Saturday, April 13, 2013

মুছে যাবে গ্লানি, ঘুচে যাবে জরা, নতুন শপথে প্রত্যয়ী মোরা!



আমেরিকার মিসিসিপি রাজ্যের ছোট্ট একটি বাড়ী্, সেই বাড়ীর অ্যাটিকে খুবই ছোট একটি পরিসরে আমি মাঝে মাঝেই প্রার্থণায় বসি। প্রতি মাসের কোন একটি শনি অথবা মঙ্গলবার আমি দেবী বিপদনাশিনী মায়ের পূজা করি। পূজা শেষে যখন প্রার্থণায় বসি, আমার নিজের জন্য কিছু চাইতে ভুলে যাই। আমার সকল চাওয়া জুড়ে থাকে আমার প্রিয়জনেরা। সে প্রিয়জন যে কেউ হতে পারে। আমার বাবা-মা, ভাই বোন থেকে শুরু করে না-দেখা কোন বন্ধুও হতে পারে। আমি অনেকবার প্রমান পেয়েছি, খুব সংকটকালে আমি যখন প্রার্থণায় বসি, সংকট কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে আমার মনে অন্যরকম 'নিশ্চিন্ততা' এসে ভর করে। আমি বুঝে যাই, সংকট কেটে যাবে।
আমার মনে আছে, গত বিএনপি সরকারের আমলে পার্থ সাহা নামের এক যুবককে মিথ্যে অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল 'পাঙ্কু বাবরের' সৈনিকেরা। প্সেরার্থণায় বসে ই ছেলেটির মুক্তির জন্য আমি অনেক কেঁদেছিলাম, ছেলেটি জীবিত অবস্থায় ফিরেছে। আমার এক স্নেহভাজন ছোট ভাই রেজা, পরিচয় হয়েছিল ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে থাকার সময়, ২০০৪ সালে যখন মিসিসিপি চলে আসি, তার তিন মাস পরেই রেজার স্ত্রী, আমার অতি আদরের ছোট বোন সোমা, বাচ্চা প্রসবকালীন নানা জটিলতায় ক্লিনিক্যালী মারা গিয়েছিল ( ক্লিনিক্যালী ডেড), লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার আগে রেজার অনুমতির অপেক্ষায় ছিল চিকিৎসকেরা, রেজা অনুমতি দেয় নি। মিসিসিপির ছোট ঘরে বসে আমি আকুল নয়নে কেঁদেছিলাম, বিপদনাশিনী মায়ের কাছে সোমার প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলাম, পূজার ফুল সাথে নিয়ে ১৮ ঘন্টা ড্রাইভ করে সোমাকে শেষবারের মত দেখতে গিয়েছিলাম। ক্লিনিক্যালী ডেড সোমার বালিশের নীচে পূজার ফুল রেখে এসেছিলাম। সোমা এখন হুইল চেয়ারে করে চলাফেরা করে। বিস্তারিত আর কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি না, কারণ এগুলো একান্তই বিশ্বাসের ব্যাপার।

আজকেও আমি বসেছিলাম দেবী বিপদনাশিনীর পূজার্চনায়! প্রত্যেকের নামে একটি করে মোমবাতি জ্বালিয়েছি, যাদের নামে মোমবাতি জ্বালিয়েছি, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, 'বাংলাদেশ'। হ্যাঁ, আমি সমগ্র বাংলাদেশের নামে একটি মোমবাতি জ্বালিয়েছি। আকুল হয়ে প্রার্থণা করেছি যেন দেশে শান্তি ফিরে আসে, যেন নতুন বছরের প্রথম দিনটা দিয়েই শুরু হয় সামনের দিকে এগিয়ে চলা। প্রার্থণা কবুল হবে কী হবে না, জানিনা, তবে মনের ভেতর এক ধরণের নিশ্চিন্ততা বোধ করছি। গতকাল পর্যন্ত ভেবে রেখেছিলাম, দেশে মৌলবাদীদের অত্যাচারের প্রতিবাদ হিসেবে ১৪২০ সালের পহেলা বৈশাখ আমি অরন্ধন দিবস হিসেবে কাটিয়ে দেবো। মত বদলেছি, পূজায় বসার আগেই দেশে বাবার কাছে ফোন করেছিলাম, ৮৫ বছর বয়সী বাবা বলেছেন, অন্যান্যবারের তুলনায় আরও বেশী উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নববর্ষের দিনটি পালন করতে। এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যে কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরেছেন, আমার মনের বিষাদ ও ভয় কেটে গিয়ে সাহস ফিরে এসেছে। মূল উপদেশ ছিল, কোন অপশক্তিকে ভয় পেতে নেই, ভয় পেলেই এরা মাথায় চড়ে বসবে। বাবার মতে মৃত্যু যখন আসবে, তখনই মরা ভাল, মরার আগেই মরে যাওয়া কোন প্রগতীবাদীর কাজ নয়। বর্তমান গণজাগরণের প্রতি বৃদ্ধ মানুষটির অবিচল আস্থা আছে। বাবার সাথে কথা শেষ করেই আমি নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলাম। বাবা বলেছেন, বাংলাদেশে এইসব অপশক্তি আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতে থাকবে কিনা তা নির্ভর করছে বর্তমান প্রজন্মের মন মানসিকতার উপর। বর্তমান প্রজন্মের কথা উঠতেই আমার মুখটাতে আলো দেখা গেল। মন চলে গেল ঢাকার রমনার বটমূলে।


বাংলাদেশের সরকারী পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ থেকেই বাংলা নতুন বছরের হিসেব শুরু হলো, ১৪২০ সালের ১লা বৈশাখ। ্বাংলাদেশের জাতীয় উৎসবগুলোর অন্যতম উৎসব হচ্ছে 'পহেলা বৈশাখ', অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমুজ্জ্বল এ উৎসবটি শুধুমাত্র বাঙালীদের প্রাণের উৎসব হিসেবেই উদযাপিত হয়, বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গে এবং বিশ্বের যে কোন বাঙালীর পরিবারে। উৎসবটির অঙ্গে কোন ধর্মীয় আবরণ নেই, যা আছে তা শুধুই আবহমান বাংলার সংস্কৃতি, বাঙালী চেতনা আর বাঙালীর প্রাণের সুর। বাঙালীকে আবেগপ্রবণ জাতি হিসেবেই সারা বিশ্ববাসী চেনে। এ আবেগ একেবারেই অন্যমাত্রার আবেগ, এ আবেগ একেবারেই বিশুদ্ধ আবেগ। দেশের জন্য, বাংলা মায়ের জন্য, বাংলা ভাষার জন্য একমাত্র বাঙালীই পারে মন-প্রাণ উজার করে দিতে। দিয়েওছিল একবার ১৯৫২ সালে, সৃষ্টি হয়েছিল অমর একুশে, আরেকবার মন-প্রাণ উজার করে দিয়েছিল ১৯৭১ সালে, সৃষ্টি হয়েছে নতুন একটি স্বাধীন ভূখন্ড, যার নাম বাংলাদেশ, এরওপরে বাঙালী বহুবার, বহুভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেছে বাংলা মা'কে ভালোবেসে।

বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ১৯৭১ সালে, কিন্তু এরও কয়েক বছর আগে থেকেই ছায়ানটের কলাকুশলীদের তত্বাবধানে পহেলা বৈশাখের ঊষালগ্নে ঢাকার রমনা বটমূলে ছোট্ট পরিসরে গানের মাধ্যমে নববর্ষকে স্বাগত জানানো হতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও প্রতি বছরই ছায়ানটের শিল্পীরা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান আয়োজন অব্যাহত রেখেছেন। তবে সময়ের সাথে সাথে রমনা বটমূলের নববর্ষ উদযাপনের নান্দনিক দিকটি সম্পর্কে সারা দেশবাসীর উৎসাহ বেড়েছে, পরিসর বেড়েছে, মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন শাসকবাহিণী বাংলা নববর্ষ উদযাপণকে 'হিন্দুদের পরব' হিসেবে গণ্য করতো। যেহেতু চৈত্র সংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় কিছু রীতি নীতি, আচার-আচরণ মেনে পালন করতো, তাই পাকিস্তানীরা পহেলা বৈশাখকে হিন্দুদের পরব বলে বাংলার জনগণকে ভাঁওতা দিতে চেয়েছিল। যেহেতু বাংলার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল ধর্মভীরু মুসলমান, তাই পাকিস্তানী শাসকদের দূরভীসন্ধিমূলক অপপ্রচারে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল, তাই 'রমনা বটমূলে'র বৈশাখী অনুষ্ঠান সীমিত পরিসরেই উদযাপিত হতো। কিন্তু সময় বদলেছে, মানুষের মন মানসিকতা বদলেছে, এক প্রজন্ম থেকে নতুন আরেক প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটেছে, তাই রমনার বটমূলের বৈশাখী উৎসবের চেহারাই পালটে গেছে। এখন আর কারো সাধ্যি নেই যে বলবে, পহেলা বৈশাখ হচ্ছে হিন্দুদের পরব।

তাহলে কী পাকিস্তানীদের প্রেতাত্মারা বাংলা মায়ের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! অবশ্যই না, প্রেতাত্মারা নিশ্চিহ্ন হয় না, এরা ভূতের মতই ঘুরে বেড়ায়, আশেপাশের সকলকে ভয় দেখিয়ে বেড়ানো হচ্ছে ওদের একমাত্র কাজ। এরা যুগে যুগে মানুষের অকল্যান সাধনে ব্যস্ত থাকে, প্রেতাত্মা বলেই অন্ধকারে ওদের বসবাস, আলোকে ওরা বরাবরই ভয় পায়। ওরা তাই মোমবাতি ভয় পায়, ওরা প্রদীপ দেখে চমকে উঠে, ঢোলের বাদ্য শুনলে ওদের গা জ্বালা করে, দৃষ্টি নন্দন আল্পনা দেখে ওদের মতিভ্রম হয়! আর তাই বাংলার আবহমানকালের সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে ওদের বিরোধ। সেই বিরোধের জের ধরেই ওরা ২০০১ সালের ১৪ই এপ্রিল, ১৪০৮ সালের ১লা বৈশাখে রমনা বটমূলের বাঙালী মিলনমেলায় ঘটিয়েছিল স্মরণকালের নৃশংস ঘটনা, যে ঘটনায় কতগুলো তাজা প্রাণ নিথর হয়ে গেছিল, স্তব্ধ হয়ে গেছিল রমনার বটবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা, নিস্তব্ধ হয়ে গেছিল বটমূলের বাঁধানো চওড়া বেদী। কতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেল সেদিন! প্রতিবছরের ন্যায় আমারও সেদিন যাওয়ার কথা ছিল পরিবার-পরিজন নিয়ে, যাওয়া হয় নি কারণ পরদিন আমার বি এড ফাইন্যাল পরীক্ষা ছিল। আসলে আমার আয়ুর জোর ছিল, তাই বি এড পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। অতর্কিত হামলায় যে প্রাণগুলো ঝরে গেলো, সেই ঝরে যাওয়া মুখগুলো এখনও স্মৃতিকোষে জমা আছে, এখনও স্মৃতি হাতড়ালেই শিল্পীর মুখখানা ভেসে উঠে। ভাই-ভাবীর কাছে বেড়াতে এসেছিল শিল্পী, ফিরে গেল বোমায় ক্ষত-বিক্ষত লাশ হয়ে।

এত বড় নৃশংস হত্যাকান্ডের পরেও কিন্তু পহেলা ্বৈশাখ বা বইমেলা অথবা বিজয় দিবস অথবা স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ থেমে থাকেনি, যেমন থেমে থাকে্নি একুশের প্রথম প্রহরে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন পর্ব। প্রেতাত্মাদের জীবিত স্বজনেরা এখনও নানাভাবে প্রচার চালায় মঙ্গলদীপ প্রজ্বলনের বিরুদ্ধে, অপপ্রচার চালায় বৈশাখী মেলার বিরুদ্ধে, অপপ্রচার চলে পহেলা বৈশাখের চারুকলা আয়োজিত মুখোশ র‌্যালীর বিরুদ্ধে, প্রবল আপত্তি উঠায় রাস্তা-ঘাট আলপনার বিরুদ্ধে! তারা জোরে শোরে বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতি, সভা সমাবেশ, নানা টকশো-তে খোলামেলাভাবেই বলে যায়, বাঙ্গালীর এই শাশ্বত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, খোলামেলাভাবেই বলে যে এগুলো সবই হিন্দুয়ানী কালচার। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, যে সংস্কৃতি বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব গৌরব, সেই সংস্কৃতিকে কী করে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর মালিকানাধীন সম্পত্তি বলে প্রচার চালান হয়!

আলপনা কেন হিন্দুদের পৈতৃক সম্পত্তি হতে যাবে! একজন মুসলমান নারী যখন তার স্বামী বা সন্তানের জন্য পরম মমতায় নক্সী কাঁথা তৈরী করে, তখন কেন কাঁথায় সূচিত আলপনাগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠে না, যে চিত্রকর্ম কাঁথায় ফুটিয়ে তুললে অপরাধ হয় না, একই চিত্র কর্ম শহীদ মিনার চত্বর অথবা কংক্রীটের রাস্তায় করলে কেন অপরাধ হবে, সেই উত্তর এখন পর্যন্ত জানা হলো না। মঙ্গলদীপ জ্বালানোই হয় পারস্পরিক মঙ্গল-অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে। আলোর ধর্মই হচ্ছে অন্ধকার বিদূর করা, আলোর ধর্মই হচ্ছে সামনের পথ দেখানো। গ্রামে- গঞ্জে গৃহবধূরা এখনও মাটির পিদিম জ্বেলে সন্তানের শিয়রে বসে থাকে, বৈদ্যুতিক আলো চলে গেলে শহর-বন্দরে বসবাসকারী মানুষ পিদিমের বদলে মোমবাতি জ্বালায়, অভিজাতরা শুভ জন্মদিনের কেক কাটার আগে মোমবাতি ফুঁ দেয়। শুধুই কী হিন্দুদের মন্দির বা উপাসনালয়েই মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালানো হয়? কত সম্মানিত পীরের মাজারে, গির্জায় মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালানো হয়ে থাকে। নিজস্ব প্রয়োজনের সময় মোমবাতি প্রজ্বলন করা জায়েজ, কিন্তু যে কোন গণ আন্দোলনে মোমবাতি প্রজ্বলনকে জায়েজ বলা যাবে না, শুধুই 'হিন্দুদের পূজা' মনে করা হবে, এমন দ্বিমুখী কথার কোন জবাব আছে কিনা, তাইবা কে জানে! অবশ্য এটাও ঠিক, যে কথার জবাব হয় না, তার জবাব আশা করাও বাতুলতা।

তবে, আশার কথা, সুবিধাবাদীদের অপপ্রচারে বর্তমান প্রজন্ম ভুলেও বিভ্রান্ত হচ্ছে না। তারা প্রত্যেকেই মনে ও আচরণে শতভাগেরও অধিক বাঙ্গালী। সুবিধাবাদীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে বলেই বর্তমান প্রজন্মের মেধাবী তরুণ-তরুণীরা অপপ্রচারের খেলাটি খুব ভালো করে অনুধাবন করতে পেরেছে। আর তাই শত হুমকী-ধামকীর মধ্যেও রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ অনেক বেশী জাঁকজমক সহকারে উদযাপিত হয়। এমন কি ২০০১ সালের সেই বোমা হামলার পরেও বাঙালী বটমূলে যাওয়া বন্ধ করেনি। বরং যে নারী ২০০১ সালে কিশোরী মেয়ের হাত ধরে যেত, সেই নারী ২০১৩ সালে সেদিনের কিশোরী মেয়ের ঘরের ফুটফুটে বাবুটাকে কোলে নিয়ে যায়, যে যুবক ২০০১ সালে প্রেমিকার হাত ধরে বটমূলে গিয়েছিল, সেদিনের সেই যুবক আজকে সাথে করে স্ত্রী, কন্যা, পুত্রকে নিয়ে যায়। এভাবেই রমনার বটমূলে জনস্রোত বেড়েই চলেছে, কোন রকম ফতোয়া জারী করেও এই বাঙালী জনস্রোতকে থামানো যাবে না। এ বছরও আবার শকুনেরা এসে ভীড় করতে চাইছে। তবে কোটি প্রাণ আজ জেগেছে, সকল জরা-জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে সকলে একসাথে মিলে সব শকুনের মোকাবেলা করবে।

No comments:

Post a Comment