Monday, April 23, 2012

ঋষিকন্যা


তখন থেকেই আমি তাকিয়ে আছি ঋষিজার দিকে,
   কেমন ধীর-স্থির চলন-বলন তার।

অতি মৃদুস্বরে যখন সে বাবা বলে ডাকে,
আমার হৃদয়ের গহীনে টের পাই শীতলতার আমেজ!

ভাবি আমি, ঋষিজা নামের মানে যদি হয় ‘ঋষিকন্যা’,
    আমিই তাহলে সেই ঋষি!

আগেতো কোনদিন ভাবিনি এমন করে নামের কি মহিমা,
যিনি ঋষিজা নামটি রেখেছিলেন,
     বাংলা ভাষার প্রতি
তাহার মমতাকেই ধরে নিয়েছিলাম এমন
    নামকরনের কারন হিসেবে।

আমার চেতনায় ছিলোনা নামের কি গুরুত্ব, নাম তো নাম,
মনে পড়ে, কতশিশুর নাম রাখা হয়েছিল ‘মিলেনিয়াম’
যারা ভুমিষ্ঠ হয়েছিল একুশ শতকের প্রথম দিবসে
অথবা প্রথম মাসের যে কোন এক ক্ষনে!

    আহ! একুশ শতকের কথা ভাবতেই
‘একুশ’ কেমন ঝংকার তুললো হৃদয় বীণার তারে!

বাংলা ভাষার জন্য প্রান উৎসর্গ করেছিলেন
রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার, সালাম নামের তরুনের দল
    সেও তো আজ থেকে ষাট বছর আগে!
ষাট বছর পরেও দেখি প্রায় প্রতি রাতের ঘুম
    বিসর্জন দিয়ে চলেছে এক নারী,
তাঁর কিশোরী বালিকাটিকে বাংলা শেখানোর অদম্য উৎসাহে!
দোষ আমার! উচ্চশিক্ষার মানসে চলে এসেছিলাম
    স্বদেশ ছেড়ে মার্কিন মুলুকে।
আমার উপর নির্ভর করেই ওরাও এসেছিল,
     মা ও তিন মেয়ে।

কাজের চাপে দিশেহারা আমি, খেয়াল করার অবসর নেই
মায়েরা আমার মাতৃভাষা ভুলেই গিয়েছে কিনা!
আসলে খেয়াল করার প্রয়োজনই বোধ করিনি
সারাক্ষন তো ‘বাবা’ ডাক শুনি, ‘মা’ ডাক শুনি
কই ‘ড্যাডি’ বা ‘মাম্মি’ তো এখনও শুনিনা
তাহলে আমিই বা কেন অযথা উতলা হতে যাব
    মেয়েরা বাংলা ভুলে গেছে ভেবে!

আমি প্রতিদিন খাবারের থালাতে দেখি গরম ধোঁয়া উঠা ভাত
    সাথে ডাল, মাছ আর একটা সব্জী।
আমার পাশে বসেই ‘ঋষিজা’ হাত দিয়েই ভাত মেখে
    কেমন সুন্দর করে খেয়ে যায়!
রুই, ইলিশ, পাবদা, কই ভালো চেনে, আরও
    জানে পিঠা পায়েসের কথা।
মাকে ডেকে বলে, ‘মা, পাটিসাপটা পিঠা বানাও,
    ক্ষীর দেবে বেশী করে’
তার মায়ের দেখি মুখ উপচে পড়ে খুশীর ঝলক!
    তা পড়ারই কথা।

‘ঋষিজা’কে নিয়ে এসেছিলাম যখন সে মাত্র দুই বছরের শিশু,
    ভাল করে কথাই ফুটেনি মুখে।
মনে পড়ে, এসে উঠেছিলাম বাঙ্গালী বিবর্জিত এক শহরে।
    ঋষিজা পড়ে গিয়েছিল মহাবিপদে
কি হবে তার মুখের ভাষা, ইংরেজী নাকি বাংলা!

ছয় নম্বর বিপদ সঙ্কেত টের পেয়েছিলাম যখন
ঋষিজা ‘বাংলিশ’ এ কথা বলা শুরু করেছিল।
আমার মুখে অসহায়তা দেখে মেয়ের মা বলেছিল,
    “মেয়ের নাম ঋষিজা, নামের প্রভাবেই
    ঋষিকন্যা সকল বাধা কাটিয়ে উঠবে”।

তা বাধা সকলই কেটে গেছে, ঘুচে গেছে সকল সংশয়
ঋষিজা এখন আর ‘বাংলিশ’ এ কথা বলেনা
    নিরেট ইংলিশেও কথা বলেনা।
যখন যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি করেই
    ও কথার আদান-প্রদান করে।

তার মুখের ঝরঝরে বাংলা উচ্চারণ শুনলে দেশের
   ‘বাংলিশ’ ছেলেমেয়ের বাবা মায়েরাও
   থমকাবে, নিজের ছেলেমেয়েদের প্রতি,
নিজের ভাষার প্রতি তাদের চরম অবহেলার জন্য।

তারা এখানেও থমকায়, যখন ঋষিজা ‘একুশের অনুষ্ঠানে’
   শুদ্ধ বাংলায় কবিতা আবৃত্তি করে যায়।
গত তিন বছর আগেই মাত্র নয় বছর বয়সে
   ঋষিজা আবৃত্তি করেছিল, ‘কাজলা দিদি’
হলভর্তি মানুষের চোখ আবেগে ছলছল করে উঠেছিল।
তারা ঋষিজাকে বুকে চেপে ধরে আহ্লাদে আহ্লাদে ভরিয়ে দিয়েছিল।

গেলো বছর ‘একুশের’ অনুষ্ঠানেই ঋষিজা আবৃত্তি করলো ‘নিমন্ত্রণ’।
সবাই এখন ধরেই নিয়েছে, এ বছরের ‘একুশে’তে
ঋষিজা আরও বড় কোন কবিতা আবৃত্তি করবে।
   হয়তো সত্যিই ঋষিজা এবছর
   আরও বড় কোন চমক দেখাবে।
সবকিছু নির্ভর করে ঋষিজার বাংলাপ্রেমী মায়ের উপর।

এই নারীকে দেখলেই বাংলাকে দেখা হয়ে যায়,
   তার সাথে কথা বললেই বাংলাকে
   ভালো না বেসে উপায় থাকেনা।
‘একুশে পদক’ পায় শুধুমাত্র মুখচেনা কীর্তিমানেরা
যখন ঋষিজার মায়েরা থেকে যায় পর্দার অন্তরালে!

সে কোন পদকের অপেক্ষায় থাকেনা, যেমন
থাকেনি ষাট বছর আগের সেই দামাল তরুনেরা।
এঁরা জন্মেছেই সবার হয়ে মাতৃভূমির প্রতি
     ঋণশোধের দায় নিয়ে।


3 comments:

  1. "বাংলা আমার ভাষা!
    বাংলা আমার অহংকার!
    অহংকার সকল বাঙালির হয়ে! আমি এই পৃথিবীর বাঙালি! বাংলা আমার স্বদেশ!"

    ঋষিজার জন্য অনেক অনেক আদর! ওরাই আমার ভবিষ্যৎ!

    আর ওদের ভার যাদর হাতে সেই ঋষিজার বাবা মা কে আন্তরিক প্রাণভরা ভালোবাসা!

    এই লেখাটি বাকিদের পথে
    আলো দিক অগ্রসরের!

    ReplyDelete
  2. অ কবি'র দিকে চেয়ে বললাম! দ্যাখ ! পদ্মপাতার রং !
    সে বলল! বর্ষার কদম ফুলের লাহান !
    আমি বললাম ! ধূত ! রংধনু !
    ও বলল ! বেনি আ স হ ক লা ...
    আমি বললাম বাংলার রুপ তুমি দেখিয়াছ !?
    সে বলল! ..কি লাভ !!!!!

    ReplyDelete