Saturday, May 31, 2014

হারিয়ে গেছে যে ছেলে!

জুনায়েদ নামটা শুনলেই বুকে ভীষণ ধাক্কা লাগে। জুনায়েদ নামের না-দেখা যুবক মেডিক্যাল থার্ড ইয়ারে উঠে ডাক্তারী পড়া ছেড়ে থিয়েটারের উপর এক বছরের কোর্স করতে পাকিস্তান থেকে মিসিসিপি চলে এসেছিল, মিশাকে ছোট বোনের মত স্নেহ করতো, মিশার সাথে আমাদের বাড়ী আসবে বলে বায়নাও ধরেছিল। মিশা যখন জুনায়েদের কথা আমাকে বলেছিল, আমি সোজা মানা করেছিলাম, পাকিস্তানী কোন ছেলে আমাদের বাড়ীতে আনা যাবেনা। আমি খুবই মায়াবী ধরণের মানুষ, মা সম্পর্কে এমনটাই আমার মেয়েরা বিশ্বাস করে, তাই আমার 'না' শুনে মিশা খুব আহত হয়েছিল।
পরেরবার মিশা বাড়ী এসে বলল, " জুনায়েদ ভাইয়া পাকিস্তানীদের সাপোর্ট করেনা, বাংলাদেশের পক্ষে, তোমাকে 'মাম্মী' ডেকেছে, তোমার সাথে দেখা করতে আসতে চায়"।
আমার মন গলে গেলো, এর আগে মিশা হোস্টেলে ফেরার সময় বাসা থেকে ঘরে তৈরী বিরিয়ানী, রসমালাই বাক্সে করে নিয়ে যেত, আমি ভাবতাম, ওর নিজের জন্য নিয়ে যায়। পরে একদিন জুনায়েদ আমাকে ফোন করে যখন বলে, " মাম্মী, তোমার পাঠানো রসমালাই খেয়ে মনে হয়েছে আমি আমার মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছি, বিরিয়ানী খেয়েও আমার মাম্মীর কথা মনে হয়েছে। আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই"।
সব ভুলে আমি তখনই বলে ফেললাম, " অবশ্যই বাবা, তুমি অবশ্যই আসবে"।
জুনায়েদ আসতে পারেনি, কোর্স শেষ হতেই ওকে পাকিস্তান ফিরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু ছেলেটি আমার সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ রাখতো, আমার যে কোন ছবিতে স্বরচিত কবিতার ভাষায় কমেন্ট করতো, আমাকে 'মাম্মী' সম্বোধন করলেও উত্তম কুমারকে ডঃ রয় বলে সম্বোধন করতো।
পাকিস্তানের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকুরী পায়, এক বছরের মধ্যেই ও আন্তর্জাতিক কোন সম্মাননা পুরষ্কার পায়, সে কখনও এগুলো প্রকাশ করতোনা, তার বন্ধুরা যখন তার ওয়ালে কনগ্র্যাচুলেট করতো, তখনই জানতে পারতাম। যদি অনুযোগ করতাম, সাথে সাথে বিনয়ের সাথে বলতো, ওর এগুলো নিয়ে কথা বলতে লজ্জা লাগে।
হঠাৎ একদিন খবর পেলাম, জুনায়েদকে গ্রেফতার করা হয়েছে, গ্রেফতার করে কোথায় নেয়া হয়েছে কেউ জানেনা। এক পত্রিকার কাটিং পড়ে যেটুকু জেনেছি, ক্লাসে লেকচার দেয়ার সময় জুনায়েদ মৌলবাদের বিরুদ্ধে এমন কিছু বলেছিল যা মৌলবাদী ছাত্রছাত্রীদের পছন্দ হয়নি। ক্লাসের সবাই বোধ হয় হই চই করে একেবারে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা করে ফেলেছিল। ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ ছিল, জুনায়েদ নাকি প্রায়ই মৌলবাদ বিরোধী কথাবার্তা বলে, এবার আর তাকে ছাড়া হবেনা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জুনায়েদকে বহিষ্কার করে, জুনায়েদ গ্রেফতার হয়, এরপর চিরতরে হারিয়ে যায় আমার ফেসবুক থেকে।
এরপর থেকে আমি জুনায়েদকে খুঁজি, পাইনা। আমার সব ছবি লক করে দিয়েছি যেখানে আমার এই পুত্রের মায়াবী কমেন্ট ছিল। শুধুই মনে পড়ে, পাকিস্তান ফিরে গিয়ে জুনায়েদ ওর মায়ের কাছে আমার গল্প করেছিল, আমাকে ইনবক্সে কতবার মেসেজ দিয়েছিল, " মাম্মি, আমি আবার আসবো আমেরিকা, তোমার সাথে দেখা করতে হলেও আসবো"।
এখনও সব মনে পড়ে, ভীষণ গ্লানি বোধ করি, অপরাধ বোধ হয়, ছেলেটি আমার কাছে আসতে চেয়েছিল, পাকিস্তানী বলে আমি মিশাকে 'না' করে দিয়েছিলাম, মিশার আহত দুই চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। যে রসমালাই খেয়ে ছেলেটি তৃপ্ত হয়েছিল, ভেবেছিল 'মাম্মি পাঠিয়েছে, সেই রসমালাই আসলে আমি পাঠাইনি তো, মিশা নিয়ে গেছিল। তখন মিশা আন্ডারগ্র্যাড করছে, পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে সেখানেই জুনায়েদকে দেখেছিল, রুমের মেঝেতে পত্রিকা বিছিয়ে বসে ভাত খাচ্ছে, টমেটো সস দিয়ে মেখে। পরিচয়ের সূচনাতেই মিশার খুব মায়া লেগেছিল, এরপর থেকে যতবার মিশা বাসায় এসেছে, কিছু খাবার প্যাকেট করে নিয়ে গিয়ে সব বন্ধুদের খাইয়েছে, জুনায়েদও খেয়েছে। কেউ মিশার এই ভালোবাসা মনে রেখেছিল কিনা জানিনা, জুনায়েদ মনে রেখেছে।
জুনায়েদ কি বেঁচে আছে? মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বললে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কাউকে বাঁচিয়ে রাখে? জুনায়েদের ফেবু অ্যাকাউন্ট তখনই ডিঅ্যাক্টিভেটেড হয়ে গেছে। আমি পারিনি ওর নাম আমার লিস্ট থেকে মুছে দিতে, কোনদিন পারবোও না। আমার একবার মনে হয়, জুনায়েদ বেঁচে আছে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে, আরেকবার মনে হয় নেই। একজন প্রতিভাবান যুবক, প্রতিভাবান কবি, প্রতিভাবান নাট্যকার হারিয়ে গেছে কোথায়! জুনায়েদরা আসলে হারিয়েই যায়, বাংলাদেশে থাকলেও হারিয়েই যেতে হতো। হায়! জুনায়েদ, আজ তোমাকে খুব বেশী মনে পড়ছে!

No comments:

Post a Comment