Friday, April 12, 2013

মিশা বলেছিল, 'ব্যাঙ একটি শ্রদ্ধার প্রাণী'!!!

"ব্যাঙ একটা শ্রদ্ধার প্রাণী!!" 

আমার দুই মেয়ে মৌটুসী ও মিশা, চার বছরের ছোট-বড়। বড় মৌটুসী খুবই শান্ত, ধীর-স্থির, বুদ্ধিমতী এবং কঠিন পার্সোন্যালিটির, আর মেজো মিশা চঞ্চল, আমার মতই শর্ট টেম্পার্ড, এবং 'আহারে'! পার্সোন্যালিটির।  দেখতেও ওরা দুই রকম।  একজন পেয়েছে মায়ের চেহারা, আরেকজন বাপের। স্বভাবেও ঠিক তাই, মৌটুসী পেয়েছে বাবার স্বভাব, মিশা পেয়েছে মায়ের। মৌটুসীর গায়ের রঙ আমার মত শ্যামলা, আমার মতই ছোটোখাটো গড়ন, ওর আছে মনভুলানো হাসি, মায়াবী চোখ। আর মিশা পেয়েছে ওর বাবার গায়ের রঙ, অর্থাৎ ফর্সা, আমার  চেয়ে চার/পাঁচ ইঞ্চি বেশী উচ্চতা, বাদামী চোখ, ঘন কোঁকাড়ানো চুল।  খুব ছোটবেলা থেকেই পরিচিতজনেরা দুই বোনকে দেখে বলতো " বড় মেয়ে মায়ের মত শ্যামলা হইছে, মেজো মেয়ে বাপের মত সুন্দর হইছে"। 

ছোটবেলায় মিশা  বড় বোনকে 'দিদিসোনা' বলে ডাকতো, মৌটুসী ওকে ডাকতো 'বোনসোনা'। তখন ছিল দুজনের মধ্যে 'মধুমাখা' সম্পর্ক। কিছুটা বড় হওয়ার সাথে সাথে সম্পর্কের মধু ঝরে যেতে থাকে, তৈরী হতে থাকে  'দা-কুমড়ো' সম্পর্ক। তবে মিশার স্বভাবে 'আহারে' ভাব থাকার কারণে দিদিসোনার সাথে ঝগড়া করলেও 'দিদিসোনাকে' সে খুবই ভালোবাসতো। ছোটবেলা থেকেই অন্যের মুখে " মিশা সুন্দর' শুনতে শুনতে ওর ছোট্ট মায়াবী হৃদয়ে খুব কষ্ট হতো,  দিদিসোনাকে খুশী করার জন্য বলতো, 
" দিদিসোনা অনেক জ্ঞানী, অনেক কিছু জানে। দিদিসোনা তো বেশী কালো না, একটু কালো। মা তো কালো, এইজন্যই বাবার মতো নায়ক জামাই ( এভাবেই মিশা বলতো) পেয়েছে, দিদিসোনা, তুমিও নায়ক জামাই পাবে, আমিও নায়ক জামাই পাবো"।
সাথে সাথে মৌটুসী হয়তো বলতো, " তুমি তো ফর্সা, তুমি তো নায়ক জামাই পাবেনা, আমি শুধু নায়ক জামাই পাব, হা হা হা কী মজা, তুমি ফর্সা, নায়ক জামাই পাবেনা"।
মিশা বলতো, দিদিসোনা, দেখো আমিও তোমার মতোই কালো হয়ে যাচ্ছি"।

মৌটুসী হেসে ফেলতো, বলতো, " আমাকে আর খুশী করতে হবেনা, আমার কোন দুঃখ নেই কালো হয়েছি বলে। তোমাকে রোদে পুড়ে আর জোর করে কালো হতে হবেনা। আমি বিয়েই করবোনা"।

এভাবেই ওরা কখনও ঝগড়া, কখনও বন্ধুত্ব আবার কখনও বড়-ছোট সম্পর্ক বজায় রেখে চলতো।  মিশা খুব দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করতো যে তার দিদিসোনা পৃথিবীর সবকিছু সমন্ধে অনেক বেশী জানে।  হয়তো দিদিসোনাকে কেউ সুন্দর বলতোনা বলে মিশার মনে এক ধরণের চাপা কষ্ট হতো। ওরা তো আর জানতোনা, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শিশুদের মনস্তত্ব নিয়ে কেউ ভাবেনা! ভাবলে ওরা কখনও দুইটি বাচ্চার সামনে বলতে পারতোনা, বড় মেয়ে কালো হইছে, মেজোটা বাপের মত ফর্সা-সুন্দর"। একটা গল্প মনে পড়ে গেলো। যখন মেলবোর্ণে ছিলাম, ডঃ সজল পালিত'দার সাথে খুব খাতির ছিল ছোট্ট মিশার। পালিত'দা মিশাকে খুব আদর করতেন। একদিন পালিত'দা মিশার হাত দেখে বলেছেন, 
" আরে! এই মেয়েতো বড় হয়ে অনেক বড়লোক হবে। বিরাট ধনীর ছেলের সাথে বিয়ে হবে মিশার"।---এই কথা শুনে মিশা ভারী খুশী। ওর সব সময় বড়লোক হতে ইচ্ছে করতো। পালিত আংকেল যখন বলেছে, ওর বড়লোকের সাথে বিয়ে হবে, তাহলে আর চিন্তার কিছু নেই, ও বড়লোক হবে। তিন বছর পরে আমরা তখন ঢাকাতে থাকি। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের ডি আই জি ক্ষিতীশ চন্দ্র দে'র সাথে উনার ছেলের মাধ্যমে পরিচয় হয়। মিশা ও মৌটুসী উনাকে দাদু ডাকতো, আমি ডাকতাম মেসোমশায়। তখনও মিথীলার জন্ম হয়নি। মেসো খুব ভাল হাত দেখতে পারতেন। উনি মৌটুসীকে খুব আদর করতেন। অবশ্য শুধু উনি নন, মৌটুসীর ধীর-স্থির স্বভাবের জন্য অনেকেই ওকে পছন্দ করতো, যাই হোক, মেসোমশায় মিশা-মৌটুসীর হাত দেখে বলেছে, " মৌটুসী,  তুমি বড়লোক হইবা। বড়লোকের ছেলের সাথে বিয়ে হবে"। মিশাকে বিয়ের কথা কিছু বলেনি। বাসায় ফিরে মিশা কী কান্না! বলে, " দিদিসোনার বড়লোকের সাথে বিয়ে হবে কেন?" মৌটুসী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, বলে, " কেন, আমি কালো বলে বুঝি বড়লোকের সাথে বিয়ে হতে পারবেনা!" সাথে সাথে মিশা ভুল বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে বলে, " দাদু তো আমাকেও বলতে পারতো। আমাদের দুই বোনেরই বড়লোকের সাথে বিয়ে হোক"।  এই চলতো দুই বোনের মধ্যে সারাক্ষণ।


ঝগড়া করলেও মিশা সব সময় মৌটুসীকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতো। কারণও আছে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সকলেই জানতো, মৌটুসী খুবই লক্ষ্মী একটা মেয়ে, আর মিশা মায়ের মত পাগলী স্বভাবের মেয়ে। তাই মিশার মধ্যে একধরণের নিরাপত্তাহীনতা কাজ করতো, ও ভাবতো, দিদিসোনা যাই করে, সেটাই বোধ হয় অনুকরণীয়। মৌটুসী জিটিভিতে 'হরর শো' দেখতো, ভুতের ভয়ে অস্থির মিশা রাত জেগে দিদিসোনার পাশে বসে বসে এই হরর শো দেখতো আর ওকে জাপটে ধরে রাখতো। মৌটুসী নাচ শিখতো, ছোট্ট মিশা দিদিসোনাকে অনুকরণ করে নিজের চেষ্টায় নাচের মুদ্রা পায়ে তুলে ফেলতো। মৌটুসী ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো ছবি আঁকতো। আমেরিকায় এসে ইলেভেনথ গ্রেডে স্কুলে আর্ট ক্লাস নিয়ে খুব ভাল ভাল কিছু আর্ট করেছিল। মিশা পিছিয়ে থাকবে কেন? ও যখন ইলেভেনথ গ্রেডে উঠলো, ও  আর্ট ক্লাস নিয়ে ফেললো।  দিদিসোনা বাবার জন্মদিনে পেইন্টিং গিফট করেছে, তাই মিশাও  বাবার জন্মদিনে  পেইন্টিং গিফট করেছে। দিদিসোনা মিথীলাকে 'টনি' ডাকে, তাই মিশাও মিথীলাকে 'কনি' ডাকে। সবকিছুতে দিদিসোনাকে অনুকরণ করা চাই।

খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও ছিল দিদিসোনার সাথে মিশার কমপিটিশান! দিদিসোনার থেকে কোন অংশেই ও পিছিয়ে থাকতে রাজী ছিলনা। মৌটুসী মোটামুটি সর্বভুক, গরু বাদে হাতী, ঘোড়া, বাঘ ভাল্লুক, শিয়াল, হরিণ সবই সে খেতে পারবে। মিশা সেটি পারতো না। খাবার দাবারের ব্যাপারে ও খুব ভীতু ছিল, কিন্তু দিদিসোনার কাছে হেরে যাবার ভয়ে রেস্টুরেন্টে অথবা প্লেনে  সে শামুক, ঝিনুক জাতীয় ল্যাতল্যাতে খাবার চোখ-নাক বন্ধ করে খেয়ে ফেলতো।  দুটি মজার ঘটনা  বলিঃ

২০০২ সালের ঘটনা। আমরা তখন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে থাকি। সবাই মিলে একটি চায়নীজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেছি। সাথে নিয়ে গেছি এক আমেরিকান দম্পতী বন্ধুকে।  রেস্টুরেন্টে ছিল বুফে ( বাফে) সিস্টেম। ১৫০টি আইটেম সাজানো, যে যার মত খাবার দাবার নিয়ে এসে টেবিলে বসেছি। আমার পাশেই বসেছে মৌটুসী, উল্টোদিকে  মিশা। মৌটুসীর প্লেটের  খাবারগুলো অন্যরকম। ঝিনুক,  থলথলে জেলী ফিস, সী উইড ( গাঢ় সবুজ রঙের সামুদ্রিক শাক) কাঁচা মাছ দিয়ে তৈরী র‍্যাপ 'সুশী' এবং বেশ কিছু ছোট ছোট পাখীর ঠ্যাং ভাজা। প্লেটের পাখীর ঠ্যাং দেখিয়ে বলেছি, " বাহ! এগুলো কী পাখি রে? কী সুন্দর দেখা যাচ্ছে"। মৌটুসী জবাব দিল, " এগুলো তো পাখীর পা না, ব্যাঙের পা।"


আমি তো ' অ্যাঁ! ব্যাঙের পা'!!! ইয়াক!! বলে ওর কাছ থেকে শরীর যতখানি সম্ভব ছোট্ট মিথীলার দিকে সরিয়ে নিয়েছি। মৌটুসী নির্বিকার ভাবে বললো, " হ্যাঁ, ব্যাঙের পা তো অনেকেই খায়। আমিও একটু টেস্ট করে দেখতে চাই"। মিশার প্লেটের দিকে তাকালাম। দেখি মিশার প্লেটে চিকেন ফ্রাই আর 'সুশী'। দিদিসোনার দেখাদেখি 'সুশী' নিয়ে এসেছে, ক্কিন্তু কাঁচা মাছে তৈরী বলে সাহস করে মুখে দিতে পারছে না। এদিকে দিদিসোনা তো গপাগপ করে খেয়ে চলেছে। হেরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মিশা বললো,

" দিদিসোনা, তুমি কেন ব্যাঙের পা এনেছো?"

মৌটুসী বললো, টেস্ট করে দেখতে। তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও নিয়ে আসো।

মিশার জবাব, " দিদিসোনা, ব্যাঙ একটা শ্রদ্ধার প্রাণী। কেন তুমি ব্যাঙ খাবে"?

আমরা সবাই ( আমেরিকান বন্ধুরা বাদ) বিষম খেলাম, মুখে খাবার, হাসতেও পারছিলাম না ভাল করে!

মৌটুসী বললো, " কী???? ব্যাঙ একটা শ্রদ্ধার প্রাণী???? আর তুমি যে চিকেনের পা খাচ্ছো, চিকেন কী অশ্রদ্ধার প্রাণী?

মিশা  মরীয়া হয়ে বললো, হ্যাঁ শ্রদ্ধার প্রাণীই তো,  ব্যাঙ অনেক কিউট দেখতে, কত মায়া লাগে ব্যাঙের চেহারার দিকে তাকালে।

মৌটুসী বলল, " মুরগীর দিকে তাকালে মায়া লাগে না? মুরগী কী কিউট না? তাহলে তো মুরগীও একটা শ্রদ্ধার প্রাণী!! হা হা! ব্যাঙ নাকি শ্রদ্ধার প্রাণী, আর মুরগী নাকি অশ্রদ্ধার প্রাণী, হা হা! হা হা!

মিশা বলল, আমরা সবাই তো মুরগী খাই, কিন্তু কেউ ত ব্যাঙ খাই না, তুমি শুধু ব্যাঙ খাও। তোমার একটুও ঘেন্না লাগে না, মা তো ঘেন্না পেয়েছে, মায়ের জন্য একটুও মায়া লাগে না?

মৌটুসী হেসেই চলেছে, আর বলে চলেছে, ব্যাঙ একটা শ্রদ্ধার প্রাণী,  মুরগী হচ্ছে অশ্রদ্ধার প্রাণী।  মিশা ব্যাঙের ঠ্যাং খায় না, কিন্তু মুরগীর ঠ্যাং খায়।

শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, " মৌটুসী, এরপর থেকে তোমার সাথে আমি আর খেতে বসবোনা, সাপ-ব্যাঙ নয়া খেলে কী চলেনা? এত অ্যাডভেঞ্চার করার কী আছে? খাওয়া-দাওয়া রুচীর ব্যাপার। এমন কুৎসিত রুচীর খাবার কেন খাবে?
মৌটুসীর জবাব, মামনি, এইমাত্র তুমি বললে, খাওয়া-দাওয়া রুচীর ব্যাপার, তাহলে তো যার যার রুচীমতই তার তার খাওয়া উচিত। মিশা ব্যাঙের ঠ্যাঙ খেতে পারছেনা, আমি পারছি। আমি কী মিশাকে বলেছি একবারও যে মিশা আমার দেখাদেখি তুমিও ব্যাঙের ঠ্যাঙ খাও! মিশাতো বলেইছে ব্যাঙ একটা শ্রদ্ধার প্রাণী, হা হা হা!!!!!

সেই মিশা  ২০১০ সালে আমরা সবাই যখন মিসিসিপিতে থাকি, দিদিসোনার সাথে রেস্টুরেন্টে গিয়ে কুমীরের মাংস খেয়ে এসেছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, " মিশা, ছিঃ তুইও শেষ পর্যন্ত কুমীর খেলি?"
ওর উত্তর, মা, দিদিসোনা আসলে অনেক অভিজাত রুচীর মানুষ। আগে বুঝতামনা, বড় হয়ে বুঝি, দিদিসোনার স্বভাব একেবারে হাই ফাই সেলেব্রিটিদের মত। তবে কুমীরের মাংস আমার ভাল লাগেনি। আর খাবনা।

মিশা মৌটুসীকে নিয়ে আরও মজার গল্প আছে। ইলিশ মাছ খাওয়ার গল্প বলি। মিশা ছোটবেলায় মাছ খেতে খুব ভালোবাসতো। মৌটুসী মাছ  খেতে হতো বলেই খেতো। মিশা ছোট মাছ, বড় মাছ, কাটা মাছ, কাটা ছাড়া মাছ, সব রকম মাছই পরম আনন্দে খেলেও মৌটুসী ছোট মাছ খেতো না, মাছের শরীর খুঁটে খুঁটে খেয়ে মাছের মাথা, কাঁটা মিশাকে দিয়ে দিত। ইলিশ মাছের পিঠের চাক খেতো মৌটুসী, আর মিশা খেত কোলের টুকরা। কোন এক অজানা কারণে মিশা কোল থেকে মাছের ডিম বের করে দিদিসোনাকে দিয়ে দিত। ভালোবাসা থেকে দিত না, কারণ মৌটুসীকে পাশে ্না পেলে আমাকে দিত। আমি ত মহাখুশী হতাম ইলিশ মাছের ডিম পেয়ে। একদিন কথায় কথায় জানতে চেয়েছি, 

-মিশা, ইলিশ মাছের ডিম কত ভাল খেতে, তুই খাস না কেন?
-মা, মাছের ডিমের মধ্যে কত হাজার হাজার বাচ্চা মাছ থাকে। আমি মাছের বাচ্চাদের খেতে চাইনা। আমার মায়া লাগে! ইস! বাচ্চা মাছ কত কিউট!

ছোট্ট মিশার কথা শুনে 'থ হয়ে গেছি, মৌটুসী বলল, " তুমি একটা ভন্ড সাধু মিশা! রান্না করা মাছের ডিম খাওনা, অথচ মাছ খাচ্ছ। মাছের বাচ্চাদের জন্য মায়া লাগে, আর মা মাছের কোল খেয়ে ফেলছো, তখন মায়া লাগে না?
মিশা প্রতিবাদ করতে পারেনা, কারণ ওতো জানে, ওর দিদিসোনা অনেক জ্ঞানী, অনেক বুদ্ধিমতি। দিদিসোনা যা বলে ঠিকই বলে। কিন্তু তারপরেও মিশা প্রাণে ধরে মাছের ডিমগুলোকে খেতে পারেনা, এখনও না!

No comments:

Post a Comment