Sunday, July 29, 2012

স্মৃতির পাতায় হুমায়ুন ও তাঁরই অতি প্রিয়জনেরা



আমি লেখক হুমায়ুন আহমেদের দারুন ভক্ত। হুমায়ুন আহমেদের লেখা বই, যে কোন আর্টিক্যাল নজরে পড়লেই শত ব্যস্ততার মাঝেও এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। কিনতু,  ঠিক কখন থেকে  হুমায়ুন আহমেদের লেখা বই পড়তে শুরু করেছি, এখন আর তা মনে পড়েনা। তবে কৈশোরেতো অবশ্যই না। খুব ছোটবেলা থেকেই মাকে দেখেছি অবসরে গল্পের বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতে। একটি কাঠের আলমিরা ভর্তি ছিল মায়ের সংগ্রহসেই সংগ্রহে মহাশ্বেতা দেবী, আশাপূর্ণা দেবী, সৈয়দ মুজতবা আলী, বুদ্ধদেব বসু, গজেন্দ্র নারায়ন মিত্র থেকে শুরু করে মানিক, শরত, নজরুল, রবীন্দ্রসহ আরও অনেকের ভারী ভারী উপন্যাসের বই শোভা পেলেও নীহার রঞ্জন, নিমাই, হুমায়ুনের বই শোভা পেতনা। 

যেহেতু মায়ের সংগ্রহে হূমায়ুন আহমেদের কোন বই ছিলনা, তাই কৈশোরে হুমায়ুন আহমেদ নামের কোন লেখককে আমরা জানতামনা। উনার নাম প্রথম জেনেছি বিটিভিতে প্রচারিত এইসব দিনরাত্রি ধারাবাহিকের মাধ্যমে। এই ধারাবাহিকটি ৮৫সালের শুরুর দিকেই প্রথম প্রচারিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে বসে ধারাবাহিকটি দেখতাম। আমি তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। বছরেরই মাঝামাঝি সময়ে আমার বিয়ে হয়। হুমায়ুন ম্যাজিকের শুরু এইসব দিনরাত্রি থেকেই।  ছোট্ট একটি ঘটনা মনে পড়ছে, আমার বিয়ের পরদিন ছিল এইসব দিনরাত্রির একটি এপিসোড। বাপের বাড়ী ছেড়ে স্বামীর বাড়ীতে এসেও অঝোরে কেঁদেছিলাম। কান্নাকাটির মধ্যেও  ‘এইসব দিনরাত্রির  নতুন এপিসোডের কথা ঠিকই মনে ছিল। নতুন বাড়ীতে এসেই টিভি দেখতে চাইলে অনেকেই চোখ গোল গোল করে নতুন বউয়ের দিকে তাকাবে, সেই ভয়মনের মধ্যে ছিল। তারপরেও লজ্জার মাথা খেয়ে  একফাঁকে স্বামীকে বলেই ফেলেছিলাম, আজকে এইসব দিনরাত্রির নতুন পর্ব দেখাবে। আমি সেটা দেখতে চাই। আমি আজও জানিনা নতুন বউয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমার স্বামীর কি অনুভূতি হয়েছিল। তবে উনি হাসিমুখে আমার জন্য নাটক দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এ  সবই আজ স্মৃতি।

হুমায়ুন আহমেদ আজ আমাদের মাঝে নেই। আমার কতই না ভাগ্য, এই সাহিত্য সম্রাটকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল।   লেখক হুমায়ুনকে দেখিনি,  দেখেছি পরিবার পরিজন আঁকড়ে থাকা হুমায়ুনকে, পরিবারন্তঃপ্রান হুমায়ুনের খুব কাছের মানুষগুলোকে, যারা তাদের হুমায়ুনকে নিয়ে গর্বিত ছিল, যারা এই মানুষটিকে ঘিরে বেড়ে উঠেছিল।  অনেক বছর পর পত্রিকার পাতায় নোভা, শীলা, তাদের দাদী, গুলতেকীন আহমেদের কথা ছাপা হচ্ছে,  প্রতিদিন নামগুলো  পড়ি আর তাদের সাথে ফেলে আসা দিনের কিছু স্মৃতি নিয়ে চুপচাপ নাড়াচাড়া করি।  সময়ের সাথে সাথে কত কিছু বদলে যায়। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর পরিবারের  খুব ঘনিষ্ঠ  স্বজনদের সাথে যে অন্তরংগ  মুহূর্তগুলো কেটেছিল, সেগুলোই চোখের সামনে ইদানিং ভেসে বেড়ায়।

আমার স্বামীকে বিয়ের পর থেকেই আমি উত্তম কুমার ডাকি। সে বেশ কয়েক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমায়ুন আহমেদের সহকর্মী ছিলেন। তাছাড়া দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিলেন বলে বয়সের কিছুটা ব্যবধান থাকা সত্বেও তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। উত্তম  হুমায়ুন আহমেদকে ‘ভাই’ সম্বোধণ করতেন। ৮৫ সালে উত্তমেরর সাথে যখন আমার বিয়ে হয়, হুমায়ুন আহমেদ তখনও ব্যস্ত হয়ে উঠেননি। বন্ধুবান্ধবকে সময় দিতে পেরেছেন। তবে ব্যস্ত না হলেও জনপ্রিয় হতে শুরু করেন। বিয়ের আগে থেকেই আমি হুমায়ুন আহমেদের লেখার ভক্ত। আমার পরম সৌভাগ্য যে আমাদের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রখানি হুমায়ুন ভাই করে দিয়েছিলেন। ্পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ততা থাকায় আমাদের বিয়েতে উনি উপস্থিত হতে পারেননি, তবে লাল টুকটুকে এক শার্ট পড়ে বৌভাত অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, একা। তাই শুধু হুমায়ুন ভাইয়ের সাথেই পরিচয় হয়।পর্যায়ক্রমে খালাম্মা (মিসেস আয়েশা ফয়েজ), গুলতেকীন ভাবী, তিন মেয়ে নোভা, শীলা, বিপাশা, হুমায়ুন ভাইয়ের ছোট বোন শিখু আপার সাথেও পরিচয় হয়েছিল। হুমায়ুন ভাইয়ের ফ্যামিলির প্রতিটি সদস্যকে আমার ভালো লেগেছে। মানুষকে তারা এত আপন করে নিতে পারে, যারাই তাদের কাছাকাছি এসেছে তারাই ভাল বলতে পারবে।

শিখু আপার সাথেঃ

বিয়ের পরে হানিমুন করতে আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম, ঢাকা থেকে ট্রেনে চেপে চিটাগাং, চিটাগাং থেকে মুড়ির টিন বাসে করে কক্সবাজার যাওয়ার পথে এক জায়গায় গাড়ী থেমেছিল। সেখানে আরেকটি জীপ গাড়ীও থেমে ছিল। হঠা করেই জীপ গাড়ী থেকে চোখে কালো গগলস পড়া এক মেজর সাহেব নেমে এসে আমাদের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন,  দাদা, আপনাকে আমার স্ত্রী গাড়ী থেকে দেখতে পেয়ে আমাকে পাঠিয়েছে।  আমি মেজর অমুক এবং আমার স্ত্রী শিখু, আমার শাশুড়ী আম্মাসহ সকলেই গাড়ীতে আছে। আমরাও কক্সবাজার যাচ্ছি। বাস থেকে নেমে আসেন, চলেন আমাদের সাথেই, একই রেস্ট হাউজে উঠবেন

পথ চলতে শিখু আপাদের সাথে দেখা হওয়ায় উত্তম খুব খুশী তখনই জানতে পারলাম শিখু আপা হচ্ছেন হুমায়ুন আহমেদের ছোটবোন। যেহেতু আমাদের হোটেল আগে থেকেই বুকিং দেয়া ছিল তাই উনাদের সাথে সমুদ্র সৈকতে দেখা হবে বলে শিখু আপার বরকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল। কক্সবাজার গিয়ে পরদিনই শিখু আপাদের সাথে দেখা করেছি উনাদের রেস্ট হাউজে গিয়ে। তাঁদের মা মিসেস আয়েশা ফয়েজকে নিয়ে যখনই কোন লেখা পড়ি, আমার চোখে ভেসে উঠে ২৭ বছর আগের স্মৃতি। কক্সবাজারের সেই রেস্ট হাউজে যাওয়ার পরেই শিখু আপা বড় বোনের মত আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। এক মুহূর্তেই শিখু আপাকে আমার ভালো লেগে গেল। দারুন প্রানবন্ত এক মেয়ে। চুপ করে থাকতেই জানেনা। মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, আম্মা এই হচ্ছে দাদাভাইয়ের বন্ধু জীবেনদার বউ। উনারা এসেছে হানিমুনে। কালকে জীপে বসে যাদেরকে দেখেছিলাম, এরাই তারাউত্তম ‘খালাম্মা কেমন আছেন বলে পায়ে হাত ছুঁয়ে উনাকে প্রনাম করতেই আমিও তাঁকে অনুসরন করলাম। খালাম্মা খুবই আপনার জনের মতই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে উনার পাশে বসালেন। খালাম্মাকে দেখে আমার বুকটা ভাললাগায় ভরে গেল। পান খেয়ে ঠোঁট দুটো লাল টুকটুকে হয়েছিল, পরনে তাঁতের শাড়ী, মাথায় আধাআধি ঘোমটা টানা মানুষটিকে দেখেই নিরহংকারী সম্ভ্রান্ত পরিবারের গিন্নীমা লাগছিলো। আমরা একসাথে অনেক ছবি তুললাম।

চা-টা খাওয়ার পরে একসাথে বীচে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই শিখু আপাই খেয়াল করলো যে আমি সিল্কের শাড়ী পড়ে রওনা হয়েছি। শিখু আপা আর উনার স্বামী শুরু থেকেই আমাকে পিচ্চী একটা মেয়ে ভেবে আদুরে ভঙ্গীতে কথা বলে যাচ্ছিলেন। শাড়ী পড়ে সমুদ্রস্নানে যাচ্ছি বলে শিখু আপা বলেই ফেললো, বৌদি তুমি কী পাগল হয়েছো, শাড়ী পড়ে সমুদ্রে নামতেই পারবেনা। তোমাকে সালোয়ার কামিজ পড়ে নামতে হবে। আমি পড়ে গেছি মহা ফাঁপড়ে। আমাদের হিন্দু ঘরের মেয়েরা বিয়ের পরে শাড়ী পড়েই অভ্যস্ত, সালোয়ার কামিজ পড়ার কথা চিন্তাই করা যেতোনা। কিনতু  নিজের দূর্বলতা  প্রকাশ পেয়ে যায় ভয়ে আমি বলেছিলাম, আপা, আমার সালোয়ার কামিজ আছে, কিনতু সাথে করে নিয়ে আসিনি। হোটেলেই পড়ে আছে। আমি আজকে না হয় শাড়ী পড়েই যাই, কালকে সালোয়ার কামিজ পড়ে আসবো। শিখু আপা তা মানতে রাজী নন। বললেন, এমনিতেই এক পিচ্চী মেয়ে, তার উপর শাড়ী পেঁচিয়ে পানিতে নামলেই ঢেউয়ের ধাক্কায় কোথায় চলে যাবে! আমার দাদাটার কী হবে”! বলেই সাথে সাথে সমস্যার সমাধান করে দিলেন।

তাদের সকলের ছোটবোন মনির সালোয়ার কামিজ আমাকে পড়তে হবে। মনি তাদের সকলের ছোট। খালাম্মার পাশেই বসা ছিল হাসিমাখা মুখে। ওর সাথে আমি কথা বলে চলেছি অথচ মনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে শুধুই মিটিমিটি হাসছিলো।  আমি তখনও জানতে পারিনি যে মনি বাক প্রতিবন্ধী। তবে কথা না বলতে পারলেও মনি আমাদের সকল কথা বুঝতে পারছিল। র একসেট সালোয়ার কামিজ (লাল টুকটুকে) আমাকে পড়তে দিয়ে শিখু আপা নিজেও লাল কালো চেকের সালোয়ার কামিজ পড়ে তৈরী হয়ে নিল। এ সমস্ত প্রস্তুতির ফাঁকে খালাম্মা আমাকে পরম মমতায় পাশে বসিয়ে অনেক গল্প করতে লাগলেন। আমি কী পড়ছি, বাবা মাকে ছেড়ে কেমন লাগছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন। মনিকে একবারের জন্যও কাছছাড়া করছিলেননা। সেদিন শিখু আপাদের সাথে উনার এক মামা মামীও এসেছিলেন। পারিবারিক সফর যেমন হয়, তেমনই এক সফর ছিল ওটা। শিখু আপার বাচ্চা আর মামীর ছোট বাচ্চা, এই দুটি ফুটফুটে শিশুকে নিয়েই আমরা সদলবলে বীচে গেছিলাম। শিখু আপার ছোট্ট টুকটুকী মেয়েটা আজকে নিশ্চয়ই ৩০ বছরের তরুণী, আর সেই মামার মেয়েটাও নিশ্চয়ই এতদিনে সংসার সাজিয়ে বসেছে।

সৈকতে গিয়ে সমুদ্রের গর্জন আর বিশালত্ব দেখে আমি খুব ঘাবড়ে গেছিলাম। শিখু আপার স্বামী (দুলাভাইয়ের নামটা কি শহীদ ছিল কিনা আজ আর মনে পড়ছেনা) শিখু আপাকে নিয়ে অনেকটা দূর চলে গেছেন, আমার স্বামী ক্যামেরা হাতে শুধু বউয়ের ছবি তুলতে ব্যস্ত, মামা মামীকে নিয়ে ব্যস্ত, মনি সমুদ্রের জলে পা ডোবায় আবার তুলে ফেলে, দুই শিশু সৈকতের বালিতে বসে ঝিনুক কুড়াচ্ছিল, আর আমি হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে থেকে ভয় ও ভালো লাগায় দুলছিলাম। শিখু আপাই হঠা করে খেয়াল করেছিল, নতুন বৌদি ভয়ে সমুদ্রে নামছেনা। তার স্বামীকে পাঠিয়ে দিল আমাকে যেন টেনে নিয়ে যায় তার কাছে। দুলা ভাই আর্মির মেজর, সাহসী হওয়ারই কথা, আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে শিখু আপার কাছে নিয়ে যেতেই সবাই মিলে শুরু হয়ে গেল হৈ হৈ করে জল ছোঁড়াছুঁড়ির খেলা।

এরপরে আমরা সকলেই যে যার কর্মস্থলে ফিরে এসেছি। তাঁদের সাথে আরও কয়েকবারই দেখা হয়েছিল।  আমরা তখন ছিলাম সাভারে, গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোয়ার্টারে। এখন গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের হালচাল কেমন তা আমি জানিনা। কিনতু ৮৫ সালের দিকে ওখানের পরিবেশ ছিল সমাজতন্ত্র কায়েমের এক ব্যর্থ পরিহাস। আমার স্বামী একটা ডিভিশানের ম্যানেজার ছিলেন। ম্যানেজার শব্দটি যতই গালভরা হোক না কেনো, আমাদের কোয়ার্টারের হাল ছিল খুবই করুণ। ঘরগুলো ছিল অনেকটাই ভাঙ্গাচোরা ধরনের। ঘরের মেঝে্য এখানে ফাটল, ওখানে ফাটল, কাছেই ছিল গরুর আস্তাবল, সেখান থেকে গোবরের গন্ধ আসত। এমন ছিল যে ওখানে যে সন্ধ্যায় গুলতেকীন ভাবী, শিখু আপাসহ ১২/১৪ জনের একদল গিয়ে হাজির হলেন, আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছিলাম। খুব লজ্জা লাগছিল গুলতেকীন ভাবী, শিখু আপার কাছে বাসস্থানের দৈণ্যতা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায়। উত্তমকে অবশ্য এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখিনি। সে সবার জন্য ক্যান্টিন থেকে তেলেভাজা আনায় ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম চা বানাতে। দুই জনের সংসারে অতগুলো কাপ ডিশ কোথায় পাব? শিখু আপা বা গুলতেকীন ভাবী এতো ভালো যে আমার অসহায়ত্ব টের পেয়ে নিজেরাই হাতে হাতে করেই কাপে, গ্লাসে চা ঢেলে খেয়ে নিলেন।

শিখু আপাকে সদা  উৎফুল্ল মুডে থাকতে দেখতাম। আরেকদিন, কক্সবাজার থেকে ফেরার কয়েকমাস পরে শিখু আপা আর দুলাভাই এসে হাজির আমাদের সাভারের বাসায়হানিমুনে গিয়ে উনাদের সাথে  তোলা ছবিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই শিখু আপা বললো, বৌদি, তুমি মনে হয় জান যে তোমার হাসি খুব সুন্দর, তাই সব সময় হেসে হেসে ছবি তোল আমি তখনও মানুষের কথায় হাসি ঠাট্টা বা কৌতুকের অংশটুকু আলাদা করতে শিখিনি। একটু ভড়কে গিয়ে বললাম, আমি ছোটবেলাতে একেবারেই হাসতাম না বলে আমার বাবা আমাকে তেঁতুলের ঘটি ডাকতো। বাবা যেনো আমাকে আর তেঁতুলের ঘটি না ডাকতে পারে সেজন্য আমি আয়নাতে দেখে দেখে হাসি প্র্যাকটিস করেছি। এখন আমি সব সময়ই হাসি।”  শিখু আপা বললো, আল্লাহরে! এই মেয়ে পিচ্চী হলে কী হবে, কথা বলে টকর টকর”!  আজও  খুব মনে আছে সে সন্ধ্যার কথা।

শিখু আপার সাথে আরেকদিনের ঘটনা মনে পড়ে। আমরা অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরে এসেছি। ২০০০ সালের দিকে, আমরা তখন উত্তরা থাকি। উত্তম তখন নামকরা এক ঔষধ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। নানা কারনেই হুমায়ুন ভাইয়ের সাথে একটু দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে। শিখু আপাদের সাথেও যোগাযোগ ছিলনা। হঠা করেই এক সকালে শিখু আপা ফোন করে,  জানতে চায়, বৌদি তোমরা সবাই কেমন আছো। কতদিন তোমাদের খোঁজ পাইনা। দাদা কেমন আছে”? সবাই ভালো আছি শুনে শিখু আপা ফোনে থেকেই  বড় একখানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, বৌদি, অনেক কষ্টে তোমাদের ফোন নাম্বার পেয়েছি। দাদাকে নিয়ে খুব খারাপ এক সংবাদ পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। একজনের কাছ থেকে  শুনেছি দাদা মারা গেছে। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠেছে। তোমরা সবাই ভালো আছো জেনে এতো ভালো লাগছে আমার দাদাটার হায়াৎ বেড়ে গেছে” এত বছর পরে শিখু  আপার কাছ থেকে ফোন পেয়ে কী যে খুশী হয়েছি, শিখু আপা সেদিন তা টের পেয়েছিল কি না কে জানে। ফোনটা উত্তমের হাতেই দিয়ে শিখু আপাকে নিশ্চিন্ত করতে চাইলাম। শিখু আপা কলকল করে কথা বলছিলো। কথা বলার এক পর্যায়ে উত্তম জানতে চাইলো, শিখু, হুমায়ুন ভাইকে নিয়ে যেসব রিউমার চারদিকে শুনি, সেসবের কতটুকু সত্যি আসলে তখন হুমায়ুন ভাইকে নিয়ে নানা রকম মুখরোচক গল্প বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমি বা উত্তম কখনও হুমায়ুন ভাইকে নিয়ে কোনরকম রসালো আলোচনায় অংশগ্রহন করিনি। এখনও হুমায়ুন ভাইয়ের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবন নিয়ে কথা উঠলে আমরা চুপ থাকি। সেদিন  শিখু আপা বলেছিল,  দাদা, কিছুতো অবশ্যই সত্যি। আমরা খুব অশান্তিতে আছি। দাদাভাই যে কেনো এমন করছে তা আল্লাহ জানেন। শিখু আপার সাথে আমাদের আর কথা হয়নি। কিনতু শিখু আপাকে আমার মনে থাকবে আজীবন। হুমায়ুন ভাইয়ের অনেক লেখাতেই শিখু আপার কথা পড়েছি। চমকার এক মানুষ। প্রানবন্ত মানুষটি তার দাদাভাইকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। দাদাভাইয়ের বন্ধু জীবেনদাদা কেও দারুন পছন্দ করতেন। আর আমাকেতো বড়বোনের মমতায় বেঁধেছিলেন। উনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।


গুলতেকীন ভাবীর সাথেঃ


গুলতেকীন ভাবীর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল উনাদের আজিমপুরের বাসায়।  পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ততা থাকায় আমাদের বিয়েতে হুমায়ুন ভাই উপস্থিত হতে পারেননি, তবে লাল টুকটুকে এক শার্ট পড়ে বৌভাত অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, একা। ভাবীকে সাথে আনেননি কিনতু উনাদের বাসায় যাওয়ার নিমন্ত্রন করেছিলেন। বিয়ের দুমাস পরে এক বিকেলে উত্তমেরর সাথে হুমায়ুন আহমেদের আজিমপুরের বাসায় বেড়াতে যাই।

বেল টিপেছি, দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো যে সুন্দরী নারীকে দেখলাম, উনিই যে গুলতেকীন ভাবী তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনি। গুলতেকীন ভাবীর গল্প আমি উত্তমেরর মুখে অনেকবার শুনেছি। আমেরিকা থাকাকালীন ছোট্ট নোভাকে কোলে নিয়ে তরুনী গুলতেকীনের ছবি আমার স্বামীর পুরানো এলবামে এখনও জ্বলজ্বল করছে। একই ক্যামেরায় বন্দী হুমায়ুন আহমেদ, গুলতেকীন আহমেদ ও শিশু নোভার ছবি এখনও একটি সুখী পরিবারের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ভাবী যে সুন্দরী ও স্মার্ট ছিলেন, সেই ছবিগুলো দেখেই তা আঁচ করেছিলাম। সেই ভাবীই পরম সমাদরে আমাদের ভেতরের ঘরে নিয়ে গেলেন। সেই ঘরে হুমায়ুন ভাই তখন বেতের সোফায় পা তুলে বসে সিগ্রেট টানছিলেন। ভাবীকে দেখার আগে ভেবেছিলাম এমন নামী দামী লেখকের স্ত্রী নিশচয়ই খুব অহংকারী হবেন। আমার মত সাধারণ এক মেয়েকে হয়তো পাত্তাই দেবেননা। কিনতু ভাবীকে সামনাসামনি দেখে একটু চমকালাম। খুব সাধারন ছাপা সূতীর শাড়ীতে ভাবীকে একটুও অহংকারী লাগছিলোনা, বরং দারুন স্নিগ্ধ ও সুন্দর লাগছিল, আমার মনে আজও সেই ছবি ভেসে উঠে। 

বিশাল ধনী পরিবারের মেয়ে হলেও উনাকে বরং লেখক স্বামীর বউ হিসেবেই বেশী মানিয়েছিল। প্রথমদিন থেকেই হুমায়ুন ভাইয়ের পারিবারিক পরিমন্ডল আমার মনে দাগ কেটে যায়। সাধারণ মধ্যবিত্তের সংসারের চারদিকে সুখ যেনো উপচে পড়ছিল। কন্যাঅন্তঃপ্রান হুমায়ুন ভাইয়ের দুই বছর বয়সী কন্যা বিপাশা বাবার চারপাশে ঘুরঘুর করছিল, মেয়ের সাথে খেলা করতে করতেই উনি আমাদের সাথে গল্প চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দারুন সংসারী বউয়ের মতই ভাবী নিজে হাতে ছোলার ডালের   হালুয়া বানিয়ে খাইয়েছিলেন। পরে  আমাকে ভেতরের ঘরে নিতেই দেখা হলো খালাম্মার সাথে। আমাকে চিনতে পেরে উনিও খুশী হলেন, হাতে ধরে উনার খাটে নিয়ে বসালেন একেবারে আপন জনের মত। ছোটবোন মনিও আমাকে দেখে চিনে ফেললো এবং যথারীতি খুশী হয়েছিল। ঐ বাড়ীর বারান্দা থেকে গোরস্তান দেখেছিলাম কিনা মনে পড়ছেনা। তবে মন উদাস করা কিছু দেখেছিলাম তা মনে পড়ছে। আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম হুমায়ুন ভাইয়ের সামনে বসে কথা বলতে। মাথার মধ্যে একটা জিনিসই কাজ করছিল, এই কী সেই হুমায়ুন আহমেদ, যাঁর এইসব দিনরাত্রি দেখার জন্য সবাই পাগল হয়ে থাকে! উনি এতো সাধারন জীবন যাপন করেন! অনেকক্ষন গল্পগুজব করার পরে আমরা চলে এলাম। খালাম্মার সাথে এরপরে আর দেখা হয়নি। তবে দুই বারের সাক্ষাতেই আমি এক দারুন সম্ভ্রান্ত নারীকে কাছে থেকে দেখে ফেলেছি।

এরপরে গুলতেকীন ভাবীকে নিয়ে হুমায়ুন ভাই এসেছিলেন ইবনে সিনহা ক্লিনিকে আমাদের প্রথম সন্তান মৌটুসীকে দেখতে। সেদিনও ভাবীর পরনে ছিল হালকা ঘিয়ে রঙের জমিনে খয়েরী ছাপা সূতী শাড়ী, খুবই সাধারন সাজ অথচ কী যে রূপসী দেখাচ্ছিল উনাকে। এই ভাবীকে শুরু থেকেই আমার ভালো লেগে যায়। খুব কম কথা বলেন, দেখেই বুঝা যেত স্বামী গরবে গরবিনী এক নারী। সে সকালে স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলেই কত মজার মজার গল্প শোনালেন এক নতুন মাকে। উনাদের গল্প শুনে আমার শারীরিক যন্ত্রনার কথা কিছুক্ষনের জন্য ভুলে ছিলাম।

আরেক সকালে  হুমায়ুন ভাইয়ের শহীদুল্লা হলের বাড়ীতে গিয়ে হাজির হয়েছি। দরজার কড়া নাড়তেই ভাবীই দরজা খুলে দিয়ে আমাদের ভেতরে এনে বসালেন। বলেই ফেললেন, জীবেনদা, আপনার বন্ধু আইন জারি করেছে, কেউ এসে তাঁর খোঁজ করলে যেন বলে দেই উনি বাড়ীতে নেই। ঈদের উপন্যাস লিখছেতো, তাই এত সাবধানতা। তবে আপনার বেলায় এই নিয়ম খাটবেনা”খবর পেয়ে হুমায়ুন ভাই এলেন, অনেকক্ষন গল্প করলেন। হুমায়ুন ভাই যখন গল্প করতেন, মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম। ভাবীও পাশে বসে থাকতেন। গল্প করার ফাঁকেই ভাবী নিজহাতে চা-খাবার নিয়ে আসতেন। গল্প চলাকালীন সময়েই হুমায়ুন ভাইয়ের কাছে ভাবীকে প্রথম দেখার অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইলাম বললেন, দূর থেকে দেখে মনে হয়েছিল ফুটফুটে এক পরী হেঁটে আসছে। এটা শুনে ভাবী মিটিমিটি হাসছিলো। বিয়ের এত বছর পরেও স্বামীর মুখ থেকে এমন মধুবাক্য কজন স্ত্রী শুনতে পায়! এরপর হুমায়ুন ভাই বললেন, আর কী কী জানতে চাও, বলে ফেলো পরে আর বলবোনা”। জানতে চাইলাম আপনার উপন্যাসের নায়িকাদের নাম সব সময় জরী, নীলু না-হয় রূপা হয়ে থাকে। বিশেষ করে জরী। এই জরীটা কে? উত্তরে পাশে বসা সুন্দরীকে দেখিয়ে বললেন, ইনিই হচ্ছেন জরী। গুলতেকীনকে আমি জরী নামে ডাকি, আমার দেয়া নাম এটা। আর কিছু জানতে চাইনি। সুখী দম্পতীর গল্প শোনা হয়ে গেছে।



আরেক  শীতের সকালে ঢাকা থেকে সাভার ফেরার পথে আমার আবদারে উত্তম আমাকে নিয়ে হুমায়ুন ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিল। আমার কোলে তখন দুই বছরের মৌটুসী। সেদিন হুমায়ুন ভাই খুব আড্ডার মুডে ছিলেন। বেতের সোফায় পা মুড়ে বসে গল্প শুরু করে দিলেন। আমরা গল্প করছি, এরই একফাঁকে গুলতেকীন ভাবী একখানা কমলা এনে দিলেন মৌটুসীর হাতে। মৌটুসী ছোটবেলায় কারো হাত থেকে কিছু নিতনা, মাঝে মাঝে আমি অস্বস্তিতেও পড়তাম। কিনতু সেদিন ভাবীর হাত থেকে কমলা নিয়েছিল বলে আমি খুশী হয়েছিলাম। গুলতেকীন ভাবীকে আমি খুব পছন্দ করতাম। উনার দেয়া কমলা যদি মৌটুসী না নিত আমার কাছে ব্যাপারটা অনেক বিব্রতকর মনে হতো হয়তো। ঘন্টা দুয়েক ছিলাম ঐ বাড়ীতে। হুমায়ুন ভাইয়ের সান্নিধ্যে থাকা মানেই দারুন অভিজ্ঞতা। এমন সুন্দর করে গল্প করতে পারতেন উনি যে একমনে তা শুনে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিলনা। গল্প বলার ঈন্দ্রজালে সবাইকে আটকে রাখতে পারতেন উনি।

আরেক দুপুরে উত্তম হুমায়ুন ভাইয়ের বাড়ী থেকে ফি্রেছে হাতে হুমায়ুন আহমেদের লেখা নক্ষত্রের রাত বইটি নিয়ে। হাতে নিয়ে বইটি খুলে দেখি, মিঠু ভাবীকে, টিঙ্কু আহমেদ। টিঙ্কু আহমেদ কে? জানলাম গুলতেকীন ভাবীর আরেক নাম। সে দিনটি ছিল শীলার জন্মদিন। ভাবী নিজ হাতেই অনেক কিছু রান্না করেছিলেন। আস্ত ফুলকপির রোস্ট খাইয়েছিলেন উত্তমকে। আমি নতুন নতুন রান্না করতে ভালোবাসি জেনে উত্তম বাড়ী ফিরেই আমাকে বলেছিল আস্ত ফুলকপি রোস্টের কথা। এরপরে গত ২৫ বছরে কত নতুন নতুন রান্না করে উত্তমকে খাইয়েছি, কিনতু সেদিনের ফুলকপি রোস্টের গল্প এখনও মাথায় আটকে আছে। খাওয়াপর্ব শেষ হতেই ভাবী আমার জন্য নক্ষত্রের রাত বইটি নিয়ে আসেন। ভেতরে উপহারবাণীতে নিজের নাম স্বাক্ষর করেছিলেন।   বই পেয়ে আমি খুবই খুশী হয়েছিলাম। বইয়ের ভেতর ভাবীর স্বাক্ষর দেখে আবারও একজন সফল লেখকের গর্বিতা স্ত্রীকেই যেনো খুঁজে পেলাম।   

১৯৯১-৯২ সালের কথা। আমরা তখন সাভার ছেড়ে ঢাকা চলে এসেছি। আমার স্বামী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে। উত্তম জানতেন আমি হুমায়ুন ভাইয়ের লেখার অন্ধভক্ত। এইজন্য সুযোগ পেলেই সে আমাকে উনার বাড়ীতে বেড়াতে নিয়ে যেতো।  হুমায়ুন ভাই এবং গুলতেকীন ভাবীও আমাদেরকে পছন্দ করতেন। বিশেষ করে গুলতেকীন ভাবী বা  শিখু আপা উত্তমকে খুব পছন্দ করতেন। শেষবার ভাবীর সাথে দেখা হয় ১৯৯১-৯২ এর দিকে। বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ুন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক অয়োময় তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এক বিকেলে জীবেন অয়োময় নাটকের শুটিং দেখাতে নিয়ে যাবে বলতেই সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম।। ঠিক হলো প্রথমে হুমায়ুন ভাইয়ের বাড়ীতে যাব, তারপর উনার গাড়ীতে করেই টিভি স্টেশানে যাব। উনারা তখনও শহীদুল্লা হলের বাড়ীতেই থাকতেন। বিকেলে উনাদের বাড়িতে যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ আড্ডা হলো। বেডরুমের ফ্লোরে সবাই গোল হয়ে বসে গল্প চলছিল। পাশের রুমে নোভা, শীলা আর বিপাশা হুড়োহুড়ি, লুটোপুটি করছিল। আড়ং থেকে কিনে আনা স্টাফড কুমীর ছানা দিয়ে এ ওকে পিটানি দেয় আর হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। খেলার ফাঁকে ফাঁকেই মেয়েরা পালা করে করে একেকবার বাবার কাছে আসে, কয়েক মিনিট বাবার পাশে ঘুরঘুর করেই আবার খেলাতে ফিরে যায়। দারুন সুন্দর দৃশ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই চায়ের ট্রে হাতে গুলতেকীন ভাবী এসে আমাদের পাশে বসলেন। সাদার উপর কালো প্রিন্টের জামা, সাদা সালোয়ার, সাদা উড়নাতে উনাকে বিষন্ন দেখাচ্ছিল। উনাকে দেখামাত্র বিষন্ন সুন্দরী শব্দটি আমার মাথায় গেঁথে গেল। এক বছর আগেই উনাদের প্রথম পুত্র রাশেদ হুমায়ুন জন্মেই মারা যায়। সেই শোক তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ভাবী যতক্ষণ আমাদের সাথে বসেছিলেন, হুমায়ুন ভাই পুরোটা সময় ভাবীর হাঁটুতে পরম মমতায় আলতো করে চাপড় দিচ্ছিলেন। ছোট্ট এক দৃশ্য, কিনতু আমার মনে দাগ কেটে গেছে। সুখের দৃশ্য, সুখী মানুষ দেখতে কার না ভালো লাগে!

সন্ধ্যার পরে হুমায়ুন ভাই উনার লাল টুকটুকে গাড়ীতে চড়িয়ে আমাদেরকে টিভি স্টেশানে নিয়ে গেলেন। শরীর খারাপ ছিল বলে ভাবী আসেননি (এর কয়েকমাস পরেই নুহাশের জন্ম হয়)  অনেকক্ষন  শ্যুটিং দেখলাম, দারুন অভিজ্ঞতা। বাড়ী ফেরার তাড়া ছিল, শ্যুটিং শেষ না হতেই আমরা বেরিয়ে এসেছি। হুমায়ুন ভাইয়ের গাড়ীতে করেই বাসায় চলে যাব, গাড়ীর কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে প্রয়াত অভিনেতা মোজাম্মেল হোসেনের গলা শুনে থামলাম। উত্তমেরর নাম ধরে ডাকছেন, কাছে এসে উত্তমেরর সাথে খুব নীচু স্বরে কিছু বললেন। উত্তমকে দেখলাম মাথা দোলাচ্ছিল। বাড়ী ফিরে জানলাম, হুমায়ুন ভাই আজকে বাড়ী ফিরবেননা। গুলতেকীন ভাবী যদি হুমায়ুন ভাইয়ের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি যেনো বলি, হুমায়ুন ভাই আমার সাথেই আছে! আমি প্রচন্ড এক ঝাঁকুনী খেলাম। কাজের ব্যস্ততায় বাইরে থাকতে হতেই পারে, কিনতু ভাবীকে মিথ্যে বলতে হবে কেনো! উত্তম বললো, জানিনা, মনে হয় হুমায়ুন ভাইয়ের বাইরে রাত কাটানো ভাবী পছন্দ করেননা

হুমায়ুন ভাই তাঁর জরীকে না জানিয়ে এমনি আরও কত রাত বাইরে কাটিয়েছেন তা আমার জানার কথা নয়। তবে ঈশ্বর সেদিন আমাদের সহায় ছিলেন, উত্তমকে মিথ্যে বলতে হয়নি। ঐ সুন্দর সন্ধ্যার পরে গুলতেকীন ভাবীর সাথে উত্তম বা আমার আর কোনদিন দেখা হয়নি। এরপর সময়ের সাথে সাথে হুমায়ুন ভাইয়ের ব্যস্ততা বেড়েছে। শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছেন। আমরাও চলে গেছিলাম অস্ট্রেলিয়াতে তিন বছরের জন্য। দেশে ফিরে এসে আমার স্বামী শিক্ষকতা পেশায় ফিরে না গিয়ে দেশের নামকরা ঔষধ শিল্প প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। দুই শিক্ষকই তাঁদের পুরানো পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য আরেক কর্মজগতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যে শিক্ষকতার সূত্র ধরে আমার স্বামীর সাথে হুমায়ুন আহমেদের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেই পেশা থেকে দুজনে সরে যাওয়াতে তাঁদের যোগাযোগের সূত্রটাই ছিঁড়ে যায়। 


আমাদের চোখে তো হুমায়ুন ভাই আর তাঁর জরী ছিলেন স্বপ্নলোকের সুখী দম্পতি। সেই সুখী দাম্পত্যের মাঝে কখন ফাটল ধরেছিল তা একমাত্র তাঁরাই বলতে পারতেন। গুলতেকীন ভাবীকে আর সামনাসামনি না দেখলেও দুইবার টিভিতে দেখেছিলাম। একবার একটি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে হুমায়ুন ভাইকে পাশে রেখেই ভাবীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, উনার তিন কন্যার কোন একজনকে কি কোন লেখকের সাথে বিয়ে দিবেন কিনা! ভাবী সরাসরি না বলে দিয়েছিলেন। ভাবী সেদিন কেন না বলেছিলেন তা আমি বুঝিনি। আমিতো ভাবীকে একজন সফল লেখকের গর্বিতি স্ত্রী হিসেবেই চিনেছিলাম। তবে কেনো উনি না বলেছিলেন!

শেষবার ভাবীকে দেখি হুমায়ুন আহমেদের ৫০তম জন্মবার্ষিকীতে। টিভিতে ভাবীকে দেখে আমি চমকে গেছিলাম। ভাবীর সৌন্দর্য্যের যে একটা নির্মল দিক ছিল, সেদিন যেন উনার চেহারাতে তা দেখিনি। কেমন শুকিয়ে যাওয়া মুখ, ভেতর ক্ষয়ে গেলে যা হয়, তারই বহিঃপ্রকাশ দেখলাম প্রিয় গুলতেকীন ভাবীর চেহারাতে। মনটা খারাপ হয়ে গেছিল আমার।

 একান্তই আমার কথাঃ

এরপরে আমরা চলে আসি আমেরিকাতে। ্পত্র পত্রিকায় হুমায়ুন ভাইকে নিয়ে নানা কথা পড়তাম। একটা সময় হুমায়ুন ভাইয়ের লেখালেখি সম্পর্কে যতটুকু খবর ছাপা হতো, তার চেয়েও অনেক বেশী খবর ছাপা হতো হুমায়ুন আহমেদ আর শাওনকে নিয়ে। শাওনকে আমি সামনাসামনি দেখিনি। শাওন খুবই গুণী এক শিল্পী। নতুন কুঁড়িতে শাওনের নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।  নতুন কুঁড়ি চ্যাম্পিয়ন সে।  তার মত এমন এক গুনী মেয়েকে জড়িয়ে নানা রটনার  কোনটাই  আমার  বিশ্বাস হতোনা। অথচ একদিন সবই বিশ্বাস করতে হলো। সাধারন মানুষ ২০০৫ সালের এক দুপুরে সংবাদ পেল, হুমায়ুন আহমেদ ও গুলতেকীন আহমেদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে এবং হুমায়ুন আহমেদ শাওনকে বিয়ে করেছেন। 


আজকে গুলতেকীন ভাবীর কথা খুব মনে পড়ছে। উনার সেই ব্যক্তিত্ব, সেই নির্মল চেহারার কতটুকু অবশিষ্ট আছে জানিনা। তবে ঈশ্বর গুলতেকীন ভাবী, খালাম্মা, শিখু আপা, নোভা, শীলা, বিপাশাসহ হুমায়ুন আহমেদের সেদিনের সেই প্রিয়জনদের সকল শোক সহ্য করার শক্তি যেনো দেন, সেই প্রার্থণাই করে চলেছি। শাওনের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও এই মেয়েটি উপর আমার এতটুকুও রাগ হয় না। বাবার বয়সী মানুষটিকে সে সত্যিকারের ভালোবেসেছিল এবং তাঁর জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত পরম মমতায় তাঁকে আগলে রেখেছিল। আজ মেয়েটির বড় দূর্দিন।  হুমায়ুন ভাইয়ের জীবিতাবস্থায় কেউ শাওনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে একটাও খারাপ কথা বলেনি,  অথচ   এখন মেয়েটিকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে চাইছে।  কারো মাথায় একবারের জন্যও আসছেনা, এই মেয়েটিও গুলতেকীনের মতই হুমায়ুনের প্রেমে পড়েছিল, আর সেই আবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন হুমায়ুন ভাই স্বয়ং। তাহলে আজ বিচারের কাঠগড়ায় শুধু শাওন কেনো, হুমায়ুন ভাই নয় কেনো?  মেয়েটির এমন বিপদের দিনে তার জন্য আমি মমতা বোধ করছি। তার মঙ্গল হোক।  মানুষের মন সত্যি সত্যিই বিচিত্র। নাহলে  নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বাচ্চা মেয়েটি  এক প্রৌঢ় হার্টের রোগীর জন্য এমন পাগল হতে পারে! ভালোবাসলে এভাবেই বাসতে হয়। গুলতেকীন ভাবীকে সামনাসামনি দেখে ভালোবেসে ফেলেছিলাম, আর শাওনকে না দেখেই ভালোবেসে ফেলেছি। এই দুই রমণীই হুমায়ুন ভাইকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিল। হুমায়ুন ভাই ভাগ্যবান, ভালোবাসার ভেতর দিয়ে যে দাম্পত্য জীবন শুরু করেছিলেন, ভালোবাসার ভেতরে থেকেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটুকু ফেললেন।

5 comments:

  1. Chomotkar ekta lekha.Suru theke purotai porlam ar onek ojana bishoy janlam.Besh valo likhecho mithu.
    Subhashis Bhowmik.

    ReplyDelete
  2. বেশ ভাল লাগলো! একপশলা স্নিগ্ধ মুগ্ধতা রেখে গেলাম!

    ReplyDelete
  3. Wonderful story. I want to say, Shaon is not only responsible
    for the disaster happened in Humayun Ahmed's family. Late Humayun was more responsible. He didn't care about his wife or children! Something unbelievable, but not uncommon.

    Anup Das

    ReplyDelete
  4. Mithu lekhata khub chamatkar hoyechhe no doubt.Kintu onek karonei Shaowaner byapare tor montobber sathe ekmot hote parchhina.Shilar frnd hisebe Gultekin vabi nischoy okeo meyer motoi valobasten.Shaowan sudhu Humayun Ahmed kei valo baslo,matrisoma Gultekin vabir kotha ekbar o vablona!!!!!

    ReplyDelete
  5. Mithu uporer comments ta ei odhomer-Ashok

    ReplyDelete