Friday, April 26, 2013

তিনি এবং ডাঃ ফ্রিলুক্স

শেষ পর্যন্ত তিনি ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাঃ ফ্রিলুক্স উনাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। ফ্রিলুক্সকে উনি পছন্দ করেন, মুখের দিকে তাকালেই এক ধরণের নির্ভরতা খুঁজে পাওয়া যায়। ফ্রিলুক্সের কাছে অকপটে মনের কথা খুলে বলা যায়। তিনিও আজ মনের কথা খুলে বলবেন বলেই ডাক্তারের চেম্বারে গেলেন। নার্স এগিয়ে এসে জানতে চাইলো,
" কী সমস্যা আপনার?"
"সমস্যা তো অনেক। কোনটা রেখে কোনটা বলবো?"
"একটি একটি করে সবই বলুন, ডক্টরের কাছে আগে থেকেই সমস্যা জানাতে হয়, ডক্টর ওভাবেই তৈরী হয়ে আসেন"।
" আমাকে তোমার ডক্টর ভালভাবেই জানেন, কারণ উনি আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। আমার ফাইল উনার কাছে আছে।"
" তবুও আপনাকে নির্দিষ্ট করে বলতে হবে সমস্যার কথা, এটাই আমার কাজ"।
" ঠিক আছে, বলছি, গত কয়েকমাস যাবৎ আমার দুটি চোখ সারাক্ষণ জলে ভরে থাকে, গত একমাস যাবৎ আমার হৃদযন্ত্রে ব্যথা হয়, গত পঁচিশ দিন ধরে মস্তিষ্কের কোষে কোষে যন্ত্রণারা ছুটে বেড়ায়, আর কিছুদিন ধরে মনের ভেতর কেমন হাহাকারের শব্দ শুনি, তারপর~~~~~~
" আর বলতে হবে না, আপনি অপেক্ষা করুণ, আমি ভেতরে যাচ্ছি।" বলেই নার্স মেয়েটি চোখ সরু করে উনার দিকে তাকাল। উনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গট গট করে চলে গেল ভেতরের দিকে।

নার্স মেয়েটিকে উনার পছন্দ হলো না, বেশী ফাজিল টাইপের। সমস্যার কথাগুলো শেষ করতে দিল না। মনে বিরক্তি নিয়েই তিনি সাইড টেবিলে থাকা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করলেন। একটার পর একটা পাতা উলটে যান, সব স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ফীচারে ভরে আছে। ভাল লাগে না এগুলো পড়তে। হাতের কব্জী উলটে ঘড়িতে সময় দেখলেন, ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গেছে, নার্স মেয়েটি এখনও ফিরলো না। একপাশের ওয়ালে টাঙানো টিভিতে রান্না-বান্নার অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে, খাবারের গুণগত মান ঠিক রেখে কীভাবে রান্না করতে হয়, সেগুলোই দেখাচ্ছে, এমন কিছু না, পাস্তা আর সালসা বানানোর টেকনিক। কেউ দেখছে না, তারপরেও যতসব ভ্যাজর ভ্যাজর! ব্যাগের ভেতরে থাকা মোবাইল ফোনটি বের করে দেশে ফোন করার চেষ্টা করলেন। দেশ মানে বাংলাদেশ। উনার বাবা-মা, ভাই বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মিলে বিশাল এক পৃথিবী আছে ওখানে। প্রতিদিন তাদের সাথে কথা না বললে উনার ঘুম হয় না। এটা ভাবতেই মনে পড়ে গেল, আরে, নার্সকে তো এটা বলা হয় নি, রাতে ঘুম আসেনা, তন্দ্রার মত আসে, তখন খুব ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেন। গত পরশু রাতেই দেখেছেন, একদল কালো পোশাক পড়া মানুষ উনাকে ঘিরে রেখেছে, তাদের দাবী হচ্ছে, উনি নাকি নাস্তিক, নাস্তিকদের ফাঁসী চাই, তাই উনারও ফাঁসী হবে। উনি যতই বলার চেষ্টা করছেন যে উনি ব্লগে লিখেন না, উনি সব সময় আল্লাহ খোদার নাম নেন, তবুও তারা মানতে রাজী নয়।

নার্স মেয়েটি কাছে এসে উনাকে মৃদু কন্ঠে ডাক দিল, " ম্যাডাম, আসুন, আমার সাথে"।
ভেতরে নিয়ে গিয়ে নার্স মেয়েটি উনার ওজন নিল, উচ্চতা কত জানতে চাইল। উনার খুব বিরক্ত লাগলো, কেনরে বাবা, আমার ফাইল খুলে দ্যাখ, সেখানেই তো লেখা আছে উচ্চতা। নাহলে আবার উচ্চতা মেপে নে, অত জিজ্ঞেস করার দরকার কি? বিরক্তি চেপে রেখে উনি বললেন, " আগে আমার উচ্চতা ছিল ৫ফিট ১ ইঞ্চি। এখন হয়তো একটু কমে গেছি, মা বলেছেন, বয়সের সাথে সাথে মানুষ বেঁটে হতে থাকে। " এত কথা বলার দরকার ছিল না, বয়স হয়েছে বুঝা যায়। নার্স মেয়েটি উনার উচ্চতা মেপে বললো ৫ ফিট, ৩/৪ ইঞ্চি। ১/৪ ইঞ্চি কমে গেছে! হুম, মা তো ঠিকই বলতেন।

ডাঃ ফ্রিলুক্স উনার চেয়ারে পেছনে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। উনাকে দেখেই বলে উঠলেন,
" হেল্লো, মিস ব্যাংলাডেশ!"
উনি বললেন, বলো বাংলাদেশ, ব্যাংলাডেশ না।
ফ্রিলুক্স বললেন, " ওহো! সরি, ভুলেই গেছিলাম, তুমি বলেছিলে যে দেশের ব্যাপারে তুমি কোন কম্প্রোমাইজ করো না। ঠিক আছে, আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিলাম। কেমন আছো মিস বাংলাডেশ!
তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, আমি কেমন আছি সেটা জানার জন্যই তো তোমার কাছে এলাম। নার্স মেয়েটিকে সমস্যার কথা বলছিলাম, কিন্তু মেয়েটি পুরোপুরি না শুনেই চলে এলো।
ডাঃ ফ্রিলুক্স বললেন, তোমার তো অনেক সমস্যা দেখলাম। আমি প্রতিটি সমস্যার জন্য আলাদা আলাদা ডাক্তারের কাছে রেফার করে দিচ্ছি। উনারা দেখবেন, তারপর তোমার চিকিৎসা শুরু হবে।
তিনি বললেন, তোমাদের দেশের এই ঢং আমার সহ্য হয় না। কার কার কাছে যেতে হবে, সেটা তো আমিই জানি, তারপরেও তোমার রেফারেন্স লাগবে, কেন? শুধু শুধু আজকের পুরো দিন নষ্ট করলাম এই রেফারেন্স নেয়ার জন্য!

মিস বাংলাডেশ, সরি ফর দ্যাট! কিন্তু এটাই এখানের নিয়ম। তুমি আগামী মাসের ৫ তারিখে আবার আসবে। ততদিনে ওদের কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়ে যাব।

আজ ৫ তারিখ। তিনি ডাঃ ফ্রিলুক্সের চেম্বারে গেলেন। উনাকে দেখেই ডাঃ সারা মুখ ছড়িয়ে হাসি দিল। তিনি বুঝতে পারছেন না, খবর ভাল না মন্দ! এখানের ডাক্তাররা রুগীর মৃত্যুর দিন ক্ষণও হাসিমুখে জানিয়ে দেয়। উনার কত সমস্যা , নিশ্চয়ই উনাকেও মৃত্যুর দিনক্ষণ জানানো হবে, তারই পূর্ব প্রস্তুতি চলছে।

" বসো মিস বাংলাডেশ! আমার কাছে সব রিপোর্ট চলে এসেছে।"
" তা তো বুঝেছি, শুধু বুঝতে পারছি না, আমার মৃত্যুর তারিখ কত হতে পারে"?
" হোয়াট! মৃত্যুর তারিখ মানে"!
" না, ও কিছু না, মনটা খুব দূর্বল। ক্রমাগত দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি"।
" কেন, তোমার মিঃ কী তোমাকে আর ভালোবাসে না? তার কী নতুন কোন গার্ল ফ্রেন্ড হয়েছে"?
"আরে না, আমার মিঃ এর কপাল খারাপ, তোমাদের দেশে জন্মালে নতুন নতুন গার্ল ফ্রেন্ড পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের ছেলেদের সেই উপায় নেই, তাদের বউগুলো এত সুন্দর আর এত বেশী মায়াবী যে অন্য মেয়েদের দিকে চোখ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এখন কাজের কথা বলো, টেনশান হচ্ছে।"

বলছি, তবে তার আগে তোমার মন্তব্যটিকে শতভাগ সমর্থণ করলাম। তোমার মত এমন সুন্দরী তরুণী বউ পাশে থাকতে তোমার স্বামীর তো অন্যদিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই, ঠিকই বলেছো। যাক, এবার আসল কথায় আসি,
চোখের ডাক্তার বলেছে, তোমার চোখে উল্লেখ করার মত কোন সমস্যা পায়নি।
হার্টের ডাক্তার বলেছে, তোমার হৃদযন্ত্রের কোথাও কোন ব্লক বা ফুটো নেই, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক, হার্টের মাসলেও কোন অ্যাবনর্ম্যাল কিছু পায় নি।
নিউরোলজিস্ট বলেছে, মস্তিষ্কের কোন কোষেই কোন সমস্যা নেই।

মনের ডাক্তার কী বলেছে, সেটা বলার আগে আমি নিজে কিছু বলতে চাই। মিস বাংলাডেশ, তুমি আমার পুরানো রুগী, আমি তোমার ইতিবৃত্তান্ত জানি। প্রথমবার যখন এসেছিলে, আমার সাথে কথা বলার সময় বার বার তুমি ' আমার দেশে' 'আমার দেশে' করছিলে। ফরমে লেখা ছিল তুমি আমেরিকান সিটিজেন, অথচ আমেরিকাকে তুমি একবারও আমার দেশ বলে বলছিলে না, উপরন্তু তুমি আমেরিকার প্রতিটি বিষয় নিয়ে বাংলাডেশের সাথে তুলনা করছিলে। প্রথম দিন আমি তোমার উপর বিরক্ত হয়েছিলাম। দ্বিতীয় দিনেও তুমি একই কাজ করছিলে, বাড়ী ফিরে আমি আমার স্ত্রীর কাছে তোমার গল্প করেছি। আমার স্ত্রীর চোখ ভিজে উঠেছে। সে বলেছে, তুমি নাকি খাঁচায় বন্দী এক পাখী। তুমি তো জানোই, আমার স্ত্রী একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। যদিও আমি তোমাকে তার কাছে রেফার করিনি। আমার স্ত্রী বাংলাডেশ সম্পর্কে পড়াশোনা করেছে। তোমার এই রিপোর্টগুলো তাকে দেখাইনি, তবে তোমার সমস্যার কথাগুলো তাকে গল্প করতেই সে সমাধান দিয়ে দিয়েছে। সে বলেছে,

তোমার দেশে গত কয়েকমাস ধরেই চলছে নানা অশান্তি। বাংলাডেশ একটি শান্তিপ্রিয় দেশ, বাংলাডেশের মানুষ খুবই ইমোশনাল ( সেটা আমার চেয়ে বেশী আর কে জানে বলো), বাংলাডেশের মেয়েরা খুবই সুন্দরী এবং গুণী। এই দেখো, আমার গায়ের শার্টটি মেড ইন বাংলাডেশ, এই শার্টটি আমাকে কী সুন্দর মানিয়েছে বলো! সেই দেশের শান্তি বিনষ্ট করছে কিছু ডেভিল, আমার স্ত্রী ইন্টারনেট থেকে একটি সংবাদ পড়ে শোনালো। যাদের হাতে আমার গায়ের শার্টটি তৈরী হয়েছে, তাদের উপর বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়েছে। এবং বিল্ডিংটি্তে আগে থেকেই ক্র্যাক ছিল, তারপরেও ডেভিলগুলো শ্রমিকদেরকে সেই বিন্ডিং এ কাজ করতে পাঠিয়েছে। ছবি দেখে আমি শিউরে উঠেছি। মানুষ এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? আমি রেগে উঠতেই আমার স্ত্রী আরেকটি সংবাদ দেখালো, সেখানে দেখলাম বাংলাডেশের আসল রূপ। সাধারণ মানুষেরা হুমড়ী খেয়ে পড়েছে বিল্ডিং এর নীচে চাপা পড়া ভাই বোনদের উদ্ধার করতে। তোমাদের দেশে ত্রান সামগ্রী অপ্রতুল, কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের দরদ দেখে চমৎকৃত হয়েছি। তোমার রোগের কারণও নির্ণয় করতে পেরেছি।

তোমার দুই চোখের কোনে বে অফ বেঙ্গলের (বঙ্গোপসাগর) জল ধরা আছে, সেটাই উপচে উপচে পড়ছে, কারণ তুমি তোমার ডেশে যেতে পারছো না।

তোমার হৃদযন্ত্রটিতে 'ভালোবাসা'র পরিমান এত বেশী যে তার প্রেশারে তোমার বুকে ব্যথা হচ্ছে।

তোমার মস্তিষ্কের অনুভূতি ও আবেগপ্রবণ কোষগুলো এই মুহূর্তে খুব বেশী সক্রিয় হয়ে উঠেছে, জানো তো, আবেগ ও অনুভূতি একসাথে ছোটে, তাই মাথার যন্ত্রণাও ডাবল হয়ে গেছে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আমি ফোনে আলাপ করেছি। উনি বলেছেন, তোমার রোগটির নাম হচ্ছে 'ব্যাংলাডেশ সিনড্রোম' [ সরি, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তো তোমার বকা খায় নি, তাই বাংলাডেশ বলতে শিখেনি, হা হা হা]। উনি
উনি তোমাকে খুব লো ডোজে ট্র্যাঙ্কুইলাইজার দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। দুঃশ্চিন্তা করতে না করেছেন, প্রতি রাতে এক গ্লাস দুধ খাওয়ার কথাও বলেছেন। আর আমার স্ত্রী বলেছেন, তোমার খাঁচার ঢাকা খুলে দিতে, তুমি ডানা মেলে উড়ে যাও বাংলাডেশ নামের সেই স্বপ্নপুরীতে। সেখানে গিয়ে তুমি সবার হাতে হাত রাখো, ডেভিলদেরকে ঝাড়ু পেটা দিয়ে আমাদের আমেরিকা পাঠিয়ে দাও। দেখো, আমরা কী ব্যবস্থা করি! হা হা হা!
মিস বাংলাডেশ, মুখ নীচু করে বসে আছো কেন? কী, পছন্দ হলো না আমার পরামর্শ?

তিনি ব্যাগ থেকে টিস্যু পেপার বের করে দুই চোখে চেপে ধরলেন। দুই মিনিট পর ডাঃ ফ্রিলুক্সের দিকে তাকাতে পারলেন। ডাঃ ফ্রিলুক্স চোখ টিপে 'ইটস ওকে' করলেন। এবার তিনি মুখ ফুটে শুধু বললেন,
ডঃ তোমার স্ত্রীকে আমার সালাম দিও। আমার অসুখ তিনিই ধরতে পেরেছেন বলে নয়, সালাম জানাচ্ছি, উনি ইন্টারনেটে গিয়ে আমার বাংলাদেশ সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন, উনি আমার কষ্ট বুঝতে পেরেছেন, উনি আমার দুঃখে সমব্যথী হয়েছেন, উনি বাংলাদেশের 'ডেভিল' দের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের মানবতার দিকটি বড় করে দেখেছেন! আর তুমি? এমন একজন অসাধারণ মহিলার স্বামী, তুমিও অসাধারণ। আমি একজন নিয়মিত রুগী বই তো কিছু নই। তুমি আমাকে খুশী করার জন্য 'মেড ইন বাংলাদেশ' শার্ট কিনেছ এবং তা আজকেই পড়ে এসেছো। আমি তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। উপচে পড়া ভালোবাসা থেকে তোমাদেরকে কিছু দিতে চাই, নাহলে বুকটাতে খুব বেশী চাপ হয়ে যাচ্ছে!


No comments:

Post a Comment