Friday, January 18, 2013

শীতের আমেরিকা!

আমেরিকাতে সময়টা এখন শীতের মাঝামাঝি।  শীতের শুরুতে এখানে ভালোই লাগে, অনেকটা বাংলাদেশের শীতের মত, আকাশ পরিষ্কার থাকে, সারাদিন রোদে ঝলমল করতে থাকে চারদিক, সন্ধ্যে এগিয়ে আসে একটু তাড়াহুড়ো করেই। মাঝে মাঝেই গায়ে শীতকাঁটা দেয়, ক্লজেট থেকে গরম কাপড়-চোপর বের হতে থাকে একটা একটা করে। শীতের তীব্রতা অনুযায়ী শীতবস্ত্রের ব্যবহার চলে। অবশ্য আমেরিকানদের মধ্যে এর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তারা চল্লিশ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায়ও হালকা সোয়েটার পড়ে ঘুরে বেড়ায়। এখানে সর্বত্র একটি সার্বক্ষণিক সুবিধা আছে, নিজের বাড়ী, গাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, কারখানাসহ সর্বত্র তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থা আছে। ফলে শীত, গ্রীষ্ম কোথা দিয়ে আসে, কোথা দিয়ে চলে যায়, তা ভালো করে আঁচ করা যায় না।

আমেরিকার স্টেটের সংখ্যা হচ্ছে পঞ্চাশ। প্রতিটি স্টেটেই শীত আসে একই সময়ে, তবে শীতের তীব্রতায় থাকে পার্থক্য। যেমন আমেরিকার উত্তর দিকের রাজ্যগুলোতে শীত মানেই তুষারপাত এবং দক্ষিণী রাজ্যগুলোতে  তুষারপাত ছাড়াই হাড়কাঁপানো শীত। রাজ্যগুলোতে তুষারপাত না হলেও বৃষ্টিপাত হয়। আর সে বৃষ্টির পানির ফোঁটাতে কী ধার, গায়ে পড়লেই মনে হয়, ঠান্ডা একেবারে হাড়ের মধ্যে গিয়ে বিঁধেছে বুঝি। দক্ষিনী রাজ্যের মানুষগুলো উত্তর রাজ্যের মানুষদের থেকে এই একটি দিকে অনেকটাই যেনো পিছিয়ে আছে। এই রাজ্যে তুষারপাতের মত  দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক শোভা নেই, পরিবর্তে আছে টর্ণেডো, হ্যারিকেনের মত বিধ্বংসী ব্যাপার -স্যাপার। অনেকটাই আমাদের বাংলাদেশের মত অবস্থা। বাংলাদেশ নাম শুনলেই যেমন ইউরোপ-আমেরিকানদের ধারণা, সাইক্লোন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, তেমনি দক্ষিনী রাজ্য শুনলেই মনে হয়, টর্ণেডো আর হ্যারিকেনের কথা। কোন কোন বছর প্রকৃতি সদয় হলে, দক্ষিনী রাজ্যগুলোতেও এক আধদিন অল্প-স্বল্প তুষারপাত হয় বৈকি! তেমন ঘটনা ঘটলে রাজ্যবাসীদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ওয়েদার ফোরকাস্ট শুনে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে, কিভাবে সামাল দেবে আসন্ন তুষারবর্ষণকে। অযথাই তিনদিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় খাবার-দাবার মজুদ করার কাজ,  সাথে ফ্ল্যাশ লাইট, মোমবাতি, ওয়াইন,পাণীয় জল, সফট ড্রিঙ্ক, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে শুরু করে হেন জিনিস নেই যে কারো নজর এড়িয়ে যাবে। অফিসে, দোকানে খুব গল্প চলতে থাকে  আসন্ন তুষারপাত নিয়ে। একজন অন্যজনকে সাবধান করে দেয়, গাড়ী যেনো সাবধানে ড্রাইভ করে, রাস্তাঘাট আইসি (বরফ জমে পিচ্ছিল) হয়ে থাকার সম্ভাবণা, সাবধানে না চালালে গাড়ী স্লীপ কেটে চলে যাবে আরেক ট্র্যাকে, অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে--এমন ধরনের গল্প চলতেই থাকে।

 শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এক সপ্তাহ আগে থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস মনিটর করতে থাকে। শেষ মুহূর্তে হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা চাইই চাই। তুষারপাত তো আর সাধারণ কোন ঘটনা নয়, সারা শীতকাল ধরে শুধু অন্য স্টেটের তুষার বর্ণনা শুনতে হয়, এবার নিজেদের স্টেটেও তুষার ঝরছে, হোক তা অতি সামাণ্য, না হয় শাবল দিয়ে পরিষ্কার করার প্রয়োজন হলোই না, তবুও তো আকাশ থেকে ঝরছে ওরা, কেমন পেঁজা তুলোর মত! এটুকু জমে জমে যতটুকু হয়, তাই দিয়ে না হয় ছোট ছোট স্নোম্যান বানানো যাবে, তবুও তো তুষারপাত হচ্ছে। অনেকটাই যেনো জাতে উঠার প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার মত ব্যাপার।

আমেরিকায় শীতের শুরুতেই সকল গাছের পাতা ঝরে যায়, ন্যাড়ামুন্ডি গাছগুলো ডালা-পালা ছড়িয়ে দিয়ে শূণ্যদৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পত্রবিহীন গাছগুলোর দিকে তাকালে কখনওই মনে হয় না, যে ওরা আবার পত্রফুল্লশোভিত হয়ে উঠবে। যে সকল স্টেটে তুষারপাত হয়, ঐ সকল স্টেটে গাছের ন্যাড়া শাখায়  তুষার জমে জমে  অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়! দেখে মনে হয় প্রতিটি গাছে থোকা থোকা শ্বেতশুভ্র ফুল ফুটে আছে। টিভিতে ওয়েদার চ্যানেল থাকেআবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রতি ঘন্টায় আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়। আমেরিকার উত্তরের রাজ্যগুলোতে তুষারপাত মানেই সুন্দরের সাথে বাড়তি কিছু পরিশ্রম যোগ হওয়া। সারারাত যখন তুষার ঝড় হয়, আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় যেনো সারা আকাশজুড়ে সাদা চাদর উড়ে বেড়াচ্ছে। তুষারঝড় থেমে গেলে উড়ন্ত চাদরগুলোই যেনো ভূমিতে, বাড়ীর ছাদে, গাছের ডালে এসে নেতিয়ে পড়ে। চাদরের পরত জমে জমে বরফের পাহাড় হয়ে যায়। তাপমাত্রা থাকে শূণ্য ডিগ্রীর অনেক নীচে, ফলে তুষার জমে বরফ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবণা থাকে। একবার বরফ হয়ে গেলে, কখনও কখনও তা বিপদজনক হয়ে দাঁড়ায়। পথ চলতি পথিক পা পিছলে পড়ে কোমড় ভাঙ্গে, দূর্ভাগ্যবশতঃ কোমড় ভাঙ্গার পর্বটি যদি কারো বাড়ীর সামনের রাস্তায় ঘটে যায়, পথচারী সেই বাড়ীর মালিকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। নিজ বাড়ীর সামনের রাস্তা হলেও পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রতিটি বাড়ীর মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

কারণেই তুষারপাত শুরু হওয়ার আগেই মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ট্রাকে করে সারা রাস্তায় তুষার গলানো লবন ছিটানো হয়, প্রতিটি বাড়ীর মালিকেরা নিজেদের ড্রাইভওয়ে, পথচারী চলাচলের রাস্তায় একইভাবে লবন ছড়িয়ে দেয়। লবন ছিটানো রাস্তায় তুষার পড়ে সেটা আর বরফ হয় না, তার আগেই গলে যায়। ভারী তুষারপাত হলে গৃহস্বামীকে হাতে শাবল, কোদাল নিয়ে বের হতে হয়, কোদাল দিয়ে জমে থাকা বরফের পাহাড় ভেঙ্গে রাস্তা বের করতে হয়। খুবই কঠিন ও পরিশ্রমের কাজ এটা, কিন্তু করতেই হয়। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে জমে থাকা বরফ গলে পানি হয়ে যায়।


যতই কষ্ট হোক বরফ পরিষ্কার করতে, তারপরেও তুষারপাতের নান্দনিক দিকটিই অনেক বেশী আকর্ষণীয় মনে হয় প্রতিটি মানুষের কাছে। শীতকাল এগিয়ে এলেই সবার মাথায় প্রথম চিন্তা আসে, বছরের ক্রীসমাসটি কেমন হবে, হোয়াইট নাকি স্বাভাবিক? যে ক্রীসমাসে তুষারপাত হয়, সে ক্রীসমাসে সকলের মন আনন্দে পরিপূর্ণ থাকে। তাদের মনে হয়, স্যান্টা ক্লজ নর্থ পোল থেকে বুঝিবা তুষার নিয়ে এসেছে। তবে এ বছর শীত তেমন জোরালোভাবে আসেনি, অন্যবারের মত তুষারপাতও হয় নি। যেটুকু হয়েছে, তা অন্য বছরের তুলনায় অনেক কম। আবহাওয়ার গতি প্রকৃতি হয়তো বদলে যাচ্ছে, এখন তুষারপাতের পরিবর্তে বৃষ্টিপাত বেশী হয় শীতকালে। তারপরেও যে কটা দিন তুষারপাত হয়েছে, সেটাই বা কম কি!


তুষারপাতের বর্ণনা লিখতে গিয়ে নায়াগ্রা ফলসের কথা মনে পরে গেলো। নায়াগ্রা ফলসের নাম পৃথিবীব্যাপী সকলেই জানে। সারাবছর কত লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসে নায়াগ্রা ফলস দেখতে। নায়াগ্রা ফলস দুই দেশ থেকে দেখা যায়, আমেরিকা প্রান্ত এবং কানাডা প্রান্ত। দুই প্রান্তের মধ্যে আবার রেষারেষিও আছে, কেউ মনে করে, নায়াগ্রা ফলস আমেরিকা প্রান্ত থেকে বেশী কাছের মনে হয়, কারণ হাতের পাশ দিয়েই নায়াগ্রা বয়ে যায়, আবার কানাডাবাসী মনে করে ওদের প্রান্ত থেকে নায়াগ্রার আসল সৌন্দর্য্য দেখা যায়! সবার কথাই ঠিক, নায়াগ্রা নদী, যে যার সুবিধামত দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। সারাবছর নায়াগ্রা দেখা যায়, তবে শীতকালে যদি নায়াগ্রা ফলস দেখতে যাওয়া যায়, সেখানে গিয়ে অপূর্ব এক দৃশ্য দেখা যাবে। নায়াগ্রা ফলস যারা দেখেন নি, তাদের বুঝে নেবার সুবিধার্থে এটুকুই বলা চলে, নায়াগ্রা রিভারের জল ক্রমাগত বয়ে বয়ে একটা জায়গায় এসে সামনে চলার আর কোন পথ পায় না, পথ না পেয়ে হঠাৎ করেই যেনো নীচে পড়ে যায়। গভীর নীচে, অনেক গভীর সেই খাদ। যার তলদেশ দেখা যায় না। নায়াগ্রা নদীর নীচে পড়ে যাওয়ার ঘটনা থেকেই ‘নায়াগ্রা ফলস’ এর উৎপত্তি। নায়াগ্রা নদী যেখানে এসে পড়ে যাচ্ছে, তার চারপাশে নদীর লক্ষ লক্ষ জলকনা ছিটকে পড়তে থাকে। ফলে ঐ অঞ্চলের চারপাশ নায়াগ্রার জলে ভেজা থাকে। শীতকালে তাপমাত্রা শূণ্য ডিগ্রীর নীচে নেমে যায় বলে নায়াগ্রার ছিটানো পানি চারদিকে ক্রিস্ট্যাল তৈরী করে। সূর্য্যের কিরণ পড়ে সেই আইসি ক্রিস্ট্যালগুলো থেকে রঙধনুর সাতরং বিচ্ছুরিত হয়। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করেও শত শত পর্যটক ওখানে গিয়ে ভীড় করে, এই দৃশ্য দেখার জন্য। চারদিক বরফ হয়ে গেলেও নায়াগ্রা থামে না, বয়ে চলে, চলতে চলতেই শেষ পর্যন্ত সেই অতল গভীরে ঝাঁপ দেয়।

এক সময় শীত কেটে যায়, তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। তুষারপাত কমে আসতে আসতে এক সময় থেমে যায়। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়। শীতে কুঁকড়ে থাকা মানুষ হাত-পা খুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে নতুনভাবে দিন শুরু করে। উত্তর রাজ্যের মানুষ আগামী শীতের আগ পর্যন্ত বেশ ঝরঝরে থাকে, আর দক্ষিণ রাজ্যের মানুষ অপেক্ষা করে, সামনের শীতে যেনো আরেকটু বেশী স্নো হয়, বাচ্চাগুলো যেনো ভালো করে একখানা স্নোম্যান বানাতে পারে।

1 comment:

  1. অনেক ভাল লাগলো পরে। অনেক তথ্য বহুল।

    ReplyDelete