Thursday, July 5, 2012

বালিকার চেতনা!

আজকে গিয়েছিলাম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার দাদা থাকেন ওখানে। আমার সাথে আমার দুই মেয়ে মিশা ও মিথীলাকেও নিয়েছিলাম। মিথীলা আমার ছোট মেয়ে, বয়সে এখনও বালিকা। ওদের নিয়ে দুই বছর পর পর দেশে আসি। নানা জায়গা ঘুরে বেড়াই। আমার ছোট মেয়েটা বাংলা বলতে পারে মোটামুটি ভালই, এতোদিনে পড়তেও শিখে যেতো। অনেক ছোটবেলাতেই মিথীলার বর্ণ পরিচয় হয়ে গেছিল। তারপরে আমি নিজে চাকুরী করা শুরু করতেই ওকে নিয়ে আর বসতে পারিনি। তবে মাঝে মাঝেই হুমকী ধমকী দেই। ওকে নিজে নিজেই বাংলা বই পড়ে পড়ে বাংলা চর্চ্চা রাখতে বলি। মুখের কথা মুখেই থেকে যায়, ছোট মানুষ সে, কতটুকুই বা চর্চ্চা করতে পারে কে জানে! পরখ করে দেখার জন্য আমি ওকে কমপিউটারের সামনে ডেকে বাংলা পত্র পত্রিকা থেকে কিছু কিছু পড়ে শোনাতে বলি। একটু সময় নেয় পড়তে, তারপরেও মিথীলা পড়তে পারে, বুঝি আমার হুমকী ধমকীকে এখনও ভয় পায়। এবার বাংলাদেশে এসেই মিথীলাকে বলে দিয়েছি, " তুমি বাংলাদেশে থাকতে থাকতে যদি বাংলা গড়গড়িয়ে পড়তে না শেখো, নেক্সট টাইম তোমাকে নিয়ে আসবোনা। আমি একা একা চলে আসবো"। ওর জন্য মারাত্মক হুমকী। কারন মিথীলা বাংলাদেশে আসতে পছন্দ করে, আরও বেশী পছন্দ করে আমার সাথে ঘুরে বেড়াতে। আমার এই হুমকী শুনে ও মুখে কিছু বলেনি, ভেতরে ভেতরে একটু ঘাবড়ে গেছে।
বাংলাদেশে এবার এসে ঢাকা শহরের ট্র্যাফিক জ্যাম দেখে ভড়কে গেছি। ৩০ মিনিটের রাস্তা গাড়ীতে করে যেতেও প্রায়ই দুই আড়াই ঘন্টা লেগে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে লাগে সাড়ে চার ঘন্টা। তবুও বের হচ্ছি প্রায় প্রতিদিন। সাথে থাকে মিশা ও মিথীলা। আমি গাড়ীর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঢাকার জনজীবন দেখি। আমার ভালো লাগে। কত রকমের মানুষ, একেক জনের মুখের অভিব্যক্তি একেক রকম। মিশা কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে আইপডে গান শুনে আর বাইরে চোখ রাখে কোথা দিয়ে আমড়ার ঝুড়ি নিয়ে ফেরিওয়ালা যাচ্ছে। আমড়াওয়ালা দেখলেই ওকে আমরা কিনতে হবে। ধোওয়া ধুয়ির বালাই নেই, মরিচ লবন মিশিয়ে কচকচ করে আমড়াগুলো খায় আর মাথা দুলিয়ে গান শুনে। মিথীলা এমনিতেই শান্ত স্বভাবের। ও এভাবে রাস্তার জিনিস খাবেনা। ও খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। খাবার দাবারও না ধুয়ে খায়না। তাহলে গাড়ীতে ওর সময় কিভাবে কাটে? মিথীলা আমার মতই দুই চোখ জানালার বাইরে মেলে রাখে। কি ভাবে কে জানে! মাঝে মাঝে ওকে খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করি, " ঐ রিক্সার গায়ে কি লেখা আছে বলতো"। মিথীলা বলে, " মায়ের দোয়া"। একটা পারলে আরেকটা জিজ্ঞেস করি। ড্রাইভার সাহেব বলে উঠে, " আন্টিতো ভালই বাংলা পারে দেখি। এত কষ্ট কইরা বাংলা শিখা কি হইব? আন্টিতো আর বাংলাদেশে আইবোনা'। আমি বলি, " কে জানে, আসতেওতো পারে। পড়ালেখা শেষ করে এখানেই বড় চাকুরী করবে, সবার সাথে আরামে আনন্দে থাকবে"। আমি এসব কথা ইচ্ছে করেই বলি। মিথীলার চোখে একটা স্বপ্ন এঁকে দিতে চাই। এই যে আমার প্রচ্ছন্ন হুমকীতে একটু হলেও ভয় পেয়ে মিথীলা বাংলা চর্চ্চা করে যাচ্ছে, এতেই আমার আনন্দ।
আজকে গাজীপুর যাওয়ার পথে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়েছি। আমাদের সামনেই ছিলো একটা অটো। মিথীলা আমাকে ডেকে অটোর গায়ে লেখা 'স্কাইলাইন' শব্দটি দেখালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, " এই যে স্কাইলাইন লেখা আছে, দন্ত্য'স কে কি এভাবেই লিখে সব জায়গাতে"? আমি বললাম যুক্তাক্ষরগুলোতে এভাবেই লিখে। আমি কিনতু যুক্তাক্ষরকে মিথীলার সাথে যুক্তাক্ষরই বলি। এসব কঠিন শব্দ নিয়ে আগে থেকেই গল্পচ্ছলে কথা বলতাম। একটু পরেই মিথীলা জিজ্ঞেস করলো, "প্রগতি মানে কি"? বলে দিলাম প্রগতি মানে উন্নতি। এরপরেই এক ধমক দিলাম, " এই মেয়ে, তুমি আর কতকাল এই একটা দুটা করে শব্দ পড়ে যাবে? গড়গড়িয়ে পড়তে না পারলে কিনতু তোমাকে নেক্সট টাইম আমি সত্যি সত্যি আনবোনা"। মিথীলা বললো, " আমি মনে মনে সব পড়ি, শুধু যে শব্দের মানে জানিনা, সেটাই তোমাকে জিজ্ঞেস করি"।
গাড়ী উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে গেলো। এই প্রথম খেয়াল করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার মুখেই সম্ভবতঃ তিনকোনা টাইপের একটি স্থাপত্য শোভা পাচ্ছে যার প্রথমটিতে বংগবন্ধুর মুখচ্ছবি খোদাই করে অংকিত আছে। কিছু না ভেবেই আমি মিথীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, " মিথীলা বলতো এটা কার ছবি"?
মিথীলার জবাবঃ "শেখ মুজিবুর রহমান"।
আমিঃ " নামের আগে বংগবন্ধু বলতে হয়। তুমি কি জানো উনি কে ছিলেন"?
মিথীলাঃ " ঐ যে ফ্রীডম ফাইটের লীডার, মানে মেইন লীডার ছিল"।
আমি ভেতরে ভেতরে খুশীতে ফুটতে শুরু করেছি। আরেক ধাপ এগিয়ে প্রশ্ন করলাম, " আচ্ছা একটু বুঝিয়ে বলো, ধরো আমেরিকার কোন লীডারের সাথে বংগবন্ধুকে তুলনা করা যায়"?
মিথীলার চটপট উত্তরঃ মার্টিন লুথার কিং"।
মিথীলার এই উত্তর শুনে সামনে বসে থাকা মিশা ঝট করে আমার দিকে তাকালো, দুজনেই চমৎকৃত হয়েছি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমার মাথায়ও আসেনি মার্টিন লুথার কিং এর নাম। মিথীলাকে প্রশ্ন করে আমি নিজেও খুঁজছিলাম আমেরিকান লীডারের নাম, যাঁর সাথে বংগবন্ধুকে তুলনা করা যায়"।
মিথীলার জবাব আমার মাথায় আটকে আছে। সত্যিইতো, মার্টিন লুথার কিং সংগ্রাম করেছিলেন কালোদের মুক্তির জন্য আর বংগবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন বাঙ্গালীর মুক্তির জন্য। মার্টিন লুথার কিং যেমন আততায়ীর গুলীতে নিহত হয়েছিলেন, বংগবন্ধুও তেমনিভাবেই আততায়ীর গুলীতে নিহত হয়েছিলেন। মিথীলার এর চেয়ে বেশী কিছু জানার কথা নয়। দুই বছর আগে মিথীলাকে নিয়ে ৩২ নাম্বার বাড়ীতে গিয়েছিলাম। সেদিন ঐ বাড়ীতে প্রধানমন্ত্রীর আসার কথা ছিল বলে আমরা ১৫ মিনিটের বেশী সেখানে থাকতে পারিনি। ঐ ১৫ মিনিটে যতটুকু দেখার এবং যতটুকু বুঝার তা মিথীলা বুঝে নিয়েছিল। সেই ছোট্ট অভিজ্ঞতাটুকু দিয়েই ও দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছে। আমি মিথীলার মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। বারো বছর বয়সী ছোট্ট মিথীলা, যে দুই বছর বয়স থেকেই আমেরিকাতে বড় হচ্ছে, সেই মিথীলা বাংলা পড়তে পারে, বংগবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখে চিনতে পারে, তার চেয়েও বড় কথা, বংগবন্ধুকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে (ছোট্ট করে হলেও), এর চেয়ে বেশী আর কি চাইতে পারি আমি! মিথীলা যেখানে থাকে, তার আশেপাশে কোন বাঙ্গালী নেই, যতটুকু শিখছে তার সবটুকুই ঘরে বসে, আমার হুমকী ধামকী খেয়ে। আমিও কি একটু গর্ব বোধ করতে শুরু করেছি? না, আমি গর্ব বোধ করছিনা তবে আত্মতুষ্টি বলে একটা ব্যাপার আছে, আমি সেটুকু অনুভব করছি। নাহ! মিথীলাকে নিয়ে আসতেই হবে। যতবার বাংলাদেশে আসবো, ততবার ওকে নিয়ে আসবো। তবে হুমকী ধামকী চালিয়ে যাবো।

2 comments:

  1. That's why, I call Mithila "The Best".

    ReplyDelete
  2. Mithila, you are really "The Best"- Your BoroMama

    ReplyDelete