Saturday, March 23, 2013

রাষ্ট্রপতির মৃত্যু, বেগম জিয়ার শোক এবং বুদ্ধিজীবিগণের উচ্ছ্বাস!!

আজকের লেখাটি ঠিক কীভাবে শুরু করবো, তার কোন সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভীষন এক অস্থিরতায় ভুগছিলাম, অস্থিরতা কাটানোর জন্যই অনলাইনে সংবাদপত্র পড়তে শুরু করে দিলাম। অনলাইনে গিয়ে আমার পছন্দসই পত্রিকার শিরোনাম পড়ে ফেললাম। গতকাল সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নামাজে জানাজা শেষে উনাকে বনানী কবরস্থানে উনার প্রাণপ্রিয় পত্নীর কবরেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে। গত তিনটি দিন ধরে পত্রিকার পাতা জুড়ে শুধুই আমাদের রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে।

যাঁরাই লিখেছেন, সকলেই খুব দরদ দিয়ে লিখেছেন, আবেগ দিয়ে লিখেছেন, একেকটা লেখা পড়েছি, ভালোলাগা, শ্রদ্ধায় মন আপ্লুত হয়েছে। তা আজকের পত্রিকায়ও রাষ্ট্রপতি সংবাদে খুবই আবেগঘন সংবাদ ছাপা হয়েছে। আমার জীবনে এই প্রথমবারের মত দেখলাম, একজন মানুষের প্রতি দেশের সর্বস্তরের জনগণের অকুন্ঠ ভালোবাসার প্রকাশ। সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতির প্রতি দেশের প্রতিটি মানুষের শোক, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা দেখে চোখ ভিজে উঠেছে।

পত্রিকা পড়তে পড়তেই একফাঁকে লেখার সূত্র খুঁজে পেয়েছি। রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে লেখা সংবাদগুলো যখন পড়ছি, তখনই একটি বিশেষ সংবাদের প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গতকাল বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন, শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেছেন, রাষ্ট্রপতির সন্তানদের সাথে কথা বলেছেন। এই সংবাদ পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছে। বেগম জিয়ার রাজনৈতিক নেত্রীসুলভ ব্যবহার দেখে খুবই খুশী হয়েছি। তবে খুশী হলেও বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করেছি, এর মধ্যে কোন ব্যতিক্রমতা বা বিশালত্ব খুঁজিনি। কিন্তু আমি বিশালত্ব না খুঁজলে কী হবে, কিছু কিছু বুদ্ধিজীবি এই ঘটনার মধ্যে অনেক বিশালত্ব আবিষ্কার করেছেন। কেউ কেউ তো চব্বিশ ঘন্টা পার হতে দেন নি, বেগম জিয়ার স্তুতি বন্দনা করে বিরাট বড় আর্টিক্যালও লিখে ফেলেছেন। আর্টিক্যালে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, বেগম জিয়াকে নাকি বংগভবনে যথাযথ সম্মান দেয়া হয় নি। কোন রকম সাদর সম্ভাষণ জানানো হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেখানে উপস্থিত থাকলেও সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রীর সাথে কথা পর্যন্ত বলেন নি। কেউ কেউ আবার বলেছেন, এই সুযোগে দুই নেত্রী একসাথে বসে (রাষ্ট্রপতির কফিনকে সামনে রেখে ) দেশের চলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনাও করেন নি।

আজকের সংবাদপত্রগুলো পড়েই বুঝে গেছি, আগামী দিনের রাজনৈতিক আলোচনা কোনদিকে মোড় নিতে যাচ্ছে। পত্রপত্রিকায় কলাম লেখার ধুম পড়ে যাবে, টিভিতে টকশো এর ধুম পড়ে যাবে, কলাম এবং টকশোগুলো জুড়ে থাকবে বেগম জিয়ার স্তুতি বন্দনা, টকশোতে নিয়ে আসা হবে মুখচেনা কিছু কুতার্কিককে, যারা অন্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেরাই টেবিল চাপড়ে যুদ্ধংদেহীরূপে রেকর্ড বাজাবে এই বলে, " অমুক দিনের বাংলদেশ প্রতিদিন, আমাদের সময়, আমার দেশ, মানবজমিন সাথে করেই নিয়ে এসেছি, দেখুন, সবাই কত উচ্চ গলায় দেশনেত্রী বেগম জিয়ার ভুয়সী প্রশংসা করেছেন, বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন বলে। আর শেখ হাছিনা তো (নামের আগে প্রধান মন্ত্রী যোগ করবেন না) বেগম জিয়ার সাথে দেখা পর্যন্ত করলেন না।"। অপরপাশে মুখে তালা লাগিয়ে বসে থাকা আওয়ামী ঘরাণার বুদ্ধিজীবিরা মুখের তালা খুলতে খুলতে টকশোয়ের সময় শেষ হয়ে যাবে।

আমি টকশোগুলো দেখবো আর মনে মনে আওয়ামী ঘরাণার বুদ্ধিজীবিদেরকে উত্তর শিখিয়ে দেবোঃ বলবো, আমার সাথে সাথে বলেনঃ

মাননীয় বিরোধী দলের নেত্রী রাষ্ট্রপতির মরদেহে পুষ্পস্তবক অর্পন করতে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন বলে দেশের সকলেই খুশী হয়েছে। সকলেই তো চায়, দুই নেত্রী মিলেমিশে দেশ শাসন করুক। তবে বেগম জিয়াকে বংগভবনে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হয়নি বলে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তার উত্তরে বলা যায়, বাঙ্গালী অতিথিপরায়ন, গৃহে অতিথি এলে তাঁকে যথাযথ সম্মান দিয়েই অভ্যর্থণা করা আমাদের সংস্কৃতির অংশ, তবে সেদিনের অনুষ্ঠানটি ছিল একটি জাতীয় শোকানুষ্ঠান, ভ্যেনু ছিল বঙ্গভবনে, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির বাড়ীতে নয়, এমতাবস্থায় বিরোধী দলীয় নেত্রীকে প্রধান মন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদর অভ্যর্থণা করতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও, পারস্পরিক সৌজন্যবোধ থাকা উচিত ছিল, এমন কি শত্রুর মুখ বন্ধ করতে হলেও সরকারী দলের এই দিকে খেয়াল রাখা উচিত ছিল। সংসদ নেত্রী যেমন ছোট হতেন না বিরোধী নেত্রীর সাথে কুশল বিনিময় করলে, তেমনই বিরোধী নেত্রীও হেরে যেতেন না যদি দুই পা এগিয়ে গিয়ে সংসদ নেত্রীকে 'হেলো' বলতেন। বিনয় বা ভদ্রতার চেয়ে দামী ব্যবহার আর কী-ই বা হতে পারে!


শেখ হাসিনা সংসদে সরকারী দল তথা সংসদ নেত্রী এবং বেগম জিয়া এখনও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপতির চেয়ারখানি অলংকৃত করে রেখেছিলেন।

রাষ্ট্রপতির পদটি কার্যক্ষমতাহীন হলেও, প্রকৃতই তা দেশের সর্বোচ্চ আসন। রাষ্ট্রপতির উপরে একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ নেই। প্রধান মন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তিটিও রাষ্ট্রপতির অধীন। কাজেই রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে, উনার বিদেহী আত্মার প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানানো, শোক প্রকাশ করা এবং সর্বোপরী শেষবারের মত ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদ, বিরোধী দলীয় নেতা এবং সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এটা প্রত্যেকের নিজস্ব অধিকার বা দাবীর ব্যাপার। তাছাড়া বঙ্গভবন তো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন নয়, গণভবণও নয়, সেদিনের অনুষ্ঠানটিও প্রধানমন্ত্রীর কোন পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিল না, তাহলে বঙ্গভবনে যেতে হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নিমন্ত্রণপত্র পেতে হবে কেন?


রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে পুরো জাতি যেখানে শোকাভিভূত, সেখানে ব্যক্তি বিশেষের কথা আসে কেন? রাষ্ট্রপতি তো সকলের অভিভাবক ছিলেন। কোন পরিবারে পিতার মৃত্যুতে বড় ভাই যেমন শোকাভিভূত হন, ছোট ভাইও একই রকম শোকাভিভূত হয়ে থাকেন। তবে হ্যাঁ, এই শোকের সময়টুকু দুই ভাইকে একসাথে সামাল দিতে হয়, এটাই সংসারের নিয়ম। আর ভাইয়ে ভাইয়ে যদি আকচা আকচি থাকে তাহলে বলবো, পারস্পরিক 'মেকী হাসী' বিনিময় করার চেয়ে নীরবে শোক সয়ে যাওয়া অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য।

এবার আসি, দুই নেত্রীর সংলাপের প্রশ্নে। বাঙ্গালী জাতির মনে 'আবেগ' এত বেশী খলবল করে ফুটতে থাকে যে, কখন কী বলে ফেলে তার কোন হিসেব থাকে না। গতকাল ছিল প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে শেষবারের মত শ্রদ্ধা জানানোর দিন, বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতির কফিন রাখা হয়েছিল। মৃতের প্রতি সম্মান জানানোর প্রধান এবং প্রথম ধাপই হচ্ছে 'নীরবতা'। নীরবতাই শোক প্রকাশের অনন্য ধাপ। বঙ্গভবনে যখন দেশী-বিদেশী হাজার হাজার শোকার্ত মানুষের ঢল নেমেছিল, সকলেই যখন সুশৃংখলভাবে, নীরবতায় মাথা হেঁট করে ভালোবাসার মানুষটিকে সম্মান জানাচ্ছিল, শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল, তখন কোন যুক্তিতে দুই নেত্রী দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করবেন! কেনই বা তা করতে যাবেন! দুই নেত্রীকে অনেক ধন্যবাদ যে কালকের দিনে এই নাটকের সূচনা করেন নি বলে।

কেউ কেউ আবেগের আতিশয্যে বলেছেন, বেগম জিয়া নাকি রাষ্ট্রপতিকে দেখার জন্য নিজ থেকেই 'ছুটে' গেছেন, অথচ বঙ্গভবনে কেউ নাকি উনাকে কেউ সাদর সম্ভাষণ জানায় নি, (পত্রিকায় অবশ্য পড়েছি অন্যকথা, বেগম জিয়ার স্বাস্থ্যের দিকটি বিবেচনা করেই নাকি উনাকে ভীড়ের রাস্তা পরিহার করে অন্যপথে বিশেষ দরজা দিয়ে প্রবেশ করানো হয়েছিল)। উনারা বলেছেন, নেত্রী বিষন্ন বদনে নাকি রাষ্ট্রপতির কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পন করেছেন, শোক বইয়ে সই করেছেন, এমনই সব হাজারো উপমা দিয়ে বেগম জিয়াকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। উনারা নেত্রীর বিষন্ন বদন দেখেছেন, আর নিন্দুকেরা দেখেছেন নেত্রীর পরনের 'গোলাপী জর্জেট' শাড়ী। নিন্দুকেরা মনে করেন, সব অনুষ্ঠানের একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ণ থাকে। শোকের রঙ কালো। এমন একটি শোকের দিনে নেত্রীর 'গোলাপী শাড়ী' নির্বাচন করা ঠিক হয় নি। গোলাপী শাড়ীর গোলাপী আভায় উনার মুখমন্ডলের বিষন্নতা ঢাকা পড়েছিল।

কেউ কেউ লিখেছেন,

"মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি ও আপনার দল শোক জানাতে বিলম্ব করেননি। এমনকি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বঙ্গভবনে ছুটে গিয়ে শোকার্ত হৃদয়ে বিষণ্ন মুখে আপনি রাষ্ট্রপ্রধানের কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। বঙ্গভবনের প্রধান ফটকে সরকারের কেউ আপনাকে অভ্যর্থনা জানাল কি না, দরবার হলে কেউ আপনাকে সম্মান দেখিয়ে বরণ করতে এলো কি না তা আপনি আমলে নেননি। যারা আপনার আগমনের সংবাদ পেয়েও বঙ্গভবনের প্রধান ফটকে বা দরবার হলে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসেনি এটা তাদের দৈন্যতা হলেও আপনি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যে সম্মান দেখিয়েছেন, যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, যেভাবে শোকবইয়ে স্বাক্ষর করেছেন, শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনকে ডেকে সমবেদনা জানিয়েছেন তাতে আপনিই বড় হয়েছেন। আপনার ও আপনার দলের নেতারা শোকার্ত চিত্তে যেভাবে বঙ্গভবন থেকে জাতীয় ঈদগাহের জানাজায় শরিক হয়েছেন তাতে গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় বাংলাদেশের মানমর্যাদা উচ্চতায় উঠেছে। আপনি তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক কর্মসূচির সঙ্গে একাত্দ হয়েছেন, দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এমনকি আপনার দুই দিনের বগুড়া ও জয়পুরহাট সফরসূচিসহ দলীয় কর্মসূচি যেভাবে স্থগিত করেছেন তা আমাদেরও সম্মানিত করেছে। এতে এই স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন জনতার হৃদয়ের শ্রদ্ধাই কুড়াননি, মহামান্য রাষ্ট্রপতির আত্দাও শান্তি পেয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে চলমান রাজনীতি ঘুটঘুটে আঁধার নামিয়েছিল। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে শান্তির পথে যিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন তিনিই জনতার হৃদয়ে ঠাঁই পান। এই দেশের জনগণ শুধু প্রধানমন্ত্রীকেই ক্ষমতায় অভিষিক্ত করেনি, আপনাকেও বার বার অভিষিক্ত করেছে।"



হায়রে! কিছুদিন আগেই ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জী যখন এসেছিলেন, তখন আমাদের বিরোধী নেত্রী জামাতের সাথে একতালে একটানা হরতাল দিয়েছিলেন, যে হরতালে গাড়ী ঘোড়ায় আগুন দেয়া হয়েছিল, মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, আর নেত্রী বক্তৃতায় বলেছিলেন, আরও হরতাল দিবেন, হরতালে যে ক্ষতি হবে তা মেনে নিতে বলেছিলেন, কই, তখনতো কেউ একবারের জন্যও বিরোধী নেত্রীর এহেন আচরণের কঠোর সমালোচনা করেন নাই! আর সেই নেত্রীই আজ উনার বগুড়ার সমাবেশ স্থগিত করায় কলামিস্টদের মুখ থেকে প্রশংসার ফুলঝুরী ছুটেছে। শুধু ফুলঝুরীতে ফুল টান পড়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বেলায়। প্রধান মন্ত্রীকে তুলাধূনা করছেন কেন উনি বিরোধী নেত্রীকে বঙ্গভবনের দরজা থেকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে যাননি। কেন প্রধান মন্ত্রী বিদেশী মেহমানদের সাথে খোশগল্পে (!) মেতেছিলেন, কেনই বা তিনি মেহমানদের কাছে বিরোধী নেত্রীকে আলাপ করিয়ে দেননি।



প্রধান মন্ত্রী কী করে ভুলে যাবেন, মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই ভারতের রাষ্ট্রপতির প্রতি বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় নেত্রীর অশোভন আচরনের কথা! ভারতের প্রথম বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতি আমাদের দেশে এসেছিলেন সস্ত্রীক, বাংলাদেশ সফরের আনন্দে কী উচ্ছ্বসিত ছিলেন এই দম্পতি, রাষ্ট্রপতি প্রথমবার শ্বশুরবাড়ী নড়াইলে যাবেন, আগে থেকেই প্রোগ্রাম করা ছিল, বেগম জিয়ার সাথে সাক্ষাত হবে, এটাও আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। অথচ বেগম জিয়া ভারতের রাষ্ট্রপতির সাথে পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাতকার বাতিল করে দিয়ে একটানা হরতাল ডেকেছিলেন। বিরাট কোন ইস্যু ছিল না, শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এই একটানা হরতাল আহবান করেছিলেন। ভারতের রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশে এসে হরতালে অবরুদ্ধ থাকতে হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন আমাদের দেশের মেহমান। উনি নড়াইল গিয়েছিলেন হরতালের মধ্যেই। কই, তখনতো খালেদা জিয়া একদিনের জন্য হরতাল স্থগিত করেন নি! এবং তা নিয়ে প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবিদের কলম থেকে এক ফোঁটাও কালি বের হতে দেখিনি। অথচ এক কলামিস্ট তো প্রনব মুখার্জী আসার আগেই বেগম জিয়ার ঊদ্দেশ্যে কত মধুর ভাষায় আবেদন করেছিলেন, যেন বেগম জিয়া সংসদে যান, প্রনব মুখার্জীকে দেখিয়ে দিতে পারেন, শুধু ভারতের লোকসভাতেই নয়, বাংলাদেশের মহান সংসদেও দারুণ গনতন্র আছে। বিরোধী দল খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে চলেছে। হাঃ কথায় বলে " তোমার কথা তুমি কইতে থাক, শোনা না শোনার ভাগ আমার"। বেগম জিয়া সেদিন যা করেছিলেন, এতে করে তো উনি শুধু ভারতের রাষ্ট্রপতিকেই অসম্মান করেন নি, আমাদের পুরো দেশের অসম্মান করেছেন। কতবড় আনন্দময় ঘটনা হতে পারতো যেদিন দুই দেশের দুই বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের মাটিতে একত্রিত হয়েছিলেন, কত আনন্দের, কত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ছিল বিশ্বের আপামর বাঙ্গালীদের জন্য।


মাত্র কয়েকদিন আগেই মানিকগঞ্জ আর মুন্সিগঞ্জে দলীয় সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া কী অশোভনভাবে বক্তৃতা করে এসেছেন, ইউটিউবে উনার বক্তৃতা শুনে যে কোন সভ্য মানুষের পিলে চমকে উঠার কথা। বেগম জিয়ার সমাবেশ শেষ হতে না হতেই নেত্রকোনা, বগুরা তে হিন্দুদের বাড়ীঘরে হামলা হয়েছে, মন্দিরে দেব দেবী ভাংচুর হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ভাঙ্গা মেরুদন্ড আরও ভেঙ্গে গেছে। কই, আজকের কলামিস্টদের কলম থেকে, আজকের বীর টকারদের মুখ থেকে তো এতটুকু প্রতিবাদ শোনা গেলো না। বেগম জিয়াও তো ছুটে গেলেন না সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে! আর আজ উনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন বলে দেশের বুদ্ধিজীবিরা একেবারে বিনয়ে গলে গলে পড়ছেন।


বুদ্ধিজীবিরা কী করে ভুলে গেলেন যে আজকের রাষ্ট্রপতি মানসিকভাবে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট তারিখেই মারা গেছিলেন, যেদিন অতর্কিত গ্রেনেড হামলায় ২৩জন নেতা কর্মীর সাথে রাষ্ট্রপতির স্ত্রী , আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রী আইভী রহমান মারা গেছিলেন। কেউ কেউ ভুলে যায় সব ঘটনা , আমরা ভুলিনি কিছুই! তখন বর্তমান বিরোধী দল সরকারে ছিলেন। এতবড় বিধ্বংসী গ্রেনেড হামলার বিচার তো হয়ই নি, উলটো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নানা সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগই নাকি নিজেরা বোমাবাজি করেছে। উনার দলের নেতারা, যারা আজ বড় বড় গলায় গণতন্ত্রের কথা বলে, তারা বলেছিল, শেখ হাসিনা নাকি নিজের ব্যাগে বোমা নিয়ে এসেছিল। কিছুই ভুলিনি আমরা। বুদ্ধিজীবিরা নিজেদেরকেই শুধু বুদ্ধিমান মনে করেন। আমরা যেন সবাই গাধা গরু। এই তো সেদিনও টকশোতে হালের গজিয়ে উঠা ঝগড়ুটে বিএনপি দলীয় মহিলা সংসদ সদস্য, হাত মুখ নাচিয়ে, মুখের চেহারা বিকৃত করে টিভি স্টেশান কাঁপিয়ে দিয়ে এক নাগাড়ে বলে গেলেন, আওয়ামী লীগই নাকি সেদিন গ্রেনেড হামলা করেছিল। উনি আরও বলে গেলেন, হাওয়া ভবনের কাছ থেকে সকলের রাজনীতি শেখা উচিত। তারেক জিয়ার কাছ থেকে নাকি রাজনৈতিক শিক্ষা নিতে হবে সবাইকে।

আমাদের রাষ্ট্রপতি স্ত্রীর শোকে মুহ্যমান ছিলেন বলে তো আর বধীর ছিলেন না, অন্ধও হয়ে যান নি। বুকে পাথর চাপা দিয়ে এইসব ভাঁড়ামো দেখে গেছেন, মিতভাষী ছিলেন, সহনশীল ছিলেন, শতভাগ রাজনীতিক ছিলেন, সৎ ছিলেন, আদর্শ স্বামী ছিলেন, তাই স্ত্রীর এমন নৃশংস মৃত্যুর শোক নিজ বুকে ধারণ করেছিলেন, কারো বিরুদ্ধে কিছু নালিশ করেন নি। কিন্তু উনি কী জানতেন না কে বা কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে! কলামিস্ট সাহেব লিখেছেন, বেগম জিয়ার উপস্থিতিতে নাকি রাষ্ট্রপতির আত্মা শান্তি পাবে। জীবিতকালে উনার আত্মায় কতখানি কষ্ট লুকানো ছিল, তার খবর কী নিয়েছিলেন? যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আতি পাতি নেতা নেত্রীরাও গলা ফাটিয়ে বলেছিল, শেখ হাসিনা বোমা ফাটিয়েছে! উনারা কী জানতেন না, শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানাকে জিল্লুর রহমান সাহেব সন্তানের মত ভালোবাসতেন। এ ছাড়াও শেখ হাসিনা ছিলেন দলের সভানেত্রী, তাঁকেই যখন 'আইভী রহমানের' মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছিল, এই ভিত্তিহীন অভিযোগ উনার হৃদয়ে কতখানি ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, সেই খবর কী কলামিস্ট সাহেব অনুভব করতে পারেন নি?

এখন একেবারে হঠাৎ করেই বেগম জিয়াকে বঙ্গভবন এপিসোডের 'নায়িকার' আসনে বসানো হচ্ছে! বেগম জিয়াতো অসম্ভব কিছুই করেন নি। দেশের পনের কোটি ( জামাত এবং মৌলবাদী দল বাদে) জনগণের সাথে উনিও রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে আন্তরিকভাবেই শোক প্রকাশ করেছেন, এটা নিয়ে কারোরই এত উচ্ছ্বসিত হওয়ার তো কিছু নেই। বরং আফসোস হতে পারে এই ভেবে যে, রাষ্ট্রপতিকে এই সম্মানটুকু উনার জীবদ্দশায় দেখালেই ভালো হতো। নিদেনপক্ষে, বন্ধুপ্রতিম দেশের দুই বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতি যখন একত্রিত হলেন, তখন যদি বেগম জিয়া হরতাল প্রত্যাহার করে নিতেন, অতিথির কাছে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মুখ উজ্জ্বল হতো। বাঙ্গালী যে সত্যিই অতিথিপরায়ন জাতি, তা আরেকবার প্রমানিত হতো। উনিও জীবিতকালেই উনার প্রতি বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ দেখে যেতে পারতেন। গতকাল বেগম জিয়া বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন ঠিকই, আন্তরিকভাবেই গিয়েছিলেন, শোকও প্রকাশ করেছিলেন, তবে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতি এগুলো দেখার জন্য আর অপেক্ষায় ছিলেন না, উনি চলে গেছেন উনার অপেক্ষায় থাকা প্রিয়তমা স্ত্রী 'আইভী রহমানের কাছে'।

No comments:

Post a Comment