Friday, April 27, 2012

আমিই ডাঃ মৌটুসীর মা

২০০০  সালের জানুয়ারী মাসের কোন  একদিনে,  বঙ্গবন্ধু  মেডিক্যাল  কলেজ  হাসপাতালে  গিয়েছিলাম  ছোট্ট  একটি  অপারেশানের  জন্য।  সারাদিন  অপেক্ষার  পরে  আঙ্গুল  থেকে  টিউমারটি  অপারেশান  করা  হয়েছিল। এত  দীর্ঘসময়  হাসপাতালে  অপেক্ষার  একপর্যায়ে  আমার  মেয়েদের  বাবা  দীর্ঘশ্বাস  ছেড়ে  বলেছিলেন, " যদি  আমাদের  তিন  মেয়ের  একজনও  ডাক্তার  হতে  পারে,  তাহলে-----" ।  আমি  বাড়ী ফিরে  মৌটুসী  ও  মিশার  কাছে  আর্জি  পেশ  করেছিলাম।  ওরা  তখন  বেশ  ছোট।  বাবা মায়ের  এমন  সাত সতেরো  কথা  মনে  রাখার  মত  বয়স  ছিলনা।  কিনতু  মৌটুসী  মনে  রেখেছিল   কথাটি।

আমেরিকাতে  এসেই  মৌটুসীকে  ক্লাস  টেনে  ভর্তি  হতে  হয়েছে।  আশেপাশে  কেউ  ছিলনা  মেয়েটাকে  একটু  সাজেশান  দিতে  পারে।  মৌটুসীর  ছোটবেলা  থেকেই  নানা  বিষয়ে  পড়ার  খুব  আগ্রহ  ছিল  বলেই  নিজে  নিজেই  পড়ে  স্যাট, এসিটি  নামক  কম্পিটিটিভ  পরীক্ষাতে  দারুন  রেজাল্ট  করেছিল।  আমাদের  ভিসার  স্ট্যাটাস  তখন  'ডিপেন্ডেন্ট'  ক্যাটাগরীতে থাকায়  কোন  স্টেট  ইউনিভার্সিটিতে  ফুল  স্কলারশীপ  পাওয়ার  কোন সুযোগ  ছিলনা। অথবা  আমরা  তখন  একেবারেই  নতুন  ছিলাম  বলে  অনেক  কিছু  জানতামওনা।  ফলে  একটি  প্রাইভেট  ইউনিভার্সিটিতে  স্কলারশীপের  জন্য  ইন্টারভিউ  দিতে  হয়েছে।  দুই দিন  ব্যাপী  কঠিন  ইন্টারভিউ।  ৬৭ জনের  মধ্যে  পাঁচজনকে  দেবে  ফুল  স্কলারশীপ।  আমাদের  মৌটুসী  ছিল  একমাত্র  নন আমেরিকান। ইনটারভিউ  শেষে  আমরা  আশা  ছেড়ে  দিয়েই  অপেক্ষা  করছিলাম।  তৃতীয়দিনে  একটি  ফোন  এলো,  যেখানে  বলা  হলো, " আমি  হলিন্স  ইউনিভারসিটির  প্রেসিডেন্ট  বলছি।  তুমি  ওর  মা?  তুমিই  তাহলে  মেয়ের  সুখবরটি  আগে  শোন।  ঋত্বিকা  ফুল  স্কলারশীপ  পেয়েছে।  তুমি  একজন  প্রাউড  মা"।  আনন্দের  খবরে  কান্না  আসে  সেটা  প্রথম  টের  পেলাম  সেদিন।  আমি  একা  ঘরে  হাউমাউ  করে  কেঁদেছিলাম  খুশীতে।  কারন  এই  স্কলারশীপ  না  পেলে  আমাদেরকে  ব্যাঙ্ক  থেকে  বছরে  ২৫,০০০ ডলার  লোন  করতে  হতো।

হলিন্স  ইউনিভার্সিটি  থেকে  'ওয়োম্যান  স্টাডিজ' এর  উপর  চার  বছরের  ডিগ্রী  শেষ  করেছে জিপিএ ৪  (সর্বোচ্চ) পেয়ে।  এরপর  মেডিক্যাল  স্কুলে  এপ্লাই  করার  জন্য  এমক্যাট  নামের  কম্পিটিটিভ  পরীক্ষা  দিতে  হয়েছে।  এখানেও  মৌটুসী  দারুন  স্কোর  করেছে।  মৌটুসী  আমাদের  কাছছাড়া  হয়ে  থেকেছে  ওর  ষোল  বছর  বয়স  থেকে।  আমি  ভগবানের  কাছে  প্রার্থণা  করেছিলাম  যেনো  মৌটুসী  মিসিসিপি  মেডিক্যাল  স্কুলে  চান্স  পায়।  মৌটুসীর  জন্য  মিসিসিপি  মেডিক্যাল  স্কুল  আহামরি  কিছুনা।  মৌটুসী  এখানে  আসতেই  চায়নি।  কিনতু  ভগবান  আমার  মত  মায়ের  ডাকেই  সাড়া দিয়ে  থাকেন।  এদেশে  ডাক্তারী  পড়তে  গেলে  সবাইকেই  লোন করে  পড়তে  হয়।  কিনতু  মৌটুসী  ওর  রেজাল্টের  কল্যানে  মিসিসিপি  মেডিক্যাল  স্কুল  থেকে   একটি  প্রাইভেট  স্কলারশীপ  পেয়ে  যায়।  যা  কিনা  মৌটুসীর  পড়ার  খরচ  মিটিয়েও  থাকা  খাওয়াসহ  সবকিছু  কাভার  করেছে।  কিনতু  মৌটুসী  ভার্জিনিয়ার মত  স্টেটে  চার  বছর  থেকে  এসেছে,  ওখানে  নানারকম  এক্টিভিটিতে  নিজেকে  সম্পৃক্ত  রেখেছে।  সেই  মেয়ের  কাছে  মিসিসিপির  মত  এমন  কনজারভেটিভ  স্টেট  ভালো  লাগার  কথা  নয়।  মৌটুসীর  ভালো  লাগেওনি।  এখানে  আসার  পরেই  আমার  এমন  গুনী  মেয়েটি  কেমন  যেনো  নিষ্প্রভ  হয়ে  পড়ে  আস্তে  আস্তে।  পড়ুয়া  মেয়েটি  পড়াশুনাতে  আকর্ষন হারাতে  থাকে।  যে  মেয়ে  সহজে  কান্নাকাটি  করতোনা,  সেই  মেয়েই  ফোনে  প্রায়  প্রায়  কাঁদতো। মৌটুসীকে সকলেই জানে মিতভাষিণী হিসেবে। খুব শান্ত একটা মেয়ে মাঝে মাঝে শুধু বোন মিশার সাথে ঝগড়া করতো। সেই মৌটুসী একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো। মিশার সাথে প্রতি মুহূর্তে ঝগড়া করতো। আসলে মিশাকে দেখত আনন্দফূর্তি করছে, নাচ করছে, সরাসরি বলে দিচ্ছে মরে গেলেও ডাক্তারী পড়বেনা, সাধারন চাকুরী করেই জীবন কাটাবে, এগুলো শুনেই বোধ হয় ওর রাগে শরীর জ্বলতো। আমরা শুনেছি, ডাক্তারী পড়ার চাপ সইতে না পেরে অনেকেই অনেক উলটাপালটা কাজ করে ফেলে। তাই একটু দুশ্চিন্তা হতো। আবার এমন একটি স্কলার মেয়ে ডাক্তারীতে ফুল স্কলারশীপ পেয়েও পড়বেনা, এটাও ভাবতে খারাপ লাগতো।

 মৌটুসী ওর কলেজের কাছেই এপার্টমেন্ট  ভাড়া  করে  একা  থাকতো।  আমি  ভয়  পেতাম। কেবল মনে হতো, একা ঘরে মৌটুসী যদি অজ্ঞান হয়ে যায়, যদি মনের দুঃখে সুইসাইড করে ফেলে, এমন হাজার রকমের ভয় দানা বাঁধতে শুরু করে আমার মনে। ঐসময়  আমিও এখানে ইউনিভার্সিটিতে  নার্সিং পড়ছিলাম। এদেশে নার্সিং পেশাটি ডাক্তারী পেশার মতই মূল্যবান। যাই হোক, আমার রেজাল্টও খুব ভাল হতে লাগলো। আমরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতাম, মৌটুসী  ডাক্তার হবে আর আমি হবো ওর নার্স। শেষের  দিকে  এক  টিচারের উপর রাগ করে দুই  সেমেস্টার  বাকী  থাকতেই  আমি  নার্সিং  পড়া ছেড়ে দিয়ে চলে আসলাম। নার্সিং ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে অনেকবার  বলা  হয়েছিল পড়া শেষ করার জন্য। আমার রেজাল্ট ভালো ছিল, তাই আমার এমন ডিসিশানে সবাই অবাক হয়ে গেছিল। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার মনটা এমনিতেই দূর্বল ছিল, তার উপর মৌটুসিকে নিয়ে চিন্তা। একবার মৌটুসীদের এক ভ্যাকেশান শেষে কি একটা ওয়ার্কশপ চলছিল। এই মেয়ে তার বাবার মতই একটু আনমনা।  তাই আমি নিয়মিত দিনে চারবার ফোন করতাম।  আমাকে নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করেছে । এমনকি আমার মেয়েও ফোন ধরেই বলতো, বেঁচে আছি।  সেদিন ও আমাকে বলেই নাই তার ওয়ার্কশপের কথা। আমি সকালে ফোন করে ওকে পাইনি, মোবাইলে রিং হয়, মেয়ে ফোন ধরেনা। বিকেল তিনটার মধ্যে সাতবার ফোন করেও ওর সাড়া না পেয়ে আমি কান্নাকাটি শুরু করে দেই। শুধু কান্নাকাটি না, আমি আমার বরকে ভয়ংকরভাবে  বর্ণনা দিতে লাগলাম, কিভাবে মৌটুসী অজ্ঞান হয়ে মরে গেছে। আশেপাশে কেউ নেই, কেউ জানবেওনা আমার মেয়েটা ঘরের ভেতর নিশ্চয় অনেকক্ষন অজ্ঞান হয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত মরেই গেলো"। এমন বর্ণনা শুনলে কারোর মাথা ঠিক থাকার কথা নয়। আমার বর বিশ্বাস করতে শুরু করলো। ফুল ফ্যামিলি রওনা দিলাম মেয়ের কাছে। ৩০-৪০ মাইল যাওয়ার পরে আমার ফোন বাজতে শুরু করলো। দেখি মৌটুসী কল করেছে। আমার তখন কি যে অবস্থা! ফোন ধরেই কাঁদতে কাঁদতে ওর চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করে পরে জানলাম ওয়ার্কশপে ফোন নেয়া যায়না বলে ফোন রুমে রেখে গেছিল।

আমেরিকাতে  ডাক্তারী  পড়া  কত  যে  কষ্টের  আর  কত  যে  রসকষহীন,  তা  গত  চার  বছরে  হাড়ে  হাড়ে  টের  পেয়েছি।  প্রথম  দুই  বছরে  মৌটুসী  কতবার  ডিসিশান  নিয়েছিল  ডাক্তারী  পড়া  ছেড়ে  দিয়ে  'ইনটেরিয়ার  ডিজাইন'  পড়বে।  আমাদের  এই  মেয়ে  যা-ই  পড়তো,  সব কিছুতেই  ওকে  মানিয়ে  যেতো।  তারপরেও  আমি  অনেক  বুঝিয়েছি,  অনেক  কান্নাকাটি  করেছি। একদিন আমার পিসতুত ভাইয়ের কাছে বেড়াতে গেছিলাম। তিনদিন থেকে ফিরে আসার সময় গাড়ীতে মৌটুসী মিশার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করছিল দেখে আমি বকা দিয়েছি, বকা খেয়ে মেয়ে বলতে লাগলো যে আসলে ওর মাথার ঠিক নেই। ওর কিচ্ছু ভালো লাগেনা। এই মিসিসিপির দম বন্ধ করা পরিবেশে ও একটুও ভালো নেই। ও নাকি ডিসিশান নিয়ে ফেলেছে, মিসিসিপিতে থেকে ও আর পড়াশুনা করবেনা। ওর ডাক্তারী পড়ার শখ চলে গেছে। পুরানো কথাই নতুন করে খুব জোরের সাথে বলাতে শেষমেষ  আমিও  ডিসিশান  দিয়ে  দিয়েছিলাম,  " ওকে,  বাদ  দিয়ে  দাও।  পড়াশুনাতো  জীবনের  চেয়েও  বেশী  ইমপর্ট্যান্ট  না।  পড়তে  গিয়ে  যদি  মরেই  যাও,  এমন  পড়া  আমি  চাইনা।  তুমি  অলরেডী  'ওয়োম্যান  স্টাডিজ' এ চার  বছরের ডিগ্রী  করে  ফেলেছো।  চাকুরী  পাবে।  তারপরে  যদি  অন্যকিছু  পড়তে  ইচ্ছে  করে পড়ো"।  এই  কথা  বলেই  আড়ালে  অনেক  কেঁদেছি। ওর বাবাও বলেছে, " মামনি, ঠিক আছে যে কোন কিছু ছাড়তে বেশী সময় লাগেনা। যে কোন সময় ছেড়ে দিতে পারো। ডাক্তারী পড়তে গিয়ে তুমি একাতো কষ্ট পাচ্ছোনা, আমরা সকলেই কষ্ট পাচ্ছি। তোমার মত মেয়ে যদি এমন পাগলামী করো তাহলে আর কি করা। পড়া ছেড়ে দেওয়ার আগে অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতে খোঁজ নাও, সব রাস্তা ঠিক করে তারপর ডাক্তারী পড়া ছেড়ে দিও। আগেই হুট করে কিছু করোনা"। বাসায় ফিরে এসেই একঘন্টা পরেই মৌটুসী গাড়ী নিয়ে চলে গেলো জ্যাকসান। আমি এই প্রথম বাইরে বের হইনি ওকে টা টা করার জন্য। তিন চার  ঘন্টা  বাদের  মৌটুসী  ফোন  করে  আমাকে  বলেছিল, " ওকে মামনি,  আমি  ডাক্তারী  পড়া  শেষ  করবো।  আর  কখনও  পড়া  ছেড়ে  দেয়ার  কথা  বলবোনা।  কথা  দিলাম"।

ডাক্তারী  পড়ার  এই  কঠিন  জীবনে  অন্যদিকে তাকানোর ফুরসত ছিলনা মেয়ের। আমি একদিন বলেছি বিয়ের কথা। বাঙ্গালী ছেলে বিয়ে করতে বলাতে ও আমাকে বলেছে বাঙ্গালী ছেলে খুঁজে এনে দিতে। আমি ওকে বলেছিলাম 'সাদী ডট কমে' প্রোফাইল খুলতে। আসলে ওকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা আমার ছিলনা। আমি চেয়েছিলাম মনটা একটু অন্যদিকে ডাইভার্ট হওয়া দরকার। সব বয়সের একটা ধর্ম থাকে। পড়া পড়া করে জীবন শেষ করার কোন মানে হয়! মৌটুসী খুবই ভাল একটি মেয়ে, সে মেয়ে জীবনের এমন সুন্দর সময় পার করে দেবে এই পড়া পড়া করে! শেষ পর্যন্ত  গতবছর মনীশ  গুপ্তা নামের চমৎকার একটি ছেলের  সাথে  মামনির পরিচয়  হয়। পরিচয়  থেকে  বোঝাপড়া, বোঝাপড়া থেকে  এনগেজমেন্ট।  মনীশের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই মৌটুসী আস্তে আস্তে আবার আগের ফর্মে ফিরতে শুরু করে। আমিও আর প্রতিদিন ফোন করিনা। জানি মনিশ ওর খবর রাখে। আমার দুশ্চিন্তা কমে গেছে। তবুও অভ্যাস কি আর সহজে যায়! মাঝে মাঝেই মনে হয় আমার মেয়েটার গলার আওয়াজ কতদিন ধরে শুনিনা! সাথে সাথে ফোন করি। ফোন ধরলেই বলি, কেমন আছো জানার জন্য ফোন করলাম। আগের ফর্মে ফিরে যাওয় মৌটুসী হয়ত ঠাট্টা করে কোন জবাব দেয়।  মৌটুসী রান্না করতে ভালোবাসতোনা। মৌটুসী এখন আগ্রহ নিয়ে রান্না করে, বাঙ্গালী রান্নার রেসিপি জিজ্ঞেস করে।  ডাক্তারী এখন ওর ভালো লাগে। কত জায়গাতে ও একমাস বা দুই মাসের জন্য ইন্টার্নশীপ করে আসলো। এই হচ্ছে আসল মৌটুসী। মিসিসিপিতে ইন্টার্নশীপ করবেনা, অনেক ভালো জায়গাতে চান্স পেয়েছে, ডালাসে।  গতবছর ওদের এনগেজমেন্ট হয়েছে, বিয়েটা  হবে  এ  বছর জুন মাসে।  আর বিয়ের  আগেই  মৌটুসী  ডাক্তারী  পড়া  শেষ  করে  ফেললো।

আজকে  ছিল  মৌটুসীর  মেডিক্যাল  স্কুলের  শেষদিন।
আজ  থেকে  আমি  ডাক্তার  মৌটুসীর  মা।  মৌটুসীকে  আমার  অন্তর  নিঙড়ানো  ভালোবাসা,  স্নেহ,  আদর  আদর  আদর আদর-------------

2 comments:

  1. Its a rare achievement and you can enjoy with wholehearted. We should proud for Moutushi's punctuality and sincerity. God bless her. Shuvo, Dhaka

    ReplyDelete
  2. ‘‘কিনতু মৌটুসী মনে রেখেছিল কথাটি।'' মৌটুসী ও মিশার জন্য শুভ কামনা। মন থেকে কিছু চাইলে ঈশ্বর তা পূরণ করেন। ভালো মানুষের দরজা খোলা...

    ReplyDelete