Tuesday, January 22, 2013

কো-ইনসিডেন্স!

 আমার তিন মেয়ে তিন স্টেটের তিন শহরে  থাকে,  বড় দুই মেয়ে আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকলেও ছোট মেয়ে আমাদের সাথে আছে। আজ ছিল মার্টিন লুথার কিং ডে!  কাকতালীয়ভাবে  তিনজনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আজ ছুটি ছিল। আমার স্বামী অধ্যাপনা করেন, তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছুটি ছিল। বাকী রইলাম আমি। আমি চাকুরী করি ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে। এখানে কখনওই সরকারী ছুটির নিয়মে ছুটি হয় না, এমনকি রেগুলার উইকএন্ড বলেও কিছু নেই।  ওয়ালমার্টের নিজস্ব শিডিউল জেনারেটিং সিস্টেমে সকলের  জন্য সপ্তাহে দুইদিন অফ ডে নির্ধারিত হয়। সেই অটো স্কেজিউল (শিডিউল) জেনারেটিং সিস্টেমে  আজকের দিনটি আমার অফ ডে হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে তিন সপ্তাহ আগে। আমার ছোট মেয়ে আমাদের সাথে আছে।  তাই মার্টিন লুথার কিং ডে'তে আমাদের তিনজনের ছুটি পাওয়া, এটা একটি কো-ইনসিডেন্স ছাড়া আর কিছুই না।

যেহেতু  কাকতালীয়ভাবে আমাদের তিনজন একসাথে ছুটি পেয়েছি, চেষ্টা করেছি দিনটিকে উপভোগ করার জন্য। অনেক আগে যখন তিন মেয়েই আমাদের সাথে ছিল, আমিও চাকুরী করতাম না, তখন প্রায়ই আমরা পাঁচজনে মিলে আউটিং-এ চলে যেতাম। দুই বা তিন দিনের ছুটিতে চলে যেতাম অন্য কোন স্টেটে, সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্র আমার ভীষন প্রিয়। সাঁতার জানিনা, তবুও সমুদ্র আমায় টানে। দুই মেয়ে পড়াশোনার কারণে এখন অনেক দূরে থাকে, তাই আগের মত আর বেড়ানো হয় না। ছোট মেয়েটি কিছুটা নিঃসঙ্গভাবে বড় হচ্ছে। কী মনে হতেই আজ বেড়িয়ে পড়েছিলাম শহর থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরের এক রিসর্টে।

 রিসর্টের নাম ' লেক টিয়াকু খাতা'। ভারী সুন্দর এই রিসর্টটি। একটি লেক, তার চারিপাশের সবুজ গাছপালা, লেকের উপর ঘুরে বেড়ানো রাজহাঁসের ঝাঁক, লেকের পাড়ে ভ্রাম্যমান বাড়ী, রেস্টুরেন্ট, সে এক মনোরম পরিবেশ! ওখানে পৌঁছেই মন ভালো হয়ে গেলো। গাড়ী থেকে নামতেই শীতের কনকনে হাওয়ায় দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক করছিলো, তবুও ভালো লাগছিল। আজকে আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার। মেয়ে মিথীলাকে নিয়ে লেকের ধার ঘেঁষে হাঁটি, নানা পোজে ছবি তুলি, রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুঁ মেরে দেখি, এমনই সব এলোমেলো খেলা চলছিল মা আর মেয়েতে। মেয়ের বাবা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে প্রকৃতি উপভোগ করছিলেন। আমার ছোট মেয়েটা একা থেকে থেকে একটু শান্তই হয়ে গেছে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অশান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। বললাম,

-সামারে আমরা আবার আসবো। নাহলে মাসখানেক পরেই আবার আসবো, তখন ঘরের থেকেই খাবার নিয়ে আসবো। এখানে নিজের পছন্দমত জায়গায় বসে খাবার খাব।

-হ্যাঁ, রাইস কুকার নিয়ে এসো, আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ আর ভাত রান্না করতে পারবে ( হি হি হি হি)!

-মিথীলা, তুই এত ফাজিল হয়ে গেছিস? রাইস কুকার আনবো কেনো? আমি কী স্যান্ডুইচ বানাতে জানিনা?

-তুমি তো ভাত ছাড়া কিছু খেতে ভালোবাসো না, তাই রাইস কুকারের কথা বলেছি। ( হি হি হি)

-ভালো হয়েছে, আমি বাঙ্গালী মানুষ, ভাত পছন্দ করি।

-স্যান্ডুইচ কিন্তু আমি বানাবো।

-ঠিক আছে, বানাবি। ভালো করে বানাতে হবে, নাহলে খাব না।


ঘন্টাখানেক শীতের 'টিয়াকু খাতা' লেক রিসর্টে কাটিয়ে আবার পথে নামলাম। পরের গন্তব্য 'মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট ' লা রোডেরো'। রাস্তার ধারেই রেস্টুরেন্ট, ঢুকে গেলাম। বেলা দুইটার পর আমেরিকান রেস্টুরেন্ট খোলা থাকেনা, ব্যতিক্রম শুধু চাইনীজ, মেক্সিকান আর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলো। 'লা রোডেরো' তে ঢুকে ভালোই লাগলো। স্বল্প পরিসরে বেশ ছিমছাম করে সাজানো। লাল শার্ট, কালো প্যান্ট পরিহিত মেক্সিকান যুবকেরা খাবারের অর্ডার নিচ্ছে, খাবার সার্ভ করছে। আমরা টেবিলে বসতেই একজন সুদর্শণ ছেলে এসে স্প্যানিশ অ্যাকসেন্টে  'হেলো' বলেই মেন্যু বুক ধরিয়ে দিল। এর বেশী ইংলিশ ওরা বলে না। 'হ্যালো, থ্যাঙ্ক ইউ আর বাই বাই' -এই তিনটি শব্দ দিয়েই ওরা ওদের ব্যবসা খুব ভালোভাবে চালাচ্ছে। ওরা ইংলিশ না জানলেও কাস্টমারকে খাবার খাইয়ে সন্তুষ্ট রাখে। প্লেটে খাবারের পরিমান এত বেশী থাকে যে কাস্টমার তার খাবারের বাকী অংশ প্যাকেট করে বাড়ী নিয়ে গিয়ে আরেকবেলা চালিয়ে দিতে পারে। ওখানে আমরা খাওয়া দাওয়া করলাম খুব তৃপ্তি নিয়ে। খাওয়া শেষ হতেই আবার পরবর্তী গন্তব্যের দিকে ছুটলাম। সারাপথ গাড়ীতে বাংলা গান বাজছিল, সিডি প্লেয়ারে। যেই মুহূর্তে ইন্দ্রানী সেনের কন্ঠে " আজ আবার সেই পথেই দেখা হয়ে গেলো" বাজছিল, মিথীলা বলে উঠেছে,

" এই একটা গান সারা পথ বাজছে, বার বারই একই গানই শুনছি"।
মিথীলা বাংলায় কথা বলে, তবে ওকে মাত্র দুই বছর বয়সে এখানে নিয়ে এসেছি বলে বিস্তারিত বাংলা শিখে উঠতে পারেনি। তাই বাংলা আধুনিক গানগুলোর সুর বা প্যাটার্ণ ওর কাছে একরকম মনে হয়। ওতো বাংলা গানের কথা ফলো করেনা, ব্যাপারটা আমার মাথায় আটকে গেলো। আমি ওকে বাংলা পড়তে শিখিয়েছিলাম, এক সময় ও খুব ভালোভাবে বাংলা পড়তে পারতো, নিজে নিজে লিখতেও শিখেছিল। অনভ্যাসে বিদ্যাহ্রাস হয়েছে। আমি এখন ওকে নিয়ে আর বসতে পারি না, তবে মাঝে মাঝেই পেছন পেছন ট্যাকর ট্যাকর করে যাই, " মিথীলা, একদিন তোকে ধরবো আমি, অনেক কষ্ট করে বাংলা পড়া শিখিয়েছিলাম, যদি ভুলে যাও, তোমার খবর করে ছাড়বো"। হুমকী শুনে হয়তো বা কোন একটা ছড়া ছবির বই বের করে পুরানো মুখস্ত ছড়া না দেখেই গড়গড়িয়ে পড়ে যায়। আমি সবই টের পাই, তাই হুমকী অব্যাহত রাখি। আজকে গান সম্পর্কে ওর মন্তব্য শুনে মন খারাপ হয়েছে। ভেবেছি, পরে ওকে বুঝিয়ে বলবো।

শাহীন-নিশো আমাদের সকলের কাছেই খুব প্রিয়। এই মুহূর্তে শাহীন তার পিএইচডি রিসার্চ পেপার নিয়ে ব্যস্ত, নিশো ব্যস্ত তার ইউএসএমএলই পার্ট টু পরীক্ষার প্রিপারেশান নিয়ে। অনেকদিন ওদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই, আগে যখনই মন চাইতো, হয় ওরা চলে আসতো আমাদের বাড়ীতে, নাহয় আমরাই চলে যেতাম ওদের বাড়ীতে। লেক টিয়াকু খাতা যে পথ দিয়ে গেছি, সেই পথেই মিসিসিপি স্টেট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস টাউনে ওরা থাকে। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, বাড়ী ফেরার পথে ওদের সাথে দেখা করবো, ওদের বাড়ীতে এক কাপ চা খাব। যেই ভাবা সেই কাজ, পথে ওদের বাড়িতে নেমেছি। শাহীন-নিশো অতিথিপরায়ণ, আমাদের পেয়ে ওরা খুশী হয়েছে। প্রায় চার ঘন্টা ওদের সাথে আড্ডা দিয়ে  সন্ধ্যে সাড়ে  সাতটায় বাড়ীর দিকে রওনা হয়েছি।

গাড়ীতে তখনও একই গানের সিডি বাজছিল। ভালো গান বার বার শুনতে আমার ক্লান্তি আসে না বলেই সিডি পাল্টাই না। হঠাৎ করেই ' আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেলো" গানটি শুরু হতেই মিথীলাকে বললাম,

" মিথীলা, বিকেলে এই গানটি যখন বাজছিল, তুমি বলেছো, সারা পথেই নাকি একই গান বাজছিল। তার মানে তুমি গানের কথা বুঝো না, তাই সব গান শুনেই মনে করো, একই গান।

- আরে না, আমার মনে হয়েছে, কেমন যেনো একই টোনে গান বেজে চলেছে।

-ঠিক আছে, আমি তোমাকে আগেও বলেছি, একদিন তোমাকে ধরবো, এখন তুমি গানটা ভালো করে শোন, তারপর আমাকে বলো, গানটাতে কী বলছে।

-ওয়েল! একজন তার মেমরী থেকে বলছে, অনেক কিছু মনে পড়ছে।

-কে বলছে? কাকেই বা বলছে।

-প্রেমিককে কল্পনা করে বলছে ( ঠিক এই কথাটিই ও বলেছে)।

-ভালো করে শোনো, তারপর বলো।

মিথীলা বুঝে গেছে, আমার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে গানের কথাগুলো শুনতেই হবে। আমি হয়তো আগেই লিখেছি, আমি আমার মেয়েদের সাথে খুব ফ্রী, তাই তের বছরের মিথীলাকে অনায়াসেই এই গানের মানে জিজ্ঞেস করতে পেরেছি। মেয়ের বাবা অবশ্য আমার কান্ড কারখানায় মাঝে মাঝে ভড়কে যায়, আলতো প্রতিবাদও করে, " কী সব প্রশ্ন করো"? আমি বলি, " তবুও তো ভালো, আমি জানছি, মেয়েদেরকে আমি কী শেখাচ্ছি, আর স্কুলে গিয়ে যদি ভুলভাল শিখে আসে, কিছুইতো খবর রাখবো না। তার চেয়ে এই ভালো, ওদের সাথে খোলাখুলি কথা বললে ওরাও আমাদের কাছে ফ্রী হতে পারবে। আমাদের কথা ভাবো, বাবা মায়ের চোখের দিকে তাকাতে ভয় পেতাম, মা-বাবা বকবে ভয়ে জীবনে প্রেম করতে পারলাম না, জীবনের একটা অংশ অসম্পূর্ণ থেকে গেলো ( হা হা হা হা)"। এই হচ্ছি আমি। মিথীলা বলতে শুরু করেছে,

-একটা মেয়ে তার প্রেমিককে বলছে, ওদের পাস্টের অনেক গল্প মনে পড়ছে।

-কেনো, পাস্টের গল্প কেনো? গল্পগুলো মেমরী হয়ে গেলো কেনো?

-ওদের রিলেশান ব্রেক আপ হয়ে গেছে। কিন্তু ওরা এখনও বন্ধু আছে। এইজন্য বলেছে, ' বলো, ভালো আছোতো"?


মিথীলা, আমি খুব খুশী হয়েছি, আবার মন খারাপও করছি। তুমি এত ভালো বাংলা বুঝো, অথচ বাংলাটা প্র্যাকটিসই করছো না। আবারও বলি, বাংলা পড়া শুরু করো।

-মা, আমি যখন বন্ধুদের সামনেই তোমাদের সাথে ফোনে বাংলায় কথা বলি, ওরা খুব ফ্যাসিনেটেড হয়ে যায়। ওরা বাংলা শিখতে চায়। আমি ঠিক করেছি, একদিন বাংলা বই নিয়ে ওদেরকে দেখাবো, আমি তো বাংলা পড়তে পারি, তবে ফ্লুয়েন্টলী পারি না।

-মিথীলা, ঠিক আছে, এখন ফ্লুয়েন্টলী পারো না, কিন্তু যদি আমার কথামত প্র্যাকটিস করো, তাহলে পারবে।

-টুম্পা মাসী বলেছে, অনলাইনে গিয়ে বাংলা মিসট্রি পড়তে।

অনলাইনে যাওয়ার আগে একমাস তুমি এক প্যারা করে বাংলা গল্প পড়ো। আমি সিওর, একমাস পড়ে তুমি ফ্লুয়েন্টলী বাংলা পড়তে পারবে। তুমি তো এমনিতেই গল্পের বই পড়ো, প্রতিদিন তোমার গল্পের বই খোলার আগে বাংলা বই খুলে এক প্যারা পড়ে নিও। কোথাও আটকে গেলে মার্ক করে রেখো, আমাকে পরে দেখালে আমি বুঝিয়ে দেবো। আজ থেকেই শুরু করো।

-আজ থেকে!! কাল থেকে শুরু করি?

-নাহ! আজ থেকেই। কাল কখনও আসেনা মিথীলা। আজই শুরু করো। আজ কত তারিখ? ২১ তারিখ। ঠিক এক মাস পরে আরেক ২১ তারিখে----------
আরে!!!!!!!! মিথীলা, আরেক ২১ মানে তো ২১শে ফেব্রুয়ারী!

-ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে!

-হ্যাঁ তো!! আমাদের দেশ থেকেই তো মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে শুরু! তুমি ঠিক ২১শে ফেব্রুয়ারীতেই গড়গড়িয়ে বাংলা পড়তে শিখে যাবে????  তুমি বুঝতে পারছো, কিভাবে মিলে গেলো!!!!

-হ্যাঁ, একেবারে কোইনসিডেন্স!!!!!

No comments:

Post a Comment