Thursday, July 19, 2012

হুমায়ুন আহমেদের জন্য যত প্রার্থণা (পুরানো লেখা থেকে সংগৃহীত)

আজ রাতে কাজ থেকে ফিরেই শুনলাম হুমায়ুন আহমেদের অসুস্থতার খবর। খবরটা আমাকে ভীষনভাবে নাড়া দিয়েছে। হুমায়ুন আহমেদকে একসময় হুমায়ুন ভাই বলে ডাকতাম। হুমায়ুন আহমেদকে প্রথম চিনি ‘এইসব দিনরাত্রি’ নামের ধারাবাহিক নাটকের মাধ্যমে। এই ধারাবাহিক নাটকটি টিভি দেখার প্রতি মানুষের আকর্ষণ কয়েকগুন বাড়িয়ে তুলেছিল। আমার দিদিমা ডাক্তার দেখানোর জন্য ইন্ডিয়া যাচ্ছিলেন। তখন সকালে ‘এইসব দিনরাত্রি’র কোন একটা এপিসোড দেখানো হচ্ছিল। দিদিমার খুব ইচ্ছে ছিল এপিসোডটা শেষ করে তারপর রওনা হওয়ার। কিনতু আমার দাদুর তাড়াতাড়িতে দিদিমাকে নাটকটা না দেখেই রওনা হতে হয়েছিল। সেই ছিল আমার দিদিমার শেষযাত্রা। আমার দিদিমা ইন্ডিয়াতেই মারা যান দুই মাসের ভেতর। আমার মা কাঁদতে কাঁদতে একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমার মায়ের শেষ ইচ্ছে ছিল ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটা দেখে যাওয়ার, সেই শেষ ইচ্ছেটাও পূরণ হলোনা’।
আমার বিয়ের আগে পর্যন্ত হুমায়ুন আহমেদকে হুমায়ুন আহমেদ হিসেবেই চিনতাম। বিয়ে যখন ঠিক হলো তখন আমার হবু বর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন যে আমাদের বিয়েতে হুমায়ুন আহমেদ আসবেন। তখনতো মাত্র উনার নাম হতে শুরু করেছে। তাই অত ভয়ানক ব্যস্ত তখনও হয়ে উঠেননি। আমার বর এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমায়ুন আহমেদের সহকর্মী বা বন্ধু ছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন আমার বরের সিনিয়র ভাই। পিএইচডি শেষ করে আমার বর আমেরিকা ভ্রমনে বের হয়ে হুমায়ুন আহমেদের বাড়ীতেও দুই দিন ছিলেন। এতটাই বন্ধুত্ব ছিল তখন। হুমায়ুন আহমেদের দেখাদেখি আমার বরও নাকি একটা গল্প লিখে উনাকে পড়তে দিয়েছিলেন। পড়া শেষ করে হুমায়ুন আহমেদ আমার বরকে বলেছিল আর কাউকে না দেখিয়ে পুরো স্ক্রিপটা বিছানার নীচে ঢুকিয়ে ফেলতে। আমাদের বিয়ের কার্ডটা তৈরী করা হয়েছিল হুমায়ুন আহমেদের সাহায্য নিয়ে। আমার স্বামী নিজেই একজন আর্টিস্ট (শৌখিন), তার বিয়ের কার্ড অন্য রকম হওয়ারই কথা এবং তাই হয়েওছিল। বিয়ের কার্ড এত সুন্দর হতে পারে তা না দেখলে বুঝা যাবেনা। হুমায়ুন ভাই লিখেছিলেন নাকি অন্য কাউকে কোট করেছিলেন তা এখন আর মনে নেই। উনি লিখেছিলেন, 'দুটি প্রান্ত থেকে যে কোন দুজন। বন্ধু নয়, শত্রুও নয় যে কোন দুজন, তেমনি একজন মিঠু আর অন্যজন বিনীত জীবেন।'
আমাদের বিয়ের দিন হুমায়ুন ভাই (বিয়ের পর থেকে ভাই ডাকতে শুরু করেছি) আসতে পারেননি, কোথাও ভাইবা পরীক্ষা নিতে গেছিলেন সেদিন। কিনতু বৌভাতে এসেছিলেন, চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট ‘ম্যাগডোনাল্ডস’ এ। আমার বয়স তখন অনেক কম ছিল বলে সব কিছুতেই বিস্মিত হতাম। লাল শার্ট পড়ে হুমায়ুন ভাই এসেছিলেন, এসেই আমাকে বললেন, ‘ কেমন আছো মিঠু, তোমাকেতো রাজেন্দ্রাণীর মত লাগছে’।আমি একটু হাসি ছাড়া কিছুই করিনি, কারণ আমার বিস্ময়ের সীমা ছিলোনা বলে কথা আসেনি মুখে।
এরপর নতুন অবস্থায় হুমায়ুন ভাইয়ের আজিমপুরের বাড়ীতে গিয়েছিলাম, কি সাধারন মধ্যবিত্তের সংসার। হুমায়ুন ভাইয়ের মা, গুলতেকিন ভাবী, নোভা, শীলা আর একেবারে ছোট ২ বছরের মেয়ে বিপাশা। আমার কোন জড়তা ছিলনা ওদের সাথে কথাবার্তা বলায়। দেখেছি আমাদের মত অতি সাধারণ পরিবারের চিত্র।
দেড় বছর পরে আমাদের মেয়ে মৌটুসী যখন জন্মালো, তৃতীয় দিনে হুমায়ুন ভাই আর গুলতেকিন ভাবী এসেছিলেন ক্লিনিকে, ফুল আর উনার নিজের লেখা তিনটি বই নিয়ে। নন্দিত নরকে, অচিনপুর, সৌরভ বই তিনটির প্রথম পাতায় নিজের হাতে লিখেছিলেন ‘নতুন মা-কে’। গুলতেকিন ভাবী যখন বলেছিলেন যে বাবা-মা দুজনেই সুন্দর তাই মেয়েও সুন্দর হয়েছে, হুমায়ুন ভাই বলেছিলেন যে উনার কাছে পৃথিবীর সকল নবজাতকের চেহারা একরকম মনে হয়। ঐদিন উনি তাদের মেজোমেয়ে শীলার জন্মের কথা গল্প করলেন। আমেরিকাতে মেয়ে জন্মের সাথে সাথে উনি এমন বিকট আওয়াজে আজান দিয়েছিলেন যে লেবার রুমের ডাক্তার নার্স সবাই নাকি হতভম্ব হয়ে গেছিল।
এরপর আবার গিয়েছিলাম উনার শহীদুল্লা হলের বাসায়। কয়েকবার গিয়েছিলাম। একবার উনি ঈদের উপন্যাস লেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন বলে সবাইকে নাকি বলতে বলেছিলেন, কেউ আসলে যেন বলে উনি বাড়ী নেই। কিনতু আমাদের বেলাতে আর তা হয়নি। গুলতেকিন ভাবী আমাদেরকে পছন্দ করতেন (আমার স্বামী একজন সর্বজন প্রিয় মানুষ), তাই আনন্দের সাথে ভেতরে ঢুকিয়ে হুমায়ুন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন। গুলতেকিন ভাবী আমাকে ভেতর নিয়ে গিয়ে যখন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো বাড়ীটা দেখাচ্ছিলেন, তখনই দেখলাম, বারান্দায় একটা জলচৌকি পাতা, তার উপর উনার কাগজ কলম শোভা পাচ্ছে। আরেকদিন উনার সাথে আমরা গল্প করছি, কি একটা জিজ্ঞেস করেছিলাম উনাকে, উনি বললেন যদি কোন কৌতুহল থাকে উনাকে জিজ্ঞেস করতে। আমি জানতে চেয়েছিয়াম সব গল্পে ‘জরী’ নামটা থাকে, এটা কার নাম।উনি বলেছিলেন উনি গুলতেকিন ভাবীর নাম দিয়েছিলেন জরী। আরও অনেক মজার ঘটনা, কত গল্প শুনেছি উনার মুখে। উনার সাথে আড্ডায় বসলে উনি একাই একশ যে কোন আড্ডাকে আনন্দময় করে তুলতে।
এরপর ’৯১ সালের প্রথম দিকে আমার স্বামী আমাকে আর আমার মেয়ে মৌটুসীকে নিয়ে গেছিলেন উনার শহীদুল্লা হলের বাড়ীতে। ‘’অয়োময়’ নাটকের শ্যুটিং দেখাবে বলে। ঐ সময় দুটি ঘটনা ঘটে। হুমায়ুন ভাই ও গুলতেকিন ভাবীর প্রথম ছেলে বাচ্চাটা জন্মের পরেই মারা যায়, আবার ঠিক তখনই ভাবীর দেহে আগমন ঘটে দ্বিতীয় ছেলে নুহাশের। আরেকটা ঘটনা হলো হুমায়ুন ভাই বড়লোক হতে শুরু করেন। পাবলিশার থেকে উনাকে লাল টুকটুকে একটা গাড়ী দেয়া হয়। ঐ গাড়ীতে করেই আমাদের টিভি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয় নাটকের শ্যুটিং দেখানোর জন্য। সুবর্না মোস্তফা, বিপাশা হায়াত, সারা যাকের, আসাদুজ্জামান নূর সহ সবাইকে দেখে এত ভাল লাগছিল! সুবর্না মোস্তফার মনে পড়েনি ১৫/১৬ বছর আগে আমার স্বামী তার গৃহশিক্ষক ছিলেন। অথচ ২০০০ সালে আড়ং এ একবার দেখা হয়েছিল গোলাম মোস্তফার সাথে। গোলাম মোস্তফা কিনতু ঠিক আমার স্বামীর ডাকনাম ধরেই ডাকলেন, নিজের স্ত্রীকে মনে করিয়ে দিলেন যে এই দুলাল উনার মেয়ের শিক্ষক ছিল। আমরা আমেরিকা চলে আসার আগে হুমায়ুন ভাইয়ের সাথে শেষবার দেখা হয়েছিল ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহীদ মিনার অথবা বইমেলা থেকে ফেরার পথে। আমাদের ছোট্ট মিথীলা ছিল তার বাবার কাঁধে, আর দুই মেয়ে মৌটুসী ও মিশা ছিল আমার পাশে। হঠাৎ করেই দেখতে পেলাম হুমায়ুন ভাই আর প্রয়াত অভিনেতা মোজাম্মেল হোসেন কে খুব তাড়াতাড়ি করে ভীড় ঠেলে পার হতে। আমার স্বামী হুমায়ুন ভাই বলে ডাক দিতেই উনি থেমে ছোট মেয়েকে দেখিয়ে শুধু বললেন, ভালই চালিয়ে যাচ্ছ! আমিও কথাটা লুফে নিয়ে বললাম, আপনার পথ অনুসরন করছে! ব্যস! খুব একদফা হাসাহাসি হলো, যে যার পথে চলে গেলাম।
হুমায়ুন ভাইয়ের সাথে এর পরেও আমার বরের দেখা হয়েছিল, কি একটা ডকুমেন্টারী শিক্ষামূলক ফিলম করার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান মনে হয় আমার স্বামীকে ধরেছিল যেন হুমায়ুন ভাইকে দিয়ে স্ক্রিপ্টটা লিখিয়ে দেয়। আমার স্বামী আবার সেবামূলক কাজ খুব আনন্দের সাথে করে দেয়, তাই সাথে সাথে হুমায়ুন ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব করেছিল স্বল্প পারিশ্রমিকে কাজটা করে দিতে। কি জানি কি মনে হয়েছিল হুমায়ুন ভাইয়ের, অনেক পারিশ্রমিক চেয়ে বসেছিলেন। ফলে ওটা আর করা হয়নি, আমার বরের মনেও ভীষন ধাক্কা লেগেছিল। এরপর আর কোনদিন হুমায়ুন ভাইয়ের বাড়ীতে যাওয়া হয়নি।ইগোতে লেগেছে আমার বরের। তারপরেও ২০০০ সালের নভেম্বারের ১৮ তারিখে হুমায়ুন ভাইকে ফোন করে আমার বর বলেছিল, ‘হুমায়ুন ভাই আজ আমাদের বড় মেয়ের জন্মদিন, ওকে একটু আশীর্বাদ করে দিন’। হুমায়ুন ভাই আমার মেয়েটাকে আশীর্বাদ করলেন।
এরপর আমরা আমেরিকা চলে এসেছি ২০০১ সালে, কত নতুন নতুন খবর শুনতাম। মনটা খারাপ হতো, গুলতেকিন ভাবীর কথা মনে পড়তো। তাদের দুইজনের জন্যই আমার কষ্ট হতো, আমি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি আজ পর্যন্ত। তাই যে কোন আলোচনাতে আমি বা আমার স্বামী কোন মন্তব্য করিনা। অন্যের মুখে যখন হুমায়ুন ভাইয়ে নিন্দা শুনি খুব কষ্ট পাই, আবার গুলতেকীন ভাবীর পক্ষে যখন কেউ কিছু বলে সেটাও খুব সত্যি বলে বিশ্বাস করি। মানুষের মন, কখন কোন দিকে বাঁক নেয়, কেউ বলতে পারেনা। আমি গুনী মানুষের গুনটুকুই দেখি, ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে যাইনা। যে যেখানে আছে, যেভাবে আছে, সুখে থাকুক ভালো থাকুক।
আমার মনটা আজ খুব বেশী খারাপ হয়ে গেছে। হুমায়ুন ভাইয়ের এই কঠিন রোগ যেন আমেরিকার ডাক্তারের কাছে পরাস্ত হয়, অনেক আশা নিয়ে হুমায়ুন ভাইকে এদেশে আনা হয়েছে, আশাপূর্ণ করে যেন হুমায়ুন ভাই হাসতে হাসতে দেশের ছেলে দেশে ফিরতে পারেন, মায়ের ছেলে যেন মায়ের কাছে ফিরতে পারেন, ছোট্ট ছোট্ট দুইটা ফুলের মত শিশুর বাবা যেন তাদের কাছে হাত ভর্তি বেলুন নিয়ে ফিরতে পারেন, এই শুভ কামনা করে যাব যতক্ষ্ণণ প্রয়োজন হয় ততক্ষণ।

1 comment: