Sunday, January 6, 2013

বাদাইম্যানামা!

প্রতিটি মানুষের নামের পাশে বিশেষ কোন পরিচিতি থাকে। কেউ গায়ক, কেউ নায়ক, কেউ চিত্রকর, কেউ রাঁধুনী, কেউ চোর, কেউ ডাকাত, কেউ বাটপার, কেউ ফাজিল, কেউ কিপটে, কেউ দাতা কর্ণ। আমার নামের পাশে যে বিশেষণটি প্রায়ই ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তা হচ্ছে 'বাদাইম্যা'।

শুনতে খারাপ লাগেনা, তবে বাদাইম্যার সঠিক অর্থ জানা থাকলে আমার জন্য 'উপাধী' টা গ্রহণ করা অনেক সহজ হয়ে যেতো। আমার জানামতে, বাদাইম্যা শব্দটি বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অঞ্চল বিশেষের মধ্যে ঢাকা জেলা অন্যতম। ঢাকার মানুষেরাই অপরকে 'বিটকেলে উপাধী' দিতে পছন্দ করে। উপাধী দেয়ার বেলায় মন্ত্রী-মিনিষ্টার থেকে শুরু করে কাউকেই রেহাই দেয় না। এখানে আমি অন্যদেরকে নিয়ে কথা বলতে চাইছি না, আমার নামের পাশে কেনো 'বাদাইম্যা' উপাধী যোগ হলো, সেই চিন্তাতেই আমি অস্থির। উপাধী পাওয়ার উপলক্ষগুলো যদি একে একে বলি, তাহলেও বোধ হয় 'বাদাইম্যা' শব্দের সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না।

আমার এক মামা ছিলেন, উনি সংসারের প্রতি কখনওই মনোযোগী ছিলেন না। ছুতোনাতায় বেড়াতে বের হয়ে যেতেন, সেই কক্সবাজার থেকে শুরু করে সন্দ্বীপ, সুন্দরবন, রাজশাহী, বগুড়া হয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে ফেলেছেন। তার এই যাযাবর মার্কা স্বভাবের কারণেই গুরুজনেরা তাকে 'বাদাইম্যা' ডাকতো। সেই থেকে আমার ধারণা হয়েছে, ঘুরে বেড়ানো মানুষদেরকে বোধ হয় বাদাইম্যা বলে।

আমার একজন খুব প্রাণের বন্ধু ছিল। তার সাথে ফোনালাপ হতো,  টেক্সটালাপ হতো। অনেকদিন তার সাথে দেখা হয় না, ফোনালাপও হয় না, টেক্সটালাপও হয় না, কারণ আমরা দুজনেই যার যার কাজ নিয়ে মহাব্যস্ত। আগে টেক্সটালাপ হলে আমি একটি কমন প্রশ্ন করতাম, " আজকে তুই কী রঙের শার্ট পড়েছিস? লাল? কালো? স্ট্রাইপ?"

সে সাথে সাথে উত্তর পাঠাতো, " কোনটাই না, আমি পড়েছি নটিকা ব্র্যান্ডের টি-শার্ট"

আমার এই বন্ধুটি ব্র্যান্ড নেমের প্রতি খুব দূর্বল। অনেকদিন বাদে সেদিন আমি তাকে মেসেজ পাঠিয়েছি,
" তুই আজকের প্রোগ্রামে কোন কালারের শার্ট পড়েছিলি?  আমার মনে হচ্ছে আজ তুই স্ট্রাইপড পুলওভার পড়েছিস"।
কোন উত্তর আসেনি, দুইদিন পর, গতরাত সাড়ে এগারোটার দিকে মেসেজ পেলাম,
" পুলওভার পড়িনি, আমি আরমানির স্যুট পড়েছিলাম, সাথে নীল শার্ট"।
কারো চিঠি বা মেসেজের উত্তর সাথে সাথে পাঠানোটা আমি ভদ্রতার অংশ হিসেবে মানি। তাই অত রাতেই আমি উত্তর দিয়েছি,

" তোর সাথে অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই, তাই আন্দাজটা মিললো না রে"

" আন্দাজটা তুই বেশী করিস, বাদাইম্যা একটা"

আমি তো থ' বনে গেছি, দুইদিন লাগলো তার একটা উত্তর পাঠাতে, আর সে-ই কিনা আমাকে ডাকে 'বাদাইম্যা'? এর আগেও সে আমাকে বহুবার 'বাদাইম্যা' সম্বোধণ করেছে, অবাক হই নি। কারণ শুধু তো আমার এই বন্ধুই নয়, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরাও আমাকে বাদাইম্যা বলে। গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক থেকে আমার মামাতো বোন বেড়াতে এসে আমাকে 'বাদাইম্যা' বলে গেছে। কী কারণ? কারণটি হচ্ছে, আমি ওকে বলেছিলাম, আমার ঘরটি ঢেলে সাজিয়ে 'ইন্দ্রপুরী' বানিয়ে দিতে। ঘর গুছানো কাজে আমার এই বোনটির জুড়ি মেলা ভার। আমি যখন ঢাকা থাকতাম, বোনটার বয়স কতই বা হবে, পনের কী ষোল  বছর, আমার বাড়ীতে বেড়াতে আসতো, আমার মেয়েদের সাথে খেলতো আর ফাঁকে ফাঁকে আমার শাড়ী গুছিয়ে দিত।

শাড়ীর প্রতি আমার দূর্বলতা আজীবনের। আমার সংগ্রহে কত শাড়ী আছে, আমি নিজেই জানিনা। দামী শাড়ী খুব কমই আছে, তবে কম দামী কিন্তু দারুণ সুন্দর সব শাড়ীতে বোঝাই হয়ে আছে তিনটি ক্লজেট। শাড়ীর প্রতি দূর্বলতা নেই এমন  বাঙ্গালী মেয়ের সংখ্যা খুবই কম। আমার এই বোনটি যদিও কম বয়সী এবং স্মার্ট, যদিও সে ওয়েস্টার্ণ ড্রেস পড়তে পছন্দ করে, তারপরেও শাড়ী দেখলেই হলো, ফট করে বলে বসবে,

"ফুলদিভাই, তোমার এই শাড়ীটা আমাকে দিয়ে দাও"

আমি বলি, " বইন, মাফ কর, প্রয়োজনে তুই আমারে নিয়ে যা, তবুও আমার শাড়ী নিস না"
সাথে সাথে আমার হাঁটুর বয়সী বোন বলে উঠে, " যাও, তোমার মত বাদাইম্যা মহিলাকে নিয়ে আমার কী হবে"?

-আরে! বলে কী! আমাকে বলে বাদাইম্যা! অ্যাই মেয়ে, আমাকে বাদাইম্যা বললি কেনো?

-তুমি হলে নাম্বার ওয়ান বাদাইম্যা। বাদাইম্যা না হলে এত এত সুন্দর সুন্দর শাড়ী কেউ এভাবে ডাম্প করে রাখে? তিনটি দিন লেগেছে তোমার ক্লজেট গুছাতে!

-তাই বলে আমি বাদাইম্যা হয়ে গেলাম? আমি যদি বাদাইম্যা হতাম, তাহলে কী আমি সেই পঞ্চাশ বছর আগের শাড়ী যত্ন করে রাখতে পারতাম?

বোনের সাথে আরও অনেক কথাই হয়েছে, ওকে দুটো নতুন শাড়ী দিয়েছি, তারপরেও সে আমাকে বাদাইম্যা বলবেই বলবে। বাদাইম্যা বলার জন্য সে আমার মা, বাবার রেফারেন্স পর্যন্ত টেনেছে। আমার মা ওর পিসী হয়, বাবা ওর পিসেমশায়। বোন সোজা বলে দিল,

আমি কী একাই তোমাকে বাদাইম্যা ডাকি, তোমার নিজের বাবা-মা পর্যন্ত তোমাকে উঠতে বসতে বাদাইম্যা ডাকে।

-বাবা মা আমাকে বাদাইম্যা ডাকে, এতটুকু বললেই চলতো, তা না,  সে আবার 'উঠতে বসতে বাদাইম্যা ডাকে' যোগ করেছে। হ্যাঁ, আমার বাবা আর মা , দুজনেই আমাকে বাদাইম্যা ডাকে। সংসারী বলতে যা বোঝানো হয়ে থাকে, আমি সে অর্থে সংসারী নই। অনেকটাই আমার মামার মত ভবঘুরে জীবন বেশী পছন্দ করি। ঘরে আমার পঞ্চাশ ইঞ্চি স্ক্রীন এলইডি টিভি নেই, মার্সিডিজ গাড়ী নেই, সুন্দর একখানি বাড়ী নেই, দামী দামী আসবাবপত্র নেই। নেই তো নেই, তার জন্য বিলাপও নেই। আমি শুধু সুযোগ খুঁজি বেড়ানোর। দেশে থেকেও অনেক বেড়িয়েছি,  আমি একা বেড়াতাম না, সাথে কিছু চেলা চামুন্ডা জুটিয়ে নিতাম। তখনই মা বলতো,

" যার তিনটা মেয়ে আছে, সে কিনা সংসারের দিকে নজর না দিয়ে তিদিং তিদিং করে ঘুরে বেড়ায়! এমন বাদাইম্যা মাইয়া আমার পেটে জন্মালো কী করে!"

ঘোরাঘুরির নেশা এতই প্রবল ছিল যে একবার, ছোট মেয়ের বয়স যখন মাত্র দেড় বছর, ওকে বাড়ীর 'বুয়া'র হেফাজতে রেখে আমি স্বামীর সাথে তিন দিনের জন্য 'দুবাই' চলে গেছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল, তিনদিন মায়ের অদর্শনে বাচ্চার কিছু ক্ষতি হবে না, কিন্তু 'দুবাই' বেড়ানোর এই সুযোগ আমার জীবনে আর না আসতে পারে। আরেক দিনের বাদাইম্যামির ঘটনা বলি, তখন ৯১ সাল, নির্বাচনের আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শেষ মিটিং ছিল মানিক মিয়া এভিনিউ তে। আমরা তখন সাভার থেকে ঢাকায় মুভ করেছি।  সাড়ে চার বছর ও আটমাস বয়সী দুই মেয়েকে তাদের বাবার জিম্মায় রেখে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম টুকিটাকী বাজার করতে। ফুলার রোডের ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার থেকে সাথে নিয়ে গেছিলাম আমার এক বৌদিকে। ছোট মেয়েটার  বেদম জ্বর দেখেই বেড়িয়েছি, নিউমার্কেটের কাজ সারছিলাম আর মাইকিং শুনছিলাম, শেখ হাসিনার মিটিঙে যাওয়ার আহবান জানিয়ে। বৌদিকে বললাম,

-চলো, কাছেই তো মানিক মিয়া এভিনিউ, শেখ হাসিনার মিটিঙ দেখে যাই।
-বাসায় তোমার বাচ্চার জ্বর, তুমি যেতে চাও মিটিঙে?
-বৌদি, বাচ্চাদের রোগ শোক লেগেই থাকবে। জ্বর হয়েছে, জ্বর সেরেও যাবে, কিন্তু শেখ হাসিনাকে তো আর সব সময় কাছে থেকে দেখতে পাবো না। চলো না, একটুক্ষণ থেকেই চলে আসবো।
-তোমার বর কিছু বলবে না?
-না, কিছু বলবে না। সে বাচ্চার যত্ন নিতে পারে। তাছাড়া, সে আমার স্বভাবের কথা জানে।

দুই ননদ-ভাজ মিলে চলে গেছিলাম মিটিঙে। আমি সরাসরি মঞ্চের কাছে চলে গেছি। ঊদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনার কাছ থেকে একটি অটোগ্রাফ নেয়া, বাড়ীতে গিয়ে বাবাকে দেখাতে হবে। আমার বাবা শেখ হাসিনার সমর্থক, অটোগ্রাফ নিয়ে গেলে খুশী হবে। অনেক লম্বা কাহিণী, তবে অটোগ্রাফ আমি পেয়েছিলাম। অটোগ্রাফ পাওয়া হতেই বৌদিকে বললাম,

এবার বাড়ী চলো, আমার মেয়ের গায়ে ১০৪ ডিগ্রী জ্বর দেখে এসেছিলাম। না জানি কী অবস্থায় আছে!

-বলো কী!! ১০৪ ডিগ্রী জ্বর অতটুকু বাচ্চার, আর তুমি কিনা শেখ হাসিনার মিটিঙ দেখতে এসেছো? আচ্ছা মিঠু, এমন বাদাইম্যা হলে কী করে? আগে যদি জানতাম, আমি কক্ষনো তোমাকে এখানে নিয়ে আসতাম না।

-আরে! চলো তো, বাদাইম্যার সাথে আসছো বলেই তো এতো বিশাল জনসমুদ্রের মধ্যেও শেখ হাসিনার কাছাকাছি যেতে পেরেছো, আবার কেমন সুন্দর অটোগ্রাফও পেয়ে গেলাম!

-শীগগীর বাড়ী চলো, এমন কাজ আর কখনও করো না।

-নাহ! এমন সুযোগ বার বার আসেওনা, কাজেই ভয় নেই।

আমার এমন বহু কাহিণী আছে যা শুনলে অনেকেই ভ্রু কুঁচকাতে পারে! অন্যদের সাথে কী কী বাদাইম্যামি করেছি, তা অন্যেরাই ভালো বলতে পারবে। মেয়েদের সাথে যত বাদাইম্যামি করেছি, তার থেকে মাত্র দুটি ঘটনার কথা বলেছি, বড় মেয়েই বা বাদ যাবে কেনো! ওর সাথেতো সবচেয়ে বেশী বাদাইম্যামি করেছি। একটা ঘটনার কথা বলিঃ

 '৯৮ সালের একেবারে শুরুর দিকের ঘটনা এটি। মাত্রই অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছি, ঢাকার উত্তরাতে একটি এপার্টমেন্টে উঠেছি। স্বামী যে কোম্পাণীতে চাকুরী পেয়েছেন, সেই কোম্পাণীর দেয়া ফ্ল্যাটে থাকি, কোম্পাণীর দেয়া পাজেরো চেপে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াই। ঐ সময়টা ছিল আমার মত বাদাইম্যার জন্য বড়ই সুখের! '৯৮ সালের দিকে আমার বড় মেয়ের বয়স ছিল এগারো বছর, নিতান্তই বালিকা। আমার বড় মেয়েটি পেয়েছে তার বাবার স্বভাব, খুব শান্ত, ধীর-স্থির, পড়ুয়া, মনের দিক থেকে বেশ সাহসী। অনেক ছোট বয়স থেকে সে ভুত-পেত্নী, রাক্ষস-ক্ষোক্কসের গল্প পড়তে ভালোবাসতো,  আমি যখন ভুতের ভয়ে অস্থির, এই মেয়ে লাইট নিভিয়ে অন্ধকার ঘরে একা  ঘুমাতো, অনেক রাত পর্যন্ত জী টিভিতে 'হরর শো' দেখতো।

একদিন আমার স্বামী অফিসিয়াল ট্যুরে উত্তরবঙ্গে গেছিল, দুই দিন ওখানেই থাকতে হয়েছে। এই দুইদিন আমি সাহসী কন্যাকে পাশে নিয়ে লাইট জ্বালিয়ে সারারাত বসে কাটিয়েছি। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, এরপর থেকে পরিবার প্রধান যেখানেই যাবেন, আমি তার সঙ্গী হবো। এভাবে ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে থাকতে পারবো না। পরের দিন আমার স্বামী উত্তরবংগ থেকে ফিরবেন, আমাদের কারোর তখন মোবাইল ফোন ছিল না, কাজেই ট্র্যাক করতে পারছিলাম না। অফিসের গাড়ীতে গেছেন, অফিসের গাড়ীতেই ফিরবেন, আমার কোন ভূমিকা ছিল না। আমাদের পাজেরো আমাদের তত্বাবধানেই ছিল। যেদিন স্বামী বাড়ী ফিরবেন, সেই দুপুরে আমি হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, ছোট মেয়েকে ( বর্তমানে মেজো) সাথে করে আরিচাঘাটে চলে যাওয়ার। আমার ঘোরাও হবে, স্বামীকে চমকে দেয়াও যাবে। যেই কথা সেই কাজ, বড় মেয়েকে বাসায় রেখে ছোটটাকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম। মেয়েকে বলে গেছিলাম, কেউ এসে দরজা নক করলে যেনো দরজা না খুলে দেয়।

মহানন্দে আরিচাঘাটে পৌঁছে দেখি, আমার স্বামীকে বহনকারী ফেরীটি এসে পৌঁছে নি, জানতে পেরেছি ফেরী লেট আছে। আমার আনন্দ দেখে কে! বেশীক্ষণ বাড়ীর বাইরে থাকা যাবে। নদীর চারপাশ, মানুষজনের কোলাহল, নদীর ঘাটের মাছের বাজার দেখতে দেখতে সময় কেটে যাচ্ছিল। দেড়ঘন্টা পরে ফেরী ঘাটে লাগতেই মা-মেয়ে দুজনে মিলে মেয়ের বাপকে চমকে দিলাম। মেয়ের বাপ খুশীই হয়েছে, আমাদেরকে সাথে নিয়ে পাজেরো ছুটেছে। আমাদের সাথে আরেক ভদ্রলোকও উঠেছিলেন, ফেরীতেই পরিচয়, ভদ্রলোক ঢাকায় যাচ্ছেন, আমার উদার স্বামী উনাকে আমাদের সাথেই তুলে নিয়েছেন ঢাকা নির্দিষ্টস্থানে পৌঁছে দিবেন বলে। স্বামীর এই সিদ্ধান্তে আমি খুব খুশী হয়েছি, কারণ আরেকটু বেশী সময় রাস্তায় থাকা যাবে।

সব কিছু যদি ঘড়ির কাঁটায় চলতো, আমরা বাড়ী পৌঁছে যেতাম সন্ধ্যে ছ'টার মধ্যে। কিন্তু কোন কিছুই ঠিকমত চলে নি।  ফেরী লেট, মিরপুরে জ্যাম, আসাদ গেটে জ্যাম, সেই ভদ্রলোকের বাড়ী গ্রীন রোড, এগুলো করতে করতে গাড়ীতেই রাত বেজে গেছে নয়টা। আমি ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছি। কাঁদছিলাম আমার বড় মেয়েটির জন্য। একা এত বড় বাড়ীতে মেয়ের কোন বিপদ হয়নি তো! কারেন্ট চলে গেলে,ভুতগুলো এসে মেয়েটাকে ধরে নি তো! পাঁচতলা বিল্ডিং এ একমাত্র পরিবার ছিলাম আমরা ( ঐ সময়), নীচতালায় ড্রাইভার, কর্মচারী, কেয়ার টেকার থাকতো। যতই বাদাইম্যা হই না কেনো, মায়ের মন, মেয়ের সর্বনাশের চিন্তায় অস্থির। কত কী ঘটে যেতে পারে!  অনেকটা আধমরা অবস্থায় বাড়ী ফিরেছি রাত সাড়ে দশটায়। সারাবাড়ী ঘুটঘুটে অন্ধকার! শুনলাম জেনারেটারের তেল ফুরিয়ে গেছে, তাই জেনারেটার বন্ধ। ধরেই নিয়েছি, এতক্ষণে আমার মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে! অন্ধকারের মধ্যেই দেয়াল হাতড়ে দোতালায় উঠে দরজায় ধুম ধুম ধাক্কা দেই আর ডাকি, মামনি, ও মামনি, দরজা খোল। মেয়ে অবাক চোখে দরজা খুলে দিয়ে আমার চেহারা দেখে আরও বেশী অবাক হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওর নাকি কোন অসুবিধে হয় নি, তিনবার কারেন্ট চলে গেছিল, রান্নাঘরের কোথায় ম্যাচ, কোথায় মোমবাতি থাকে জানে না বলে অন্ধকারের মধ্যে লিভিং রুমের সোফায় চুপ করে বসেছিল। আমি আর কিছুই শুনতে চাইছিলাম না, মেয়েকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেয়েছি, আমার বাদাইম্যা স্বভাব কেটে গিয়ে মাতৃত্ব ফিরে এসেছে। এই ঘটনাটি তখন বাবা বা মা'কে জানাই নি, কারণ জানালেই উনারা আমাকে একহাত নিবেন। মেয়েকে না করে দিয়েছি, কাউকেই যেনো না বলে দেয়। মেয়ে কথা রেখেছে। কয়েক মাস পরে আমি নিজেই আমার মায়ের কাছে গল্পটি করেছি।


এই কাহিণী শোনার পর থেকে মায়ের কাছে চিরস্থায়ীভাবে 'বাদাইম্যা' হয়ে গেলাম। বাবা অবশ্য এইসব ব্যাপারে নাক গলাতেন না। তারপরেও বাবাও আমাকে 'বাদাইম্যা' ডাকেন। এমনকি এখনও আমাকে কথায় কথায় বলেন,

"সারাটা জীবন পার করে দিলি বাদাম্যাগিরি কইরা!"

আমার বিরুদ্ধে বাবার দুইটি অভিযোগ আছে, প্রথম অভিযোগ,  আমি প্রচন্ড মেধাবী হওয়া সত্বেও নিজের ক্যারিয়ারকে ভুলুন্ঠিত করেছি। তা অবশ্য সত্যি, আমার একাডেমিক ডিগ্রী আছে বেশ কয়েকখানা, অথচ শখ করে চাকুরী করি ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে। প্রথম বছর আমি ক্যাশিয়ার পজিশনে জয়েন করেছিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমার ভালো লাগে জিনিসপত্র বেচা কেনা করতে। প্রথম যেবার ওয়ালমার্টে জয়েন করলাম, বাবাকে ফোনে বলেছি,

" বাবা, আমি আমেরিকাতে ফেরিওয়ালীর কাজ পাইছি। ওয়ালমার্টে কাস্টমারদের কাছে মাছ-মাংস বেচি।

আমার কথা শুনে বাবার দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। বিশ্বাস করে, আবার করেও না। এরপর অবশ্য যখন ফোন সার্ভিস সেন্টারে চলে এলাম, তখনও বলেছি,

"বাবা, এইবার তোমার খুশী হওয়ার কথা। আমি যে ডিপার্টমেন্টে আছি, এখানে সারাক্ষণ শুধু ফটর ফটর ইংলিশ বলতে হয়। ভাগ্যিস তোমার কাছে ইংলিশ শিখেছিলাম"।

" রাখ তোর ইংলিশ, তোর মতো বাদাইম্যা মাইয়া যার আছে, তার কপালটা খুবই খারাপ। কত উঁচুতে উঠতে পারতি, আর এখন আমারে শুনাছ ইংলিশ ফুটানির কথা।


 বাবার দ্বিতীয় অভিযোগ, আমি মোটেও সঞ্চয়ী নই। আমার বয়সী মেয়েদের সকলেরই গাড়ী, বাড়ী, গয়না গাঁটি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আছে, অথচ সব রকম যোগ্যতা থাকার পরেও আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই। বাবার দুঃখ, আমার সেদিকে নজরও নেই। আমি শুধু ঘোরাঘুরিতেই পয়সা খরচ করি। অন্যেরা যেখানে দশ বছরে এক দু'বার দেশে বেড়াতে যায়, নতুন বাড়ীঘরের ছবি পাঠায়, সেখানে আমি দুই বছর পর পর পুরো পরিবার নিয়ে তিন মাসের জন্য দেশে যাই। প্লেনের টিকিট থেকে শুরু করে দেশে থাকাকালীন খরচের অঙ্ক চিন্তা করেই বাবার মাথা ঘুরায় আর আমাকে বকা দেয়,

আমার মেয়ে হয়ে তুই এমন বাদাইম্যা হইলি কেমনে? এখন পর্যন্ত দেশে তোদের একটা ফ্ল্যাট নাই, এক টুকরা জমি নাই, বিদেশেই বা কী এমন লারে লাপ্পা আছে, তাও বুঝি না। কোন সাহসে তুই এইভাবে টাকাপয়সা গুলি নষ্ট করস?

-আমার যে শুধুই তোমাদেরকে দেখতে ইচ্ছে করে! টাকা পয়সা দিয়ে কী হবে? তোমরাই যদি না থাকো, টাকা ধুইয়ে কী আমি জল খাবো? যতদিন তোমরা আছো, ততদিন তোমাদের না দেখে থাকতে পারবো না।

-তা তো বুঝলাম, কিন্তু তোর তিনটা মেয়ে আছে, ওদের ভবিষ্যত আছে, এই ব্যাপারগুলিও ভাবতে হবে।

-তা ঠিক আছে, ভাববো যখন ভাবার, তাছাড়া আমেরিকাতে কেউ না খেয়ে থাকে না, টাকা না থাকলে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে পড়াশুনা করবে, পরে চাকরী করে লোন শোধ করে দিবে।  তাছাড়া আমি বাদাইম্যা বলেই আমার মেয়েগুলি ভালো হইছে, প্রত্যেকেই স্কলারশীপ পায়, এরপরেও কেনো চিন্তা করবো! একটাই জীবন, কত কিছুই দেখার বাকী থেকে যাবে!

-অবস্থা দেখছো!! মেয়েরা ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে পড়বে তবুও ও টাকা পয়সা এভাবে উড়াবে, এভাবে আলেং ফালেং করে দিন পার করবি তুই? বাদাইম্যা আর কারে কয়! এমন বাদাইম্যা হইলি কেমনে?  একটা জীবন তো সবারই, সবাই কী তোর মত এমন আওয়ারা হয়ে ঘুরে? আমার জামাই বাবাজী কী কিছুই বলে না?

-তোমার জামাই বাবাজী হাল ছেড়ে দিছে, আমি জন্ম বাদাইম্যা, সবাই আমাকে বাদাইম্যা বলে, তোমার জামাই বাবাজীই বা বাদ যাবে কেনো! মুখে না বললেও মনে মনে নিশ্চয়ই আমাকে বাদাইম্যা বলে, তবে বাদাইম্যারে সে প্রশ্রয়ও দেয়। কারণ আমি বাদাইম্যা বলেই সংসারের কুটকচাল বুঝি না, ঝগড়া-ঝাঁটি করি না, দলাদলি করি না, সরল সোজা জীবন-যাপন করি। এর চেয়ে বেশী আর কী চাই জীবনে, তুমিই বলো!

No comments:

Post a Comment