Wednesday, May 1, 2013

"লোকে মরে 'কলঙ্কিনী' নাম দিয়ে"

মেয়েটির নাম মিশা, বয়স ২২। বাংলাদেশে জন্ম হলেও ও বেড়ে উঠেছে  অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকার জল হাওয়ায়। বাংলা পড়তে পারে, কিন্তু লিখতে পারে বলে মনে হয় না। আমেরিকাবাসী হলেও বাংলাদেশের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। প্রতি দুই বছরে একবার দেশে যায়, কাটিয়ে আসে টানা তিন মাস। বর্তমানে ও পড়াশুনা করছে আমেরিকার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিষয় 'পাবলিক হেলথ'।

মিশার জন্ম হয়েছে  সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে।  জন্মের সময় সাভারের মাটিতে তখনও এত বিশাল বিশাল অট্টালিকা তৈরী হয়নি, রানা প্লাজা, অমুক প্লাজা, তমুক প্লাজা  কিছুই তৈরী হয়নি। সাভারের লালচে মাটির রাস্তা ধরে সারি সারি কাঁঠালের গাছ ছিল। সাভার বাজার থেকে কিছুদূর গেলেই  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, তারওপরে  জাতীয় স্মৃতিসৌধ, স্মৃতিসৌধ থেকে কয়েক কদম এগোলেই 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র', একটি বেসরকারী  প্রতিষ্ঠান। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র  মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্বপ্ন সফল প্রতিষ্ঠান। নারীদের জন্য, বিশেষ করে গরীব, স্বল্পশিক্ষিত, বাপে-মায়ে খেদানো, রূপ-জৌলুসহীন চেহারা, অনূঢ়া, বিধবা, স্বামীর বাড়ী থেকে বিতাড়িত নারীদের স্বনির্ভর হয়ে উঠার জন্য 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র' এর অবদান অনস্বীকার্য্য। বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার মহিলা ট্রাক ড্রাইভার (ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে দেখিয়েছিল)  সালেহা হচ্ছেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্বপ্নপুরীর একটি উদাহরণ।

আজ থেকে আরও চল্লিশ বছর আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দৃশ্যমান অংশগুলো পরিচালিত হতো মহিলাদের দ্বারা। এখানে মেয়েরা ক্ষেতে গিয়ে ধান বুনতো, বেকারীতে গনগনে আগুনের তাপে পাউরুটী, বিস্কুট বানাতো, ক্যান্টিনে রান্না বান্না করতো, ডাইং এবং বুটিকের কাজ করতো, গণ পাঠশালায় বাচ্চাদেরকে অবৈতনিক শিক্ষাও দিত। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে প্যারামেডিক, নার্স, আয়া, থেকে শুরু করে সর্বত্র ছিল নারীদের উপস্থিতি। যে মেয়ে বাপ বা স্বামীর ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করতো, সেই মেয়ে অনায়াসে রুগীদের শরীরে ইঞ্জেকশান দিত, মুমূর্ষু রুগীকে অক্সিজেন দেয়া , অপারেশান থিয়েটারে যেয়ে সার্জনকে সাহায্য করার মত কাজ অনায়াসেই করে যেত। সেই কোন আমল থেকেই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী শ্রমিকরা শার্ট, প্যান্ট পরিহিত হয়ে, হাতে লাঠি নিয়ে গেট পাহারা দিত।  নারী কর্মীরা সাইকেল চালাতো, মাঠকর্মীরা সাইকেলে চেপে আশে পাশের গ্রামে যেত।  সে এক অন্যরকম সাম্রাজ্য। কিন্তু দূর্জনের ছলের অভাব হয় না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী কর্মীদের বিরুদ্ধে আশেপাশের গ্রামে কতরকম রসালো গল্প চলতো, মেয়েগুলোর নামে নানা কুৎসা রটানো হতো। একজন পুরুষ কর্মীর কাজ আর নারীকর্মীর কাজে কোন তফাৎ ছিল না, তবুও যেন নারীরা তাদের প্রাপ্য সম্মান পেতো না।  তবুও তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিল, কারো ঘাড়ে বোঝা হয়ে ফিরে যেতে হয়নি।


গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে জন্মেছে বলেই মিশার গায়ে এখনও সাভারের লাল মাটির গন্ধ পাওয়া যায়, অনায়াসেই সে মাটির কাছাকাছি মানুষদের সাথে মিশে যায়। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে জন্মেছে বলেই সেখানকার নারী শ্রমিকদের মতই স্বাধীনচেতা। নাচ এবং ফটোগ্রাফীতে ওর দারুণ উৎসাহ। ফটোগ্রাফীতে পুরস্কারও পেয়েছে। মেয়ে পুরস্কার পায়, বাবা -মা খুব খুশী হয়। ফলে মিশা আরও বেশী উৎসাহী হয়ে উঠে। উৎসাহের চোটে একদিন সে তার বাবাকে বলে, " বাবা, আমার খুব ইচ্ছে, প্রস্টিটিউটদের নিয়ে একটা ডকুমেন্টারী টাইপ কিছু বানানো। ওদের জীবনটা খুব কষ্টের। আমি ওদের এলাকায় যেতে চাই, ওদের সাথে কথা বলতে চাই, ছবি তুলতে চাই।  সত্যিকার অর্থেই প্রোডাক্টিভ কিছু করার চেষ্টা করতে চাই। কোন একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারো"?  মিশার বাবা মেয়ের কথা শুনে চমকালো না, থমকালো না। নরম সুরে বললো, " মা গো, তোমার ঊদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু এর বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। কত রকমের বাধা এসে উপস্থিত হবে, তুমি ধারণাও করতে পারবে না। আমাদের দেশে তো 'ওদের'কে কেউ মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখে না। উলটো তুমি বিপদে পড়ে যাবে"।

মিশা গেল মায়ের কাছে, একই আবদার নিয়ে।  মা বললেন, " মিশা শোন, তুমি যে দেশে বড় হচ্ছো, সেদেশের সমাজে প্রস্টিটিউটদের অবস্থান ভিন্ন। আমেরিকায় প্রস্টিটিউটদের শ্রমিকের মর্য্যাদা দেয়া হয়।  কারণ, যৌনবৃত্তি তার পেশা। আমেরিকায় চুরী করলে জেলে যেতে হয়, কারণ চৌর্য্যবৃত্তি কারো পেশা হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের  পরিবেশ ও পরিস্থিতি, সংস্কৃতি  পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে একেবারেই পৃথক। আমাদের দেশে নারীদের অবস্থান সবচেয়ে দূর্বল এবং বিতর্কিত। বাংলাদেশে যে নারীকে 'মায়ের' মর্য্যাদায় ভূষিত করা হয়, সেই একই নারীকে পয়সার লোভ দেখিয়ে আরব দেশগুলিতে পাচার করে দেয়া হয় শেখদের মনোরঞ্জনের জন্য। বাংলাদেশে যে মেয়েকে 'বোন' বলে সম্বোধণ করা হয়, সেই একই মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পতিতালয়ে পাচার করে দেয়া হয়। আমাদের দেশে নারীর অবস্থানের নির্দিষ্ট কোন মাত্রা নেই।  আমেরিকায় কেউ কোন নারীকেই জোর করে বেশ্যা বানানো হয় না, বেশ্যাবৃত্তি যার পছন্দ, সে নিজ থেকেই এই পেশা গ্রহণ করে। যেহেতু  পতিতাবৃত্তি সমাজ স্বীকৃত পেশা, তাই একজন পতিতা সমাজে সকলের সাথে উঠা-বসা করতে পারে।

তুমি বলছো, পতিতারাও মানুষ, ওদেরও অধিকার আছে সুস্থভাবে বাঁচবার।  কিন্তু আমাদের সমাজে পতিতাদেরকে 'মানুষ' ভাবা হয় না, পতিতাকে 'পতিতা' ভাবা হয়। পতিতা কথাটি এসেছে 'পতিত' থেকে। পতিত মানে হচ্ছে যার কোন মূল্য নেই,  যে কিনা অস্পৃশ্য, যার কিনা পতন হয়েছে, অর্থাৎ পচে গেছে। আমাদের দেশে 'পতিতারা' কেউ নিজের ইচ্ছেয় পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে না। ওরা খুব গরীব ঘরের সন্তান,  বেঁচে থাকার তাগিদে, রোজগারের আশায় অন্যের ফুসলানীতে বিভ্রান্ত হয়ে ওরা ঘর ছাড়ে। অচেনা পৃথিবীতে ওরা সহজেই ফাঁদে আটকা পড়ে যায়, দালালদের কারসাজীতে ওরা হয়ে যায় 'নারী' থেকে 'পতিতা'।

আমাদের দেশে পতিতাকে 'শ্রমিক' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলছো? মাথা খারাপ? এখানে সকলে ভাবে , যৌনবৃত্তি  একটি অসামাজিক কাজ। আমাদের দেশে 'চৌর্য্যবৃত্তি'কে বড় অপরাধ হিসেবে ধরা হয় না, কারণ রাঘব বোয়াল থেকে শুরু করে চুনোপুঁটি পর্যন্ত এই চৌর্য্যবৃত্তিতে জড়িত। তাই ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার যোগার হবে।  এখানে পতিতাবৃত্তিকে এতই নিকৃষ্ট কাজ মনে করা হয় যে কাউকে গালিগালাজ করতে হলেও 'বেশ্যা' শব্দটি প্রায়শঃই ব্যবহার করা হয়। এই তো কিছুদিন আগেই হাসনাত আবদুল হাই নামের এক বিখ্যাত লেখক 'প্রথম আলো' পত্রিকায় একটি গল্প লিখেছিল, যেখানে প্রজন্ম মঞ্চের এক শিক্ষিত নারীকে 'বেশ্যা' বলা হয়েছে। অথচ লেখক-কবিদের নাকি বেশ্যালয়ে গমন না করিলে কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। কত নামী দামী লেখকের জবাণীতে পড়েছি, তারাও নাকি জীবনকে পুরোপুরি দেখার জন্য নিয়মিত পতিতালয়ে যাতায়াত করতেন।  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একখানি উপন্যাসে আছে, কেউ একজন বলছেন,  বেশ্যানারীর হাতে সাজানো খিলি পান মুখে না দিলে নাকি কবিতার পংক্তিগুলো ঠিকমত বের হতে চায় না। শুধু কবি-লেখকই নয়, নিকৃষ্ট নারীদের কাছে দেশের উৎকৃষ্ট মানের পুরুষেরাও যাতায়াত করতেন এবং এখনও করেন। অথচ পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সকলের আপত্তি। পতিতাবৃত্তিকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিলে  তো পেশাটিকে নিয়ে আর নাক কুচঁকানানো যাবে না। এই সেদিনও বক্তৃতায় এক নেতা  অপরপক্ষিয় এক নেতাকে ঊদ্দেশ্য করে বললো, উনি নাকি রাজনীতির বেশ্যাবৃত্তি করেন। কাজেই তোমার বাবার কথাই ঠিক, আমাদের দেশে পতিতালয়ে গিয়ে সরেজমিনে সব দেখে এসে রিপোর্ট তৈরী করবে, এমনটা কখনওই হবে না।"

মিশা এবার ওর মা-বাবা দুজনকেই ঊদ্দেশ্য করে বললো, " পলিটিক্যাল লীডাররা কেন একে অপরকে 'রাজনৈতিক বেশ্যা বলবে? বেশ্যাবৃত্তিতে যারা নিয়োজিত, তারা তো কোন অসাধু উপায়ে উপার্জন করছে না। কাউকে ঠকাচ্ছে না। দৈহিক ক্ষয়ের বিনিময়ে তারা উপার্জন করছে। সবচেয়ে বড় কথা, ওদেরকে কেন পতিতা বলা হবে? পতিতা আবার কি? চুরী করা তো মহাপাপ, তাই বলে চোরকে কি পতিত বলা হয়? যাদেরকে তোমরা পতিতা বলছো, ওরা কত দুঃখী। ওদের মা বাবা নেই, পরিবার পরিজন নেই, আত্মীয় নেই। ওরা শুধুমাত্র দুটি ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য নিজের দেহকে যাদের হাতে তুলে দেয়, তারাই কিনা বাইরে গিয়ে এই মেয়েদেরকে গালি দেয়! এজন্যই আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল ওদের জীবনের কঠিন ও সরল দিক সম্পর্কে একটু ওদের মুখ থেকে শোনা।"

 মিশার মা বললেন, " শোন আমাদের দেশে পতিতাদেরকে সম্মান দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পতিতাকে মাতৃরূপী ভূমিকায় দেখেছিলেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব।  শ্রী রামকৃষ্ণদেবের কৃপালাভে সমর্থ হয়ে একজন পতিতা নারী 'নটি বিনোদিনী' হিসেবে থিয়েটার জগতে অক্ষয় হয়ে আছেন। এরপর আর কোন সমাজ সংস্কারক বা ধর্মীয় নেতাকে  পতিতাদের পক্ষে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি । বাংগালী পতিতারা শুধুই 'কলঙ্কিনী' হিসেবেই সমাজে অচ্ছুৎ হয়ে আছে।

No comments:

Post a Comment