আমার
কাছে একটি ই-মেইল এসেছে। মেইলটি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সমিতির সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা
রেখা। এ বছর নববর্ষ উপলক্ষে সমিতি এখানের সকল বাঙ্গালীদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাচ্ছে। রেখা জানতে চেয়েছে আমার মেয়ে গুড্ডু ঐদিন একটা
কবিতা আবৃত্তি করতে পারবে কিনা। এর আগেও একুশে ফেব্রুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যেও
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। কিনতু আমরা যেতে পারিনি, গুড্ডুর মায়ের কাজের জায়গা
থেকে ছুটির অনুমতি না থাকায়। মেইলটি আমি গুড্ডুর মায়ের বরাবর ফরোয়ার্ড করে দিয়েছি।
কারন এই ব্যাপারগুলো আমার মেয়েদের মা’ই দেখে থাকে। আমাদের তিন মেয়ে। তাদের
পোষাকীনাম, ডাকনাম তাদের মা রেখেছে, তবে আমি আমার নিজের দেয়া নামেই ওদের ডাকি।
বড়মেয়েকে ডাকি মামনি, মেজো মেয়েকে ডাকি কুটু আর ছোটটাকে ডাকি গুড্ডু। গুড্ডুর বয়স
১২। ওকে নিয়ে যখন আমরা এই দেশে আসি, তখন ওর বয়স ছিল দুই বছর। একটু একটু করে কথা
বলতে শিখেছে। কুটু আর মামনি মিলে ওকে নিয়ে
সবসময় আনন্দে মেতে থাকত। সেই গুড্ডু এখন বড় হয়ে গেছে, ক্লাস সেভেনে পড়ে।
আমরা
এদেশে এসেছি ২০০১ সালের অক্টোবার মাসে, ৯/১১ এর ঠিক একমাস পরেই। আমি এখানে
বিশ্ববিদ্যালেয়ে কেমিস্ট্রি পড়াই। বর্তমানে আমরা আছি কলম্বাস নামের ছোট্ট একটা
শহরে। প্রথম যখন আমেরিকাতে আসি, তখন ছিলাম ক্লার্ক্সবার্গ নামের আরেকটি ছোট্ট
শহরে। ক্লার্ক্সবার্গের আশেপাশে কোথাও কোন বাঙ্গালী ছিলোনা। আমরা প্রথমেই এসে খুব
ফাঁপড়ে পরে গেছিলাম। আমাদের মেয়েগুলো তখন বেশ ছোট। মামনির বয়স ছিল ১৪, কুটু ছিল
সাড়ে দশ বছরের আর গুড্ডু মাত্রই দুই বছর বয়স। দেশে থাকতে ওরা ছিল দাদু দিদা, মামা
মামী, কাকা কাকী সকলের আদরের। এখানে এসে পর্যন্ত একটিও বাঙ্গালীর মুখ দর্শন দূরে
থাকুক, সাধারন একটা ইন্ডিয়ান গ্রোসারী শপও ছিলনা যেখান থেকে চাল ডাল পর্যন্ত কেনা
যায়। গুড্ডু ডাল, ভাত, মাছ খেয়ে অভ্যস্ত ছিল, মামনি বা কুটুকে নিয়ে সমস্যা ছিলনা,
কারন এর আগে বিদেশে থাকার অভিজ্ঞতা তাদের দুজনেরই ছিল। গুড্ডুর জন্মের আগে আমরা
মামনি ও কুটুকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে ছিলাম তিন বছর।
গুড্ডুর
মায়ের সে-কি কান্না গুড্ডুকে কিছু খাওয়াতে না পেরে। আমারও কাজের এত চাপ ছিল,
তাছাড়া তখন আমাদের গাড়ীও ছিলনা, আর পাহাড় ঘেরা রাজ্যে নিজের গাড়ী ছাড়া জীবন
একেবারেই অচল ছিল। তারপরেও গুড্ডুর মা নিজেই নানা উপায় বের করতো গুড্ডুকে ভাত
খাওয়ানোর জন্য। মুশকিল ছিল যে এই মেয়ে ম্যাগডোনাল্ডস বা কেএফসি্র মত মুখরোচক
খাবারও খেতনা। আমি একদিন বিরক্ত হয়ে গুড্ডুর মাকে বলেছিলাম,” মেয়ে বাংলা ভুলে যাবে
বলে খাবারেও বাংলাকে চালু রেখেছো, এখন এই বিপদ কিভাবে সামাল দেবো!” গুডডুর মা
অবশ্য আমার একথায় রাগ করেনি, দেখে মনে হয়েছিল যেনো সেও একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
গেছে। পরে অবশ্য আমি আমার এক বন্ধুকে ফোনে বলেছিলাম আমাদের এই খাবারের সমস্যার ব্যাপারে।
বন্ধু পরে চাল ডাল, হলুদ, মরিচ সব কিছু মেইল করে পাঠিয়েছিল। এতো গেলো গুড্ডুর কথা,
গুড্ডুর মাকে নিয়েও হয়েছিল বিপদ, সে কাঁচামরিচ ছাড়া ভাত খেতে পারেনা, টিয়া পাখীর
মতই কচকচ করে কাঁচামরিচ খায় সে। যে শহরে চাল ডাল পাওয়া যায়না, সে শহরে কাঁচামরিচের
আশা করাই বৃথা। এদিকে গুড্ডুর মায়েরও খাওয়া দাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখে গুড্ডুর
এক মামা দুই প্যাকেট কাঁচা মরিচ মেইল করে পাঠিয়েছিল। এগুলো ভাবলে এখন আমার খুব
হাসি পায়।
খাওয়ার
সমস্যা কোন না কোনভাবে সামাল দেয়া গেছে, কিনতু ভাষার সমস্যা সামাল দিতে গিয়ে
আমাদের হিমশিম খাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। হিমশিমই খেতে হয়েছে বলবো, কেননা এখানে আসার
আগে আমাদের ধারনাতেই ছিলনা যে ক্লার্ক্সবার্গ শহরের ধারে কাছে কোথাও বাঙ্গালী
ছিলনা। এদিকে গুড্ডুর মায়ের আবার স্বদেশ, স্বজাতি, মাতৃভাষার ব্যাপারে ভীষন
দূর্বলতা। আমরা এর আগে যখন অস্ট্রেলিয়াতে গেছিলাম তখন কুটু ছিল মাত্র চার বছরের।
আমার এই মেয়েটা খুব রোগা ভোগা ছিল বলে দেশে থাকতে তখনও ওকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে
পাঠাইনি, ঘরেও পড়ানো শুরু করিনি। ফলে কুটুর বাংলা বা ইংরেজী বর্ণ পরিচয় তখনও হয়নি।
অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েই কুটুকে স্কুলে ভর্তি করাতে হয়েছে। প্লেস্কুল ধরনের স্কুল।
কুটু ছোটবেলা থেকেই খুব চালাক চতুর ছিল। তাই আমাদের খুব কৌতুহল ছিল, স্কুলে গিয়ে কুটু কিভাবে সবার সাথে কথা চালায় তা
দেখা! কারন স্কুল থেকে বাড়ীতে ফিরে সে সব সময় এমনভাবে আমাদেরকে স্কুলের গল্প শুনাত
যে মনেই হতোনা এই বাচ্চা ইংরেজী জানেনা। সে তার টিচারের নাম বলতো, ‘মিস গাইও’, আমি
যতবার নাম ঠিক করে দিতাম ‘মিস গেইল’ বলে, সে আবারও বলতো ‘মিস গাইও’। তাই একদিন ওর
মা স্কুলে গেলো টিচারের সাথে কথা বলতে এবং মেয়ের অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে। স্কুলে
গিয়ে জানতে পারলো কুটুকে নিয়ে তাদের কোন সমস্যাই হচ্ছিলনা, কারন কুটু তার বডি
ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়েই নাকি সবকথা বুঝাতে পারতো। এরপর খুব তাড়াতাড়ি কুটু ইংরেজী আয়ত্ব
করে ফেলেছিল, কিনতু ইংরেজী শেখা নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা ছিলনা, মাথাব্যথা ছিল
বাংলা শেখানো নিয়ে। কারন আমরা অস্ট্রেলিয়া গেছিলাম মাত্র তিন বছরের জন্য। আমাদের
দেশে ফেরার প্ল্যান ছিল বলেই কুটুকে বাংলা পড়া শেখাতে হচ্ছিল। ঐ ছোট্ট বয়সের
রোগাভোগা একটা বাচ্চাকে ইংরেজী ও বাংলা দুই ভাষা শেখানোটা ছিল রীতিমত কঠিন
চ্যালেঞ্জ। আমি নিজে এই ব্যাপারে খুবই অসহায়। অন্যের ছেলেমেয়ে পড়িয়ে মানুষ করছি,
কিনতু নিজের মেয়ের বেলায় আমার মাথায় কোন উপায় বের হয়নি।
একদিন
দেখি কুটুর মা কুটুকে নিয়ে বসেছে, কুটুকে দিয়ে একটি চিঠি লেখাবে বলে। আমি আড়চোখে
দেখছিলাম মা মেয়ের কান্ড। মা মেয়েকে বলছে, ‘তুমিতো দিদাকে খুব মিস করছো, আমি আজ
দিদার কাছে চিঠি লিখবো, তুমিও যদি বাংলাতে দিদাকে দুই লাইন লিখতে পারো, তাহলে সেই
চিঠিও আমি দিদার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারবো। তুমি বাংলাতে চিঠি লিখলে দিদা অনেক খুশী
হবে। আমি দেখিয়ে দেবো কিভাবে লিখতে হয়’। এই কথা শুনে মেয়েও দেখলাম খুব উৎসাহিত হয়ে
উঠলো এবং বাংলা অ আ ক খ না জানা মেয়ে অন্ধের মত করে মায়ের হাতের লেখাকে অনুকরন করে
তিন লাইনের একটি চিঠি লিখে ফেললো। কুটুর কাছে মনে হয় এই ব্যাপারটা খুবই
ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল। এরপর থেকে দেখি প্রায়ই মায়ের কাছে বসে দুই তিন লাইন করে
বাংলা কপি করে করে একসময় বাংলা পড়তে শিখে গেলো।
অস্ট্রেলিয়াতে
আমাদের আশেপাশে অনেক বাঙ্গালী ছিল। তাই ওখানে বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই
থাকতো। ঐসব অনুষ্ঠানে মামনি ও কুটু ছিলো অনুষ্ঠানের মধ্যমনি। মামনি আগাগোড়াই
ধীরস্থির স্বভাবের, যা শেখানো হতো, তাই শিখতো, কোন বাদ প্রতিবাদে যেতোনা, কিনতু
কুটু ছিল বেশী টরটরে, যতটুকু না শেখানো হতো নিজে নিজেই তার চেয়ে বেশী শিখে ফেলতো।
তাই ওকে ওখানের সবাই খুব আদর করতো। সব অনুষ্ঠানে ওকে দিয়ে নাচ করাতো, আবৃত্তি
করাতো। কুটুর মুখস্থ শক্তি খুব ভালো ছিলো, পাঁচ বছর বয়সেই সে ‘সৎপাত্র’,
‘লিচুচোর’, ‘কাজলাদিদি’ সহ বড় বড় কবিতাগুলো মুখস্থ বলতে পারতো (অভিনয় সহকারে)।
তিন
বছর পরে আমরা যখন দেশে ফিরে যাই, মামনি ও কুটুকে নিয়ে ওদের মা গেলো ওয়াইডাব্লিউসিএ
স্কুলে ভর্তি করাতে। মামনিকে পেয়ে প্রধান শিক্ষিকাতো মহাখুশী (মামনি ক্লাস থ্রী
পর্যন্ত পড়েছিল এই স্কুলে), কিনতু কুটুকে ভর্তি নিতে পারবেনা বলে দিলেন উনি। কারন
কুটু ক্লাস টুতে পড়ার মত বাংলা শিখেনি তখনও। আমরা থাকতাম উত্তরাতে, শুধু বাংলা
স্কুলে পড়ানোর জন্য মেয়ের মা গ্রীনরোডের ওয়াইডাব্লিউসিএ স্কুলে নিয়ে যেতে রাজী
হয়েছিল। কিনতু স্কুল কর্তৃপক্ষ কুটুকে ভর্তি নিতে রাজী না হওয়ায় মেয়ের মা’র ইগোতে
লেগেছে। সে দুই মেয়েকে নিয়েই উত্তরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে গেলো। সেখানে আবার আরেক
বাহানা। সেখানে বলা হলো মামনি নাকি বাংলাদেশের লেভেলে অঙ্ক পারবেনা, আর কুটু নাকি
ক্লাস টু লেভেলে পড়া পারবেনা। মেয়ের মা’কে তারা পরামর্শ দিল দুই মেয়েকেই যেনো এক
ক্লাশ করে নীচে নামিয়ে দেয়া হয়। আমি জানি মেয়ের মা’কে, তারাতো আর জানেনা মেয়ের মায়ের
জেদ সম্পর্কে। মেয়ের মা রাগ করে মামনিকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করালো বি এস এফ শাহীন
স্কুলে যথারীতি ক্লাস সিক্স-এ আর কুটুকে ভর্তি করালো উত্তরার ঐ স্কুলটাতেই এবং
ক্লাস টু-তেই, তবে সে নিজে দায়িত্ব নিয়েছিল তিন মাসের মধ্যে কুটুকে ক্লাস টু এর
প্রতিটি বিষয়েই উপযুক্ত করে তুলবে। বলাই বাহুল্য, এই কাজটি সে দুই মাসের মধ্যেই
করে ফেলেছিল। কিভাবে করেছিলো আমি জানিনা, তবে প্রথম টার্ম পরীক্ষাতেই কুটুর ফলাফল
দেখে ঐ স্কুলের প্রিন্সিপাল কুটুর মা’কেও শিক্ষক হিসেবে উনার স্কুলে নিয়ে নিলো।
আমার কুটুর বয়স এখন ২০ বছর, গত দশ বছর ধরে আছে আমেরিকাতে, আমার কুটু এখনও বাংলা
বর্ণমালা ব্যাপারটির সাথে পরিচিত না, অথচ ও বাংলা পড়তে ও লিখতে পারে, সারাদিন
বাংলা গান শুনছে, উত্তম সুচিত্রার মুভি দেখছে, কাঁচামরিচ ঘষে ঘষে ভাত খাচ্ছে,
মোটের উপর মায়ের কাছ থেকে সে খুব ভালো ট্রেনিং পেয়ে গেছে।
এবার
গুড্ডুর কথাতেই ফিরে আসি। আমেরিকাতে এসেই গুড্ডুর মা ঘরে অনেকটাই সান্ধ্য আইন জারি
করে দিল। ঘরে বাংলা ছাড়া অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবেনা। মেয়েরা পড়ে গেছে
বিপদে। ওদেরতো স্কুল আর বাসা ছাড়া আর কোথাও যাতায়াত ছিলনা প্রথমদিকে। তাই দিনের
বেশীটুকু সময় স্কুলে ইংরেজীতে কথা বলে বাড়ী যখন ফিরে আসতো, মুখ ফসকে ইংরেজীটাই
বেরিয়ে আসতো। তাদের দেখাদেখি গুড্ডুও দুই একটা করে ইংরেজী শব্দ শিখে যাচ্ছিল। ঐ
সময়ে ডিশ নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের চ্যানেল পাওয়া যেতোনা, গুড্ডুর মা কম্পিউটারে খুব
বেশী সড়গড়ও ছিলোনা যে ইউটিউব দেখে দেখে গুড্ডুকে বাংলা শেখাবে! তাই বড় দুই মেয়েকে
সঙ্গী করে নিলো ‘গুড্ডুর বাংলা শিক্ষা প্রকল্পে’। চার বছর বয়স পর্যন্ত ঘরে বাংলা
বলতে বলতে গুড্ডু ইংলিশ ‘ইয়েস’ ‘নো’ শব্দ দুটিও ভুলে গেলো। আমার সহকর্মীরা আমাকে
সাজেশান দিয়েছিল, কিন্ডারগার্টেনে ভর্তির আগে কয়েকমাস যেনো গুড্ডুকে প্রাইভেট কোন
ডে কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করানো হয়, তাতে করে অন্য বাচ্চাদের সাথে থেকে আমার মেয়ে
ইংরেজী শিখে ফেলবে। সাজেশানটা আমারও মনে ধরেছিল, কিনতু বাড়ীতে এসে বলতেই মেয়ের মা
দেখি কলমের এক খোঁচায় আমার আর্জি বাতিল করে দিলো। মেয়েকে যথাসময়ে স্কুলে পাঠালাম,
মেয়ে স্কুলে যায় আসে, কিনতু ওর চেহারাতে কোন আনন্দ দেখিনা। স্কুলে গিয়ে খোঁজ
নিলাম, জানতে পারলাম ও কারো সাথে মিশতে পারেনা, ও কোন কথা বুঝতেও পারেনা, বুঝাতেও
পারেনা।
মেয়ের
মা’কে বললাম মেয়ের সম্পর্কে মেয়ের টিচারের রিপোর্ট। মেয়ের মা দেখি উলটো টিচারের
উপর অসন্তুষ্ট হয়ে গেলো। তার কথা হলো, এই টিচার আসলে কোন জাতের টিচার না।
সত্যিকারের শিক্ষক হলে তার দায়িত্ব একটি বাচ্চার সাথে কম্যুনিকেট করা। সে হার
মানতে রাজী নয়, এরপর থেকে সে স্পেশাল পারমিশান নিয়ে গুড্ডুর সাথে স্কুলে যাওয়া
শুরু করলো। দেশে থাকতে সে নিজে বাচ্চাদের স্কুলে দুই বছর শিক্ষকতা করেছে, এদেশে
আসার আগেই সে বিএড ডিগ্রী অর্জন করেছে, এদেশে না আসলে সে তখন দেশের নামকরা এক
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতো, এমনটাই কথা ছিলো, কাজেই তার অর্জিত অভিজ্ঞতা
সম্পর্কে আমার কোন দ্বিমত ছিলনা, তবে বাবার প্রানতো, মেয়ের দুরবস্থা দেখে বুকটা
ফেটে যেতো। এদিকে একমাসের মধ্যেই দেখি গুড্ডু পটপট করে ইংলিশ বলা শুরু করেছে,
গুড্ডুর মাকে আর যেতে হয়না মেয়ের সাথে স্কুলে। মেয়ে পটপট করে ইংরেজী বলে, শুনে
আমার বুকটা ভয়ে গুড়গুড় করে উঠে। মেয়ের মাকেতো জানি, পটপট করে ইংরেজী বলা মেয়েকে
ধরবে আর দুইদিন পরেই। হ্যাঁ, আমার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে, মেয়ে একটা করে ইংরেজী শব্দ
বলে, মেয়ের মা বসে যায় সেই ইংরেজী শব্দের বাংলা অর্থ বুঝিয়ে দিতে। আমার হাসিও
পেতো, আবার ভালোও লাগতো। এভাবেই কিছুদিন চলার পর আমদেরকে ক্লার্কসবার্গ ছেড়ে চলে
আসতে হলো কলম্বাস নামের ছোট শহরে।
হায়রে!
‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়’ অবস্থা
হয়েছে গুড্ডুর মায়ের। এখানে এসেও প্রথম ছয়মাস কোন বাঙ্গালীর দেখা পাওয়া গেলোনা।
গুড্ডু ততদিনে এলিমেন্টারি স্কুলে যেতে শুরু করেছে। গুড্ডুর মা দেশ থেকে
‘আদর্শলিপি’ বই, ‘খুকুমনির ছড়া’ বই আনিয়েছে গুড্ডুকে বাংলা পড়ানোর জন্য। এবার
মেয়েকে বর্ণমালা দিয়েই পড়া শুরু করিয়েছে। গুড্ডু খুবই লক্ষ্মী একটা বাচ্চা, খুব
শান্তশিষ্ট এবং মেধাবী। সে খুব তাড়াতাড়ি অ আ ক খ পড়তে শিখে গেলো। আমার মাঝে মাঝে
সন্দেহ জাগে মনে, কার কৃতিত্ব বেশী, মেয়ের মেধা নাকি মায়ের শেখানোর কৌশল। যেটাই
হোক, আমার কোনরকম ইনভল্ভমেন্ট ছাড়াই আমার তিন মেয়েই দেখি বাংলা পড়তে ও লিখতে শিখে
গেছে। আরেকটা কথা না বললেই নয়, আমার মামনি কিনতু বেশীদিন থাকেনি দেশে, সেও সেই
ছোট্ট বয়স থেকেই প্রবাসেই আছে। কিনতু মামনি বাংলা উপন্যাস থেকে শুরু করে বাংলা
সায়েন্স ফিকশান পর্যন্ত সব বই পড়ে ফেলেছে, অর্থাৎ আমাদের ঘরের লাইব্রেরীতে যত বই
আছে আমাদের নিজস্ব সংগ্রহে। আসলে আমরা প্রতি দুই বছরে একবার করে দেশে যাই, ফিরে
আসার সময় মেয়েদের মা স্যুটকেস ভর্তি করে গল্পের বই নিয়ে আসে। তার নিজের জন্য। আজ
পর্যন্ত ভালো দামের একটা শাড়ী সে কিনেনি, কিনতু একবার ডাবল ফাইন দিতে হয়েছিল তার
বইয়ে ঠাসা অতিরিক্ত ওজনের স্যুটকেসটির জন্য। ইদানীং অবশ্য সে কম্পিউটারে বসেই বই
পড়ে ফেলে।
তা
নানাভাবেই বাংলা চর্চ্চা হচ্ছিল আমার পরিবারে। কিনতু এত চেষ্টার পরেও দেখি গুড্ডু
বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম, সে ইংলিশকে
বাংলাতে অনুবাদ করে কথা বলতো। এক আসরে গুড্ডুকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছিল, উত্তরে
সে বলেছিল, ‘ ওয়েইট, একটু থিঙ্ক করে বলি’। ব্যস, এটাই হয়ে গেছিল ্গুড্ডুর জন্য একেবারে
ট্রেডমার্ক। অয়ন নামের একটি ছেলে ছিল এখানে, বাংলাতে খুব ভালো দখল ছিল তার,
পিএইচডি করতে এসেছিল, গুড্ডুর মায়ের এই বাংলা শেখানোর প্রচেষ্টাকে সে খুব শ্রদ্ধা
করতো। অয়নের সাথে এখনও আমাদের যোগাযোগ আছে, অয়ন গুড্ডুর কথা জানতে চাইলেই এভাবে
জিজ্ঞেস করে,’ আমাদের ওয়েইট থিঙ্ক করে বলি’ কেমন আছে”? সেই গুড্ডু তার নয় বছর বয়সে
বাংলাদেশ সমিতির বিজয় দিবস অনুষ্ঠানে খালি গলায়, ‘ জাদুর পেন্সিল, আহা! জাদুর
পেন্সিল’ গানটি গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এই গানটি শ্রদ্ধেয় ফেরদৌসী
রহমানের গাওয়া একটি গান। গুড্ডুর মা ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠান যখন দেখতো, তখনই
মুখস্থ করে ফেলেছিল। নিজের জীবনে এসে মেয়েকে এই গানটি শিখিয়েছে গানের অর্থ সহকারে।
ফলে মেয়ে অনুষ্ঠানে একেবারে শুদ্ধ উচ্চারনে গানটি করতে পেরেছে।
পরের
বছর একুশে ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠানে গুড্ডু যতীন্দ্রনাথ বাগচীর ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটি
আবৃত্তি করেছে। সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছিলাম আমি। ঘরে থেকেও আমি জানতেই পারিনি আমার
সেই ‘ওয়েইট, থিঙ্ক করে বলি’ মেয়েটা কখন এত সুন্দর আবৃত্তি করতে শিখে গেলো! এর পরের
বছর, মানে গত বছর গুড্ডু আবৃত্তি করেছে জসীমউদ্দীনের ‘নিমন্ত্রন’ কবিতার প্রায়
সবটুকু, এবার আরও পরিনত হয়েছে তার আবৃত্তির স্টাইল। গুড্ডুকে এখন সবাই বাংলা শেখার
ব্যাপারে বাচ্চাদের জন্য একটি আইডল মনে করে। তবে আমি নিজেও মনে করি, গুড্ডু মাত্র
দুই বছর বয়সে আমেরিকাতে এসে এমন সুন্দর বাংলা বলতে পারলে তাকে বাংলার আইডল বলাই
যায়। তাছাড়া সেতো শুধু বাংলা নিয়েই থাকেনা, স্কুলের পড়া আছে, ‘সায়েন্স ফেয়ার’,
‘রিডিং কমপিটিশান’, ‘উইকলি টেস্ট’, ‘মান্থলী টেস্ট’, ‘এন্যুয়েল টেস্ট’- এও তাকে
সেরা ফলাফল করতে হয়। না, আমরা কেউ ওর উপর ‘সেরা হতেই হবে’ ব্যাপারটি চাপিয়ে দেইনি।
মায়ের কাছে বাংলা শিখতে গিয়ে এমন কঠিন এক চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে ওকে যেতে হয়েছে,
তখন থেকেই ‘আমাকে পারতে হবে’ ব্যাপারটা ওর মাথায় ঢুকে গেছে।
ইদানিং
শুনি, গুড্ডু নাকি বাংলা পড়া কিছু কিছু ভুলে যাচ্ছে! অস্বাভাবিক কিছু নয়, যেখানে
থাকি, কোন বাংলা স্কুল নেই, মেয়ের মা ফুল টাইম চাকুরী করেন, বাড়ী এসে উনার গৃহকর্ম
করতে হয় (আমাকে উনি বা আমার মেয়েরা ঘরের কাজ করা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়াতে হাতে হাতে
সাহায্য করার অভ্যাসটাই আমার মধ্যে তৈরী হয়নি), সময়ের সাথে সাথে বয়সও বাড়ছে, আগের
সেই ধৈর্য্যও নেই, তাছাড়া মেয়েটাও বড় হয়েছে, ওর নিজের একটি কিশোরী জগত তৈরী হচ্ছে,
কাজেই আগের মতো করে আর সম্ভবও হচ্ছেনা মেয়েকে নিয়ে বাংলা চর্চ্চা করার। তারপরেও
মাঝে মাঝেই মেয়ের মায়ের হুঙ্কার শুনি, ‘ শোন, আজকে যদি তুমি বাংলা বই একটুও না
পড়ো, তাহলে তোমাকে বাংলা পত্রিকার এক পৃষ্ঠা পড়তে দেবো। পড়তে না পারলে মজা
বুঝাবো”। আমি মনে মনে হাসি।
আমার
মেইলটা মনে হয় গুড্ডুর মা পেয়েছে। এই মুহূর্তে আমি পরীক্ষার খাতা দেখছি আর মা
মেয়ের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। তাদের কথার ধরন থেকেই বুঝে গেছি, সকালে বাংলাদেশ
সমিতির রেখার পাঠানো যে মেইলটি গুডডুর মাকে ফরোয়ার্ড করেছিলাম তা পেয়েই মা মেয়েকে
ডেকেছে অনলাইনে পত্রিকা পড়ার জন্য। বুঝাই যাচ্ছে মেয়েকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। মেয়ে
পড়ছে শুনতে পারছি, ‘ বিনিয়োগ, শেয়ার মার্কেটে দরপতন, বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয়
জিনিসের অগ্নিমূল্য’ জাতীয় শব্দ। যোগ্য শাস্তি বটে! আমিতো অবাক হয়ে শুনছি মেয়ে যদি
বাংলা ভুলেই গিয়ে থাকে তাহলে এইসব কঠিন শব্দ কিভাবে পড়ছে! মেয়েকে পড়তে শুনে আমিতো
মহা খুশী যে যাক মেয়ে আমার শাস্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে! ওমা, দেখি এখানেই শেষ
নয়, মেয়ের মা ঐ সমস্ত বাংলাশব্দের ইংলিশ জানতে চাইছে! আমি প্রমাদ গুনতে শুরু
করেছি, এইরে! না পারলে শাস্তির ধরন কি হবে কে জানে! দেখলাম, মেয়ের মা অতটা কঠিন
হৃদয়ের নয়, দুই একটা শব্দ আছে যেগুলোর ইংলিশ মেয়ে জানেনা, মেয়ের মা বলে দিলো সঠিক
উত্তর, কিনতু একটা হুমকীও দিলো, ‘ আবার তোমাকে ডাকবো পত্রিকা পড়তে, যদি না পারো,
বুঝবে মজা, কত ধানে কত চাল হয়’।
আমি
গুড্ডুর মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম তার ছুটি আছে কিনা নববর্ষের অনুষ্ঠানের দিন, কারন
আমাকে জানাতে হবে আমরা ওখানে যাচ্ছি কিনা। গুড্ডুর মা গুড্ডুকে শুনিয়ে শুনিয়ে
বললো, ‘ ছুটি না থাকলে ছুটি নেবো, মেয়েকে ওখানে এবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা
আবৃত্তি করতে হবে। কোন আপত্তি শুনতে চাইনা’। যাক! আমিও বাঁচলাম, গুড্ডুর মাকে আবার
দেখতে পাবো সেই আগের রূপে, মেয়েকে কি অসীম ধৈর্য্যের সাথে কবিতা পড়াচ্ছে, কবিতা
আবৃত্তির নিজস্ব স্টাইল শেখাচ্ছে। এক সময় আমার মামনি, কুটু যখন ছোট ছিলো, তাদের মা
তাদেরকে নিয়ে কত জায়গায় যেতো, মেয়েরা বাংলা গানের সাথে নাচ করতো, কি সুন্দর কবিতা
আবৃত্তি করতো, বিশেষ করে কুটুতো অস্ট্রেলিয়াতে একেবারে ‘স্টার; বনে গেছিল মাত্র
তিন বছরে। সেইসব দিনে গুড্ডুর মাকেও দেখেছি কি উৎসাহ নিয়ে সব কাজ করতো। ইদানিং
তাকে কেমন একটু ঝিমিয়ে যেতে দেখে আমার নিজেরও মনটা খারাপ লাগে। সেজন্যই পহেলা
বৈশাখ কাছে আসাতে গুড্ডু আর গুড্ডুর মায়ের কবিতা চর্চ্চার মজাদার ‘নাটক’ (নাটক
বলেছি এই কারনে, এই সময়টুকু আমার ঘরে এই হাসি, এই কান্নার খেলা চলবে) দেখতে পাব
ভেবেই আমার মনটা ভালো লাগতে শুরু করেছে।
good luck and all the best in your venture...
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ! আপনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ReplyDelete