Thursday, May 30, 2013

প্রতিদান!

আজ বিকেলের দিকে হঠাৎ করেই মিথীলার শখ হয়েছে রাতে বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে খাবে। আমার রাতের রান্না কমপ্লীট, লেখালেখি টানছে, আমার কিছুতেই ইচ্ছে করছিল না বাইরে যেতে। আমি অনেক বদলে গেছি, সংসারে মনোযোগ দিচ্ছি না, রান্না-বান্নাও জোড়াতালি দিয়ে চলছে। নানা কারণে মন মেজাজ ভালো থাকে না, পরিবারের সকলেই এর জন্য ফেসবুককে দায়ী করছে। করুক দায়ী, কিন্তু আমি তো জানি, ফেসবুকের কল্যানেই আমি অনেক না-দেখা জীবনও দেখছি, না-জানা মানুষকে জানছি।
মানুষ আমায় বরাবর টানে, মানুষের টানেই আমি ফেসবুকে সময় দেই। ফেসবুকের সূত্র ধরেই ব্লগ, ব্লগের সূত্র ধরেই রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে লেখালেখি, ব্লগের সূত্র ধরেই গল্প-উপন্যাসের জগতে প্রবেশ! কিন্তু সেটা আমি বুঝি, মিথীলার বুঝবার কথা নয়, তাই সে কোনভাবেই মানছিল না যখন বলেছি,
” বাবলুসোনা, আজ নয়, আরেকদিন যাব বাইরে খেতে”।
মিথীলা বলে, ” যদি আজ বাইরে খেতে যাও, তাহলে আমি ১০ মিনিটের মধ্যে স্নান সেরে ফেলবো, ১০ মিনিটের মধ্যে পূজা সেরে ফেলবো, নয়া গেলে এক ঘন্টা লাগাবো”।
বাচ্চা মানুষ, কী বাচ্চামানুষী আলটিমেটাম দিয়েছে আমাকে, মিথীলা খুব ধীরগতির বালিকা, আরও অনেক বেশী চটপটে হতে হবে ওকে, দিনরাত এই মন্ত্র ওর কানের কাছে জপে যাই, এটা বুঝেই আমাকে ও ১০ মিনিটের আলটিমেটাম দিয়েছে। আমি মনে মনে হাসি, সবাই খালি আলটিমেটাম দেয়, কিছুদিন আগে ৪ঠা মে তারিখেই বোধ হয়, বেগম জিয়াও ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। আল্টিমেটামের খবর মিথীলা জানে না, এর পরিনতিও জানে না। ভাবলাম, থাক! ছোট মানুষ, আলটিমেটাম তত্ব বুঝে কাজ নেই।
বললাম, ঠিক আছে, যাব। বাইরেই খাব, রেডী হও।
আমি বাদে পরিবারের সকলেই মোটামুটি সব ধরণের খাবারে অভ্যস্ত। জাপানীজ সুশী যে ওরা কী করে খায়, তা ওরাই জানে। মেক্সিকান ফুডও আমার কাছে একঘেয়ে লাগে বলাতে মিথীলা বলে, ” আমরা যে রোজ ডাল-ভাত খাই, সেটাও তো তাহলে একঘেয়ে”। এটা বলার জন্য কী ওকে একটা চড় দেয়া উচিত ছিল? ছিলনা, কারণ যুক্তির কথা বলেছে, যুক্তির কাছে আমি হার মানতে লজ্জা পাই না, কিন্তু অযৌক্তিক এবং ঠ্যাটা মারা কথা শুনলে মাথাটা গরম হয়ে যায়! ইদানিং কিছু বন্ধু ‘আমেরিকাবাসী’ বলে নানাভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে, দেশে গিয়ে ‘ফাল’ পারতে উপদেশ দেয়। কিছুদিন আগে তো এক ভদ্রলোক বলেই বসলেন যে আমি নাকি আমেরিকার নাগরিকত্ব ভিক্ষা করে নিয়েছি, এখানে নাকি মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি আর নির্লজ্জের মত আমেরিকার জয়গান করে যাচ্ছি। এসব কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না, নাহলে বলতাম, আমরা কোটি কোটি প্রবাসী যদি দেশের টানে পাগল হয়ে গাতটি বোঁচকা বগলে করে দেশে গিয়ে উপস্থিত হই, আপনাদের মুখের চেহারা তখন কী হবে? ১৩ দফা দাবী নিয়ে ৫ই মে তারিখে যখন দেশে অবস্থিত ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগণের পায়ের চাপে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছিল, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? ভয়ের চোটে তো ঘরের দরজায় খিল এঁটে বসেছিলেন, ঢাকাকে শংকামুক্ত করতে সরকারকে কেন ১৫ মিনিটের ” গণহত্যা” [ বিরোধী নেত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী] চালাতে হয়েছিল! আমাদেরকে দেশে ডাকার আগে আরেকবার ভেবে দেখুন, আমাদের পদভারের চাপ সামলাতে পারবেন তো???????
যাই হোক, আমি ইদানিং বাইরে খাওয়া-দাওয়া করিই না। আমাদের শহরে বাংলা ক্যুজিন তো দূরের কথা, ইন্ডিয়ান ক্যুজিনও নেই, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমেরিকান স্যান্ডুইচই নানা নামে, নানা ঢঙে পাওয়া যায়, নাহলে চায়নীজ অথবা জাপানীজ রেস্ট্যুরেন্ট আছে, আর আছে মেক্সিকান, থাই, ইটালিয়ান। সব খাওয়া হয়ে গেছে, নতুনত্ব নেই। আমিই বললাম, চায়নীজ রেস্টুরেন্টে যেতে পারি, আমি মঙ্গোলিয়ান গ্রীল ( সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের পছন্দমত আইটেম উত্তপ্ত লোহার বড় প্লেটে ভাজা ভাজা করে নেয়া যায়) খাব। ওরা রাজী, মিথীলা, ওর বাবা আর আমি চলে গেলাম ওখানে। বলে রাখা ভাল, মিথীলা কিন্তু ঠিকই ১০ মিনিট এবং আরও ১০ মিনিটে ওর করণীয় কাজ সেরে ফেলেছে। তার মানে, ইচ্ছে করলেই ও দ্রুত কাজ করতে পারে, কিন্তু করে না, বাংলাদেশে জন্মানোর কারণেই বোধ হয় এই ঢিলেমীপনা, কে জানে!
রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে গেছে, ঢুকে দেখি মালিক আর কর্মচারী ছাড়া আর কেউ নেই। মালিক ছেলেটি আমাকে চিনতে পেরেছে, ফোন কিনতে যায় তো, তাই সে বেশ আন্তরিকভাবে আমাদেরকে ডেকে ভেতরে নিয়ে বসিয়েছে। এই রেস্টুরেন্টে রাতের বেলাতেও বাফে সিস্টেম (ব্যুফে) চালু আছে। মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, মঙ্গোলিয়ান গ্রীল কী আজ বন্ধ রেখেছো? সে বললো, ” না, আমি করে দিচ্ছি”। মিথীলা পাশ থেকে ফোড়ন কাটলো,
” মা, এখানে এটাকে মঙ্গোলিয়ান গ্রীল বলে না, হিবাচি গ্রীল বলে”।
বললাম, ” চুপ থাক, সব জায়গায় গিয়ে মাতব্বরী করবি না। সাউদার্ণ ইংলিশ শিখাস ঠিক আছে, এখন নাক বোচাদের সাথেও এত ভেবে কথা বলতে হলেতো আমার বিপদ!”
মিথীলা চুপ হয়ে গেছে, ও আমাকে ঘাঁটাতে চাইলো না, কে জানে, কত সাধ্য সাধনা করে মা’কে বাইরে আনা হয়েছে, এরপরে যদি মা সটান বেরিয়ে যায়!
মালিক ছেলেটি এর মধ্যেই লোহার প্লেট অন করে দিয়েছে। আমি একটি প্লেটে কাঁচা চিংড়ি, চিকেন ফিলে তুলে ছেলেটার হাতে দিয়ে বললাম, একেবারে কড়কড়ে করে ভেজে দাও, কোথাও যেন কাঁচা না থাকে, আরেকটি প্লেটে দিলাম মাশরুম, ব্রকলী, পেঁয়াজ, জুকিনি ( ঝিঙ্গা ধরনের সবজি), মরিচের সস, রসুনের কুচি আর দুটো ডিম।
ছেলেটি বলল, ভাত বা নুডলস দিবে না?
বললাম, নাহ! শুধু এগুলোই দাও, ভাত লাগবে না, শুধু খেয়াল রাখবে যেন কাঁচা না থাকে।
ছেলেটি সব প্লেটে ছেড়ে দিয়ে ক্যাশ বাক্সের কাছে চলে গেলো, বললো, সে সব ঠিকমত করে দেবে।
আমি একটি বাটিতে এগড্রপ স্যুপ নিচ্ছিলাম, খেয়াল করে দেখলাম, অন্য একটা কর্মচারী সেই গরম লোহার প্লেটের কাছে গিয়ে নাড়াচাড়া করছে, ক্যাশবাক্স থেকে ছেলেটি এক দৌড়ে চলে গেলো চুলার কাছে, কর্মচারীকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই আবার কুক করতে লাগলো। ছোট একটি ব্যাপার, আমার নজর এড়ায়নি, খুব ভালো লেগেছে। একে বলে ‘প্রতিদান’। এই ছেলেটিকে আমি ফোন কেনার সময় অনেক সাহায্য করেছিলাম, ওটা ছিল আমার দায়িত্ব, আমার সহকর্মী কৃষনাঙ্গ মেয়েগুলো খুবই অপেশাদারী আচরণ করে ভিনদেশী বা স্বদেশী বৃদ্ধদের সাথে। তাই ভিনদেশীরা আমাকে খুঁজে বের করে, আমি ওদের সমস্যা বুঝি, নিজের জীবন দিয়েই ওদের সমস্যা উপলব্ধি করি। আজ তার প্রতিদান পাচ্ছি, সে এত বড় ব্যবসার মালিক, তার সামনেই আছে তার কর্মচারী, তবুও এই সম্মানটুকু সে আমাকে দিয়েছে। ভাবলাম, পৃথিবী থেকে এখনও ভালোমানুষী বিদায় নেয় নি।
আমরা খাচ্ছিলাম, আধা পথে সেই মালিক ছেলেটি দুই হাতে করে মঙ্গোলিয়ান গ্রীলের প্লেট ( সরি, হিবাচি গ্রিল) এনে আমাদের টেবিলে রেখে গেলো, খাবার এনজয় করতে বললো। আমরা ছাড়া আর মাত্র দুজন বাইরের লোক ছিল, বুধবার রাত সাড়ে আটটার সময় আমেরিকানরা বেডে থাকে, রেস্টুরেন্টে থাকার কথাও না। আমার পাশেই বসেছিল উত্তম কুমার, সে দেখালো, আমাদের থেকে একটু দূরে কোণাকুণি দুই টেবিলে খেতে বসা কিছু চায়নীজ ছেলে মেয়েকে! বললো, “ওরা বোধ হয় কর্মচারী, কাজ শেষে এখন খাচ্ছে”।
আমার সাইড থেকে ভালই দেখা যাচ্ছিল, প্লেট ভর্তি সাদা রঙের আঠা ভাত, আর একটা কিছু তরকারী, সামনে বাটি থেকে গরম ধোঁয়া উঠছে। স্যুপ কিনা কে জানে! চার পাঁচটি ছেলে মেয়ে আঙ্গুলে কাঠি ধরে কপাকপ করে সাদা আঠা ভাত খাচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে, এগুলো ওদের জন্য আলাদা রান্না করা হয়েছে। আমার আর খেতে ভাল লাগছিল না। মনে হচ্ছিল, কেইস ভর্তি এত হরেক রকম খাবার আর ওরা খাচ্ছে শুধু ভাত আর পাতলা স্যুপ। আমাদের দেশে কিছু ধনী ব্যক্তির বাড়ীর রান্নাঘরে দুই রকমের চাল মজুত থাকে। নিজেদের জন্য রান্না হয় দিনাজপুরের ‘কাটারীভোগ’, আর গৃহভৃত্যদের জন্য মোটা ‘ইরিচাল’। আমার নিজের চোখে দেখা জিনিস, কখনওই মেনে নিতে পারিনি। কৈফিয়ত হিসেবে উত্তর পেয়েছি,
“ওরা তো অনেক ভাত খায়, কাটারীভোগ দিয়ে পোষাবে না, তাই ওদের জন্য মোটা চাল”।
বুঝলাম মোটামুটি যুক্তি আছে ধরে নিলাম, কিন্তু রুইমাছ বা কই মাছ নয় কেন ওদের জন্য?
উত্তরে শুনেছি, ওরা মরিচ পোড়া আর আলু ভর্তাতেই বেশী খুশী থাকে।
হতে পারে সত্যি কথা, কিন্তু আমার বাসার বুয়ারা আমার চেয়ে বেশী ভাত খেতো না, আলু ভর্তা নিজের বাড়ীতে খেতো বলেই মাছের টুকরা দুই একটা বেশী পেলে বাটিতে ঢাকা দিয়ে বাসায় নিয়ে যেত। আমার কাছে কতটুকু আদর পেত আমার বুয়ারা জানিনা, কিন্তু যতদিন থেকেছে, আমাকে আগলে রেখেছে বুয়া। প্রতিদান দিয়েছে, আমার মা’কে দাওয়াত দিয়ে বস্তিতে নিয়ে গেছিল, মা’কে নিজের বিছানায় বসিয়ে ‘চা’ বানিয়ে খাইয়েছে। সারা বস্তির মানুষ এসে নাকি জড়ো হয়েছিল, ‘মাসী’কে দেখতে। আমার যখন তৃতীয় সন্তান (মিথীলা) হবে, বুয়া মানত করেছিল, ‘দিদির একটা ছেইলে হইলে মিল্লাদ পড়ামু”!!!
ছেইলের বদলে মেয়ে হয়েছে দেখে বুয়া একটুও অখুশী হয় নি, মিথীলাকে কত যত্ন করে সে লালন-পালন করেছে, বুয়ার কাছে মিথীলাকে রেখে আমি বিএড কমপ্লীট করেছিলাম, বুয়ার কাছে দেড় বছরের মিথীলাকে রেখে আমি তিনদিনের জন্য ‘দুবাই’ বেড়াতে গেছিলাম!
২০০১ সালের নির্বাচনের সময় আমি বুয়াকে দিয়ে ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দেয়ার জন্য প্রচার চালিয়েছিলাম। বুয়াকে বলেছিলাম, ” বুয়া, আমি দেশে থাকলে নৌকা মার্কা হাইরা যায়, ‘৯১ সালেও হারছিল, ‘৯৬ তে আমি ছিলাম না দেশে, নৌকা জিতছিল, এইবার দেশে আছি, এইবারও না জানি নৌকা হাইরা যাইব, তুমি এক কাজ করো, তোমাদের বস্তিতে কত মানুষ, আমারে তো সবাই চিনে, তাগোরে গিয়া কও, নৌকায় যেন ভোট দেয়, নৌকা জিতলে আমি তাগোরে একদিন খাওয়ামু”।
আগের রাতে বুয়া এসে বলে গেছে, ” দিদি, অবস্থা বেগতিক, বিপক্ষের লোক আইসা সবতেরে টেকা দিয়া গেছে, আমার আনোয়ারের বাপেরেও সাধছিল টেকা, আনোয়ারের বাপে লয় নাই, কইছে না, টেকা নিমুনা, ভোট যারে খুশী দিমু।”
একে বলে প্রতিদান! বুয়াকে ভালোবাসছি, বুয়া তার প্রতিদান দিতে চেয়েছে। আমাদের ড্রাইভার মোকসেদ আলীকে তার স্যার যে কতভাবে সাহায্য করতো, ঠিক ঠিকানা নাই। হুমায়ুন আহমেদের নাটক ‘বহুব্রিহীতে’ রহিমার মা’কে সবার সাথে টেবিলে বসিয়ে খেতে দেয়া হয়েছিল বলে দর্শকদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিল। ওটাতো নাটকে দেখিয়েছে, আর বাস্তবে আমার উত্তম কুমার মোকসেদ আলীকে পাশে বসিয়ে কতদিন যে ভাত খেয়েছে, তার হিসেব নেই।
মোকসেদ আলী আমাকে নিয়ে যখনই নারায়ণগঞ্জে যেত, আমার বাবা সোফা থেকে উঠে মোকসেদকে বসতে দিতেন। মোকসেদ খুব লজ্জা পেত, বাবা তার পিঠে হাত বুলিয়ে বসাতেন। আমি সামনে থাকতাম না, কারণ আমাকে দেখলেই মোকসেদ উঠে দাঁড়িয়ে থাকতো, যত বলতাম, মোকসেদ, আপনি আমার বাবার বাড়ীতে অতিথি, এখানে আমার সামনে আপনাকে লজ্জা পেতে হবে না, কিন্তু শত হলেও বসের স্ত্রী আমি, অতটা সমাজতন্ত্র তো দেশে আসেনি! আমরা আমেরিকা চলে আসার পরেও মোকসেদ আলী নারায়ণগঞ্জে মাঝে মাঝে যেত মা-বাবাকে সালাম জানাতে, নিজের বাড়ির গাছের পাকা পেঁপে দিয়ে আসতো, একে বলে ভালোবাসার প্রতিদান! যাই হোক, নির্বাচনের আগে আমি মোকসেদের মতি গতি বুঝতে পারতাম না, তবে মোকসেদ আমার মতিগতি ভাল বুঝতো, নির্বাচনের আগের দুই একদিন মোকসেদ বলেছিল নিজের থেকে, ” আপা, নিশানা ভাল বুঝা যায় না, আহসান উল্লাহ মাস্টাররে হারানোর জন্য একদল লোক টাকা লইয়া ঘুরতাছে!”
বললাম, ” আপনি কী নৌকা মার্কার লোক?”
মোকসেদ বলে, ” হ, নৌকার লোক, তবে আহসানউল্লাহ মাস্টারের জন্য জান কোরবান”।
নির্বাচনের ফলাফল যেদিন বের হয়েছে, এখন মনে পড়লে হাসিও পায়, বুয়া এসে গালে হাত দিয়ে আমার ঘরের দরজায় বসেছে, আমি খাটে শুয়ে আছি চুপ করে, পাথর হয়ে গেছি অপমানে, কেন যে এত অপমান লেগেছিল, কে জানে! বুয়া বলে, ” দিদি, কইছিলাম না আপনেরে, প্রচুর টেকা ঢালছে বস্তিতে, এইবার দেখলেন ত,”
আমি বলি, ” যাক বুয়া, তোমাদের দোষ নাই, গরীব মানুষ, যে টাকা দিবে তার কথাই শুনতে হবে, নাহলে বস্তি জ্বালিয়ে দিলে তোমরা কই যাবে?”
বুয়া বলে, ” আমারে বুঝানো লাগবে না, আপনে বুঝলেই হয়। সক্কাল থিকা মরার মত পইড়া রইছেন, নৌকা হারছে ত কী হইছে, একবার হারছে, পরের বার জিতব। এখন শোক কইরা লাভ আছে? উঠেন শোয়া থাইক্কা, চউক্কে মুখে পানি দেন। আপনের সমস্যা কী, আপনে ত যাইতাছেন গা আমরিকা, সমস্যা হইব আমার। বিরুধী দলের লোকে আমার চেহারা চিন্যা রাখছে, এইবার আমারে ধরবো”।
আমি বলি, ” হায় হায়, এইটা কী কও বুয়া, তোমার বস্তির বাড়ীওলারে গিয়া আমার কথা কইও, দরকার হইলে আমারে লইয়া যাইও একদিন, আমি বুঝায়া বলবো নে, কিছু বলবে না তোমারে”।
” হেই বেবস্থা আমি কইরা থুইছি, চিন্তা নাইক্কা, হেগোরে কইছি, আমি ধানের শীষে ভোট দিছি, না দিলে ধানের শীষ জিতছে কেমনে? বস্তির ভোট গইন্না দেহেন, তাইলেই টের পাইবেন”।
বুয়ার কথায় আমি চমৎকৃত না হয়ে পারিনি। ছোট্টখাট্ট মানুষ, যেদিন আমার বাসায় প্রথম আসে, কী লজ্জা লজ্জা মুখ, চার বছরে কত স্মার্ট হয়ে গেছে, বুয়া আমার কাছে থেকে কী আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে, দেখে আমি খুব খুশী হয়েছি। এরপর আমেরিকা থেকে যতবার দেশে গিয়েছি, বুয়ার খোঁজ নিতেই বুয়া অন্য বাড়ীর কাজ কমিয়ে দিয়ে আমার কাছে দুই মাস থেকেছে। অন্য বাড়ীতে বলে এসেছে, “দুই মাস আমারে একটু ক্ষমা করতেই হইব, আমেরিকা থিকা আমার দিদি আসছে, দিদি না থাকলে আমার ত এইখানে থাকাই হইত না, গাট্টি বোচকা লইয়া বাড়ীতে যাওন লাগতো।” আমি বুয়ার জন্য কী করেছি তা আমার মনে নেই, কিন্তু বুয়া মনে রেখেছে!
এই হচ্ছে প্রতিদান! প্রায়ই শুনি, কাজের বুয়াকে মারধোরের সংবাদ, খারাপ লাগে, আবার বুঝি, দুই পক্ষেই দোষ আছে, গৃহকর্তার যেমন দোষ আছে, গৃহভৃত্যদেরও দোষ থাকে। তারপরেও যতটুকু সম্ভব বৈষম্যনীতি পরিহার করে চললে মনের দিক থেকে স্বস্তি পাওয়া যায়। কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এসেছি। রেস্টুরেন্টে বসে চায়নীজদের কথা বলছিলাম, সেখানেই শেষ করতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশের বুয়া ঢুকে গেছে গল্পের মাঝে। তবে বুয়া ঢুকে পড়াতে একটা উপকার হয়েছে, লেখার যবনিকা টানতে সুবিধা হয়েছে এই বলে যে,
শ্রেণী বৈষম্য সব দেশে, সব জাতিতেই বিদ্যমান আছে, কোথাও কম, কোথাও বেশী। তেমনি প্রতিদানের চেষ্টাও সব দেশের সব মানুষের মাঝেই আছে, এটাই মানবচরিত্রের ভাল বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য!

No comments:

Post a Comment