Monday, April 22, 2013

কারাগারের বাগান থেকে বেরিয়ে!!!!!!


অনেক অনেক দিন পর, আজ আমি আমার বাগানে একটুক্ষণের জন্য উঁকী দিয়েছিলাম। ওমা! বাগানে উঁকী দিয়েই তো আমি থ' বনে গেছি। তাজ্জব ঘটনা, ন্যাড়ামুন্ডি গোলাপ গাছে ইয়া বড় বড় গোলাপ ফুটে আছে। গত চার বছরে এমনটি আর দেখিনি। আমি বাগান করতে ভালোবাসি, তাই বাগানের ছোটখাটো পরিবর্তণগুলোও আমার নজর এড়ায় না! কৌতুহল জাগলো, ভাবলাম, দেখি তো ওদেরকে জিজ্ঞেস করে, এমন অসময়ে ওরা কোথা থেকে এলো, কেনই বা এলো!

প্রথমেই গেলাম আগুন রঙা গোলাপের কাছে! জিজ্ঞেস করলাম,

" কী গো আগুন সুন্দরী, কী মনে করে এই অসময়ে আমার বাগানে এসেছো"?

-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন দিদি, একটু আগে আগেই চলে আসতে হলো। যেখানে ছিলাম, সেখানকার পরিবেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, আমাদেরও মাথা গরম হচ্ছিল নানা রকম দূরাচার দেখে। এমনিতেই আমার সারা দেহে আগুন জ্বলে, তার উপর যদি এমন অবিচার করা হয় আমাদের প্রতি~~~

-ঠিক ধরতে পারছি না ব্যাপারটা, কিছু মনে করো না আগুন সুন্দরী, তুমি কোথা থেকে এসেছো, জানতে পারি? জায়গার নাম বলতে যদি কোন সমস্যা থাকে, তাহলে বলতে হবে না,
তোমাদেরকে দেখে আমি খুবই খুশী হয়েছি, জানো তো, গত আড়াই মাস ধরে আমার মন খারাপ, কিছুই ভালো লাগে না। বাংলাদেশ নামে একটি ছোট্ট সুন্দর দেশ আছে, আমি সে দেশের মেয়ে, আমেরিকাতে থাকলে কী হবে, মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে, কিন্তু বর্তমানে সেই দেশটাতে চলছে ~~~~~~~

-ব্যাস, ব্যাস!! আর বলতে হবে না দিদি, আমি সেখান থেকেই এসেছি।

-কী!! কী বললে!! তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছো? বাংলাদেশের কোন বাড়ীর বাগান আলো করে ছিলে তোমরা? কার বাড়ীর পরিবেশ তোমাদের বাসের অযোগ্য হয়ে উঠলো? তুমি কী মনে করে আমার বাড়ীর বাগানে চলে এলে!!

-হুম! বলি শোন, আমরা কারো বাড়ীতে ছিলাম না, আমরা ছিলাম দেশের সবচেয়ে বড় কারাগারের বাগানে। ভালই ছিলাম, সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা আমাদেরকে খুব ভালোবাসতো, আমাদের রূপে মুগ্ধ হয়ে সব সময় যত্ন আত্তি করতো, ধারে কাছে এতটুকুও আগাছা জন্মাতে দিত না, সময় হলেই আমাদের গোড়ায় জল দিত, শুকনো মরা ডাল-পালা ছেঁটে দিত, অর্থাৎ অনেক যতন করে বাগান করতো, তাই আমরাও প্রাণখোলা হাসিতে সকলের মন আলো করে রাখতাম। মালীর কাজ পাওয়া আসামীদের সকলেই সাময়িক সময়ের জন্য দন্ডপ্রাপ্ত, কেউই ফাঁসীর আসামী না, অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত আসামী না। আমাদের একটা সম্মান আছে না!! হাজার হলেও ফুলের রানী বলে কথা!

-সবই তো বুঝলাম, এত সুখ ছেড়ে এখানে এলে কেন?

-সেটাই তো কথা! কলিকাল, কলিকাল! একেবারে ঘোর কলিকাল! নাহলে কোন আক্কেলে একজন যুদ্ধাপরাধীকে মালীর কাজ দেয়! দিদি, তুমিই বলো, এমনিতেই কারাগার মানেই আসামীদের জগত, তারপরেও মেনে নিয়েছিলাম, আসামীরাও তো মানুষ, ওদেরও বাড়ীঘর ছিল, সংসার ছিল, হয়তো মাথা গরম করে কোন অকাজ কুকাজ করে ফেলেছে, এমনতো না যে খুন-খারাবী করে এসেছে, খুনের আসামীদের তো আর মালীর কাজ দেয় না!

-কেন, খুনের আসামীদের মালীর কাজ করতে দেয়া হয় না কেন?

-কী যে বলো দিদি! খুনীদের হাতে কী কখনও ফুল ফোটে? পড়েছো না? যে ফুল ভালোবাসে না, সে মানুষ খুন করতে পারে!

-হ্যাঁ, তা তো পড়েছি। তা কারাগারের নিয়ম ভঙ্গ করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে মালীর কাজ দিল??

-এইতো একটা লাখ টাকা দামের প্রশ্ন করেছো? সাধে কী আর কারাগারের বাগান ছেড়ে চলে এসেছি? যে বেটার মৃত্যুদন্ড পাওয়ার কথা, সেই বেটা পেয়েছে যাবজ্জীবন কারাদন্ড! আচ্ছা ভালো কথা, তোমাদের বিচারে যা সঠিক মনে হয়েছে, সেটাই রায় দিয়েছো। আমার আপত্তির কিছু নেই, আমার আপত্তি হচ্ছে, যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে দরকার হলে ভি আই পি মর্য্যাদা দিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভি আই পি কেবিনে রাখো, রেখেছো তো এক নব্বই বছরের বৃদ্ধকে, একেবারে জামাই আদরেই রেখেছো, তা এই বেটাকেও রাখতে পারতে জামাই আদরে, আমাদের কাছে কেন পাঠিয়েছো বাপু!! যে লোক মুক্তিযুদ্ধের সময় এত এত বাঙালীকে হত্যা করেছে, এত এত নারীদের বলাৎকার করেছে, হিন্দুদের ঘর-বাড়ী লুটপাট করেছে, তাকে কি না পাঠিয়েছো আমাদের বাগানে! আরে, আমরা কী ঘাসফুল নাকি? আমরা হচ্ছি ফুলের রানী, গোলাপসুন্দরী! এমনকি যে মেয়ে দেখতে সুন্দর, তার সৌন্দর্য্য বুঝাতে আমাদের রেফারেন্স টানতে হয়, গোলাপের মত সুন্দর বললে সকলেই বুঝে যায়, মেয়ে কত সুন্দর! আর আমাদের হেফাজতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঐ যুদ্ধাপরাধীর উপর!! ধিক, তোমাদের এই মানব সমাজকে!

-আগুনসুন্দরী, তোমার কথা শুনে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসছে। তুমি ফুল, তোমারও মান-অপমান বোধ আছে, অথচ আমরা মানুষ, তার উপর আবার বাঙালী, আমাদের মান-অপমান বোধগুলো লোপ পেয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো, তুমিও বুঝতে পারো অপরাধের মাত্রা, অপরাধীর মাত্রা, আর আমরা বুঝি না। তুমি কারাগারের বাগান ছেড়ে চলে এসেছো, একজনের অপরাধে অন্যেরা শাস্তি পাবে যে! যে সব আসামী তোমাকে দেখে প্রিয়জনদের কথা ভুলে থাকতো, তারা এখন কীভাবে দিন কাটাবে? তাছাড়া, মানব সমাজের উপর এত গোসসা তোমাদের, সেই আরেক মানবীর কাছেই তো এলে! হা হা হা !!

-দিদি, শোন, রাগের মাথায় অনেক কথাই বলে ফেলেছি। আমাদের ফুলের মধ্যেও তো অনেক বিভাজন আছে, ধুতুরা ফুলও ফুল, গোলাপ ফুলও ফুল। এবার পার্থক্য করে নাও! তোমরা হচ্ছো, গোলাপ ফুল, আর যুদ্ধাপরাধীগুলি হচ্ছে ধুতুরা ফুল। আর একজনের অপরাধে কেন অন্যেরা শাস্তি পাবে বলছো? এটাই তো হচ্ছে আজকাল! একজনের অপরাধে অন্যেরা শাস্তি পায়, এটাই বাংলাদেশের নিয়ম হয়ে গেছে। তুমি তো আমেরিকা বসে আছো, দেশের ভেতর কী হচ্ছে, সব তো আর জানো না, আমি দেখে এসেছি, কারাগারের ভেতরের অনিয়ম! এই যে চারদিকে ব্লগার ব্লগার শোনা যাচ্ছে, সেই ব্লগারদের কষ্ট দেখেও কষ্ট পেয়েছি। এই চারটি ছেলেও তো অন্যের অপরাধের শাস্তি ভোগ করছে! আমি কী কিছু বুঝিনা ভেবেছো? সবই বুঝি, কারাগার ছেড়ে চলে আসার এটাও একটি কারণ!
বাচ্চা একটা ছেলে শুভ, কী সুন্দর পবিত্র মুখের চেহারা, আরও তিনজনের চেহারাও দেখেছি, কত উচ্চশিক্ষিত ছেলেপেলে সব, তাদের নিয়ে যেই পরিমান টানা হেঁচড়া করা হচ্ছে, দেখে তো আমার গায়ের রঙ আরও বেশী আগুন হয়ে গেছে! এইসব অনাচার, অবিচার সহ্য করতে পারছিলাম না বলেই বিদ্রোহ করেছি। এইজন্যই আমাকে অন্যান্যবারের তুলনায় বেশী 'আগুন' দেখছো।

প্রথমে আমি আমার দলবল নিয়ে বেরিয়ে এসেছি, তুমি তো বাগানে আসো না, ঐ দিকে তাকিয়ে দেখো, মিষ্টিগোলাপীও চলে এসেছে, তবে সদলবলে আসতে পারে নি, কিছু চলে গেছে অন্য বাড়ীতে, তোমার বাড়ীর পেছনে গিয়ে দেখবে, হলুদগোলাপের দল এসে ভীড় করেছে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে, এখনও কুঁড়ি অবস্থায় আছে, ফুটলো বলে। সবাই চলে আসছে, তোমার বাড়ীতে কিছু, তোমার সতীর্থদের বাড়ীতে কিছু , এভাবেই আমরা দলে দলে ভাগ হয়ে গেছি। ঠিক করেছি, কারাগারে যতদিন ঐ বেটা থাকবে, যতদিন ঐ বেটাকে দিয়ে মালীর কাজ করানো হবে, ততদিন আমরা কারাগারে ফিরে যাবো না, তোমাদের বাড়ীতেই ভাগাভাগি করে থেকে যাবো। যদি তোমার আপত্তি থাকে বলো, অন্য কোথাও জায়গা খুঁজে নেবো!

-আগুনসুন্দরী, তুমি সারাজীবন আমার বাগানে থাকো। তোমাকে দেখে অনেক কিছু শেখার আছে। আমরা অযথাই নিজেদেরকে নিয়ে অহংকার করি, " মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব" বলে নিজেদের ঢাক নিজেরা পেটাই! ছিঃ!! একটি ফুল হয়েও তোমার ভেতর যে আত্মসম্মানবোধ আছে, সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও আমাদের মধ্যে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। তুমি থাকো, আমি আমার বন্ধুদের কাছে তোমার এই অভূতপূর্ব প্রতিবাদের কাহিনী গল্প করে বেড়াবো। তোমার গল্প শুনে যদি শতকরা দশজনের ভেতরও চেতনা জাগ্রত হয়, সেটাই হবে আমার বিজয়!

No comments:

Post a Comment