Friday, March 22, 2013

একজন মানুষের কয়বার মৃত্যু হয়!

২০০৪ সালের ২১শে অগাস্টের বিকেলে আওয়ামীলীগের জনসভায় যখন ভয়াল গ্রেনেড হামলা হচ্ছিল, আমি তখন আমেরিকার মিসিসিপি রাজ্যের ছোট শহর কলম্বাসের অ্যাপার্টমেন্টে গভীর ঘুমে ছিলাম।  কারণ তখন আমেরিকায় ভোর রাত। মনে আছে, মাত্র তিনদিন আগেই অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠেছিলাম। কম্পিউটার সেট আপ করা হয়ে উঠেনি, টিভি সেট করা হয় নি, অর্থাৎ আধুনিক বিশ্বের সাথে কোন যোগাযোগই ছিল না আমার। আমেরিকার ২১শে অগাস্ট বিকেলে আমি আমার  কাজিনের কাছ থেকে একটি ফোন কল পেয়েছিলাম, যার সারমর্ম ছিল,

ঢাকায় আওয়ামীলীগের জনসভায় কে বা কারা গ্রেনেড হামলা করেছে। গ্রেনেড হামলায় প্রচুর মানুষ হতাহত হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও উনার গায়ের আঘাত লেগেছে। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানের দুই পা উড়ে গেছে।

এমন ভয়ানক সংবাদ শোনার পর থেকে সম্ভব-অসম্ভব অনেক কিছুই ভাবছিলাম। মনের পর্দায় ভেসে উঠলো '৭৫ এর ১৫ই অগাস্টের সেই কালো সকালের কথা। সেদিন আমি ছিলাম নিতান্তই এক বালিকা, কম্পিউটারের নামই শুনিনি তখনও। 'বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে' খবরটি নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে  এসেছিল আমার ১৩ বছর বয়সী ভাই। তার মানে, আমার ভাইগুলো সব সময় ভয়ানক দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে আসে। আমি রাজনীতি সচেতন পরিবারের মেয়ে, শিশুকাল থেকেই  ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশ, মাস্টার'দা, প্রীতিলতা, চিত্তরঞ্জন দাস,  ঋষি অরবিন্দ, মহাত্মা গান্ধী,  শেখ মুজিব (বঙ্গবন্ধু), শেরেবাংলা, মাওলানা ভাসানীর গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন  নানা দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে বলে 'মুক্তিযুদ্ধ' নিয়ে গর্ব করতে শিখেছি। বড় হয়ে সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা না থাকলেও রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেছি। আর এ সকল কারণেই  সুদূর আমেরিকায় বসে দেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া এমন প্রলয়ংকরী ঘটনায় খুবই বিপন্ন বোধ করেছি।

আমার স্বামীকে ফোন করে জানিয়েছি গ্রেনেড হামলার সংবাদ। সাথে সাথে এও বলেছি, যেখান থেকে সম্ভব হয় একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞকে ধরে নিয়ে আসতে। আমার স্বামী বুঝতে পেরেছিলেন আমার অস্থিরতার পরিমান, দেশের সংবাদ জানার আকুলতায় আমি খুব ছটফট করছিলাম।

সেই বিকেলেই  বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে এসে ইন্টারনেট সেট আপ করে দিয়ে গেল। আমি কম্পিউটার অন করেই সংবাদপত্রের পাতা খুলে বসলাম।  যে বিভৎস ছবি দেখলাম, তা আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে আলোড়ণ সৃষ্টি করলো। রক্তাক্ত লাশ, রাস্তার উপর হুমড়ী খেয়ে পড়ে থাকা মহিলা, পুরুষের নিথর দেহ, জুতা, স্যানডেল চারদিকে ছড়ানো, কালো ধোঁয়া, সাদা ধোঁয়ায় ঢাকা চারিধারের সুউচ্চ দালান কোঠার ছবির পাশেই আরেকটি ছবি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আমার দিকে। ছবির মানুষটির পরণে সাদা জমিনের মাঝে কালো বুটি দেয়া শাড়ী, সেই সাদা-কালো শাড়ীটি রক্তে রাঙানো, মানুষটির দুই চোখ খোলা, পাথর চোখে তাকিয়ে আছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চোখের পলক পড়েনি অনেকক্ষণ। উনাকে ঘিরে আছে আরও কিছু মানুষ, কেউ বা তাঁকে পাঁজাকোলা করার চেষ্টায় ছিল, তখনই ছবিটা তোলা হয়েছে। ছবির নীচে মানুষটির পরিচয় দেয়া ছিল, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমান।

২০০৪ সালে আমাদের ডিশ নেটওয়ার্ক ছিল না, তাই পরের দিনের অনলাইন সংবাদের অপেক্ষায় থেকেছি, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করেছি, " ঈশ্বর, যদি পারো, মানুষটিকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তাঁর পরম প্রিয় স্বামী-সন্তানের কাছে ফিরিয়ে দাও, নাহলে তোমার কাছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টেনে নাও"। আমার প্রার্থণায় খাদ ছিল না, আমি যখনই জেনেছি, আইভী রহমানের দুটি পা উড়ে গেছে,  আমি এরপর থেকেই মনে প্রাণে চেয়েছি, পরম করুণাময় যেন সকলের প্রিয় আইভী চাচীকে নিজের কোলে তুলে নেন।

ঈশ্বর আমার প্রার্থণা শুনেছেন, তিনদিন চরম কষ্ট পাওয়ার পর আইভী রহমান শান্তির দেশে, না ফেরার দেশে চলে গেছেন। না ফেরার দেশে চলে গিয়ে আইভী রহমান বাংলাদেশের পনের কোটি জনগণকে চরম গ্লানি, চরম লজ্জার হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে গেছেন। একবিংশ শতাব্দীর বাঙালী এত নিষ্ঠুর, এত পিশাচ, এত রক্ত পিপাসু, এত ক্ষমতালোভী যে সামান্য গদী রক্ষার লোভে গ্রেনেড হামলা করে এতগুলো তরতাজা প্রাণের স্পন্দন থামিয়ে দিল! এই লজ্জা সারা বাংলার মানুষের, এ লজ্জা আধনিক সভ্যতার! এ আমাদের জন্য এক বিরাট কলঙ্ক। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা কী করে যেন প্রাণে বেঁচে গেছিলেন, তা কেউ জানে না। মাঝে মাঝে ঈশ্বর তাঁর স্নেহময় হাত কারো কারো দিকে প্রসারিত করে দেন, সে যাত্রায় ঈশ্বরের হাত শেখ হাসিনার দিকে প্রসারিত ছিল বলেই বৃষ্টির মত নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড বা বোমার আঘাত থেকে উনি বেঁচে গেছিলেন।

গ্রেনেডের আঘাত থেকে বেঁচে গেছিলেন আরও একজন, আওয়ামী লীগের  সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান সাহেব। পত্রিকায় একটি ছবি দেখেছিলাম, বিধ্বস্ত একটি ট্রাকের এপাশে জিল্লুর রহমান সাহেব মাথা নীচু করে নিজেকে আড়াল করেছেন, আর ট্রাকের অপর পাশে গ্রেনেড হামলায় হতাহতরা নিথর হয়ে পড়ে আছে। তখন তো উনি জানতেও পারেননি, কী ভয়াবহ দুঃসংবাদ উনার জন্য অপেক্ষা করছে! আমার মত উনিও নিশ্চয়ই পত্রিকা পড়ে অথবা লোকমুখে জানতে পেরেছিলেন যে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী বোমার আঘাতে পা দুটি হারিয়েও আশপাশের সহকর্মীদের কাছে বার বার স্বামীর খোঁজ নিচ্ছিলেন। আইভী রহমানকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখনও নাকি উনি আশপাশের কর্মীদের বলছিলেন, তারা যেন জিল্লুর রহমানের খোঁজ নেয়। এই না হলে স্ত্রী, এই না হলে প্রেমিকা, এই না হলে নারী! আহ! এমন একজন মমতাময়ী স্ত্রীর স্বামী ছিলেন জিল্লুর রহমান, যাঁদের বিয়ে হয়েছিল স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর সহযোগীতায়।

পত্রপত্রিকা পড়েই জেনেছি, ষাটের দশকে উনাদের বিয়ে হয়েছিল। আইভী রহমান ছিলেন বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে, দারুণ সুন্দরী, স্মার্ট, শিক্ষিতা। জিল্লুর রহমানও ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, যাঁর পিতা ছিলেন আইনজীবী, উনি নিজেও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত।  কতখানি আধুনিক মনস্ক হলে পরে সেই ষাটের দশকের রাজনীতিতে জড়িত হতে পেরেছিলেন আইভী রহমান, ভাবলে অবাক হতে হয়। শখের রাজনীতি করেননি বলেই বিয়ের পরও রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন ২০০৪ সালের ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার আগ পর্যন্ত।

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকেও দাম্পত্য জীবনে ছিলেন ঈর্ষণীয় পর্যায়ের সুখী, তিনটি সন্তানের পিতা-মাতা। স্ত্রী হিসেবে আইভী রহমান ছিলেন অত্যন্ত গুণী। বাইরে-ঘরে সমস্ত দিক সামলে রেখেও স্বামীর দিকে পূর্ণ খেয়াল রাখতে পারে কয়জন নারী! স্বামীকে কোন পোষাকে মানাবে ভাল,  কোন অনুষ্ঠানে কোন পোষাক পড়ে যাবেন, অথবা ঈদের পাঞ্জাবী কেমন হবে, স্বামী কোন খাবারটা বেশী পছন্দ করেন, এ সকল অতি ছোট ছোট বিষয়ের দিকেও উনি খেয়াল রাখতেন বলেই হয়তো বা জিল্লুর রহমান সাহেবের জীবনটা এত সুশৃংখল ছিল।  ব্যক্তিজীবনে সুখী ছিলেন বলেই রাজনৈতিক জীবনেও ছিলেন  কর্মের প্রতি, নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বস্ত, নিষ্ঠাবান এবং দায়িত্বশীল। তিনটি ছেলে-মেয়েকে উনারা রাজনীতির বাইরে রেখে মানুষ করেছেন, কোন দূর্নীতির বেড়াজালে জড়ান নি। নিন্দুকেরাও বলে, জিল্লুর রহমান এবং আইভী রহমান ছিলেন আদর্শ দম্পতি।

আইভী রহমান নিজেও ছিলেন শৌখিন স্বভাবের, রাজনীতির বাইরে উনার যে সুখী গৃহকোন ছিল, সেই গৃহকোনটি ছিল নিজের পছন্দে সাজানো। উনি অতিথি আপ্যায়ন করতে ভালোবাসতেন। দলীয় কর্মীদের ভালোবাসতেন, অপরকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন, নিজেও দুই একটা জিনিস খেতে পছন্দ করতেন। দুপুরের খাবার শেষে মিষ্টি খাওয়া ছিল উনার প্রিয় অভ্যাস। সেই ২১শে আগস্টের দুপুরেও উনি মিষ্টি খেয়েছিলেন। মিষ্টিমুখ করেই আওয়ামীলীগের সমাবেশে গিয়েছিলেন।  সেদিনের পর আর উনার নিজ হাতে সাজানো সুখী গৃহকোনে ফিরে আসেননি। সঙ্গী হারা, জুটিহারা হয়ে শূণ্যগৃহে ফিরে এসেছিলেন একাকী জিল্লুর রহমান। সেদিনই উনাদের এত দীর্ঘ সুখী জীবনের সমাপ্তি ঘোষিত হয়েছিল।

সকলের চোখে যাঁরা আদর্শ দম্পতি হিসেবে বিবেচিত হতেন, সেই দম্পতির একজন যদি বিনা অপরাধে, একেবারে অতর্কিতে, অসহায় অবস্থায়  অপরের জিঘাংসার গ্রেনেডে বেঘোরে প্রাণ হারায়, তাহলে অপরজনের কী অবস্থা হতে পারে! ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় কী শুধু আইভী রহমানই মারা গেছিলেন, উনার সাথে সাথে কী জিল্লুর রহমানেরও মৃত্যু হয় নি? একজন মানুষ কয়বার মরতে পারে? দেহের মৃত্যুটাই কী সব? মনের মৃত্যু কী কিছুই না?  একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মন যখন মরে যায়, তার দেহটিকে তখন পাখীশূণ্য খাঁচা মনে হয়। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্টের পর থেকে ২০১৩ সালের ২০শে মার্চের বিকেল পর্যন্ত জিল্লুর রহমানের দেহটাই শুধু বেঁচে ছিল, সে দেহে প্রাণ ছিল না। ২০শে মার্চ তারিখে সেই দেহটিও বিদ্রোহ করলো।

রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে সারা দেশ শোকাহত, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ কেঁদেছে, সকলেই উনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছে। রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে বিরোধী দল বিএনপি তাদের পূর্বঘোষিত হরতাল কর্মসূচি স্থগিত করেছে। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী,  মাননীয় বিরোধী নেত্রী  বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন। সারা দেশের  শোকসন্তপ্ত জনগণ প্রয়াত রাষ্ট্রপতির প্রতি বেগম জিয়ার শ্রদ্ধাঞ্জলীকে খুবই ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। তাদের সকলের মনেই ক্ষীন প্রত্যাশা জেগেছে, দুই নেত্রীই হয়তো বা অনুধাবন করতে পারবেন, জীবন একটাই, আজ হোক কাল হোক, সকলকেই এই পৃথিবীর মায়া কাটাতে হবে, মানুষ চলে যায়, রেখে যায় তাদের কর্ম, ফেলে যায় পালক পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি উনার কর্মের দ্বারাই এত বড় স্বীকৃতি পেয়েছেন। লাখ লাখ মানুষ এসেছিল উনাকে শেষ বারের জন্য দেখতে, প্রাণের ভালোবাসা উৎসর্গ করতে। আমাদের দুই নেত্রীকেও আমরা সবাই ভালোবাসতে চাই। দেশটা চলেছে স্রোতের উল্টোপিঠে। আপনারা দুজন মিলে দেশটিকে বাঁচান, শত্রুর বিষাক্ত ছোবল হতে রক্ষা করুন। আর কাউকে যেন এভাবে একটানা নয়টি বছর জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে না থাকতে হয়!




No comments:

Post a Comment