Wednesday, May 22, 2013

অপমানের ক্ষত শুকোলেই আবার ব্লগে লিখবো!

না-দেখা একটি মেয়ে, নাম দিলাম 'আফসানা', থাকে আমেরিকার কোন একটি স্টেটে, তিন বছর হলো, এদেশে এসেছে। তরুণ স্বামীর সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখবে বলে মেয়েটি ধনুক ভাঙ্গা পণ করেছে। তাই স্বামী যেভাবে বলে, আফসানা সেভাবেই চলতে পছন্দ করে। স্বামী চায় না আফসানা 'ফেসবুক' করুক, আফসানা ফেসবুক করেনা। স্বামী চায় না তার লক্ষ্মী বৌটা বাঙ্গালীদের সাথে মেলামেশা করুক, আফসানা কারো সাথে মেলামেশা করেনা। স্বামী সুযোগ পেলেই আফসানাকে নিয়ে বেড়াতে যায়, রেস্টুরেন্টে খায়, একসাথে টিভি দেখে, কিন্তু যখন স্বামীর সে সুযোগ হয় না, যখন স্বামী কাজে ব্যস্ত থাকে, তখন একাকী আফসানার সময় কী করে কাটে, সেদিকে অবশ্য স্বামীর খেয়াল নেই। স্বামীকে তো আর একা থাকতে হয় না, অফিসে গেলে সহকর্মী, বাড়ীতে ফিরলে আফসানাকে পায়। তাই একাকী আফসানা কম্পিউটারে বসে, এটাতে ক্লিক করে, ওটাতে ক্লিক করে শেষ পর্যন্ত বাংলা ব্লগ খুঁজে পায়।  বাংলা ব্লগে নানারকম লেখা পড়ে  সে  সময় কাটায়। এভাবেই আফসানার একাকী মুহূর্তগুলো কাটে।

একদিন 'প্রিয় ব্লগে' বিশ্বজিতের উপর একটি লেখাতে আফসানার নজর আটকে যায়। লেখাটি ওপেন করে পড়তে থাকে, একটু পরেই খেয়াল করে ওর দুগাল চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে। বিশ্বজিতকে আফসানা খুব ভাল করে চেনে, শরীয়তপুরে আফসানাদের প্রতিবেশী ওরা। পূজা-পার্বণে, ঈদে-রোজায় সকলে মিলে কতই আনন্দ করেছে। সেই বিশ্বজিতের করুণ মৃত্যুতে আফসানার তরুণ হৃদয় কষ্টে নীল হয়েছিল। ও ভেবেছিল, ওর মত করে আর কেউ বোধ হয় ভাবছে না, আর কেউ তো বিশ্বজিতের মা-বাবাকে চেনে না, তাই জানেনা, ছেলে হারিয়ে পাশের বাড়ীর কাকীমার কত কষ্ট হচ্ছে। প্রিয় ব্লগে রীতা রায় মিঠুর লেখা পড়ে ও জানতে পারলো, বিশ্বজিতের জন্য এই লেখকের মনও তাহলে ওর মত করেই কেঁদেছে। ও যেমন করে পুত্রহারা  'কাকীমা' (বিশ্বজিতের মা)র কথা ভাবছে, এই লেখিকাও তো দেখি তেমন করেই ভাবছে, লেখিকাকে  ওর খুব ভাল লেগে গেল। ও লেখিকার অন্যান্য লেখাগুলোও পড়তে শুরু করলো। বেশীর ভাগ লেখাতেই পেল পারিবারিক গল্প, মায়ের অনুভূতি, মেয়েদের জন্য আলাদা মমতা, ছেলেদের জন্য কিছু স্নেহমাখা কথা। আফসানা এই লেখিকার লেখার মধ্যে নিজের মা'কে খুঁজতে শুরু করে দিল। লেখিকার সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছে হলো, নাম-ঠিকানা জানা নেই, তাতে কী হয়েছে, বুদ্ধিমতী আফসানা লেখিকার কোন একটি লেখার সূত্র ধরে লেখিকার কর্মস্থলের ফোন নাম্বার যোগার করে ফেললো। ফোন নাম্বার যোগার করার সাথে সাথেই সে ফোনও করে ফেললো। আফসানার ভাগ্য ভালই ছিল, সেদিন রীতা রায় মিঠু কাজে এসেছিল, তাই তার সাথে সরাসরি কথা বলতে পেরেছে। লেখিকা তার ফোন নাম্বার চাওয়াতে আফসানা বিপদে পরে যায়, প্রথম আলাপেই ও লেখিকাকে জানাতে চায় নি পারিবারিক সমস্যার কথা। তাই ভদ্রতাবশতঃ ফোন নাম্বার দিয়েও ছোট করে বলে দিয়েছে, প্রয়োজনে ও নিজেই ফোন করবে লেখিকাকে, লেখিকা যেন ওকে ফোন না করে।

আফসানা খেয়াল করে, লেখিকা ওকে ফোন করছে না, তরুণী মনে কিছুটা অভিমান জন্মায়,  লেখিকাকে  সে 'আন্টি' ডেকেছে, মায়ের সম্মান দিয়েছে, তবুও আন্টি তাকে ফোন করলো না, অথচ আন্টিটাকে নিষ্ঠুরও মনে হচ্ছে না, আন্টির লেখা পড়ে তা মনেও হয় না্‌, সাত পাঁচ ভেবে আফসানা আরেকদিন আন্টির ফোনে কল দেয়, আন্টি ফোন ধরেনা, আফসানা মেসেজ রাখে," আন্টি, আপনি কী আমার উপর রাগ করেছেন? যদি রাগ করে থাকেন, তাহলে আর কল দেবো না্‌, আপনি কেন আমাকে কল দেন না, আমি কিন্তু আপনার লেখাগুলো খুব ভালোবেসে পড়ি"। মেসেজ দেয়াতে কাজ হয়েছে, আন্টি কল ব্যাক করেছে, " আফসানা, মামনি, তুমি তো আমাকে সময় বেঁধে দিয়েছো, আমি বুঝতে পেরেছি তোমাকে হয়ত কিছু সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, তাই না জেনে কল দিয়ে তোমাকে বিপদে ফেলতে চাইনি। তোমাকে বরং আমার নিজের ব্লগের লিঙ্ক দেই, ওখানে তুমি আমার সব ধরনের লেখা পড়তে পারবে। পারিবারিক, সামাজিক, আমেরিকান সংস্কৃতি নিয়ে লেখাও আছে। কারেন্ট ইস্যু নিয়ে লিখি, ওখান থেকেও আমার সংবাদ জানতে পারবে।" আফসানা খুশী হয়, খুবই খুশী।

এভাবে কয়েকমাস কেটে যায়। আফসানা তার আন্টির লেখার ভেতর দিয়েই আন্টিকে পায়, তার আম্মুকে পায়, আর আমি টের পাই আফসানা নামের এক একনিষ্ঠ ভক্তের উপস্থিতি। দুই মাস আগে আফসানা আবার মেসেজ রাখে, " আন্টি, আপনি খুব ভাল করেছেন, শয়তানদের বিরুদ্ধে লিখেছেন। এগুলি শয়তান, দেশটাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে"। আফসানার মেসেজ পেয়ে আমি বিশাল বড় এক ধাক্কা খাই। আমি বেশ কিছুদিন প্রজন্ম মঞ্চ, গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে অনেক লেখা লিখেছিলাম। ব্লগে, স্বদেশখবর নামক সাপ্তাহিকে।  আমি জানতাম না এই সব ছোটখাটো লেখা, বাদ-প্রতিবাদ  চব্বিশ বছর বয়সী আফসানাদের নজর এড়ায় না।  অনুপ্রাণিত হয়ে আরও বেশী করে লিখতে শুরু করি। কারো উপকারে না আসুক, নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকি।

গত পরশুদিন আফসানা আবার ফোন করেছিল, আমাকে পায়নি, মেসেজ রেখেছে,
আন্টি, আপনি কেমন আছেন? অনেকদিন আপনার কোন লেখা পড়ি না। আপনাকে বলেছিলাম, এখানে আমি খুব একা, আমার হাজব্যান্ড একটু অন্যরকম, আমাকে ফেসবুক করতে দেয় না, আমার ই-মেইল অ্যাকাউন্ট নেই, এখানে বাঙালীদের সাথে মিশতে দেয় না। আমি ব্লগে গিয়ে আপনার লেখা পড়তাম,  আমার অনেক ভাল লাগতো। এখন আর কোথাও আপনার লেখা পাই না। এমন কী আপনার নিজের ব্লগেও কোন নতুন লেখা নেই। আপনি কী লেখালেখি ছেড়েই দিলেন? একেবারেই ছেড়ে দিলেন আন্টি?  আন্টি, জানি, ব্লগারদের নিয়ে দেশে অনেক গন্ডগোল হচ্ছে, কিন্তু আপনি তো কত ভাল ভাল লেখা লিখেন, কারো নামে তো বদনাম লিখেন না, তাহলে ব্লগে লিখছেন নয়া কেন? আমাকে ফোন দিবেন আন্টি।  আপনার বাগানের ফুলের ছবি দেখেছি 'আমার ব্লগ' এ। অনেক সুন্দর লেগেছে। আপনি অনেক ভালো থাকেন আন্টি, আপনার লেখায় আম্মুকে খুঁজে পাই।"

আফসানা ঠিকই বলেছে, আমি এখন বেশ কিছুদিন হয়ে গেল, ব্লগে লিখিনা। আগে লিখতাম, প্রতিদিন একটা না একটা কিছু লিখে ব্লগে পোস্ট করতাম। আফসানা আমার লেখার একজন গুণমুগ্ধ পাঠক। যে লেখা পড়ে অনেকেই ছাইপাশ বলে ট্র্যাশ ক্যানে ফেলে দেয়, সেই লেখাতেও আফসানা ভালোবাসা খুঁজে পায়, সুদূর বাংলাদেশে থাকা আম্মুকে খুঁজে পায়! আমার জন্য এ তো বিশাল পাওয়া! আফসানার মত এমন লক্ষ্মী পাঠকের প্রতি লেখকের অনেক দায় থেকে যায়। ওতো শুধু আমার লেখা পড়েই না, লেখার ভেতর দিয়েই ও আমার হালহকিকত সম্পর্কে সচেতন থাকে। আমি যে ইদানিং ব্লগে লিখছিনা, তা ও খেয়াল করেছে, চিন্তিত হয়েছে আমার শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে। আমাকে পালটা ফোন করে বলতে হয়েছে, আমার শরীর ভালই আছে, মনটা ভাল নেই। মন খারাপের কারণেই ব্লগে লিখিনা। 

 'ব্লগ ও ব্লগার' কে বাংলাদেশের মানুষ এখন গালি হিসেবে ব্যবহার করে। একেবারে মাদ্রাসার কোমলমতি শিশু থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নামকরা কলামিস্ট,  'বঙ্গবীর' খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সহ অনেকেই 'ব্লগার এবং ব্লগ' শুনলে ' ওয়াক থুঃ' বলে মুখ বিকৃত করে ফেলে। দেশের 'অযুত নিযুত' সংখ্যক বুদ্ধিজীবি  সকল ব্লগারদেরকে সকালের নাস্তার টেবিলে বসে একবার গালি দেয়, বিকেলের টিভি চ্যনেলের টকশো টেবিলে বসে আরেকবার গালি দেয়। এই সকল গালিগালাজ শুনে মনটাতে একধরণের নির্লিপ্তি এসে গেছে। খুব বেশী অপমানিত হয়েছি যেদিন আন্দালিব রহমান পার্থ নামক এক সাংসদ টকশো টেবিলে রসিয়ে রসিয়ে বলেছে, সে নাকি সকল ব্লগারদের কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে, সকল ব্লগারকে দিয়ে নাকে খত দেয়াবে। কী কারণে? কারণ, ব্লগাররা সবাই 'নাস্তিক'। আন্দালিব পার্থ একজন সাংসদ, অর্ধ ব্যারিস্টার ( 'ডাঃ আইজু নামের সুপরিচিত ব্লগার 'আন্দালিব পার্থের 'ব্যারিস্টার' উপাধীর খোঁজ খবর নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ' আন্ডা তুই আর ফুটলি না' নামে। সেখানেই বলা আছে, পার্থ ব্যারিস্টারী পড়া কমপ্লীট না করেই দেশে চলে আসে) সাংসদ হচ্ছে আমাদের দেশের আই্নপ্রণেতাদের একজন। সেই আইনপ্রণেতা যদি মনে করে, বাংলাদেশে 'নাস্তিক'দের ঠাঁই নেই, তাহলে আর বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে লেখার কোন অধিকারই তো  কোন ব্লগা্রের  নেই। তাহলে আর ব্লগে লিখে কী হবে! ব্লগারদেরকে যারা নিয়মিত গালি দিয়ে নাস্তা শুরু করেন, তারাও তো কই একবারও এই অর্ধ ব্যারিস্টারকে ডেকে বললো না, " খোকা, ব্লগাররা নাস্তিক হতে পারে কিন্তু কেউ অর্ধ শিক্ষিত নয়, অর্ধ ডিগ্রীধারীও নয়, তাদের কান ধরতে বলেছো কোন আক্কেলে, 'সরি' বলো"।" সেজন্যই অপমান ও অভিমানে  ব্লগে লেখালেখি থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি।



আমি নিয়মিত বাংলাদেশের পত্র পত্রিকা পড়ি। অনেক পুরানো অভ্যাস। কিন্তু ব্লগে লেখালেখির অভ্যাস খুব বেশীদিনের নয়। আফসানার মত আমিও অনেকটা একাকী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। মেয়েরা বড় হয়ে গেছে, বিভিন্ন স্টেটে পড়াশুনা করছে, সামাজিক কুটকচালিতে আমি কখনওই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা বলে কোন গসিপেও থাকিনা, অথচ বিদেশ বিভুঁইয়ে সময় কাটাতে তো হবে। একাকীত্ব কাটাতেই লেখালেখি শুরু। আহামরি কিছুই না, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে গল্পের ছলে কিছু লিখে যাওয়া, যদি কারও কোন উপকারে লাগে! সেই ভেবেই লিখতাম, এর মাঝেই শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা। আমি রাজনীতি বুঝিনা, কিন্তু রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ।  'মানবিক রাজনীতির সপক্ষে থাকি, ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পছন্দ করিনা। আমি মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ, তাই মুক্তবুদ্ধির সপক্ষে কথা বলি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে  ব্লগে আমার লেখার ধরণ পালটে যেতে থাকে, যেমন পালটে যেতে থাকে 'ব্লগ ও ব্লগার' নিয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তা ভাবনাগুলো।


একজন মানুষ, যে নিজের নামের বানানটাও শুদ্ধ করে লিখতে পারেনা, যে নিজের নামের বাংলা অর্থ জানেনা, যে জানেইনা, ব্লগ কী জিনিস, তাদের মত মানুষেরাই হঠাৎ করে 'ব্লগ ও ব্লগার' নিয়ে হইচই শুরু করে দেয়। একটি ছোট উদাহরণ দেই, মোটামুটি শিক্ষিতজনের সকলেই জানে,  'রেখা' একটি গাণিতিক শব্দ, যার অর্থ 'পথ', 'রেখা'র কোন হিন্দু/মুসলমান নেই। সালমা রেখা নামের একটি মেয়ের সাথে আমি বোন ' সম্পর্ক পাতিয়েছি, ওকে আমি ফেসবুকে 'বোন' হিসেবে পরিচয় দেই। সম্প্রতি একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক ফেসবুকে প্রশ্ন রেখেছে সালমা রেখা কী করে রীতা রায়ের বোন হয়?,  রীতা রায় হিন্দু,  আর সালমা রেখার সালমা হচ্ছে মুসলিম নাম, রেখা হচ্ছে হিন্দু নাম, এর ভেতর  কী কোন রহস্য আছে?   আমি নিশ্চিত, এই ভদ্রলোকও সেই দলের যারা 'ব্লগার' মানে নাস্তিক ভাবে। যারা জানেই না, 'নাস্তিকতা' একটি বিশ্বাস। আস্তিকতা যেমন একটি বিশ্বাস, নাস্তিকতাও বিশ্বাস। এই পৃথিবীতে 'আস্তিকের যদি বেঁচে থাকার অধিকার থাকে, 'নাস্তিকের'ও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। কেউ মরণের পরেও জীবন আছে বিশ্বাস করে, কেউ মরণেই সব শেষ বলে বিশ্বাস করে। যারা মৃত্যুর পরে ঈশ্বর-আল্লাহ, স্বর্গ-নরক, বেহেশত-দোজখে বিশ্বাস করে, তাদেরকেই 'আস্তিক' বলে, যারা ঈশ্বর, স্বর্গ-নরক বিশ্বাস করেনা, তাদেরকেই 'নাস্তিক' বলে। আমার ধারণা, বুদ্ধিজীবিগণের সকলেই 'আস্তিক-নাস্তিক' এর তফাত জানেন, তারপরেও তারা 'ব্লগ, ব্লগার, আস্তিক, নাস্তিক' ঝড়ে দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলেছেন।  যে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ না করেও নামের আগে ব্যারিস্টার লাগায়, সেও যখন ব্লগারদের কান ধরিয়ে রাখবে বলে বেআইনী হুমকী দেয়, যারা ক্ষমতার লোভে, খ্যাতির লোভে, সস্তা পরিচিতির লোভে, জনপ্রিয়তালাভের আকাংক্ষায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কোমলমনে উগ্রতার বীজ বুনে দেন, কোমলমতি সাধারণ জনগণের অন্তরে ক্রোধের আগুন জ্বেলে দেন, তখন একজন সচেতন মানুষ হিসেবে, জন্ম এবং বেড়ে উঠার সূত্র ধরে মাতৃভূমির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আপাতত ব্লগে লেখালেখি বন্ধ রেখেছি।

লেখালেখির নেশাতে যাকে একবার পেয়ে বসে, তাকে যখন কলম বন্ধ করে বসে থাকতে হয়, সুদিনের অপেক্ষায় থাকতে হয়, তার মনের গভীরের কষ্ট কী কেউ জানে! প্রবাসের একঘেঁয়ে জীবনের একাকীত্ব  কাটিয়ে তুলতে ব্লগে প্রবেশ করেছিলাম।  লেখালেখির জন্য  ব্লগ আমার কাছে খুবই প্রিয় একটি মাধ্যম। নিজের মনের কথা, নিজস্ব চিন্তা চেতনার কথা খোলাখুলি প্রকাশ করা যায়, শব্দ ব্যবহারে সীমারেখা থাকেনা। ব্লগে ঢুকে কতজনের সাথে পরিচয় হয়েছে, কী তুখোড়, মেধাবী তরুণ সব, যারা লেখালেখি করতে পছন্দ করেন,  লিখেন বা অন্যের লেখাগুলো পড়েন। কেউ কেউ আছেন, নিজে লিখেন ্না, তবে অন্যের লেখার উপর মন্তব্য করেন, সেই মন্তব্যগুলোও খুবই উপভোগ্য। মন্তব্য থেকেও বর্তমান প্রজন্মের মন মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ব্লগে তো শুধু আওয়ামী ঘরাণার পাঠকই থাকেনা, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, নির্দলীয়, গৃহিনী, চাকুরীজীবি, বেকার থেকে শুরু করে কত পাঠক নিয়মিত ব্লগ পড়ে। ব্লগে প্রগতিশীল এবং চরম প্রতিক্রিয়াশীল, দু ধরণের লেখক ও পাঠক বর্তমান। আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন তরুণ লেখকদের বিশ্লেষণধর্মী লেখা, যে কোন বিখ্যাত  কলামিস্টদের কাছে চিন্তার খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। একেকটি লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। কিছু কিছু ব্লগার প্রচুর পড়াশোনা করে, গবেষনা করে একেকটি লেখা তৈরী করে। 

লেখালেখি করা নেশার মতো।  ব্লগে লেখালেখি করে কোন রকম আয়-উপার্জন হয় না। ভালো লাগা থেকে লিখে সবাই, প্রত্যেকেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, অনেকেই পেশাজীবি, আমার মত কেউ কেউ মাঝ বয়সীও আছে, যারা শখের বশে লিখে থাকে। আমিও  দু বছর ধরে শখের বশে লিখি। কোন পয়সা পাইনা, সংসারে কাজের ক্ষতি হয়, সামাজিকতা রক্ষা করতে পারি না, তবুও লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ব্লগে লেখালেখির সূত্র ধরেই দু' একটি পত্র পত্রিকাতেও লেখালেখির সুযোগ পেয়েছি। দায়িত্ব নিয়ে লিখতে গেলে প্রচুর পড়াশুনো করতে হয়, একটি বিষয়ের উপর পড়াশুনো করতে গিয়ে কাছাকাছি আরও অনেক বিষয় সম্পর্কে অবহিত হতে হয়। যারা মনে করে, ব্লগে লেখালেখি করা পাপ কাজের শামিল, তারা কেউ ব্লগ সম্পর্কে ধারণা রাখে না। তারা নিজেদেরকে সর্বজ্ঞানী ভাবে, তারা ধরেই নেয়, তাদের চেয়ে বেশী জ্ঞান আর কারও নেই, বা থাকতে পারে ্না। তারা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধকে বলে 'গন্ডগোলের' বছর, তাদের অনেকেই বলে, মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পরে যুদ্ধাপরাধী বলে কিছু থাকা উচিত নয়, যা হয়ে গেছে, তা পেছনে চলে গেছে। এখানেই বিপত্তি বেঁধেছে, ব্যক্ত্বিত্বের সংঘাত, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সিংহ ভাগই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন, তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, কিন্তু আধুনিক টেকনোলজী ব্যবহার করে , নানা তথ্য উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেক অজানা তথ্য সম্পর্কে জেনেছে, তারাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের রিসার্চলব্ধ তথ্য উপাত্ত ব্লগে প্রকাশ করে দিয়ে সকল পাঠকের সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছেন। 

ব্লগাররা সব সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সোচ্চার ছিল, তারাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য বর্তমান সরকারের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের সকলেরই দায়বদ্ধ থাকার কথা, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলেই আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের বিজ্ঞজনেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ব করতে ভালোবাসে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গভীরতা নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ স্বীকার করে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের রূপকারকে স্বীকার করে না। এভাবেই বাংলাদেশে আমাদের প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় একেবারেই শিশু ছিলাম, যাদের বেড়ে উঠা ছিল সীমিত সুযোগের ভেতরে, আধুনিক টেকনোলজীর সাথে পরিচয় ছিল না, তারা মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের জীবনে তার গুরুত্ব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাইনি। ফলে আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক বিষয়েই ধোঁয়াশা নিয়ে বড় হয়েছি, নানাভাবে বিভ্রান্ত হয়েছি। এর জন্য যারা দায়ী, তারাই  ব্লগারদের উত্থানে  ভয় পেয়েছে, তারাই পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে সারাদেশে 'আস্তিক-নাস্তিক' ঝড় তুলে মেধাবী কিছু ছেলেমেয়ের জীবনকে হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছে। তারাই অরাজনৈতিক চেতনায় গড়ে উঠা 'শাহবাগ মঞ্চ'কে বিতর্কিত করেছে, তারাই টিভিতে প্রচারিত টকশোতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে যে শাহবাগ মঞ্চ একটি  সরকারী ছায়ায় প্রতিপালিত মঞ্চ। তারাই সকল ব্লগারকে 'নাস্তিক' আখ্যা দিয়েছে। তাদের কারণেই হেফাজত মঞ্চ তৈরী হয়েছে। তাদের দাবীর মুখে মেধাবী তরুণদের হাতে 'হাতকড়া' পরেছে, তাদের কারণেই হেফাজতীরা ব্লগারদের ফাঁসীর দাবী তুলেছে। তারাই সকল মেধাবী ব্লগারদের অপমান করেছে, তারা দলবেঁধে একজন অপরাধী ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের মুক্তি চায়, অথচ তারা চারজন  মেধাবী ব্লগারের হাতে হাতকড়া দেখে উল্লসিত হয়! তাদের ক্রমাগত উস্কানীমূলক আক্রমনের শিকার হয়েছে 'গণজাগরণ মঞ্চ'। ব্লগাররাই একটি ছোট্ট গাঁথুণীর উপর তৈরী করেছিল মানুষের বিশাল আস্থার মঞ্চ, কতিপয় নোংরা স্বার্থান্বেষীদের রোষানলে পড়েই ভেঙ্গে গেল 'শাহবাগ মঞ্চের 'গণজাগরণ চেতনা'। সরকারে আদেশে ভেঙ্গে দেয়া হলো ব্লগারদের তৈরী মঞ্চ।


এই বুদ্ধিজীবিরা কতভাবে ব্লগারদের অপমান করেছে। তাদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ প্রথম সারির দৈনিকে 'প্রজন্ম মঞ্চ' কে কটাক্ষ করে নোংরা গল্প লিখেছে, টাকা পেয়ে ফরমায়েশী গল্পে তারা প্রতিবাদী নারীকে 'পতিতা' বানিয়েছে,  প্রতিবাদী তরুণকে 'পতিতার দালাল' বানিয়েছে, তারাই একটি '৫ই মে' র জন্ম দিয়েছে। তাদের অনেকেই গলা ফাটিয়ে বলেছে, ৫ই মে ঢাকা শহরে 'গণহত্যা' হয়েছে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের' 'বঙ্গবীর', যিনি গণহত্যার ভয়াল রূপ দেখেছেন, সেই তিনিও শাপলা চত্বরে ১০ মিনিটে 'গণহত্যা' হয়েছে বলে দাবী করেছেন, 'গণহত্যা'র পরবর্তী ১৮ দল আয়োজিত গায়েবানা জানাজায় অংশ নিয়েছে্ন।  এখানেই তিনি থামেননি, যখন খেয়াল করেছেন, সরকার শাপলা চত্বর ইস্যুকে কিছুটা ঠান্ডা করে এনেছেন, সেই ঠান্ডাকে আবার চাঙ্গা করে তোলার জন্য ১৪ই মে এবং ২১শে মে'র ' বাংলাদেশ প্রতিদিন' পত্রিকায় পর পর দুটি উস্কাণীমূলক মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। জানিনা, এতে উনার কতটুকু লাভ হয়েছে, তবে আমাদের মত প্রগতীশীলদের জন্য অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। উনার মত একজন প্রথিতযশা বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এই প্রথম অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি। এই প্রথম মনে সন্দেহ জাগছে, উনি কোন আদর্শে উদ্বুদ্ব হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন! যে স্যেকুলার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উনারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, কোথায় হারিয়ে গেলো সেই চেতনা! কেন বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে, হুমায়ুন আজাদের লেখা একটি উক্তি, " একজন মুক্তিযোদ্ধা সব সময় মুক্তিযোদ্ধা থাকেনা"। এগুলো ভাবতে চাই না, কিন্তু ভাবনাগুলো পিছু ছাড়ে না, শুধু তো বঙ্গবীরই নন, আরও কত ডাকসাইটে মুক্তিযোদ্ধারা আজ অন্য সুরে কথা বলছে! স্যেকুলারিজমের পরিবর্তে তারা আজ আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে দেশকে  নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে!

এখন কথায় কথায় মানুষের লাশ পড়ে, কথায় কথায় গাড়ীতে , বাসে বোমা পড়ে, যাত্রী মারা যায়, পথচারী মারা যায়, পুলিশ মারা যায়, পুলিশের গুলীতে নিরপরাধ মানুষ মারা যায়, ধর্মীয় জিহাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আসা উত্তাল জনতার মধ্যেও কতজন মারা গেলো! আহারে! মানুষের প্রাণ, যার যায়, সেই শুধু বুঝতে পারে, কী হারিয়ে গেলো, কে হারিয়ে গেলো! অথচ এগুলো কিছুই হতো না যদি একটি দৈনিক পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক  পত্রিকা জুড়ে 'ব্লগারদের' সম্পর্কে কুৎসিত রটনাগুলো না প্রচার করতেন, এসব কিছুই হতো না যদি সেই 'উত্তরা ষড়যন্ত্রের নায়ককে' 'বঙ্গবীর' সহ  কতিপয় বুদ্ধিজীবি সমর্থণ না জানাতেন, এর কিছুই হতো না যদি একদল রাজনীতিবিদ তড়িঘড়ি করে  ক্ষমতায় না যেতে চাইতেন, এর কিছুই ঘটতো না যদি একদল কলামিস্ট  নিজ আদর্শের বাইরে গিয়ে ফরমায়েশী উস্কাণিমূলক লেখা না লিখতেন, এর কিছুই ঘটতো না যদি সরকার সময়মত বিচক্ষনতার পরিচয় দিতেন। আজ আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, ভবন ধ্বসে বারো'শ প্রাণ বেরিয়ে গেছে, ধর্মীয় জিগির থেকে সৃষ্ট টর্ণেডোতে কত নিরীহ প্রাণ ঝরে গেছে, মাইকিং ঘোষণায় কত প্রাণ ঝরে গেছে, মহাসেন সাইক্লোনে কত ক্ষতি হয়েছে,   বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে সবচেয়ে সফল গার্মেন্টস শিল্পে ধ্বস নেমেছে, এসবের কিছুই হতো না যদি ক্ষমতালোভী মানুষগুলো একটু ধৈর্য্যশীল, সহনশীল এবং পারস্পরিক সহানুভূতিশীল হতেন।

আমাকে আফসানা ছাড়াও বেশ কিছু পাঠক ফেসবুকে মেসেজ পাঠিয়ে জানতে চেয়েছেন, আমি কেন আর ব্লগে লেখালেখি করি না, কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন আমি কেন আর বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় লিখিনা, দু'জন জানিয়েছেন, গত দুটি সংখ্যায় তারা 'স্বদেশখবর' এ আমার লেখা পান নি! আমি নিয়মিত লেখক নই, এই লেখার শুরুতেই বলেছি আমার অতি সম্প্রতি লেখক হওয়ার কারণ সম্পর্কে! তবে খুব অল্প সময় ধরে লিখলেও লেখালেখির প্রতি এক ধরণের নেশা বোধ করি। হাতে গোনা কয়েকজন আমার লেখা পড়তে ভালোবাসেন, তাই তারা আমার অনুপস্থিতিতে চিন্তিত হয়েছেন, তারা আমার লেখার ভক্ত পাঠক, আমার মত অতি সাধারণ এক লেখকের জন্য তাদের উদ্বেগ আমাকে আশান্বিত করেছে, আস্থাহীন মনে আস্থার বীজ বপন করেছে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাদের কাছে আমি ভালোবাসার দায়ে আবদ্ধ হয়ে গেছি, সেজন্যই আজকের এই কৈফিয়ত! ব্লগে লিখবো, পত্রিকাতেও আবার লিখবো, অপমানের ক্ষত শুকোতে যতটুকু সময় লাগে, ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা, আসলে আমি সুদিনের অপেক্ষায় আছি!

3 comments:

  1. ফ্যান্টাস্টিক লেখা দিদি। আমি ও প্রথম আপনার বাদাইম্যা পরে ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম

    ReplyDelete
  2. ঠিক বলেছেন দিদি। আমি ও আর লিখতে পারছি না এই । না আমার ব্লগে, না ফেসবুকে। অনেক কিছু লেখার ইচ্ছে.... সব টুঁটি টিপে মেরে ফেলছি মনে হয়! আমরা মেয়েরা কি বেশী সেনসেটিভ? নাকি লাল কষ্ট নীল কষ্টে যুবে যাই? ভালো থাকবেন দিদি!

    ReplyDelete
  3. কলম সচল ও সক্রিয় থাকুক, এই কামনা

    ReplyDelete