Saturday, May 31, 2014

মঙ্গলময় দিনে কোন এক মঙ্গলের অপেক্ষায়!

আজ শনিবার, ৩১ শে মে, আমাদের ২৯তম "এনগেজমেন্ট বার্ষিকী", সৌভাগ্যক্রমে আজ আমার ছুটির দিন। আরও দশজন পুরুষের ন্যায় আমার স্বামীও আজকের দিনটির কথা মনে রাখেননি। অথচ সকাল থেকেই গ্রিল মেশিন নিয়ে খুটখাট শুরু করে দিয়েছিলেন। ব্যথানাশক এবং নিদ্রাসুখ প্যারাসিটামল খেয়ে ঘুম দিয়েছিলাম বলে বেশ দেরী করেই ঘুম ভেঙ্গেছে আমার। ঘুম ভাঙ্গার পর কনিষ্ঠ দূত মিথীলা সংবাদ দিল, আজ তার পাপা আমাদের জন্য লাঞ্চ তৈরী করবে। দূত মারফত সংবাদ পেয়ে আমি খুশীতে বিগলিত। অপেক্ষায় আছি, কখন খাওয়ার ডাক আসে।

বেলা সাড়ে বারোটায় 'বান্দরের খাঁচা' থেকে উত্তম ডাক পাঠালেন। পৌঁছে দেখি, এলাহী আয়োজন। এবার আর চিকেন গ্রিল নয়, চিকেন বার্গার বানানো হয়েছে, সাথে চিংড়ি, নানা রকমের সব্জী, পেঁয়াজ গ্রিল করে সাজানো, আস্ত আস্ত ভুট্টা গ্রিল করেছে, শসা কেটেছে, পাঁচ মিশেলী বাদাম, এবং টোস্টেড ব্রেড, সাথে পানীয় হিসেবে কোক। পাপাকে সব কাজে সহায়তা করেছে তার কন্যা গুড্ডু।

খেতে বসেছি তিনজন, মিথীলা বলল, " এই প্রথম পাপা শুধু আমাদের ফ্যামিলির জন্য সবকিছু গ্রিল করলো"। আমার কিন্তু খেয়ালে আসেনি বিষয়টা, মিথীলা সবকিছু খুব সূক্ষ্মভাবে নোটিশ করে। আজ কেন জানি আমার ভীষণ ক্ষিদেও পেয়েছিল, উত্তমের অনুমতি নিয়ে সবার আগে আমি খেতে শুরু করেছি। তিনজনেই খাচ্ছি, একসময় আমি উত্তমকে বললাম,

" আজকের দিনে আমাদের এনগেজমেন্ট হয়েছিল, শুভ একটি দিন, এইদিনেই কাকতালীয়ভাবে তুমি আমাকে যত্ন করে খাওয়াচ্ছো, আমি খুবই খুশী হয়েছি যে ২৯ বছর পেরিয়ে গিয়ে তুমি দিনটির কথা স্মরণ করেছো। আমার মনটা ভালো নেই, তবুও তোমার কাছ থেকে এমন আপ্যায়ন পেয়ে আনন্দিত নাহয়ে পারছিনা।"

উত্তম বলে ফেললো, " আমার তো মনে ছিলনা, গতরাতে গুড্ডু আমাকে বলেছে, আজকের দিনের কথা"।

আমার উত্তম এমনই মানুষ, কোন ছল-চাতুরীর মধ্যে নেই, আমার খুশী ধরে রাখতে ইচ্ছে করলে সে বলতে পারতো, " ওমা, দিনটা আমাদের দুজনের, দুজনেরই মনে থাকার কথা, আজ তোমার ছুটি, তাই এই সামান্য আয়োজন করেছি"।

কিন্তু উত্তম ভুলেও তা বলবেনা, এমন সরাসরি উত্তর শুনে আমি যে দুঃখ পেতে পারি, এটাও সে বুঝেনা, এমনই শুদ্ধমনের মানুষ সে। আমিও তাই এখন আর এসব ক্ষুদ্র বিষয়ে দুঃখ পাইনা, বরং এমন শুদ্ধসত্য মানুষের পাশে থাকার সুযোগ পেয়েছি, এতেই খুশী। খাওয়া-দাওয়ার মাঝে এবং শেষে আয়োজককে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার পাশ্চাত্য রীতি বরাবর মেনে চলি। রীতি অনুযায়ী আমার মুখোমুখি বসা শুদ্ধতম মানুষটিকে বললাম,

" আজকের দিনে তোমার কাছে একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে, আমার চোখে দেখা শুদ্ধতম মানুষের মধ্যে তুমি অন্যতম। তুমি কি তোমার অন্তরের সমস্ত শুদ্ধতাকে জড়ো করে জুনায়েদের জন্য প্রার্থনা করবে?"

আমার এমন অপ্রাসঙ্গিক অনুরোধে উত্তম কুমার এতটুকুও চমকায়নি, ২৯ বছরে সে আমাকে চিনে ফেলেছে। ***আমার মধ্যে অনেক ক্ষুদ্রতা আছে, কখনও কখনও ব্যবহারে নীচতাও প্রকাশ পায়, আমার মধ্যে ঈর্ষা আছে, ক্রোধ আছে, জেদ আছে, একগুঁয়েমী আছে, এতগুলো দোষের মাঝখানে যে দয়ার সমুদ্র আছে, খুব কাছাকাছি থাকার কারণেই সেই দয়ার সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ উত্তমের কাছে পৌঁছে যায়।***
গত তিন দিন ধরে না-দেখা একটি ছেলের জন্য কান্নাকাটি করে চলেছি, ভাল-মন্দ না-বুঝেই ফেসবুকে এর কাছে, তার কাছে, সবার কাছে Raise your voice অনুরোধ করেই চলেছি। বেশীর ভাগ বন্ধু আমার এই ব্যাপারটিকে 'পাগলামী' হিসেবে নিয়েছে, কেউ নিয়েছে আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুযোগ হিসেবে, কেউ কেউ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছে, কেউ নিয়েছে রাজনৈতিকভাবে, আর কেউ কেউ মনে করেছে, আমি তেঁতুল কচলে তেতো বানাচ্ছি, নিজের সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দিচ্ছি। একটা বিষয় ভেবে খুব অবাক হচ্ছি,

***আওয়ামীলীগের প্রাক্তন এমপি, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার নিয়মিত লেখক **একজন কাদের মোল্লার** প্রশস্তি গেয়ে লিখেন, একজন ***দেলোয়ার হোসেন সাইদীর*** জন্য বিশাল প্রশস্তিসূচক লেখা লিখেন এবং হাজার হাজার পাঠক সেই লেখা মুহূর্তের মধ্যে শেয়ার করে, 'লাইক' করে, অথচ একজন নিরপরাধ, প্রতিভাবান, মেধাবী আলোকিত তরুণ অধ্যাপকের মুক্তির জন্য পোস্ট করা আবেদনে 'লাইক' করেনা, উলটো এহেন আবেদনকে নিছক প্যানপ্যানানি বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়****

উত্তম এসবের কিছুই জানেনা, আমি বাইরের সংবাদ উত্তমকে দেইনা। তারপরেও সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ তো সে শুনতেই পায়। সে এটাও জানে, যখন কোথাও থেকে কোন দিশা পাইনা, আশা পাইনা, শেষমেশ আমি উত্তমের শরণাপন্ন হই। উত্তম যা বলে, সেটাই শেষ উত্তর হিসেবে গ্রহণ করি। আমার অনুরোধটুকু শুনে মাথা হ্যাঁ বোধক দুলিয়ে জানালো, সে অবশ্যই প্রার্থনা করবে অন্ধকার কুঠুরীতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকা আরেকজন শুদ্ধ মানুষের জন্য। উত্তমের সম্মতি পাওয়ার পর আমার মনের মেঘ কেটে যেতে শুরু করেছে, দয়ার সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শব্দও ক্ষীণ হয়ে আসছে, সমুদ্র শান্ত হচ্ছে কোন এক মঙ্গলের অপেক্ষায়, কোন এক মঙ্গলের আশায়।

No comments:

Post a Comment