Tuesday, March 19, 2013

যে দেহকে ভালোবাসি, সেই আমায় কাঁদায় বেশী!

নাহিদ জাহান লীনার সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। তাকে আমি আগে কোথাও দেখিওনি, তার কথা শুনিওনি।   আজকেই তাঁর কথা প্রথম জানলাম।  দুপুরে অনলাইনে গিয়ে পত্রিকা পড়ার জন্য প্রিয়. কমে যেতেই একটি  আর্টিক্যালের দিকে আমার নজর আটকে গেলো,  নাহিদ জাহান লীনাকে নিয়ে লেখা আর্টিক্যাল। আর্টিক্যালটির দিকে এক লহমায় নজর গেছে লীনার অনিন্দ্য সুন্দর ছবির দিকে তাকিয়ে।  গতকাল ১৭ই মার্চ রবিবার রাত ১টার দিকে  ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত লীনা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪০। পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। সাংবাদিকতা ছাড়াও তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নানারকম সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লীনা লড়াই করছিল ২০০৯ সাল থেকে। ২০১৩ সালের শুরুতেই তাঁকে  মৃত্যুর কাছে পরাজয় বরণ করতে হলো। তাঁর মৃত্যুতে  একমাত্র সন্তান ছয় বছর বয়সী 'আনা' মাতৃহীন হয়ে গেল। কয়েকমাস আগে আমিও মাতৃহীন হয়ে গেছি। আনার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য আকাশ  আর  পাতালের  মধ্যেকার  পার্থক্যের সমান হলেও,  আমাদের  দুজনের মধ্যে  মিলও আছে, সেটা হচ্ছে আমরা দুজনেই আজ  মাতৃহারা  এবং দুজনের মা-ই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আনা তার মায়ের জন্য যতখানি কাঁদছে, আমি এখনও আমার মায়ের জন্য ততখানিই কাঁদছি। আমরা দুজনেই আজ অসহায়, ক্যান্সারের নির্মম শক্তির কাছে পরাজিত।


আমি ইদানিং ঘরে থাকতেই বেশী পছন্দ করি। সাত বছরেরও বেশী সময় ধরে ওয়ালমার্টে চাকুরী করছি, প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগতো, ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে গিয়ে কত ধরণের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, কত রকমের গল্প শুনেছি, কত ধরণের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা যে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ইদানিং খুব টায়ার্ড লাগে, আর ভাল লাগে না অফিস কাছারী করতে। সেজন্যই ছুতোয় নাতায় বাড়ী চলে আসি।  বিশেষ করে এক ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকেতো আসা চাই-ই চাই, বাড়ী আসতে গেলে আসা-যাওয়ায় চলে যায় বিশ মিনিট, বাকী চল্লিশ মিনিট আমি ঘরে থাকি।  খুব ভাল লাগে।  নিন্দুকেরা অবশ্য  বলে, আমি নাকি ফেসবুকের টানে বাড়ী চলে আসি। জানিনা, নিন্দুকের কথা সত্যি কিনা, তবে বাড়ী এসে আমি সত্যিই কম্পিউটারে গিয়ে বসি। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঘোরাঘুরি করি, এখানেও হরেক রকমের সংবাদ পাঠ করি। আগে অবশ্য কাজে যাওয়ার সময় সাথে করে বিরাট এক গল্পের বই নিয়ে যেতাম। পনের মিনিটের টি-ব্রেকেও আমি গল্পের বইয়ে নাক-মুখ ডুবিয়ে রাখতাম। বইগুলো এখন আমার বুকশেলফে শোভা পাচ্ছে। বই পড়তে আর ভাল লাগে না। তার চেয়ে ফেসবুক অনেক বেশী জীবন্ত, অনেক বেশী দুরন্ত মনে হয়।

আমার মায়ের মৃত্যুর পরে আমার মধ্যে এই পরিবর্তণটা এসেছে। সম্প্রতি আমার মা মারা গেছেন  ইউটেরাসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। রোগ চিহ্নিত হয়েছে অগাস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে, মা মারা গেছেন অক্টোবারের আট তারিখে। মাত্র দুই মাসের মধ্যে সব কিছু শেষ। সেই থেকে আমার মনের এই পরিবর্তন! একটুও শান্তি পাই না মনে। আমার মায়ের বয়স হয়েছিল পঁচাত্তর বছর। আমি মায়ের তৃতীয় সন্তান, মায়ের কনিষ্ঠ সন্তানের বয়স চল্লিশ পার হয়ে গেছে। অর্থাৎ গত চল্লিশ বছর  আগে মায়ের দেহের অভ্যন্তরে থাকা 'ইউটেরাস' বা 'জরায়ু' নামক অর্গ্যানটি তার দায়িত্ব শেষ করেছিল মায়ের কনিষ্ঠ সন্তানটিকে ধারণ করে। মা হয়তো ভুলেও গেছিল তার দেহের ভেতরে থাকা 'জরায়ু' নামের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটিকে। কিন্তু মা ভুলে গেলেও ক্যান্সার নামক কর্কটরোগ মশাই সেটা ভুলে নি। সে তার বিষাক্ত থাবায় খাবলে ধরেছে  আমার বৃদ্ধ মায়ের জরায়ুটিকে, যেখানে মা আমাদের চার ভাই বোনকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে ভাবি, কী এমন ক্ষতি হতো আমার মা'কে শান্তিতে মরতে দিলে! পঁচাত্তর বছর বয়সে মারা যাওয়ার জন্যতো কত রকমের অসুখ আছে। হার্ট অ্যাটাক হলেও মন্দ হতো না, শেষ পর্যন্ত ক্যান্সার, তাও আবার দেহের রিটায়ার্ড একটি অংশে। ঈশ্বরের লীলা বুঝা ভার। ক্যান্সারের নাম শুনলে এখনও আমাদের বুক কাঁপে। শুনেছি, আমার মায়েরও বুক কেঁপেছিল। তবে উনাকে জানতে দেয়া হয়নি যে উনার ক্যান্সার হয়েছে। বলা হয়েছিল, ইউটেরাসে সিরিয়াস ইনফেকশান হয়েছে। রেডিওথেরাপী দিলেই সেরে যাবে। মা একবার বলেছিল, " দেখিস, আবার যেন কেমোথেরাপী না লাগে। কেমোথেরাপী দিলে বাঁচবো না"! আমরা মা'কে জানতে দিতে চাইনি বলেই বোধ হয় থেরাপী শুরু হওয়ার আগেই মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। খুব বেঁচে থাকার শখ ছিল,  কর্কট রোগ আমার বৃদ্ধা মায়ের জরায়ুতে অযাচিতভাবে, অনাহুতের মত গিয়ে বাসা বেঁধেছিল। জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত দেহ পারেনি ক্যানসারকে রুখে দাঁড়াতে। আহারে! নারীর এত সাধের অঙ্গ, যেখানে একটি ভ্রূন থেকে একটি পূর্ণাংগ মানবশিশুর সৃষ্টি হয়, তার প্রতি এমন অবিচার!

লীনার করুণ জীবনাবসানের খবরটি আমার অন্তরে-বাহিরে ঝড় তুলেছে। অদৃশ্য ক্যান্সারের প্রতি ঘৃণা উপচে পড়ছে। ক্যান্সারের কী কোন বিবেক বিবেচনা থাকতে নেই! ক্যান্সারও কি পাকিস্তানী মিলিটারীর মত পিশাচ, ক্যান্সার কী কতগুলো নারীলোলুপ পুরুষের মত উন্মাদ! ক্যান্সারও কি 'ধর্ষক' , 'কামুক' পুরুষের ন্যায় নির্লজ্জ, পাষন্ড?  ক্যান্সারের কী সৌন্দর্য্যবোধ, রুচী বোধ থাকতে নেই! নারী শরীর দেখলেই কি ক্যান্সারের ক্ষিদে পেয়ে যায়? নাহলে পাকিস্তানী হায়েনাদের মত কেন সে স্থান কাল ভুলে একজন বৃদ্ধার 'জরায়ু'তে আক্রমণ করলো, কেনই বা সে দুই বছর বয়সী শিশুর মায়ের স্তনে গিয়ে আস্তানা গাড়লো? এই সব নষ্ট রক্তবীজের ঝাড়দের কি আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই?  পঁচাত্তর বছর বয়সের এক নারী তো এমনিতেই তাঁর দেহের 'নারী অঙ্গের' অস্ত্বিত্বের কথা ভুলেই যায়। নারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গই তো হচ্ছে 'স্তন এবং জরায়ু', যা নারীকে 'নারী'র মর্যাদা দিয়েছে, নারী জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।  প্রতিটি নারীর কাছেই তার দেহের এই দুটি অঙ্গ পরম ভালোবাসার, পরম মমতার। এ দুটি অঙ্গ নারীকে দিয়েছে এক ও অদ্বিতীয় ক্ষমতা।  এ দুটি অঙ্গ আছে বলেই পৃথিবী আজও ঘুরছে, আজও নতুন নতুন প্রাণের সৃষ্টি হচ্ছে। আজও কোটি কোটি শিশুর  কলকাকলীতে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে।  পৃথিবীর বুকে এসে প্রথম যে পাণীয়ের সাথে শিশুর পরিচয় ঘটে, তা হচ্ছে মায়ের বুকের দুধ। শিশুকে স্তন্য দান করার সাথে সাথে নারী হয়ে উঠে 'মা'। আর সেই মা'কেই কিনা সন্তানের কাছ থেকে এভাবে কেড়ে নিতে হয়!

ছবিতে লীনাকে দেখে নিজের অজান্তেই দুই চোখ জলে ভরে এসেছে। কী প্রাণবন্ত, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, দারুণ মিষ্টি দেখতে! একমাত্র মেয়ের সাথে তোলা ছবিগুলো দেখে বুক ফেটে যায়! আর আর্টিক্যালটা পড়ার পর থেকে কোনভাবেই শান্তি পাচ্ছি না। আমি জীবনকে বড্ড বেশী ভালোবাসি। বেঁচে থাকার যে কী সুখ, তা যেন পলে পলে উপলব্ধি করি। মানুষ হয়ে জন্মেছি, এ যে কত আনন্দের, কত গর্বের! এই জীবন ছেড়ে চলে যেতে হয় এত তাড়াতাড়ি! মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে! অসহায়ের মত আমারও ঈশ্বরকে দোষারোপ করতে ইচ্ছে করে।

ঈশ্বরকে তো এমনিতেই হাজারবার দায়ী করি নারীকে অবলা বানিয়ে পাঠিয়েছেন বলে।  দেয়ার মধ্যে দিয়েছেন একতাল রূপ আর মাতৃত্বের ক্ষমতা। অথচ এত রূপৈশ্বর্য্য দিয়েও ঐশ্বর্য্যকে রক্ষা করার মন্ত্র শিখিয়ে দেননি। স্তন যুগলে অমৃত ধারা দিয়েছেন সন্তানের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যে, অথচ হায়েনার কামড় থেকে বাঁচবার জন্য অমৃত কুম্ভের তলায় একটু বিষের ব্যবস্থা রাখেন নি। যদি বিষের ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে যে বিকৃত কামুকের দল নারীর এই অনাবিল সৌন্দর্য্যের আধারকে নিছক একতাল মাংস মনে করে খুবলে খেতে চায়, তাদের সারাদেহ বিষের প্রতাপে বিকল হয়ে যেতে পারতো। সব দোষ ঈশ্বরের। যখনই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কোন লেখা পড়ি,  ঐ সময়ে পাকিস্তানী হায়েনাদের অত্যাচারের কাহিনী পড়ি, যখনই পড়ি, কী অত্যাচারটাই তারা করেছিল লাখ লাখ মেয়ে, নারীর উপর, দূর্দমনীয় আক্রোশে পা থেকে মাথা পর্যন্ত গরম হয়ে যায়। আহ! কত কাহিনীতে যে পড়লাম, হায়েনার দল তাদের ক্যাম্পে রেখে মেয়েগুলোক্বে শুধু বলাৎকারই করেনি, পৈশাচিক উল্লাসে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় নি, নখের আঁচড়ে, বিষাক্ত দাঁতের কামড়ে নারীদেহ ক্ষত বিক্ষত করেছে, নারীর দেহ থেকে তার স্তন যুগল কেটে ফেলেছে, আরও যতরকম সম্ভব-অসম্ভব, অবর্নণীয় কায়দায় অত্যাচার করেছে, এগুলো জানার পর শুধুই ঈশ্বরকে দোষারোপ করা ছাড়া  আমি অবলা আর কী করতে পারি!

শুধুই পাকিস্তানী মিলিটারী কেন, আমাদের চারপাশে কত ভদ্রবেশী পশু আছে, যাদের ভয়ে মেয়েদেরকে সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, ভীড়ে যেখানেই যাক নারী, কিছু হায়েনাও সেখানে জুটে যায়। হায়েনারা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় তক্কে তক্কে থাকে, সুযোগ পেলেই লোমশ হাত দিয়ে নারীর বক্ষ ছুঁইয়ে দেয়, পৈশাচিক আনন্দে চোখ মুখ চকচক করে উঠে। আর 'অবলা নারী', সবাই তো আর 'ফেরদৌসী প্রিয়ভাষীনির' মত অমন সাহসী নয়, অথবা একজন 'তসলিমা নাসরীনের' মত বিদ্রোহী নয়,  তাই মুখ বুজে অপমান সয়ে মাথা নীচু করে সরে আসাকেই স্বস্তির মনে করে। এইজন্যই 'ক্যানসার' এর উপর আমার এত রাগ। ক্যান্সারও তো পাকিস্তানী মিলিটারী বা আমাদের চারপাশে লুকিয়ে থাকা হায়েনাদের মতই হিংস্র। ক্যান্সার হিংস্র বলেই  আজকের পৃথিবীতে কোটি কোটি নারী হয় ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে, নয়তো ইউটেরাস, ওভারীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।

লীনাকে আমি চিনতাম না, তাই লীনার কষ্টগুলোকে কাছে থেকে দেখিনি কিন্তু আমার মা'কে দেখেছি। কী কষ্ট বুকে নিয়ে, কী বেদনা দেহে নিয়ে উনি দুটি মাস বিছানায় ছটফট করেছেন। লীনা নাকি এক মুহূর্তের জন্যও সাহস হারায় নি, কেমোর পর কেমো নিয়ে গেছে, অপারেশান করিয়েছে, আমার মা-ও ভয় পাননি, সাহস বুকে নিয়েই অপারেশান থিয়েটারে গিয়েছিলেন, পর পর দুইবার। লীনার কথায় কেন বার বার আমার মা'কে মনে পড়ছে! নারীরা মায়ের জাত বলে! লীনা তার শিশু কন্যাটির জন্য বাঁচতে চেয়েছিল, আমাদের মা আমাদের জন্য বাঁচতে চেয়েছিলেন। অথচ দুরারোগ্য ক্যান্সার একজনের স্তনে বাসা বেঁধেছিল, আরেকজনের অকেজো জরায়ুতে বাসা বেঁধেছিল। এ দুটি অঙ্গই নারীর অহংকার, এ দুটি অঙ্গ নিয়েই নারী পুরুষ থেকে আলাদা, এ দুটি অঙ্গ পারস্পরিকভাবেই মানব সন্তান সৃষ্টি ও রক্ষনাবেক্ষনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে! আমি নারী যে আমার এ দুটি অঙ্গকে বড়ই ভালোবাসি! এ দুটি অঙ্গ দিয়েই আমি আজ একাধারে নারী ও মা হতে পেরেছি। নিজের অঙ্গকে ভালো না বেসে পারা যায়! আর ভালোবাসি যাকে, ভালোবাসি যা, সে তো কাঁদাবেই, সেই তো কাঁদায়!


1 comment:

  1. "ভালোবাসি যাকে, ভালোবাসি যা, সে তো কাঁদাবেই, সেই তো কাঁদায়!"
    অসাধারন !

    ReplyDelete