Friday, January 4, 2013

কষ্টগুলো ফিরে ফিরে আসে!

আজ সন্ধ্যায় আমাদের এক জুনিয়ার বন্ধুকে দেখতে বাড়ী থেকে মাত্র বের হয়েছি।  বন্ধু বললেও ওদের স্বামী-স্ত্রীকে ছোট ভাই-বোনের মত স্নেহ করি।  ওরাও আমাকে 'দিদি' বলে সম্বোধন করে। পনেরো দিন আগে ছোট ভাইটির একটি মাইনর অপারেশান হয়। মাইনর বলছি কারণ,  যদিও ফুল এনেসথেসিয়া ব্যবহার করেই অপারেশান হয়েছে , তারপরেও যেদিন অপারেশান হয়েছে, সেদিনই হসপিটাল থেকে ওকে  রিলিজ করে দিয়েছে। ক্রীসমাসের ছুটিতে  আমার মেয়েরা বাড়ী এসেছে, আমার কাজিন এসেছে বেড়াতে, তাই বন্ধুটিকে দেখতে যাওয়ার সুযোগ হয় নি। ২৩শে ডিসেম্বার  আমার বাড়ীতে ওদের নিমন্ত্রণ ছিল, কিন্তু ছোট ভাইটি তখন ডাক্তারের নির্দেশে হাঁটাচলা বন্ধ রেখেছে। তাই নিমন্ত্রণে ওরা  আসতে পারেনি।  তবে ওদের ছোট্ট মেয়েটিকে পাঠিয়েছিল আরেক বন্ধুর সাথে।

 বিদেশে আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের স্বজন, একজনের সুখেও থাকি, বিপদেও থাকি। তা আমাদের ছোটভাইসম বন্ধুটির অপারেশান হওয়ার সংবাদে একটু চিন্তিত হয়েছিলাম, তবে অপারেশান শেষে ঐদিনই সে বাড়ী ফিরে আসায় অনেকটাই নিশ্চিন্ত বোধ করেছি। নিজে ব্যস্ত ছিলাম চাকুরী আর মেয়ে-বোনকে নিয়ে। ৩১শে ডিসেম্বার ছিল আমার স্বামীর জন্মদিন,  ওরা আমার ফোনে কল করেছিল, তাদের দাদাটিকে বার্থ ডে উইশ করার জন্য। বার্থডে উইশ করেছে, আরও কিছু টুকিটাকী কথার ফাঁকে আমিও ভাইটির শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতেই জানলাম, আগের রাতে ওকে হসপিটালের ইমার্জেন্সীতে নিতে হয়েছিল। কারণ, ওর ক্ষতস্থানে ইনফেকশান হয়ে গেছে। জানলাম, ডাক্তার এন্টিবায়োটিক ইনজেকশান দিয়েছে। ব্যস! আবার নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম।

আজ গাড়ীতে বসেই ওদের ফোন করলাম। মেয়েটির ফোন অফ আছে দেখে ছোট ভাইয়ের নাম্বারে কল দিতেই সে ফোন ধরে বললো,
-আমি তো হসপিটালে আছি।
-হসপিটালে আছো মানে! সেদিন যে হসপিটাল থেকে ফিরলে!
-না মিঠু'দি, আমাকে ওরা ভর্তি করে নিয়েছে, ইনফেকশান খুব মারাত্মক হয়েছে, পরশুদিন আরেকটি অপারেশান হয়েছে।
-কী বলো! আরেকটা অপারেশান হয়েছে! আমেরিকাতেও ইনফেকশান হয়? দ্বিতীয়বার অপারেশান লাগে! তাহলে আমাদের দেশের সাথে তফাৎ রইলো কোথায়! ঠিক আছে, আমরা হসপিটালেই আসছি।


আমার এই ভাইটি খাওয়াতে ভালোবাসে, খেতেও খুব ভালোবাসে। এটা ভেবেই ওর জন্য পুডিং বানিয়েছিলাম, পুডিং এর ট্রে সহই হসপিটালে চলে গেলাম। সন্ধ্যা সাতটায় ওখানে পৌঁছে দেখি, চারদিক শুনশান নীরব। পার্কিং লটে গাড়ী পার্ক করা আছে, কিন্তু একটিও মানুষ নেই কোথাও। আমি আর আমার স্বামী গিয়েছিলাম, নীরব পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে হসপিটালের বিশাল বিল্ডিং এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার অজান্তেই কিছু একটা অস্বস্তি আমাকে ঘিরে ধরছিলো। প্রথমে বুঝতে পারিনি। শীতের সন্ধ্যায় বেশীক্ষণ বাইরে না থেকে চট করে ঢুকে গেছি হসপিটাল বিল্ডিং এর ভেতর।

বাঁপাশে রিসেপশান কাউন্টারে কেউ নেই, ছোট ভাইয়ের ফোনে কল দিয়ে জেনে নিলাম রুম নাম্বার। দোতলায় একটি রুমে ও আছে। লিফটের দরজা খুলে যেতেই দু'জনে ঢুকে গেলাম। এবার আমার কাছে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো। গত তিনটি মাস ধরে মনের ভেতর বয়ে বেড়ানো কষ্টগুলো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইলো। গত অক্টোবার মাসের চার তারিখ সকালেই আমি ঢাকার একটি আধুনিক হাসপাতালের লিফটে উঠেছিলাম।  সময়ও মিলে যাচ্ছে, আমাদের তিন তারিখ সন্ধ্যা মানেই বাংলাদেশে চার তারিখ সকাল। আমার মা' ছিলেন ঐ হসপিটালের আইসিইউ তে।

এখানে লিফটের দরজা খুলতেই বিশাল চওড়া করিডোর, রুম নাম্বারগুলো তীর চিহ্ন দিয়ে নির্দেশিত আছে, নাম্বার ধরে ধরে এগোচ্ছি আর তিন মাস আগের স্মৃতির সাথে মেলাচ্ছি। বুকটা ভারী হয়ে আসছিল, সেদিনের সকালবেলা যেনো ফিরে এসেছে, অন্যরূপে, অন্যখানে। এখানে করিডোর জনমানব শূণ্য, বাংলাদেশে করিডোর ভর্তি রোগীর স্বজন। সকলের চোখে মুখে উৎকন্ঠা, কারো চোখে অশ্রু, কেউ তার পাশের জনের কাঁধে শোকার্ত মাথা দিয়ে দাঁরিয়ে বা বসে আছে। এরই মধ্যে কেউ কেউ ক্যান্টিনে যাচ্ছে চা-কফি পান করতে, কাউকে ছুটতে হচ্ছে ব্লাড ব্যাংকে। আমি কী করেছিলাম!


ভোর সকালে প্লেন থেকে নেমেছি, সম্পর্কে দাদা হোন, উনিই আমাকে এয়ারপোর্টে আনতে গেছিলেন। আমি তখনও জানি, মা কেবিনে আছেন, আমি পৌঁছালে হয়তো উনাকে আরেকবার অপারেশানের জন্য ওটিতে নেয়া হতে পারে। দাদার গাড়ীতে উঠেই আমি প্রথম যে কথাটি বলেছিলাম,
-দাদা, এখান থেকে সরাসরি হসপিটালে চলেন। আমার স্যুটকেসসহ আমি হসপিটালে যেতে চাই। মা বোধ হয় আমার জন্য অপেক্ষা করছে, আজ থেকে আমি মায়ের সাথে কেবিনেই থাকবো। কাজেই আমার স্যুটকেসটাও ওখানেই থাকবে।

-বৌদি, মাসীমাকে তো আইসিইউতে রাখা হয়েছে।

-আইসিইউ তে রাখা হয়েছে কেন? কী হয়েছে মায়ের?

-উনার একটা মেজর অপারেশান হয়েছে, কালকেই হয়েছে, সেজন্যই আইসিইউ তে রাখা হয়েছে।

-তাহলে যে আমাকে বলা হয়েছিল, আমি আসার পর সিদ্ধান্ত হবে অপারেশানের ব্যাপারে! মা'কে তো তাহলে জ্ঞানে পাব না।

-আগে চলেন আমাদের বাড়ীতে, একটু ফ্রেশ হয়ে নিবেন, তারপর না হয় হসপিটালে যাবেন।

সেই থেকে শুরু। আমার হতভম্ব হওয়ার পালা, হতভম্ব হওয়ার যন্ত্রণা যে কী ভীষন কষ্টের, প্লেনের ক্লান্তিকর জার্নি কী এক আশায় কাটিয়ে দিলাম, মায়ের সাথে শেষবারের মত আরেকবার কথা বলবো, মা'কে দুইটা দিন যত্ন করবো, সারা জীবনে আমার মা কারো কাছ থেকেই সেবা নেন নি, সেই মা'কে দুইটা দিনের জন্য হলেও ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাব, কিচ্ছু খেতে পারে না মা, আমি ড্রপার দিয়ে দিয়ে একটু একটু করে খাওয়াবো, জল জল বলে চীৎকার করে, ডাক্তারের নিষেধ আছে বলে কেউ মা'কে একটু জল দেয় না, আমি গিয়ে আঙ্গুলের ফোঁটায় মার শুকিয়ে যাওয়া জিভটা ভিজিয়ে দেবো। কত কিছু করবো, কত কিছু করবো, আমার ভাইগুলো মায়ের জন্য জীবন দিচ্ছে আর আমি মেয়ে বলেই কিছু করতে পারবো না, তাই কি হয়! ছেলে প্রসবের একই কষ্ট পেয়েই তো মা আমাকেও পৃথিবীতে এনেছেন, ঈশ্বর কি আমাকে মায়ের সেবা করার এতটুকু সুযোগও দিবেন না?

দাদা বলে চলেছেন, " জানেন তো, আপনি যদি আমাদের বাড়ী না যান, মাসীমার কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো। কালকে আপনার শাগরেদ ( উনার মেয়ে) গেছিল দিদাকে দেখতে, দিদা ওকে বলেছে, " টুম্পা শোন, কাল সকালে তোমার মামী যখন আসবে, সরাসরি হাসপাতালে না এনে মামীকে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবে। হাত-পা ধুয়ে জামাকাপড় চেঞ্জ করা হলে আগে কিছু খেতে দিবে, তারপর আমার কাছে নিয়ে আসবে"।

-দাদা, মা যখন কথাগুলো বলেছিল, তখন ভাবে নি যে উনি আইসিইউতে থাকবেন। এখন তো মা দেখতেও আসবে না, জানতেও পারবে না, তার মেয়েটা এসে পৌঁছেছে। আমি এখন আর আপনাদের বাসায় যাবো না, আমাকে আমার মামার বাসায় নামিয়ে দিন। ওখানে আমার ভাই আছে, ভাইটার সাথে আগে দেখা করি। তারপর হসপিটালে যাব। অবশ্য হসপিটালে গিয়েই বা কি হবে, মা'কেই তো দেখতে পাবো না।

-না, ডাক্তারের কাছে বলে আপনার জন্য স্পেশ্যাল পারমিশান নিয়ে রেখেছি, আপনাকে আইসিইউ তে ঢুকতে দিবে।

আমি জানালার দিকে মুখ ফিরিয়েছিলাম। একটা ময়লা রঙের ট্রেন ঢাকার দিকে ছুটে যাচ্ছে, আকাশটাও কেমন ঘোলাটে রঙ ধরে আছে। মাত্র দুই মাস আগেই এই রাস্তা ধরে কতবার আসা যাওয়া করেছি, তখন মনে ছিল আনন্দ, আমার মা-বাবা, ভাই, আত্মীয়-স্বজনে ঘিরে ছিলাম, আমার মেয়ের বিয়েতে কত আনন্দ হলো, আমার মা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নাতনীর বিয়ে দিলেন, সেই মা মাত্র দুই মাসের ভেতর ইউটেরাস ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন, বড় বড় ডাক্তারের পরামর্শে কত সাহসের সাথে অপারেশান টেবিলে গিয়ে ইউটেরাস অপসারণ করিয়ে এলেন, অপারেশানের পর কত খুশী, ফোনে কতবার সেই গল্প করেছেন! আর আজ, মাত্র দুই মাসের মধ্যে মায়ের এমন করুণ পরিনতি! বেঁচে থেকেও বেঁচে নেই! মায়ের সাথে শেষ কী কথা হয়েছিল আমার?

মা'কে বলেছিলাম, " মা আমি আবার আসি?"
জবাবে খুব ক্লান্তস্বরে মা বলেছিল, " কী হবে এসে? কোন লাভ তো নাই। তুই তো আর ডাক্তার না, ডাক্তারের চিকিৎসা চলছে, মাত্র দুই মাস আগেই এত টাকাপয়সা খরচ করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে গেলি!

-মা, আমার যে মন মানে না। তোমার এতো কষ্ট হইতেছে, কিছুই খেতে পারো না, তোমার জন্য ভিটামিন মিল্ক নিয়ে আসবো। এক প্যাকেট খেলেই অনেক পুষ্টি হবে শরীরে।

-মিথীলাকে একা ফেলে আসবি ওর বাবার উপরে, এটা কি ঠিক?

আমার সেই মা, সেই মা মারা যাচ্ছে? দুই চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল পড়ছিল। পাশে বসে দাদা খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। মাস ছয়েক আগেই উনার মায়ের মৃত্যুর কথা বলছিলেন। আমার কোন কথাই কানে ঢুকছিল না, অথবা কোন কিছুতেই আমি সান্ত্বনা পাচ্ছিলাম না। আমি মায়ের একটা মাত্র মেয়ে, আমার নিজের যখন তিনটি মেয়ে হয়েছিল, এই মা আমাকে সাহস দিয়েছিলেন, বলেছিলেন  "তোর একেকটা মেয়ে একেকটা রত্ন। তোর মেয়েরাই তোর ছেলের দুঃখ ঘুচাবে।" সব মনে পড়ছে, আর দুই একদিনের ভেতর মা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, আর কেউ থাকবে না আমাদের পাশে, যে সব সময় নীতিশিক্ষা দিয়ে যাবেন, যিনি সব সময় আমাদের সাথে শাসনের সুরে কথা বলবেন।

গাড়ী এসে পৌঁছালো মামার বাড়ী। ঘন্টা দুই বিশ্রাম নিলাম, এর মধ্যেই শুনলাম, হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে, মায়ের জ্ঞান ফিরেছে। অবাক কান্ড, মায়ের ব্লাড প্রেসার ফল করেছে, কিডনী ফেল করেছে, পেট ওপেন করে ইন্টেসটাইন থেকে ডাক্তার প্রায় দেড় ফুট কেটে ফেলে দিয়েছে ( ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছিল)। কাঁধের কাছে চ্যানেল তৈরী করে দুই তিনটি নল ঢুকিয়েছে প্রয়োজনে খাবার দেয়ার জন্যে। আর ইউটেরাস অপারেশানের ক্ষত তো ছিলই। এই মানুষটির জ্ঞান ফিরে এসেছে, অবাক কান্ডই বটে।

আমি আর আমার মেজোভাই গেলাম হসপিটালে। এই প্রথম লিফটে উঠেই খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল আমার সব হারিয়ে গেছে। লিফট থেকে বের হতেই দেখি একটি কক্ষের দরজা ঘিরে প্রচুর চেয়ার পাতা, সেখানে মানুষে ভর্তি। আমার বুক কাঁপছিল, মেজদা আমাকে নিয়ে সেই কক্ষের বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে রিসেপসনিস্টকে বললো, আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়ার স্পেশ্যাল পারমিশানের কথা। শুধুই আমাকে ঢুকতে দিবে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেজদার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুক মুচড়ে উঠলো। গত দুই মাস আমার মেজ ভাই আর ছোট ভাই মা'কে কোলের উপর রেখে যত্ন করেছে। আর আজ মায়ের জ্ঞান ফিরেছে অথচ সে দেখতে পাবে না মা'কে, তা-কি হয়! প্রয়োজনের সময় আমি আমার আবেগ কাজে লাগাই। রিসেপশনিস্ট ছেলেটিকে বললাম, আমি প্লেন থেকে নেমেই হসপিটালে এসেছি, মা'কে কী অবস্থায় দেখবো, হয়তো সহ্য করতে পারবো না, কাজেই আমার ভাইকেও সাথে নিয়ে যেতে চাই।

আমার চেহারার মধ্যে অনেকেই নিজের মা, বোনকে খুঁজে পায়, সেই রিসেপশনিস্ট ছেলেটিও পেয়েছিল। ঐ মুহূর্ত থেকে বাকী পাঁচদিন ছেলেটি আমাকে অনেক বেশী সাহায্য করেছিল, এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার সাথে সাথে কাঁদছিল। আমাদের ভাই বোনকে সেই ছেলেটি তার ভান্ডার খুলে দুটো অ্যাপ্রন এনে দিয়েছিল। দুই ভাই বোনে হেঁটে হেঁটে মায়ের রুমের কাছে আসতেই কাঁচের জানালার বাইরে থেকে মায়ের বিধ্বস্ত দেহটি দেখা যাচ্ছিল। আমি তো জানতাম, মা খুব অসুস্থ, মা হয়তো আর বাঁচবেন না, তারপরেও কী মা'কে এমন করুণ চেহারায় দেখবো ভেবেছিলাম! দুই ভাই বোন মায়ের শয্যা পাশে দাঁড়িয়েছি, মেজদা অনবরত চোখ মুছে চলেছে, আমি ইশারায় কাঁদতে না করে মা'কে ডাকলাম,

'মা, ও মা, মাগো! আমি আসছি।

চেতনার কোন অতল গহ্বর থেকে আমার  মা জেগে উঠলেন, আমার দিকে তাকালেন, দুই তিন সেকেন্ড, কাঁদতে শুরু করলেন। আমি কিন্তু নিজেকে শক্ত রেখেছি, একটুও কাঁদিনি, মায়ের মাথায় হাত বুলিয়েছি আর বলেছি,

" মা তুমি কাঁদো কেনো? তুমি কত সাহসী। এতবড় অপারেশানের পর তোমার সাথে সাথে জ্ঞান ফিরে এসেছে, ডাক্তার বলেছে তুমি ভালো হয়ে যাবে। এই তো আমি চলে এসেছি, আর কোন চিন্তা নেই"।

আমার কথায় মা বোধ হয় একটু ভরসা পেয়েছিলেন, কান্না থেমে গেছিল, মাথায় হাত বুলাতেই শান্ত হলেন। বেশীক্ষন ওখানে থাকতে দেয় নি। দশ মিনিট পরেই মা'কে বুঝিয়ে বলেছি, আইসিইউ তে আমাদের থাকতে দিবে না, ইনফেকশান হয়ে যেতে পারে, তাই আমরা মায়ের রুমের খুব কাছেই বাইরে বসে আছি। মা খুব খুশী হয়েছে, বাচ্চা মেয়েদের মত মাথা কাত করে আচ্ছা বলেছে।


কাকতালীয়ভাবে আজকেই আমি মায়ের শাড়ী, শাঁখা-পলা, চুড়ি গুছিয়ে রাখছিলাম, কান্নাকে সব সময় দমন করা যায় না, করা উচিৎও না। মা নেই, তাঁর কথা মনে করে কাঁদবোনা, তা কি হয়! খুব কেঁদেছি। খুব কেঁদেছি। তারপর তো সন্ধ্যাবেলা নিয়তি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। যে স্মৃতিকে মনের গহীনে চাপা দিতে চাইছি, সেই স্মৃতিই আবার নিজে থেকেই ফিরে ফিরে আসতে চাইলে আমি কী করতে পারি! আজকের কথাই ধরি না কেনো, আমি যাচ্ছিলাম ছোট ভাইটিকে ওর বাড়িতে গিয়েই দেখতে, আমি তো জানতামও না, বেচারা আবার হসপিটালে ভর্তি হয়েছে!

আমার ছোট ভাইটিকে দেখে এসেছি, খুব ভালো ছেলে। ওর কাছ থেকেই শুনলাম, ভীষন কষ্ট অপারেশানের ক্ষততে, আহারে! বলেছি, "বছরের শুরুটা বাজে হয়েছে, তোমার সারা বছর ভালো কাটবে"।


৪ঠা অক্টোবারঃ

ঢাকা এসে পৌঁছেছিলাম অক্টোবারের চার তারিখ সকালে। মিসিসিপি থেকে রওনা হয়েছিলাম আমেরিকার ২ তারিখ সকালে। মিসিসিপি এমনই এক অবস্থানে আছে, সেখান থেকে বের হতে গেলে দুই তিনবার প্লেন বদলাতে হয়। ফলে মিসিসিপি থেকে ঢাকা পৌঁছাতে প্রায় ৩২ থেকে ৩৬ ঘন্টা লেগে যায়। দেশে যাওয়ার পথে এই দীর্ঘ জার্নি ক্লান্তিকর মনে হয় না, দেশে যাচ্ছি, এটা ভাবলেই কষ্টগুলোকে কষ্ট মনে হয় না। নাহলে, দুই তিনবার প্লেন পালটানো, হ্যান্ড লাগেজ টেনে টেনে দৌড়ানো, একবার ট্রেন ধরো, আরেকবার বাস ধরো, বাঙ্গালীর লাগেজও তো ছোটখাটো হয় না, একটি মাত্র হ্যান্ড লাগেজ বহন করা যায়, সেই জায়গায় আমি মাথা প্রতি 




No comments:

Post a Comment