Saturday, December 29, 2012

হলিডে'জ ভ্যেনু, হলিডে'জ মেন্যু

এ বছর ক্রীসমাসের ছুটিতে আমরা কোথাও যাইনি।  কারণ আমাদের বাড়ীকে এবারের ক্রীসমাস ব্রেক এর ভেন্যু বানিয়েছি, মেয়েরা  আসবে, অতিথি  আসবে এবং আমার বোন  আসবে তার সাড়ে চার বছর বয়সী  কিউট পুত্রটিকে নিয়ে। এরকম প্ল্যানই ছিল আমাদের।  মেয়েরা বলতে আমার বড় দুই মেয়ে, অতিথি হচ্ছে কাছাকাছি আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড আর বোন হচ্ছে আমার 'তুতো' বোন। আগের একটি লেখাতে  যে 'তুতো' বোনের বেড়াতে আসার কথা লিখেছিলাম, সে ইতোমধ্যেই আমাদের কাছে চলে এসেছে। এখানে আসার প্ল্যান সে করেছে আরও দুই মাস আগে থেকে, তবে  আসার ব্যাপারে  আমাকে আগাম কিছুই বলেনি।  একেবারে কিছুদিন আগে তার আসার সংবাদ জানিয়ে সারপ্রাইজড করেছে।

কয়েকদিন আগে আমার এক অতি প্রিয়ভাজন জানতে চেয়েছে, 'তুতো' বোন ব্যাপারটি কি? তাকে বলেছি, তুতো  শব্দটি এসেছে  মাসতুতো, পিসতুতো, জ্যেঠতুতো, খুড়তুতো, মামাতো ভাই-বোন সম্পর্ক থেকে।  আমার বেশ কয়েকটি তুতো বোন আছে। সবগুলো আমাকে জ্বালিয়ে মারে। তুতো হলেও আমার বোনগুলো আমার কাছে আমার সন্তানের মত,  আমাকে 'ফুলদিভাই' বলে ডাকে।  'ফুলের সাথে মিলিয়ে ফুলদিভাই, ফুলদিভাই ডাকে আর  আব্দারের ঝুলি খুলে বসে। আব্দারেরও কি শেষ আছে, ফুলদিভাই এটা খাব, ফুলদিভাই ওখানে যাবো, ফুলদিভাই বেড়াতে আসো, ফুলদিভাই মন খারাপ, ফুলদিভাই মাথা ব্যথা, ফুলদিভাই ওর সাথে ঝগড়া হয়েছে, ফুলদিভাই সে আমাকে বকেছে---------------বিরামহীন।

ওরা আমার কাছে আব্দার যেমন করে, তেমনি আমার কথা মান্যও করে।  শরীর খারাপ হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে আমাকে ফোন করবে, রান্না করতে হলে আমার কাছে রেসিপি জানতে চাইবে, কারো সংবাদ জানতে হলে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, কতভাবে যে আমাকে ওরা ব্যস্ত রাখে তার ইয়ত্তা নেই। আমার ভাইগুলো কিন্তু ওদের মত আবদারে নয়, আবদার করার আগেই আমি ভাইদের পাশে দাঁড়িয়ে যাই। এ নিয়ে অবশ্য বোনদের মনে একটু আধটু ঈর্ষা হয়, তবে আমার ধ্যাতানি খেয়ে আবার চুপ করে যায়। ঈর্ষা করার ব্যাপারে যে মহাওস্তাদ, সেই তুতো বোনটিই আমার কাছে বেড়াতে এসেছে।  দুজনেই আমেরিকায় থাকি, অথচ দেখা হলো ছয় বছর পর। এরই নাম জীবন-যাপন,  এরই নাম মেয়েদের কপাল, এরই নাম কঠিন বাস্তব!

আমার তুতো বোনটির নাম চৈতালী। চৈতালী নামটি রেখেছিল আমার মা। ছোটবেলায় চৈতালী ভীষন চঞ্চল ছিল, এখন সে বড় হয়েছে, সংসার করছে, সংসারের বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে চঞ্চলতা বাহ্যতঃ কমে গেছে , তবে জন্মগত চঞ্চলতা নিপুণভাবে নিজের ভেতরে চেপে রেখেছে। অবশ্য 'ফুলদিভাই' এর কাছে এসে ছোটবেলা হয়তো বা একটু একটু করে ফিরে আসছে। কত খলবল করে কথা বলতো চৈতালী, সে এখন পুত্রকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, ফুলদিভাইয়ের কাছে আবদার করার সুযোগ পায় না। দেখে মায়া লাগে। তবে এখানে আসার আগে ফোনে কতবার বলেছে,

-ফুলদিভাই, তোমার কাছে গেলে আমাকে অনেক কিছু রান্না করে খাওয়াবে। যা চাই তা খাওয়াবে। একেবারে আমাদের বাপের বাড়ীর স্টাইলের রান্না, ঘরোয়া খাবার কিন্তু আমাদের পুরাণো স্টাইলে, ছোটবেলাতে যেমন খেতাম।

-কী কী খাবি, আগে থেকে বল, রেডী করে রাখি।

-এই ধরো, সব সময় স্বাভাবিক খাবার কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে পোলাও, বিরিয়ানি, চিংড়িমাছের মালাইকারী, চিকেন রোস্ট, নানা রকম ভর্তা, ধইনা পাতার বাটা, বাকীগুলি পরে বলবো।

চৈতালী আসার আগের দুইদিন আমাদের বাড়ীতে প্রচুর অতিথি এসেছিল, নিমন্ত্রণ করেছিলাম। অনেক কিছু রান্না করেছিলাম। ২৩শে ডিসেম্বার আমাদের কাছাকাছি বয়সী কিছু বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম, ১২-১৩ পদ রান্না করেছিলাম। পরের দিন ২৪ শে তারিখে আমার মেজো মেয়ে বেশীর ভাগ রান্না করেছে, আর নিমন্ত্রিত অতিথিদের সকলেই একটি একটি আইটেম নিয়ে এসেছিল। এদিনের অতিথিরা ছিল বয়সে তরুণ , তাই আনন্দ ফূর্তিও প্রচুর হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার তো হিসেবই নেই।

চৈতালী  এসেছে ২৫শে ডিসেম্বার। এদিন রান্না করেছে আমার উত্তম কুমার। মুরগীর কিমা দিয়ে ছোলার ডাল, স্যালমন ফিশ ফ্রাই, আগের দিনে রান্না করা রুই মাছের ঝোল, ক্যাট ফিশ ফিলে তন্দুরী, আমের চাটনি, লেমন রাইস, সাদা ভাত।

পরদিন বেলা এগারোটায় ঘুম থেকে উঠে চা আর কুকি, দুপুরে ছিল ফ্রিজ থেকে বের করা চিকেন বিরিয়ানী, আগের দিনে রান্না করা চিকেন রোস্ট, চিংড়ি মাছের ডাল, তিন চার পদের সব্জী,  পায়েস----

ডিনারে ছিল, চিংড়ি মাছের মালাইকারী, মাটন কারী,  ডালের বড়ি দিয়ে রান্না করা পাবদা মাছের ঝোল,  মুসুরের ডাল, পালং শাক চিংড়ি মাছ, বরবটি ভর্তা---------

আগামী পরশু আমার বড় মেয়ে ফিরে যাবে তার বাড়ীতে। আজ কাজে 'সিক' কল দিয়েছি। বেলা এগারোটায় সবাই চা খেলাম, চা বানিয়েছে গৃহকর্তা। চা এর সাথে রকমারী কুকী। দুপুরে খেতে দিয়েছিলাম, গরম গরম ডালপুরী, ছানা মিশিয়ে  ঝিঙ্গে-কুমড়ো চচ্চড়ি, মাটনকারী, বেকড চিকেন।

আজ ডিনারে ছিল, মুসুর ডাল,  বরবটি ভর্তা, পাঁচমিশেলী সব্জী, পালংশাক-চিংড়ি, কেচকী মাছের চচ্চড়ি, চিকেনের পাতলা ঝোল, কাঁচা কাঁঠাল -চিংড়ি-আলুর রসা।

আগামীকাল সারাদিন বাইরে থাকবো, গাড়ীতে করে শুধুই ঘুরবো, দুপুরে যাব এক বন্ধুর বাড়ী, আলু-পরাটা খাওয়াবে। আমার মেয়ের ধারণা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলুপরাটা তৈরী হয় আমাদের বন্ধুর বাড়ীতে। আর সন্ধ্যায় যাব আহাদ-তাসমিন দম্পতির সাজানো ছিমছাম ফ্ল্যাটে। ডিনারে নেমন্তন্ন করেছে। মাত্র তিনদিন আগেই ওরা আমাদেরকে খাইয়েছে, চিকেন বিরিয়ানী, চিংড়ি মালাইকারী। আবার আগামীকাল খাওয়াবে।

চৈতালীর সময় কেমন কাটছে? খুব একটা ভালো কাটছে বলে মনে হয় না। আমি আগেই ফোনালাপে বলেছিলাম, এখানে এসে আমার বাড়ীঘর একটু গুছিয়ে দিয়ে যেতে। ফোনালাপের সময় অতিরিক্ত আনন্দের চোটে কথা দিয়ে ফেলেছিল, ঘর সাজিয়ে দিয়ে যাবে। আমার এই বোনটি বাড়ীঘর সাজিয়ে রাখার ব্যাপারে ওস্তাদ। এখানে আসার পরের দিনই ও আমার কিচেন গুছাতে গিয়ে মহাবিপদে পড়ে গেছে। দুনিয়ার জিনিস জমেছে, এগুলো নিয়ে ও বিপদে পড়েছে। 'গুছাতে পারবো না' বলতেও পারছেনা, ফোনে দুজনেই দুজনকে কথা দিয়েছি, আমি আমার কথা রাখার চেষ্টা করছি, চৈতালীকেও তার কথা রাখতে হবে।  কাজ সহজ করার জন্য জিনিস  ফেলে দিতে যায়, ছোট মেয়ে মিথীলা গিয়ে আটকায়, বলে যে এ জিনিসটা মায়ের খুব কাজে লাগে, ফেলে দিও না।

অসহায় ভঙ্গীতে চৈতালী আমার অন্য দুই মেয়েকে ডাকে,  মেজো মেয়ে চালাক, আইপ্যাড নিয়ে বসে থাকে,  এই কাজে আসেনা। বড় মেয়ে এসে চৈতালীকে সাহায্য করে আর উৎসাহিত করে জিনিস ফেলে দেয়ার ব্যাপারে। ওরা যখন ফেলে দিতে যায়, আমি তখন করুণ সুরে বলি, তোদের সংসার জীবন শুরু, কোন জিনিসের উপর মায়া জন্মেনি, খুব সহজেই ফেলতে পারিস, আমার সাতাশ বছরের সংসার, মায়ায় জড়িয়ে গেছি, কোন কিছুই ফেলতে ইচ্ছে করে না। আমার আর্তি শুনে বড় মেয়ে বলে,

- আমি আগেই জানতাম মামনি কিছুই ফেলতে দিবে না, এগুলি বরং আবার আগের জায়গায় রেখে দাও।

চৈতালী বলে, না রে! তোর দিদা বলেছে, কাউকে কিছু দিয়ে ফিরিয়ে নিতে হয় না, ফিরিয়ে নিলে পরের জন্মে কালীঘাটের কুত্তা হয়ে জন্মাতে হয়।

মেয়ে বলে, -তুমি তো কাউকে কিছু দাও নি।

-ফুলদিভাইকে ফোনে কথা দিছিলাম ঘর গুছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে, কথা ফিরিয়ে নিলে কালীঘাটের কুত্তা হবো।

হাসতে হাসতে আমি বলি, পাড়ার নেড়ী কুত্তা আর কালীঘাটের কুত্তার মধ্যে তফাৎ কি রে!

-চৈতালী হেসে দেয়, তা অবশ্য জানি না, কুত্তা হইতে চাই না।

আমি বলি, কথা দিছিলি আমেরিকায় বসে, কাজেই কথা না রাখলে পরজন্মে আমেরিকায় কুত্তা হয়ে জন্মাবি। এর চেয়ে মধুর জীবন আর আছে নাকি!

আমার কথা শুনে ওরা হেসে ফেলে।  এত বছর পর আবার ফুলদিভাইকে কাছে পেয়ে চৈতালী  মনে হয় ওর ছোটবেলায় ফিরে যেতে চায়! একেকবার হাসে, একটু পরেই আমাকে মুখ ঝামটা দেয়। আবার কাজে ব্যস্ত হয়। ওর ছোট্ট ছেলেটা দেখতে রাজপুত্রের মত হয়েছে, পুরো মায়ের রূপ পেয়েছে। হ্যাঁ, চৈতালী দারুণ রূপসী, দারুণ স্মার্ট, ভালো চাকুরী করে। বাইরের দুনিয়ায় স্মার্ট মেয়েটি তার ফুলদিভাইয়ের কাছে এসে একেবারেই কিশোরী হয়ে যায়। ভাইদের প্রতি আমার বিশেষ নজর সম্পর্কে খোঁটা দেয়! মনে করিয়ে দেই, ওর ফরমায়েশ মত রান্না করতে গিয়ে আমি কাজ থেকে ছুটি নিয়েছি, সেটার মূল্যায়ন করতে বলি।

আমাদের দুই বোনের কথা শুনে বড় মেয়ে  হাসি দিয়ে জায়গা ছেড়ে চলে যায়, চৈতালী বসে বসে গুছায়। আমার কাছে একটু পর পর চা চায়, রান্নার ব্যাপারে আমার একটুও অলসতা নেই, তা ওরা সবাই জানে। আমি খুব সুন্দর করে 'চা' বানাই, দুই বোনে যার যার কাজ করি আর চুক চুক করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যাই। দুজনের কেউই বেশীক্ষণ চুপ করে থাকতে পারি না। আবার কলকল শুরু করে দেই।



1 comment:

  1. কী দারুণ গল্প লিখেছো দিদি! এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো! গল্পটা আমার ওয়ালে শেয়ার করছি।

    ReplyDelete