Monday, March 11, 2013

তবুও দহন লাগে!

আজকের দিনটি আমার জন্য মহানন্দের দিন হওয়ার কথা ছিল। তিন মেয়ে, বড়  মেয়ের জামাই, ছোট  ভাই, ভাইয়ের বৌ, পিসী, পিসেমশায়সহ সকলে একসাথে এক বাড়ীতে মিলনমেলা বসেছে। আমাদের এই পারিবারিক 'মিলনমেলা'টি নানা দিক থেকেই  তাৎপর্য্যপূর্ণ। প্রথমতঃ আমাদের একেকজনের বাস একেক শহরে, পিসী আর পিসেমশায় থাকেন বাংলাদেশে। আমরা থাকি মিসিসিপি স্টেটে, ভাই থাকে জর্জিয়া স্টেটে, এক মেয়ে থাকে নর্থ ক্যারোলাইনা, ভাইয়ের বৌ পড়াশোনা করে কানাডা  ইউনিভার্সিটিতে, আমাদের বড় মেয়ে আর তার বর থাকে টেক্সাস। কারো সাথে কারো সহসা দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ  নেই বললেই চলে। আমার দীর্ঘ তের বছরের প্রবাস জীবনে এই প্রথমবারের মত সুযোগ এসেছে, এমন পরিপূর্ণ পারিবারিক মিলনমেলা আয়োজনের।

আমার স্বামী এবং ছোটভাই, দুজনেই অধ্যাপনা করেন, তিন মেয়ে পড়াশোনা করে, আমি ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে চাকুরী করি।  পরিবারের সকলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত বলেই ওদের ছুটিছাটা গুলো একই সময়েই হয়ে থাকে, ব্যাতিক্রম আমি। কর্পোরেট অফিসের চাকুরীতে স্প্রিং ব্রেক, সামার ব্রেক অথবা উইন্টার ব্রেক বলে কিছু নেই। তাই আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে ভ্যাকেশান কাটানোর ইচ্ছে থাকলেও সব সময় সেটা সম্ভব হয় না।

এই বছর আমার পিসী আর পিসেমশায় আমেরিকা আসার ভিসা পেয়েছেন এবং মাস ছয়েক তাঁদের ছেলে -ছেলে বৌয়ের সাথে কাটিয়ে যাবেন বলেই গত মাসে আমেরিকা এসে পৌঁছেছেন। পিসীর আসার সংবাদ পাওয়ার পর থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি, কবে উনারা আমাদের বাড়ীতে উনাদের পা ফেলবেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপি বসন্তকালীন  ছুটি সম্বল করে ভাই তার মা, বাবা, স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের বাড়ী বেড়াতে এসেছে। নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে মেজো মেয়েও এসেছে বসন্তকালীন ছুটিতে। আমি অনেক কষ্ট করে চারটি দিনের ছুটি ম্যানেজ করেছি। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই ছুটিতে সবাই মিলে টেক্সাস যাব, বড় মেয়ের বাড়ীতে। বড় মেয়ের বিয়ে হলো গত বছর, মেডিক্যাল স্কুলের পড়া শেষ করে মেয়ে এখন  ডালাসের একটি হাসপাতালে রেসিডেন্সী করছে। তরুণ দম্পতী কয়েক মাস আগে একটি বাড়ী  কিনেছে,  সেই থেকে আমাদেরকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করেই চলেছে,  একটিবারের জন্য হলেও ওদের বাড়ীটা ঘুরে দেখে যেতে। আমরাও চাইছিলাম, মেয়ের জীবনের সাফল্যের শুরুটুকু নিজ চোখে দেখে যেতে। অনেক কষ্ট করেছি আমরা, মেয়েগুলোকে জীবনের এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে, আর আমাদের চেয়ে আরও কয়েকগুণ বেশী পরিশ্রম করেছে আমাদের মেয়েগুলো, দুই পক্ষেই অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি, নানা প্রলোভন উপেক্ষা করেছি, এজন্যই মেয়েদের যে কোন সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হই, আনন্দে আত্মহারা না হলেও আত্মহারা হতে চাই।

আমরা সকলেই খুব আনন্দের মুডে ছিলাম। জর্জিয়া থেকে ভাই, তার বৌ, মা-বাবাকে নিয়ে আমাদের বাড়ী এসে পৌঁছাতেই আমাদের আনন্দ বেড়ে কয়েকগুণ বেশী হয়ে যায়। কোনটা রেখে কোনটা করবো, ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না। দুই দিন আগে থাকতেই নানা রকম খাবার রেঁধে রেখেছি, পিসী যদিও ্সম্পর্কে আমার বাবার বোন, তাই বলে আমার স্বামী আমার চেয়ে এক বিন্দুও কম খুশী হননি। তিনি অনেক আগেই মা-বাবাকে হারিয়েছেন, বিদেশ বিভুঁইয়ে মাতৃস্থানীয়া স্বজনকে কাছে পাওয়াটাই পরম বিস্ময়ের, পরম আনন্দের মনে হয়।

আমরা যখন খুব আনন্দ করছিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই দেশ থেকে আমার বাবা ফোন করেছেন, ফোন ধরেছি আমি নিজে। ফোনে হ্যালো বলতেই কোনরকম ভণিতা ছাড়াই বাবা সরাসরি বললেন, ব্লগে লেখালেখি না করতে। আমার বাবা এমনই ব্যাক্তিত্বের অধিকারী যে উনার কথার উপর দিয়ে আর কারো কথা চলে না। উনি সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলে তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না, কারণ প্রশ্ন করে খুব একটা লাভ হয় না। আমিও প্রশ্ন করিনি, তবে খুব আহত হয়েছি। স্বৈরশাসনের চাপে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কে জলাঞ্জলী দিয়েছিলাম, আর জীবনের এই পর্যায়ে এসেও এমন 'এরশাদী' হুঙ্কার শুনতে হলো বলে অভিমান করে ফোন রেখে দিয়েছি। ফোন রেখে দেয়ার সাথে সাথেই আমার দুই চোখ ফেটে জল এসেছে, লেখালেখির মত এমন  আনন্দময় কাজে পিতার কাছ থেকে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারী হতেই মনে পড়ে গেল দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা। আমার মনে পড়ে যায়, কোন অশান্তি বুকে নিয়ে আমার বাবা দিন কাটাচ্ছেন, কী ভয় বুকে চেপে আমার বাবা দিন কাটাচ্ছেন,  স্বজনের আগমনে দুই একটা দিন অন্যরকম এক জগতে বিচরণ করছিলাম। আবার ফিরে এলাম বাস্তবে, এবং খুব জোর এক মানসিক ধাক্কা খেয়ে। বাবার বকা খেয়েই ব্লগে লেখা ছেড়ে দেবো, এমনটা ভাবিনি। কারণ আমি জানি, আমি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কিছু লিখিনা, আমার বাবা ব্লগ কী জিনিস তাই জানেন না। কিন্তু বাইরে ঘরে অনেককেই বলতে শোনেন ব্লগ সপর্কে নানা রকম আজগুবী কথা। বাবার উপর অভিমান করেছি ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণেই ঠিক হয়ে গেছি। ভেবেছি, কয়েকদিন পিসী আর মেয়েদের সাথে গল্প গুজব করে সময় কাটাই, পরে অন্য কিছু ভাবা যাবে।  অনলাইনে গিয়ে পত্রিকা খুললাম, দুই চোখ স্থির হয়ে গেল! নারায়ণগঞ্জের গণজাগরণ মঞ্চের প্রধান উদ্যোক্তার কিশোর ছেলে, মেধাবী তৌকিরকে কে বা কারা খুন করে শীতলক্ষ্যার তীরে ফেলে রেখেছে। তৌকীর 'এ' লেভেল পরীক্ষায় বিশাল সাফল্য অর্জন করেছে। মাত্রই রেজাল্ট বেরিয়েছে, দেখা গেছে ফিজিক্সে সে ২৯৭ পেয়েছে আউট অফ ৩০০।      
তৌকিরের সংবাদটি আমার ভেতর কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, অনুভূতিটুকু  আমি নিজের মধ্যেই রেখে দিতে চাই। একদিন বাদেই পূর্বপরিকল্পনানুযায়ী সবাই মিলে রওনা হয়েছি টেক্সাসের ঊদ্দেশ্যে। বড় মেয়েটা আর ওর বর, সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ঠিক যেমন করে অপেক্ষা করে প্রতিটি সন্তান তার পিতামাতার জন্য, এবং প্রতিটি পিতা-মাতা তার সন্তানের জন্য। নিজেদের গাড়ীতে করেই রওনা হয়েছি, অনেক বছর বাদে এমন একটি পারিবারিক ট্যুর, গল্প, খাওয়া-দাওয়া, হাসি ঠাট্টার ভেতর দিয়েই গাড়ী ছুটছিল। সবই ঠিক ছিল, আমি শুধু মাঝে মাঝেই ভাবনায় খেই হারিয়ে ফেলছিলাম, আমি যাচ্ছি কৃতি সন্তানের কাছে, আর একই সময়ে আরেক কৃতি সন্তান তৌকিরকে হারিয়ে তার মা-বাবা আছড়ে পিছড়ে কাঁদছে। বুকের ভেতর জ্বলছিল, কিন্তু জ্বালা আর কারও ভেতর ছড়াতে দিচ্ছিলাম না। আমার পাশে বসেছেন আমার পিসী, গায়ে গা লেগেই যাচ্ছিল, পিসীর শরীরের স্পর্শে ছিল শোকের তাপ, আমি টের পাচ্ছিলাম। সেই তাপে ছিল দহনের যন্ত্রণা। আমি বুঝতে পারছিলাম, পিসী এবং পিসেমশায় কী যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখেছেন। মুখে কিছুই প্রকাশ করছিলেন না। আমেরিকা এসেছেন একমাত্র ছেলের কাছে বেড়াতে, খুশীর ঝলক মুখে লেগেই আছে। অথচ আমি কিন্তু ঠিকই টের পাচ্ছিলাম পিসীর স্পর্শে সন্তান হারাণোর যন্ত্রণা। মাত্র পাঁচ বছর আগেই পিসীর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একমাত্র মেয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলো, মার্চের ২৩ তারিখে। তপা বেঁচে থাকলে পিসীও এখন আমার মত করেই  মেয়ের বাড়ীতে বেড়াতে যেতেন। তপা নেই, তপার জন্য দহনটুকু আছে উনাদের অন্তরে, বাকী জীবন থাকবে। ত্বকীর বাবা-মায়ের দহন হবে আরও অন্যরকম, পিতার উপর আক্রোশ মেটাতে দুর্বৃত্তরা নিরপরাধ, মেধাবী কিশোর ছেলেকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে। অভাগা পিতার ভেতর তো পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবে।

ত্বকী এবং তপার কথা ভাবতে ভাবতে আরেক জনের মুখ মনে পড়ে গেলো। আমার 'তপু বৌদি'র কথা। দুইটি মেধাবী পুত্রের জননী। ছোট ছেলেটি এ বছর কম্পিউটার সায়েন্সে ব্যাচেলর ডিগ্রী কমপ্লীট করার কথা ছিল। কলকাতার বুকেই ওদের বসবাস। ছেলেটি সন্ধ্যেবেলা কলেজ থেকে ফেরার পথে এক ট্রেন থেকে নেমে এক দৌড়ে রেল লাইন ক্রস করে অন্য প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেনে উঠতে চেয়েছিল। ঐ মুহূর্তেই মেইল ট্রেন চলে আসে, ছেলেটির উপর দিয়ে চলে যায়, রেখে দিয়ে যায় তপু বৌদি'র জন্য সারা জনমের দহন জ্বালা। গাড়িতে সবার সাথে আনন্দ করছিলাম, আর ফাঁকে ফাঁকেই এই দুঃখী মায়েদের কথা ভাবছিলাম। এক সময় গাড়ী টেক্সাস ওয়েলকাম সেন্টারে এসে পৌঁছাতেই আমার স্বামীকে দেখলাম পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে মেসেজ পড়ছেন। মনে মনে একটু অবাকই হলাম, উনার কাছে কে টেক্সট করতে পারে! আমার কৌতুহল মিটে গেল অতি বড় দুঃসংবাদ শুনে। ওকলাহোমা থেকে উনার বন্ধু মেসেজে জানিয়েছে, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাইকে কে বা কারা হত্যা করেছে। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মাথাটা ফাঁকা লাগছিল। মিনিট দশেক পরেই মেজ মেয়ে জানালো, আরেকটি পুলিশকে মেরে ফেলেছে জামায়াতের লোকেরা। মেয়ে অনলাইন সংবাদ থেকে খবরটা বের করেছে। মুখের ভেতরটা তেতো লাগছিল। গাড়ী ছুটেছে মেয়ের বাড়ীর দিকে, আমার মন ছুটেছে দেশের আনাচে কানাচে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। এই দেশ তো আমার সেই চেনা দেশ না। আমার চেনা দেশে অভাব ছিল, কিন্তু অশান্তি ছিল না, জন্মের হার বেশী ছিল, কিন্তু এমন অপঘাতে মৃত্যু ছিল না।

মেয়ের বাড়ী পৌঁছে গেলাম, অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। বাড়ীর লিভিং রুমে সানরুফ আছে, বৃষ্টির ফোঁটা পরে 'রিমঝিম' আওয়াজ তুলেছিল। দেশী স্টাইলে বৃষ্টির আওয়াজ শুনিনি সেই কতকাল,  শোনার জন্য কতকাল হাঁ করে বসেছিলাম। মেয়ের নতুন বাড়ীতে ঢুকেছি, প্রকৃতি আমার খুশীর জন্য নিজেকে আগে থেকেই প্রস্তুত রেখেছিল, মেঘ না চাইতেই জল দিয়েছিল, বৃষ্টির ঝমর ঝমর আওয়াজে মনটা আরও বেশী বিষন্ন হয়ে গেল। টিভি অন করে দিয়ে বাংলা নিউজ শুনতে বসে গেলাম। সাথে আসা সকলেই নতুন দম্পতি, তাদের নতুন বাড়ীর উচ্ছ্বাসে মশগুল হয়ে গেছিল, আর আমি তাকিয়েছিলাম টিভি স্ক্রীণের দিকে। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সাক্ষাৎকার দেখাচ্ছিল, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আমার প্রিয় শিল্পী, প্রিয় বললে কম বলা হয়, অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধাবান ব্যক্তিত্ব। উনার একটি উক্তি, " জাতি আমাকে শ্রেষ্ঠ উপহার দিল" বুকে গেঁথে গেছে। চুইয়ে চুইয়ে ব্যথাগুলো সারা দেহমন অবশ করে ইচ্ছে।

আমাদেরকে আজ মেয়ে ডালাস ডাউন টাউন, মিউজিয়ামসহ আরও কোথায় কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। মিউজিয়ামে ঢুকেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মিউজিয়াম দেখবো না। ওরা ঘুরে দেখে আসুক, আমি চুপ করে নীচে বসে থাকবো। তাই হলো, আমার পাশেয়ামার পিসী এসে বসলেন। আমার বুকটা ফাঁকা লাগছিল, ইমতিয়াজ বুলবুলের " জাতি আজ আমাকে শ্রেষ্ঠ উপহার দিয়েছে' মনে পড়ছিল। নিজেকে অতি নিকৃষ্ট জীব মনে হচ্ছিল। আমিও তো সেই জাতির একজন প্রতিনিধি। আমার প্রিয় শিল্পীর অন্তরে যে দহন চলছে, যে দহনে জর্জরিত হয়ে " জাতি আজ আমাকে শ্রেষ্ঠ উপহার দিল' বলে  যে চরম চপেটাঘাত  দিলেন, তার জ্বালা আমি অন্তঃত টের পাব, কারণ আমিও এই বাঙালী জাতির একজন  প্রতিনিধি, দায় এড়াবো কী করে!

No comments:

Post a Comment