Sunday, December 9, 2012

যে ছবি কথা বলে!

একটি ছবি, মায়ের সাথে আমার। ছবিটি কোন আনন্দঘন মুহূর্তে তোলা নয়, তবে আমার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তোলা ছবি।  ক্লিনিকের বেডে অচেতন অবস্থায় আমার মা চোখ বুজে শোয়া, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, মায়ের বালিশের এককোণে আমি মাথা রেখে শুয়ে আছি।  ছবিটি দেখে বুঝা যায়, ঐ মুহূর্তে আমি মায়েতেই মগ্ন ছিলাম। আমার ঐ মুহূর্তের পৃথিবী জুড়ে ছিল আমার মা, আর কেউ না। ঘন্টা তিনেক আগেই মা'কে হাসপাতাল থেকে নিয়ে চলে এসেছি। হাসপাতালে মা ছিল লাইফ সাপোর্টে, কিন্তু সজ্ঞানেই ছিল। খুবই কষ্ট পাচ্ছিল মা, মুখের ভেতর দুই তিনটি নল ঢুকানো, আদরের ছেলে মেয়েদের চোখের সামনে দেখেও কথা বলতে পারছিলেন না, অসহায়ভাবে দুই চোখের কোন দিয়ে কেঁদে চলেছিলেন। ডাক্তারের পরামর্শে লাইফ সাপোর্ট খুলে দিতেই মুখের ভেতর থেকে নলগুলো বের হয়ে আসে। এরপর প্রায় ঘন্টা ছয়েক মায়ের দেহে প্রাণ ছিল, কিন্তু চেতনা ছিল না। তবে শেষের ঐ পাঁচ ছয় ঘন্টা মা আমাদের ছায়ায় থেকেছিলেন। কথা বলার ক্ষমতা ছিল না, তবে তাঁর অক্সিজেন মাস্কের ভেতর দিয়ে মুখের যতটুকু দেখা যাচ্ছিল, বুঝা যাচ্ছিল, অচেতনেও মা অনেক নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত আছেন। মায়ের অমন শান্তিময় মুখখানির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কখন যেনো আমি নিজের মাথাটি মায়ের বালিশে পেতে দিয়েছিলাম।  সেই ছবিটিই আমার হাতে এসেছে, ছবিটি কে তুলেছে, আমার জানা নেই। ঠিক কখন তুলেছে, সেটাও জানা নেই। ছবিখানি আমার মেইলিং এডরেসে আসার পরেই আমি দেখতে পেয়েছি।


আজ ৮ই ডিসেম্বার। মাত্র দুই মাস আগে ঠিক এমনই এক ৮ তারিখের বিকেলে আমার মা, আমাদের সকলকে বিরাট এক ঝাঁকুনি দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গেছেন। যখন মা চলে গেলেন, তখনও বুঝিনি, এই যাওয়া তাঁর শেষ যাওয়া। আর কোথাও তাঁকে পাব না। মায়ের মৃত্যুর পর, 
প্রথমদিকে আমার ব্যবহারে কোন অস্বাভাবিকতা ছিল না অথবা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছি, সেটাই ছিল অস্বাভাবিক। মৃত্যুর ঠিক আট দিন পর আমি আমেরিকা ফিরে আসি।  আমেরিকা ফিরে আসার পর থেকে একটু একটু করে যেন মায়ের অভাব টের পেতে শুরু করি। আমাদের ভাইবোনদের অভ্যাসই ছিল, পান থেকে চুন খসাতে হলেও মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে নেয়া। মা যদি অনুমতি দেয়, তবেই পান থেকে চুন খসাতে পারবো। তা আমেরিকা ফিরে এসে কতবারই আমার পান থেকে চুন খসানোর কথা মনে হয়েছে, সাথে সাথে মায়ের 'ওয়ারিদ'এর নাম্বারে কল করতে গিয়ে থমকে গেছি। এখান থেকেই শুরু আমার মানসিক বিপর্যয়!

কী যেন মনে হলো, ভাবলাম আমার কষ্টগুলো মনে চেপে না রেখে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দেই! আকাশে বাতাসে ছড়াতে গিয়ে ফেসবুকের শরণাপন্ন হয়েছি, দুইদিন পর পর কান্নাগুলোকে একসাথে জড়ো করে বন্ধুদের মাঝে ভাগ করে দিয়েছি। আমার অনেক বন্ধু আমার কান্নার ভাগ মাথা পেতে নিয়েছে। আমার সাথে সাথে তারাও কেঁদেছে। তাদের প্রতি আমি সারাজীবন এক ধরণের কৃতজ্ঞতা বোধ করে যাব।

আমার আরেক বন্ধু এবং বড় ভাই, তাঁর ক্যামেরাতেই আলোচ্য ছবির  দারুণ মুহূর্তটুকু বন্দী হয়েছিল। সেদিন কতক্ষণ আমি জীবনের শেষবারের মত মায়ের পাশটিতে শুয়েছিলাম, তা জানিনা। এমনকি আমি আদৌ মায়ের পাশে মাথা রেখেছিলাম কিনা তা জানতেও পারতাম না, যদি না আমার দাদাটির ক্যামেরায় অমূল্য এই মুহূর্তটি বন্দী হতো।  দাদার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো,  কারণ  বন্ধু দাদা ছবিটি আমাকে পাঠিয়ে দিতেই আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে সাড়া পড়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো, স্কুল জীবনে প্রতি রবিবারের দুপুরে আমার মা হাতে গল্পের বই নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেন। পাশে শুয়ে থাকতাম আমি। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস আমার ছিল না। মায়ের ভেজা কোঁকড়ানো চুলগুলো বালিশের চারধারে ছড়াণো থাকতো। মায়ের পাশে শুয়ে তাঁর চুলগুলো নিয়ে আমার মাথায় জড়াতাম। আমার বাবা আমাকে সব সময় চুলে 'বেবী কাট' দেওয়াতো বলে চুল কখনওই লম্বা হতে পারতো না। আমার ইচ্ছে করতো আমার মাথার চুল লম্বা হলে আমাকে কেমন দেখা যাবে, তা পরখ করার। রবিবারের দুপুরে মায়ের পাশে শোয়ার আগে সাথে আয়না নিয়ে আসতাম। মায়ের মাথার চুলগুলোকে নিজের কাঁধ থেকে টেনে এনে সারা শরীরে ছড়িয়ে দিতাম। আয়নায় দেখতাম, আমাকে সুন্দর লাগছে কিনা।

আমি যখন মায়ের চুল ধরে টানাটানি করতাম, মা কিছুই বলতো না, শুধু একটু জোরে টান পড়ে গেলে মুখে 'উহু!' শব্দটুকুই করতো। মা'র মন পড়ে থাকতো বইয়ের পাতায়, আর আমার মন পড়ে থাকতো মায়ের অসম্ভব সুন্দর কোঁকড়াণো চুলের দিকে।এমনও হয়েছে, মা আকাশবাণী কলিকাতা থেকে সম্প্রচারিত নাটক শুনছেন মনোযোগ দিয়ে, আর আমি মায়ের চুল নিয়ে নিজেকে সাজাচ্ছি। গল্পের বই  এবং নাটক, এই দুটি বিষয়ের প্রতি ছিল মায়ের তীব্র আকর্ষণ। আমি যেদিন ঢাকা ছেড়ে চলে আসি, আমার পরম শ্রদ্ধেয় দাদা, ডঃ শান্তি নারায়ণ ঘোষ, আমার কাছে মায়ের স্মৃতিচারণ করছিলেন। এই দাদা ছিল মায়ের ভাগিনা এবং বন্ধু। আমার দাদা মায়ের জন্য নতুন বই জোগাড় করে আনতো, ভালো কোন নাটক বা সিনেমার খোঁজও দাদা এনে দিত। আমার কৈশোরে রবিবারের দুপুরগুলোর সাথে দাদার স্মৃতিচারণে খুব মিল পেয়ে গেলাম।

এরপর বড় হয়ে গেছি, কৈশোর পেরোতেই মায়ের পাশে আর শোয়ার সুযোগ ছিল না, অথবা নিজের ব্যাক্তিত্ব তৈরী হওয়ার সময়টাতে কোন ছেলেমেয়েই মায়ের আঁচলের নীচে থাকাটাকে কৃতিত্বর বলে মনে করে না। আমিও করি নি। এরপর নিজের সংসার হয়েছে, আমার মেয়েদের মা হয়ে গেছি, অলস দুপুরে আমার মেয়েরা আমার পাশে শুয়েছে। ব্যস! জীবনের চক্র তো এভাবেই ঘোরে।

এত বছর পরে, আমার মা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আমাকে আবার সেই কিশোরীবেলার মত নিজের পাশে মাথা রেখে শোয়ার সুযোগ দিয়েছেন, আমি ধন্য হয়েছি। ধন্যবাদ আধুনিক প্রযুক্তিকে, ক্যামেরা আবিষ্কৃত হয়েছিল বলেই এই ছবিটির ভেতর দিয়েই আমি আরেকবার ছুঁতে পারলাম আমার শৈশব, শত কান্নার ভেতরেও সান্ত্বণা হয়ে থাকবে এই ছবিটি, এখনও আমি একা থাকলেই কাঁদি, বিশ্বাস করতে পারিনা কোনভাবেই, ওয়ারিদের নাম্বারে ডায়াল করে আর কখনওই শুনতে পাবো না, " এই মিঠু, অমুকের মাইয়া বিয়া, কিছু সাহায্য করতে হইব, অথবা তুই আসার সময় তোর মাইয়ার পুরাণ জামাকাপড় লইয়া আইয়িছ, কত গরীব দুঃখী কাপড়ের জন্য কান্নাকাটি করে, অথবা ঐদিন নন্দা মেথরের বউ আইছিল, বিছানার চাদরের লাইগা কান্নাকাটি করছে, তুই যে আরেকবার দিয়া গেছিলি, ঐ চাদরই দিয়া দিলাম, চাদর পাইয়া বেটি কী খুশী! অথবা শোন, ডাইলের বড়ি দিয়া রাখছি, কেউ তগো ঐখানে গেলে পাঠায় দিতে পারতাম, অথবা সারাটা সময় খালি আলেং ফালেং কইরা কাটাস, সংসারের দিকে কোন মন নাই তোর"। এই ছবিটিই আমাকে সান্ত্বণা দিবে, শেষ মুহূর্তে কোন এক অমোঘ টানে আমি আমার মায়ের পাশে মাথা রেখেছিলাম, ঠিক কৈশোরের রবিবারের দুপুর বেলার মত।

সবশেষে আমার সেই বন্ধু এবং দাদাকে অশেষ ধন্যবাদ মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় ধরার জন্য এবং ছবিটি আমাকে মেইল করে দেয়ার জন্য!



No comments:

Post a Comment