছিপে গড়ণের রাজকুমারকে দেখেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছিল। রাজকুমার  নিজ সিদ্ধান্তে আমাকে বিয়ে করে ফেললো। আমিও নিজ সিদ্ধান্তে তাকে 'উত্তম কুমার' এর স্বীকৃতি দিয়ে দিলাম। উত্তম কুমার ছিল আমার স্বপ্নপুরুষ,  না-ইবা হলাম সুচিত্রা সেন,  উত্তম কুমারকে পাশে পেয়ে তখন নিজেকে সুচিত্রা সেনের চেয়েও এক ডিগ্রী বেশী ভাবতে শুরু করে কিছু ভুল করেছি বলে মনে হয় নি। সেই উত্তম কুমারকে নিয়ে ভালোয়-মন্দয় ( ভালোর ভাগ বেশী) সাতাশ বছর কাটিয়ে দিলাম।

সাতাশ বছরে সেদিনের রাজকুমারের চেহারায় অনেক পরিবর্তণ এসেছে। ছিপছিপে গড়ন ফিকে হয়ে গিয়ে পেটে এসে বাসা বেঁধেছে কিছু স্নেহ জাতীয় পদার্থ। ফলে প্রায় ছয় ফিট মানুষটিকে এখন যেনো আর ছয় ফিট মনে হয় না! গায়ের রঙ বেশ তামাটে হয়ে গেছে। ভাগ্যিস রাণীমা ( আমার শাশুড়ী মা) বেঁচে নেই, নাহলে  ছোট রাজকুমারকে দেখে উনি খুবই দুঃখ পেতেন। হয়তো বা সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপাতেন। বলতেন,

" মিঠু গো, আমার ছেলেটার দিকে তোমার কোন খেয়াল নাই। এমন রাজপুত্রের চেহারা ছিল আমার ছেলের,  চোখের সামনে নষ্ট হয়ে গেলো সব। তুমি নিশ্চয়ই ছেলেকে ' ব্যালান্সড ডায়েট দাও না'। ইদানিং তো শুনি, কত রকমের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দাবারের কথা বলে টিভিতে, তুমি কী সেটাও খেয়াল করো না?"

আমি বৌ মানুষ তো আর রাণীমার মুখে মুখে তর্ক করতে পারতাম না। ঝগড়াটে বৌ হলে হয়তো বলতাম,

" রাণীমা, আমার দোষটাই দেখলেন! আপনি কী জানেন যে আপনার রাজপুত্র ডিপার্টমেন্ট থেকে বাড়ী ফিরেই তার সিংহাসনে গিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসে! সিংহাসনের আশেপাশে তার সব কিছু রাখা আছে। টিভির রিমোট কন্ট্রোল, কফি মাগ, বাদাম ভর্তি বোয়াম, মুড়িভাজা ভর্তি টিন, চকোলেটসহ তার প্রিয় যাবতীয় জিনিসে ঠাসা হয়ে আছে সিংহাসনের চারিপাশ। ল্যাপটপটাও সাথেই রেখেছে। আগে আমি অনেক বলেছি, জিমে যেতে। আপনি তো জানেন না, ইউনিভার্সিটির জিমটা কী ভালো।  ছয় বছর আগে যাও বা জিমে নাম লিখিয়েছিল, সেখানে গিয়ে সে এক বুড়া প্রফেসারের সাথে গল্প জুড়ে দিত। কাজের কাজ কিছুই করতো না। এদিকে আবার ঠাট-বাট ছিল, একসারসাইজ করার উপযোগী টিশার্ট, ট্রাউজার, রানার শু ( বাংলাদেশে যেগুলোকে কেডস বলে), সবকিছু কিনে এনেছিল।  জোর করে পাঠাতে হতো জিমে, এইজন্য আমাকে সে 'ক্যাটক্যাটানি' বলতো। আপনিই বলেন,  আমি তার ভালোর জন্য বলতাম, আর সে আমাকে নাম দিয়েছে ক্যাটক্যাটানি! আমার শ্বশুরমশাই যদি আপনাকে এই নামে ডাকতেন, আপনার কেমন লাগতো! আপনি নিশ্চয়ই উনার উপর অভিমান করে সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতেন! আমিও তাই করেছি। কোনরকম ক্যাটর ক্যাটর করি না। জিমে গিয়ে যেটুকু মেদ ঝরেছিল, গত চার বছরে তা সুদে আসলে দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এসেছে। যদি আমার কথা বলেন, আমি কিন্তু রান্না বান্না ভালই করি। খাবারের মেন্যুতে শাক-সব্জী তো থাকেই।  তা শাক-সব্জী আবার উনার তেমন পছন্দ হয় না। ডাল, মাছ, মাংস হলে খুব খুশী।   রাণীমা, আরেকটি কথা বলি, আপনার রাজকুমার যখন যুবক ছিল, তখন ভাত খেতে চাইতো না, রুটি বেশী পছন্দ করতো।  কিন্তু ইদানিং  সে আটার রুটি পছন্দ করে না, রুটি থাকলেও সে ভাত খায়। আমি যদি  তিনজনের  জন্য ছয়খানা রুটি বানাই, আপনার পুত্র খায় মাত্র একখানা রুটি। ডিম খেতে হলে সেটাকে তেলে ভেজে খাবে, জল পোচ করে দিতে চাইলে, খাবেনা। রুটির বদলে যদি পরোটা বানায়ে দেই, তাহলে খাবে, সাথে চীজ ভর্তি ডিম ভাজা।  আগে ফলমূল খেতে পছন্দ করতো, এখন তার ধারে কাছে দিয়েও যায় না। তাহলে  এবার বলুন, কার দোষ বেশী"!


হ্যাঁ, আমার উত্তমের শরীরটা ইদানিং একটু ভারীর দিকেই যাচ্ছে। খুব শৌখিন এবং আরামপ্রিয় মানুষ উনি। আমাদের লিভিং রুমের এককোণে একখানি আরামদায়ক সোফা আছে।  সেই সোফাতেই তিনি দিনের অর্ধেকের বেশী সময় কাটিয়ে থাকেন। সোফাতে বসে টিভিও দেখেন, লেখালেখিও করে্ন।  টিভি সারাক্ষণ অন করাই থাকে। সিএনএন, বিবিসি, এবিসি, বাংলা সাতটি চ্যানেল  আছে টিভিতে। গত তিন বছর ধরেই চলছে তার এই আরাম-বিলাস।  আরামের সাথে যোগ হয়েছে 'ব্যারাম'। যেমন, সে চায়ের কাপে বিস্কুট না চুবিয়ে খেতে পারে না।  বিস্কুট চায়ে ভিজিয়ে অনেকেই খায়। এটা তেমন নিন্দনীয় কিছু নয়, ব্যারাম হচ্ছে, চায়ে ভেজানো বিস্কুট মুখে তোলার আগেই টপ টপ করে মেঝের কার্পেটের উপর পড়ে। চায়ে ভেজানো বিস্কুটের দাগে কার্পেটের একপাশ বিচিত্রবর্ণ ধারণ করেছে।  দেশে থাকতে আম খাওয়ার সময় একই চিত্র দেখা যেতো। মায়ের রাজপুত্র আম খাচ্ছেন, হাত বেয়ে আমের রসে চারদিক আঠা হচ্ছে!  মায়ের সর্বশেষ সন্তান বলেই এমন 'নাড়ু গোপাল' হয়েছে বোধ হয়!

এই আরাম কেদারায় বসা থাওকতে থাকতেই গত বছর জানুয়ারীতে তার লেখা একটি টেক্সট বই ( ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স)   ইংল্যান্ড থেকে পাবলিশড হয়েছে, এ বছর আরেকটি বই আমেরিকা থেকেই পাবলিশড হবে। বই লেখা নাকি খুবই জটিল কাজ, একমনে বসে লিখতে হয়। লেখার সময় বৌ, ছেলেপেলে এসে জ্বালাতন করলে লেখা এগোয় না। তাই আমরাও কোনদিন তাকে জ্বালাতন করিনি। সে বসে থাকে সোফার গভীরে, আমি বসে থাকি কম্পিউটার চেয়ারে। আমার চেয়ারটি আবার খটখটে শক্ত।  লেখায় মন বসাতে পারি না, পিঠে ব্যথা পাই। তাই বোধ হয় আমার লেখা এগোয় না। তবে আমি খুবই বুঝদার মানুষ। উত্তম আমাকে আগের মত সময় দিতে পারছে না বলে রাগ করি না, তবে মনে মনে ফন্দী আঁটি, কী করে উত্তমকে একটু টাইট দেয়া যায়! দুইদিন আগেই টাইট দেয়ার কায়দা পেয়ে গেছি।

আগেই বলেছি, আমি উত্তমের সাথে বেশী কথা বলে তাকে বিরক্ত করি না। তবে মাঝে মাঝে  তাকে নিয়ে দুই একটা বন্ধুর বাড়ী বেড়াতে যাই, তারও ভালোই লাগে সেখানে গিয়ে। শিক্ষক মানুষ, কথা বলতে জানে খুব ভালো।  সেখানে গিয়েও সে টিভিতে দেখা নানা অনুষ্ঠানের গল্প জুড়ে দেয়। সেই গল্প ওবামাকে নিয়েও হতে পারে, উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেনকে নিয়েও হতে পারে। মাঝে মাঝে ক্লিন্টনকেও ডাকে, ডঃ ইউনূসকে টানে। প্রায়ই দেখি ইটিভিতে দেখানো নানা নাটকের দৃশ্য বর্ণনা করে। বুঝি, টিভি তার বেশ ভালোই দেখা হয়। গত সপ্তাহে সে একটি ভিন্ন অনুষ্ঠানের কথা বলতেই আমি কান সজাগ করে ফেলেছি। কোন এক সেলেব্রিটিকে টিভিতে  স্বাস্থ্যকথায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এক জনপ্রিয় ডাক্তার 'ওজি' সেই অনুষ্ঠানের হোস্ট ছিলেন।   অনুষ্ঠানে দেহ থেকে  কী করে 'বেলী ফ্যাট' ঝরানো যায়, দর্শক-শ্রোতার মঙ্গলের কথা ভেবে ডাক্তার ওজি একটি ডায়েট চার্ট করে দিয়েছেন,

ব্রেকফাস্টে একখানা ডিম পোচ + এক কাপ দই
লাঞ্চে স্যালাড
আর্লি ডিনারঃ যাহা খুশী তাহা, তবে কার্বোহাইড্রেট কম।

পর পর দুই দিন  বন্ধুদের সাথে এই গল্প আমি তাকে করতে শুনেছি, পেয়ে গেছি সুযোগ। এত উৎসাহ নিয়ে যখন ডাক্তারের গল্প বলছে, তখন নিজেদের উপর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে দেখি, কেমন হয়!  আমি সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছি না, এভাবে খাওয়া দাওয়া করলে আমাদের দেহ থেকে অতিরিক্ত স্নেহ ঝরে পড়বে। দেখতেও ফিট থাকবো, অসুখ-বিসুখও কম হবে।

আমার কিচেনের খাদ্যভান্ডারে মাছ, মাংস, সব্জী বারো মাসই মজুত থাকে। এলোমেলোভাবে  খাওয়া হয়, ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ মোতাবেক খাওয়া হয় না। অনেক আগে  মেয়েরা যখন ছোট ছিল, আমিই ছিলাম সংসারের একমাত্র দন্ডমুন্ডের কর্ত্রী, তখন অনেক হেলথি ডায়েট চলতো আমার তত্বাবধানে। মেয়েরা বড় হতে তারাও মাতব্বর হয়ে উঠলো, বাবা পেয়ে গেলো মেয়েদেরকে, মেয়েরা পেলো বাবা কে। চোরে চোরে মামাত ভাইয়ের মত অবস্থা। আমি হয়ে গেলাম কোণঠাসা। শুধু ছোট মিথীলা আমার পক্ষে আছে। কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পেয়ে গতকালকেই আমি 'স্যালাড' এর জন্য বোনলেস চিকেন, কেইজ ফ্রী ডিম, লেটুস, টমেটো, শসা, লেবু, কমলা, আপেল, অ্যাভোকাডো, বেকড কটকটে ঝুরিভাজা কিনে এনেছি। আজ দুপুর বারোটায় আমার কাজের স্কেজিউল, ঘুম থেকে দেরী করে উঠবো বুঝেই কাল রাতেই চিকেন বেক করে রেখেছি। সকাল হতেই লেটুস, শসা, টমেটো কেটে সাজিয়ে রেখেছিলাম। মেয়োনিজের বদলে টক দই, লেবুর টুকরো রেখেছি। এভোকেডো ( এক ধরণের স্বাদহীন সব্জী বা ফল) টুকরো করে টমে্টোর পাশেই রেখেছি। নিজের জন্য স্যালাড সাজিয়ে নিয়ে গেছি। তাড়াহুড়ো করে রওণা দিয়েছি কাজে, পথে অনেক বড় ধরণের বিপত্তি ঘটেছে। সে অন্য গল্প, পরে বলা যাবে। রাত আটটায় বাড়ী ফিরে ভয়ে ভয়ে উত্তমকে জিজ্ঞেস করেছি, স্যালাড কেমন হয়েছিল। বলেছে,

" বেশ ভালো হয়েছে"।

ঐ পাশ থেকে মিথীলাও বলেছে, " স্যালাড খুব ভালো হয়েছে।"  আমি বললাম, তাহলে চলো, ডিনার করে ফেলি। জবাব এলো,

" আমি তো আর্লি ডিনার করে ফেলেছি"।

-বাবারে! তুমি তো দেখি ডঃ ওজির পরামর্শ শতভাগ মেনে চলছো। বৌ এত কষ্ট করে সব রেডী করলো আর বৌ এর জন্য একটু অপেক্ষা করতে পারলে না!!

-ঠিকমত ফলো না করলে তো রেজাল্ট পাওয়া যাবে না। তুমি এত কসরৎ করছো আমাকে স্লিম বানানোর জন্য, আমার তো উচিৎ তোমাকে সহযোগীতা করা। তাছাড়া দুপুরে এতগুলো ঘাস-পাতা খেয়ে সন্ধ্যে না হতেই খিদে পেয়ে গেছিল।

-খুব ভালো কাজ করেছো। একমাস অন্তঃত চলতে হবে এই নিয়মে, তবেই বুঝবো টিভি দেখার সার্থকতা কতটুকু!

No comments:

Post a Comment