Wednesday, January 16, 2013

বেঁচে থাক বাঙ্গালী ডালে, মাছে-ভাতে!!!

বেঁচে থাক বাঙ্গালী ডালে, মাছে-ভাতে!!!

আজ ছিল আমার অফ'ডে, অর্থাৎ টিফিন বাটি হাতে নিয়ে কাজে যেতে হয়নি। এর নামই অফ'ডে। বাকী সব অন'ডে! অবশ্য অফ'ডে তে আমার বেলায় একটু বৈচিত্র্য আছে, ইচ্ছে করলে সারা সকাল ঘুমাতে পারি। ঊত্তম কুমার আর মিথীলা নিজে নিজেই রেডী হয়ে যার যার পথে চলে যায়। যাওয়ার আগে উত্তম আমার জন্য এক কাপ চা কিচেনের কাউন্টার টেবিলে রেখে যায়। যখনই আমি ঘুম থেকে উঠি, নীচে নেমে সেই ঠান্ডা চা মাইক্রোওয়েভ ওভেনে দুই মিনিট গরম করে নেই। খুবই বিস্বাদ লাগে সেই চা খেতে, তবুও খাই। আগে খাবার অপচয় করতে চাইতাম না বলে কাপের তলাণীটুকুও চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলতাম, ইদানিং বিস্বাদ হয়ে যাওয়া চা দুই চুমুক খেয়েই রেখে দেই। আমি কফি খাই না, চা খাই দিনে দুইবার, সেটুকুও যদি যুতমত না পাই, খাই কী করে! তবে এটা তো আর উত্তমের দোষ নয়, আমি ঘুমিয়ে থাকি বলে আমাকে ডাকে না। সোজা হিসেব।

আজকে অবশ্য ঘুম ভেঙ্গেছে বেশ দেরী করে, সকাল সাড়ে দশটায়। আমি যখনই ঘুম থেকে উঠি না কেনো, আমাকে কেউ বকবার নেই, তবুও ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হলে ছোটবেলার মত বকা খাওয়ার ভয় লাগে। মনটা খারাপ হয়ে গেছে ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজতে দেখে। গতকালকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, আজকে অনেক কিছু রান্না করবো। তা কখন করবো? ফেসবুকে বসতে হবে না? ফেসবুকে একবার অন্তঃত একটুক্ষণের জন্য হলেও ঢুঁ মারতে হবে, নাহলে সারাদিনে মুড অফ হয়ে থাকবে। আগে মানুষের বাড়ীতে বেড়াতে যেতে কী যে ভালোবাসতাম, এখন কেউ নেমন্তন্ন করলে চিন্তায় থাকি, কখন ফিরতে পারবো। ফেসবুকে যেতে হবে, মজার কথা বলি, সেদিন আমাদের বন্ধু সব্যসাচী তার ক্রুজে ভ্রমণ করে আসার অপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিল, পাশে ছিল শুভাশীষ'দা ও রঞ্জনা বৌদি। তাদেরও ক্রুজে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে। তিনজনে মিলে উত্তম কুমারকে বলছিল, তাঁর সুচিত্রাকে নিয়ে যেনো একবারের জন্য হলেও ক্রুজে যায়। উত্তম তো পারলে তখনই টিকেট বুকিং দিয়ে ফেলে! এদিকে আমার তো মনে ভয়, হায় হায়! ক্রুজে গেলে পাঁচদিনের ধাক্কা, ওয়াইফাই থাকবে তো! জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছে, কারণ ওরা সকলেই আমার ফেসবুক নেশার কথা জানে। আড়ালে এবং সামনাসামনি একটু হাসাহাসিও করে আমাকে নিয়ে।  মরীয়া হয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ক্রুজে ওয়াইফাই আছে কিনা। জাহাজের ডেকে বসে রাতের বেলা আকাশের তারা দেখা যাবে কিনা, ল্যাপটপ সাথে নিয়ে গিয়ে লেখালেখি করা যাবে কিনা! আমার প্রশ্ন শুনে উত্তমের উৎসাহে ভাটা পড়ে গেলো, মেয়ে মিশা হেসেই ফেললো, বন্ধুরা ভরসা দিল, সবই আছে জাহাজে, শুধু গেলেই হলো। এবার আমি সায় দিলাম, যদি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারি, তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই। উত্তমকে আর সাড়াশব্দ করতে না দেখে, মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি।


অনেক প্যাঁচাল পারলাম। সাড়ে দশটায় ঘুম থেকে উঠে কম্পিউটার অন করলাম। স্ক্রীণ অন হওয়ার মুহূর্তটুকুতে নীচে নেমে চায়ের কাপ মাইক্রোওয়েভ ওভেনে দুই মিনিট দিয়ে ঝাড়ু হাতে বাসি ঘর ঝাড়ু দিতে লাগলাম। দুই মিনিট শেষ, ওভেনে পিপ পিপ আওয়াজ হচ্ছে, ভেবেছিলাম দুই মিনিটেই ঘর ঝাড়ু শেষ হবে, কিন্তু বাস্তবে আরও পনের সেকেন্ড সময় বেশী লেগেছে। এক হাতে চায়ের কাপ, আরেক হাতে ঝাড়ু নিয়ে উপরে উঠে এলাম। ততক্ষণে স্ক্রীণ পুরোপুরি অন হয়ে গেছে। সকালের ঘর ঝাটপাট শেষ করেই চায়ের কাপে সুড়ুৎ করে এক চুমুক দিতেই জিভটাতে ছ্যাঁকা লাগলো। উঃ করার আগেই ফেসবুকে ঢুকে গেছি। মেসেজ বক্সে মেসেজ আছে দেখে খুশী হয়েছি। খুলে দেখি আলীম হায়দার ধ্রুব মেসেজ পাঠিয়েছে। সেই মেসেজ পাওয়ার উপর একটি লেখা " ঘুম ভেঙ্গে দেখি",সাথে সাথে লিখে ওয়ালে পোস্ট করে দিলাম।

এরপর দুইটা ঘন্টা রান্নার কথা ভুলে ফেসবুকেই বসে থাকলাম। যখন বেলা বাজে একটা, মাথায় বাজ পড়লো। উত্তম কুমারের আসার সময় হয়ে গেছে, লাঞ্চ রেডী করি নি। এক দৌড়ে নীচে গেলাম, দেখি আগের রাতের সেই ভুনা খিচুড়ী কিছু রিয়ে গেছে। সেটাই গরম করে ডাবল ডিমের ওমলেটসহ খেতে দিলাম। নিজেও খেলাম। মাথায় চিন্তা, কখন রান্না করবো, আমার যে ফেসবুক থেকে উঠতেই ইচ্ছে করছে না। আসলে আমি ফেসবুক ওপেন করে রেখে হাজারটা ওয়েব সাইট ব্রাউজ করি, তার মধ্যে ইউটিউব আছে। ইউটিউবে গিয়ে গান না শুনতে পারলে ভালো লাগে না। অনেকেই তাদের লেখা আমার ওয়ালে ট্যাগ করে, সেগুলোও পড়ি। সেসব করতে করতেই বেজে গেলো বিকেল পাঁচটা। এই রে! এবার কিচেনে ঢুকতেই হবে।


আমাদের এক অনেক বড় শুভাকাংক্ষী আছেন এখানে, উনার অনুরোধে উনাকে আমি 'ভাইয়া' না ডেকে 'দাদা' ডাকি, আমার ভাই ভাগ্য বরাবর ভালো, এই দাদাটিও আমার জন্য বিরাট বড় পাওয়া। গতকাল উনি বিশ্বভ্রমণ শেষ করে ফিরে এসেছেন, আজকে উনাকে রাতে খেতে বলেছি, অথচ বিকেল পাঁচটাতেও কিছুই রান্না করিনি। এই দাদার স্বভাবটিও আমারই মতো, খান অল্প, কিন্তু আয়োজনে ত্রুটি দেখতে পছন্দ করেন না। উনার সামনে রাশি রাশি খাবার থাকলে উনি খুশী হন, বার বার বাহ! বাহ! করতে থাকেন, অথচ প্লেটে নেন যৎসামান্য। নিজের বাড়ীতে কড়াই ভরে ভরে রান্না করেন, অতিথিকে গলা পর্যন্ত খাওয়ান। সেই দাদা আসবেন আর আমি রান্না করবো না, তা কী করে সম্ভব! শুরু করে দিলাম রান্না-বান্না।

রাত আটটায় ডিনার রেডী। রান্না করেছিলামঃ   টার্কী কিমা, তেলাপিয়া মাছের ঝুরী,  চিকেন মাখানি,  দেশী মুসুরের ডাল আর ফুলকপির ডাটা চচ্চড়ি ( সাথে বড়ি ভাজা দিয়েছি)।

দাদা প্রথম দানে একটু একটু করে চামচের আগায় খাবার তুলে নিয়েছেন, আমরা স্বাভাবিক পরিমানেই নিয়েছি। কিন্তু দাদাকে বলেছি,

" দাদা, আপনার অনারে রান্না করেছি, আপনি এই এতটুকু করে নিচ্ছেন, আবার চাইলে কিন্তু পাবেন না, আমি আর নিতে দেবো না"।

-" কী করি বলো বইন, বয়স হচ্ছে তো, অল্প অল্প খাওয়া উচিৎ, বাঁচতে হবে তো"

" আমার রান্না খেলে মরা মানুষও বেঁচে উঠে, আর আপনি ভয় পাচ্ছেন মরা-বাঁচা নিয়ে"।

" হা হা হা!! এইটা তুমি কী বললা বইন, আচ্ছা যাও, আমি দ্বিতীয়বার এসে নিয়ে যাবো"।

আমি আজকে ডাল রান্নাই করতাম না, যদি দাদা না আসতেন। সেই দাদা প্লেটে নিয়েছে এক চামচ ডাল। কেমনটা লাগে! ঠিক করেছি, কিছু বলবো না, দেখি উনি কী করেন!  উনি যা খেয়ালী মানুষ, পাখীর মত এইটুকুনী খান, কিন্তু এমন আহ! কী মজা হয়েছে, অথবা, মিঠু, বইন এইটা কী খাওয়াইলা, এতো মজা হইছে, ধরণের স্তোকবাক্য শোনান। তবে আমার রান্না যে কোন ডাল, মহাভারতের দ্রৌপদীকে অনায়াসে চ্যালেঞ্জ করতে পারতো!

আমরা খাচ্ছি আর গল্প করছি। দাদার বিশ্বভ্রমণের গল্প শুনি আর কল্পনায় দেখি, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান, বাংলাদেশ!!!!! সব কিছুর পাশাপ্সহি এটাও খেয়াল করি,
দাদা দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার  টেবিলে এসেছেন, শুধু মুসুর ডাল আর তেলাপিয়ার ঝুরী নেয়ার জন্য। বেঁচে থাক বাঙ্গালী ডালে, মাছে-ভাতে!

No comments:

Post a Comment