Sunday, April 28, 2013

ছেলেটির গায়ে ছিল কালো স্ট্রাইপ শার্ট!!

একটু আগে টিভিতে চ্যানেল ২৪ এর সংবাদপ্রচার দেখছিলাম। সাভার ট্র্যাজেডির পর এই প্রথম টিভিতে প্রচারিত সংবাদপাঠ দেখার জন্য একটুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়েছি। কালো স্ট্রাইপ শার্ট গায়ে একটি যুবক ভাঙ্গা ছাদের নীচে চাপা পড়ে কাতরাচ্ছে।  এ কয়দিন সংবাদপত্রের পাতায় শুধুই মৃতের ছবি দেখেছি,  আজ টিভিতে জীবন্ত মানুষের চেহারা দেখতে পেয়ে উৎসাহ বেড়ে গেল। কী বলছে শোনার চেষ্টা করলাম। যুবকটি শরীরের অর্ধেক উঁচুতে তুলছে আর বলছে, " ও আল্লাহরে, আমারে বাঁচাও! আমারে বাঁচাও। বলেই ক্লান্ত দেহ নিয়ে শুয়ে পড়ছে। এর বেশী কিছু করার সাধ্য নেই, কারণ তার কোমড় থেকে বাকী দেহ বিশাল ভারী কংক্রীটের ভাঁজে আটকে গেছে। যুবকটির মুখটা তখনও সতেজ, শুধু যন্ত্রণায় কোঁকাচ্ছিল। খবরে জানালো, যুবকটিকে শেষ পর্যন্ত জীবিতাবস্থায় বের করে আনা সম্ভব হয় নি। পরদিন তার নিথর দেহ বের করে আনা হয়েছে। বুঝতে একটু সময় লাগলো, কী বলছে, একটু আগে যে স্পষ্ট স্বরে 'আল্লাহ'কে ডাকছিলো, সে পরদিনই মারা গেলো! এমন সংবাদ শোনার জন্য থেমেছিলাম! মনে হলো, কী নিষ্ঠুর সংবাদ পাঠক!!

মিডিয়ায় যেভাবে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছে।  পত্রিকার পাতা খুললেই রক্তাক্ত দেহ, সেই কতদিন থেকেই দেখে চলেছি। শুরুটা হয়েছিল বিশ্বজিতের রক্তাক্ত ছবি দিয়ে, এরপর ব্লগার রাজীবের রক্তাক্ত লাশের ছবি।  এরপর আর যেন থামেই না, পুলিশের রক্তাক্ত দেহ, পুলিশের  দুই হাতের কব্জী কাটা ছবি,  ফটিকছড়ির ভুজপুরের হতভাগ্য চার আওয়ামী কর্মীর রক্তাক্ত দেহের ছবি, শিবির কর্মীদের রক্তাক্ত দেহের ছবি।  প্রতিদিনই  একটি না একটি রক্তাক্ত লাশ বা দেহের  ছবি সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়েই চলেছে। ওভাবেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সব কিছুরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে। অসুস্থ হলে ওষুধ সেবনও মাত্রা ধরেই হয়ে থাকে। কিন্তু সেদিনের 'রানা প্লাজা' দূর্ঘটনার ছবিগুলো যেন সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে।  কিছু কিছু ছবি দেখে তার ভয়াবহতা সহ্য করার মত শক্তি অনেকের নেই এটা সত্য, কিন্তু  এতে সংবাদকর্মীরা কতখানি দায়ী হতে পারে? তাদের দায়িত্ব সংবাদ সংগ্রহ করে আনা, তারা তো সেটিই করছে। সাভারের বাজার রোডের রানা প্লাজার ভাঙ্গা বিল্ডিং-এর স্ল্যাবের নীচে চাপা পড়ে যদি মানুষ চ্যাপ্টাই হয়ে যায়, সংবাদকর্মীরা তো সেই চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া দুঃখী মানুষগুলোর রক্তাক্ত ছবিই নিয়ে আসবে, এর মধ্যে বাড়াবাড়ির কিছু তো দেখিনা। 


রানা প্লাজার এত বড় দূর্ঘটনার জের ধরে যার জীবন ও দেহের উপর দিয়ে ঝড় গেল এবং এখনও যাচ্ছে, যার স্বজনের দেহ কুৎসিত বিভৎসতার শিকার হয়েছে, তারা কী করে সহ্য করছে!! মাথা থেকে কালো স্ট্রাইপ শার্ট পরিহিত যুবকের ছবিটি সরছে না। চাইও না ছবিটা সরে যাক, ছবিটা মুছে যাক। বাঁচার জন্য আকুতি দেখলাম, তরতাজা প্রাণ নিথর হয়ে যাওয়ার সংবাদ পেলাম ! বাংলাদেশে জীবন কত সস্তা, এই ছিল, পরক্ষণেই পৃথিবী থেকে মুছে গেল, সে যখন আল্লহকে ডাকছিল, তার মন কী বলছিল? সে কী ভেবেছিল যে সে সত্যিই মরে যাবে!! আমরা তো যখন তখন, বিপদে পড়লেই আল্লাহ বা ভগবানকে ডাকি! অভ্যাসবশেই ডাকি, তখন কী একবারও মনে হয় যে মরে যাচ্ছি! বরং ভরসা জাগে, ঈশ্বর কোন একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু কালো  স্ট্রাইপ শার্ট পরিহিত যুবকের চীৎকার বোধ হয় আল্লাহর দরবারে পৌঁছাতে পারেনি, 'আর্তের চীৎকার' নামক নেটওয়ার্ক  নিশ্চয়ই খুব বিজি ছিল।

কালো স্ট্রাইপ শার্ট পরিহিত ছেলেটির বাঁচার জন্য যে ক্রন্দন আর আকাংক্ষা দেখলাম,মিডিয়াতে সংবাদগুলো ছবিসহ প্রচারের যৌক্তিকতা খুঁজে পেলাম। ঠিকই আছে, আমাদের মত সাত তলা দালানে আরাম কেদারায় বসে থাকা রোবটগুলোর মধ্যে মানবিকতা জাগ্রত হোক। এ কেমন অভিযোগ যে মিডিয়া বাড়াবাড়ি করছে! যারাই সংবাদ সংগ্রহ করছে, তারা তো  সত্যিকার অর্থেই নরক দর্শন করে আসছে, নরকে গিয়ে যা দেখেছে, সেটাই তুলে এনেছে। নরকে গিয়ে তো আর নন্দন কানন দেখার কথা নয়। আমি খুব দূর্বল চিত্তের মানুষ, 'সহ্য করতে পারি না' বলে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবো, ভয়াবহতার চেহারা দেখবো না, দুইদিন পরেই ভুলে যাব। তার চেয়ে এই ভাল হয়েছে, স্বজাতির নারকীয়তা দেখাচ্ছে, দেখছি এবং দেখবো! তারপরেও আমার বিবেক জাগ্রত হোক, বিবেকের দংশন থাকুক, আজ-কাল-এবং বাকী জীবন। প্রতি মুহূর্তে যেন মনে হয়, জীবন অনেক মূল্যবান। এই জীবনটা কারোর দয়ার দান নয়, কারোর লোভের 'বলি' হওয়ার জন্য নয়, কারো চাপাতির আঘাত সইবার জন্য নয়! যার যার জীবন তার তার। আহারে! স্বজনেরাই শুধু বুঝতে পারে স্বজন হারাণোর বেদনা। মাথায় ঘুরছে শুধুই কালো স্ট্রাইপ শার্টের যুবকের বাঁচার আকুতি।

No comments:

Post a Comment