Thursday, December 27, 2012

পাটিসাপটার নতুন নাম 'পিষ্টা'


আমার মেয়ে মৌটুসীর বিয়ে হয়েছে এ বছরের জুন মাসে। বরের নাম মনীশ, নেপালের ছেলে, ভারতীয় অরিজিন, বাংলা বলতে পারেনা, কিন্তু ধীরলয়ে বলা বাংলাকথা বুঝতে পারে। মৌটুসী বাংলা, হিন্দী, ইংলিশ ভাষায় সমানভাবেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে, ওর বর যেহেতু হিন্দীভাষী, তাই ওদের মধ্যে হিন্দীতেই কথাবার্তা চলে।

সমস্যা হয়েছে আমাকে নিয়ে। আমি 'বাংলাকে ভালোবাসি' জেদের বশেই মনীশের সাথে বাংলায় কথা বলি। ছেলেটা এতো বেশী নমণীয় ও ভদ্র যে আমার এই ভাষার অত্যাচার হাসিমুখে মেনে নেয়।  মেনে নেয়া ছাড়া উপায়ও নেই, আমার মেয়ে আগেই ওকে সতর্ক করে দিয়েছে, " মামনি তোমাকে মাথায় তুলে রাখবে যদি তুমি বাংলায় কথা বলতে পারো"। সেই থেকে মনীশ আমার সাথে বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করে।  আমি ওকে ফোন করে বাংলায় প্রশ্ন করি,

-মনীশ, কেমন আছো?

-  মনীশ খুব সুন্দর করে বলে,
 " হ্যালো মাসী, আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছো?

-মনীশ, বলো, মাসী আপনি কেমন আছেন?
-মাসী, আপনি কেমন আছেন?
-আমি ভালো আছি। তুমি কী করছিলে?
-আমি ডিনার খাইছো
-বলো, আমি ডিনার খাচ্ছি।
হা হা হা! মাসী, আমি ডিনার খাচ্ছি।

এভাবেই চলে আমাদের মধ্যে ফোনালাপ। ফোনালাপ না করে উপায় নেই। ওরা থাকে আমাদের থেকে অনেক দূরে, ডালাসে। ফোনালাপ ছাড়া দেখা সাক্ষাৎ করার উপায় নেই। জুন মাসে ওদের বিয়ে হয়েছে, ক্রীসমাসের সময় ওরা আমাদের বাড়ীতে এসেছে, বিয়ের পর এই প্রথম আসা।  মনীশের ছুটির মেয়াদ ছিল মাত্র তিনদিন। এই তিনদিনে ওকে কী কী খাওয়ানো যায়, সেই ভাবনায় আমি অস্থির! কারণ, মনীশের মত আমারও একই অবস্থা। ছুটি নেই, প্রতিদিন ওয়ালমার্ট যেতে হয়। তারপরেও এরই ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু রান্না করে এগিয়ে রেখেছিলাম।

মনীশ মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে। আমার হাতে বানানো চমচম আর রসগোল্লার গল্প নাকি ও সারা দুনিয়াতে বলে বেড়িয়েছে। কাজেই আমি তো খুশী হবোই। এবার চিন্তা করেছি, ক্ষীরের পুর দিয়ে পাটিসাপটা পিঠে বানিয়ে খাওয়াব। যা ভাবা তাই করা। ওরা আসার আগেই দুধ ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে রেখেছি। দেশ থেকে খেজুর গুড় এনেছিলাম, পিঠার গোলা বানাতে চেয়েছি খেজুর গুড়ের রসে। আগের রাতে বিশাল সাইজের একখানা গুড় জলে ভিজিয়ে রেখেছিলাম গলে যাওয়ার জন্য। সেদিন সন্ধ্যেবেলাতেই মনীশ আর মৌটুসী এসেছে। পরেরদিন আমাদের কিছু পারিবারিক বন্ধুকে দুপুরে খেতে ডেকেছি। পাটিসাপটা পিঠে  বানাবো, খেজুর গুড়ের পায়েস রেঁধেছি, সাথে থাকবে পাটিসাপটা পিঠে। মনীশের জন্য অতি উত্তম ডেজার্ট।

পরদিন সকালে তাড়াহুড়ো করে রান্না করতে গিয়ে একটা গন্ডগোল করে ফেলেছি। ডাল রান্না করবো বলে একটি সসপ্যান খুঁজছিলাম। যে প্যানে গুড় ভিজিয়েছিলাম, গুড় গলে গিয়ে জলটি কালচে বর্ণ ধারণ করেছিল। ডাল বসানোর চিন্তায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে গুড়ের জলকে ভেবেছি, বেগুন ধোয়া নোংরা জল। প্যান কাত করে সমস্ত জল বেসিনে ঢেলে দিতেই তলানীতে গুড়ের গুঁড়ো দেখতে পেয়ে আমার " গেছে রে গেছে, আমার সব শেষ হয়ে গেছে' ধরণের অবস্থা। কিন্তু হাতের ঢিল ছুঁড়ে দিয়েছি, আর ফেরাবার উপায় নেই। আবার আরেকটি গুড়ের চাকা ভেজালাম। এবার হামানদিস্তায় গুড় ভেঙ্গে গুঁড়া করেছি।

দুপুরে নিমন্ত্রিত অতিথিদের সকলেই এসেছেন, খুব আড্ডা, গল্প চলেছে। বিকেল হতেই পিঠে ভাজা শুরু করলাম। আমন্ত্রিত অতিথিদের কেউই পিঠে খাওয়ার মুডে ছিল না। কারণ, এখানে সবাই এমন পিঠে পায়েস অহরহ বানায়। নতুন কিছু তো নয়। তবে মনীশের কাছে ব্যাপারটি নতুন। মনীশ খেয়েছে পিঠে। আগত অতিথিদের সাথে মনীশ বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করেছে, খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তবুও করেছে। আমাকে খুশী করার জন্যই এত কসরত। এক সময় আমি বললাম,

-মনীশ, আর কষ্ট করতে হবে না, তুমি হিন্দীতে বলো, আমি হিন্দী বুঝি, তুমিও বাংলা বুঝো, কাজেই আমরা যে যার ভাষাতেই কথা বলবো। মনে হলো, মনীশ আমার প্রস্তাবে রাজী নয়, সে বাংলাতেই কথা বলার চেষ্টা করে গেলো।

পরের দিন আমি জিজ্ঞেস করলাম,

মনীশ, কালকেই তো তুমি চলে যাচ্ছো, আমি কিছু স্পেশ্যাল খাবার বানিয়ে খাওয়াতে চাই। তুমি এমন একটি খাবারের নাম বলো, আমি বানাবো।

-মাসী, আর কিছু লাগবে না। আমি পুরানা হয়েছি। নতুন নেই। আমি ঠিক আছি। আপনি রেস্ট নাও।

-তুমি কখনও পুরানা হবে না। এখন আমাকে বলো, লাস্ট টু ডে'জে কোন খাবার তোমার পছন্দ হয়েছে!

-আচ্ছা, পিস্টা বেশী পছন্দ।

-পিস্টা কোনটা!

-ঐ যে মালাই আছে, ঐটা।

মৌটুসী এগিয়ে এলো, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে,  বরের কানে কানে বললো, পিস্টা না, পিস্টা না, পাটিসাপটা!

পাটিসাপটা পিঠার নাম 'পিস্টা' শুনে আমার এমন মজা লেগেছে, আমি বললাম,

-আজ থেকে আমার বাড়ীতে পাটিসাপটার নতুন নাম 'পিস্টা' ই থাকবে।

মনীশ বলে চলেছে, ওকে , পাটিসাপটা পিঠা খেতে চাই।

-না না, মনীশ, বলো, পিস্টা খেতে চাই।

সবাই মিলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। মনীশও হাসছে। আমি তো খুব খুশী। মনীশকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম, ক্ষীরভরা পাটিসাপটা খাইয়ে। তা পেরেছি। রাতের বেলা আবার চালের গুঁড়ো, খেজুর গুড় ভিজিয়ে রেখেছিলাম। পরদিন সকালে মনীশ চলে যাবে। রাতের বেলা আমার ঘুম হয় নি। সারারাত জেগে গল্প লিখতে হয়েছে। একটি প্রতিযোগীতায় গল্পটি জমা দেবো, রাত সাড়ে তিনটায় গল্প লিখে শেষ করেছি, সেইভ করার বদলে ডিলিট করে দিয়েছি। আবার নতুন করে লেখা শুরু করেছি, ভোর পাঁচটা পর্যন্ত লিখে একটু ঘুমাতে গেছি, সকাল সাড়ে নয়টায় ঘুম ভাঙ্গতেই মনে পড়েছে, মনীশ চলে যাবে। 'পিস্টা' বানাতে হবে। দৌড়ে কিচেনে এসে দেখি চালের গুঁড়ার গোলা ফারমেন্টেড হয়ে গেছে, টক গন্ধ বের হয়েছে! কী করবো! হাতে সময় মাত্র আধ ঘন্টা। ছেলেটাকে 'পিস্টা' না খাওয়ায়ে পাঠাবো! আমার জেদ খুব বেশী। আবার গোলা তৈরী করলাম, তবে গুড়ের বদলে চিনি দিয়ে। ভাগ্যিস, ক্ষীরের ভান্ডার ছিল অফুরন্ত, ঝটপট কয়েকটা 'পিস্টা' বানিয়ে প্যাকেট করে মনীশের সাথে দিয়ে দিলাম।

পাটিসাপটা পিঠা আমার নিজের কাছেও খুব প্রিয়, কিন্তু এ কয়দিনে আমি একটাও চেখে দেখার সুযোগ পাই নি। কে বলে যে উড়তে গেলে দুই পাখা লাগে! আমার পাটিসাপটা পিঠা ডানা ছাড়াই উড়ে গেছে! আমার জন্য একটাও ছিল না। কী মনে করে যেনো আমার কাছে বেড়াতে আসা ছোট বোন টুম্পা দুইটা পিঠা প্যাকেটে ভরে ফ্রীজে রেখে দিয়েছিল। আজ আমি যখন বলছিলাম,

-পিস্টাটা মনে হয় খুব ভালো হয়েছিল, বেশী থাকলে আমি একটা খেতে পারতাম।
 টুম্পা জানালো, দুইটা পিঠা সে তুলে রেখেছে। তার থেকে একটা আমি খেয়েছি, আরেকটি খেয়েছে মিশা। খেয়ে বুঝলাম, পিস্টা খেতে খুবই ভালো হয়েছিল। মনীশও আমাকে টেক্সট পাঠিয়েছে, " মাসী, পিসটা খুব ভাল হইছে। অনেক ধন্যবাদ"। খুশী না হয়ে আমার উপায় আছে!

No comments:

Post a Comment