Thursday, July 19, 2012

আরেকবার হুমায়ুন আহমেদের জন্য প্রার্থণা!

ভয়ানক দুঃসংবাদগুলো রাতের অন্ধকারেই আসে! হুমায়ুন আহমেদের কোলন ক্যান্সারের খবর যখন পেয়েছিলাম, আমি তখন আমেরিকাতে। রাত ৯টায় সবেমাত্র কাজ থেকে ফিরেছি, ঘরে ঢুকেই এমন সংবাদ শুনে মন খারাপ হয়েছিল। খুব বেশী মন খারাপ। তখনও লেখালেখির জগতে একেবারেই ্নতুন। সবেমাত্র ব্লগে লিখতে শুরু করেছি। হুমায়ুন আহমেদের সাথে আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবা্দেই উনার আরোগ্য কামনা করে 'হুমায়ুন আহমেদের জন্য যত প্রার্থনা'  লিখেছিলাম। আমার সেই লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন’ দৈনিকে ছাপাও হয়েছিল। লেখাটি ছিল হুমায়ুন আহমেদের সাথে আমাদের টুকরো টুকরো স্মৃতি থেকে নেয়া। হুমায়ুন আহমেদ অসুস্থ হওয়ার সংবাদে কত জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি উনাকে নিয়ে লিখেছিলেন, সে সমস্ত লেখার ভীড়ে আমার লেখাটি কোথায় হারিয়ে গেছিল।আমিও ভুলেই গেছিলাম লেখাটির কথা। ধরেই নিয়েছিলাম হুমায়ুন আহমেদ আমেরিকার উন্নত চিকিৎসা শেষে পুরোপুরি সুস্থ হয়েই দেশে ফিরে আসবেন। আমার সেদিনের সেই লেখাটি এখানে আবার হুবহু তুলে দিচ্ছি। লেখাটি পোস্ট করার আগে আরেকবার পড়ে দেখলাম। কোথাও কোন অসংগতি পেলামনা। কাঁচা হাতের লেখা, তারপরেও উনার রোগমুক্তির জন্য যে প্রার্থণাটুকু করেছিলাম, সেখানে কোন খাদ ছিলনা।

ব্লগে ও ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকাতে  মুদ্রিত (এডিটেড) লেখাঃ
"আজ রাতে কাজ থেকে ফিরেই শুনলাম হুমায়ুন আহমেদের অসুস্থতার খবর। খবরটা আমাকে ভীষনভাবে নাড়া দিয়েছে। হুমায়ুন আহমেদকে একসময় হুমায়ুন ভাই বলে ডাকতাম। হুমায়ুন আহমেদকে প্রথম চিনি ‘এইসব দিনরাত্রি’ নামের ধারাবাহিক নাটকের মাধ্যমে। এই ধারাবাহিক নাটকটি টিভি দেখার প্রতি মানুষের আকর্ষণ কয়েকগুন বাড়িয়ে তুলেছিল। আমার দিদিমা ডাক্তার দেখানোর জন্য ইন্ডিয়া যাচ্ছিলেন। তখন সকালে ‘এইসব দিনরাত্রি’র কোন একটা এপিসোড দেখানো হচ্ছিল। দিদিমার খুব ইচ্ছে ছিল এপিসোডটা শেষ করে তারপর রওনা হওয়ার। কিনতু আমার দাদুর তাড়াতাড়িতে দিদিমাকে নাটকটা না দেখেই রওনা হতে হয়েছিল। সেই ছিল আমার দিদিমার শেষযাত্রা। আমার দিদিমা ইন্ডিয়াতেই মারা যান দুই মাসের ভেতর। আমার মা কাঁদতে কাঁদতে একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমার মায়ের শেষ ইচ্ছে ছিল ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটা দেখে যাওয়ার, সেই শেষ ইচ্ছেটাও পূরণ হলোনা’।

আমার বিয়ের আগে পর্যন্ত হুমায়ুন আহমেদকে হুমায়ুন আহমেদ হিসেবেই চিনতাম। বিয়ে যখন ঠিক হলো তখন আমার হবু বর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন যে আমাদের বিয়েতে হুমায়ুন আহমেদ আসবেন। তখনতো মাত্র উনার নাম হতে শুরু করেছে। তাই অত ভয়ানক ব্যস্ত তখনও হয়ে উঠেননি। আমার বর এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমায়ুন আহমেদের সহকর্মী বা বন্ধু ছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন আমার বরের সিনিয়র ভাই। পিএইচডি শেষ করে আমার বর আমেরিকা ভ্রমনে বের হয়ে হুমায়ুন আহমেদের বাড়ীতেও দুই দিন ছিলেন। এতটাই বন্ধুত্ব ছিল তখন। হুমায়ুন আহমেদের দেখাদেখি আমার বরও নাকি একটা গল্প লিখে উনাকে পড়তে দিয়েছিলেন। পড়া শেষ করে হুমায়ুন আহমেদ আমার বরকে বলেছিল আর কাউকে না দেখিয়ে পুরো স্ক্রিপটা বিছানার নীচে ঢুকিয়ে ফেলতে। আমাদের বিয়ের কার্ডটা তৈরী করা হয়েছিল হুমায়ুন আহমেদের সাহায্য নিয়ে। আমার স্বামী নিজেই একজন আর্টিস্ট (শৌখিন), তার বিয়ের কার্ড অন্য রকম হওয়ারই কথা এবং তাই হয়েওছিল। বিয়ের কার্ড এত সুন্দর হতে পারে তা না দেখলে বুঝা যাবেনা। হুমায়ুন ভাই লিখেছিলেন নাকি অন্য কাউকে কোট করেছিলেন তা এখন আর মনে নেই। উনি লিখেছিলেন, 'দুটি প্রান্ত থেকে যে কোন দুজন। বন্ধু নয়, শত্রুও নয় যে কোন দুজন, তেমনি একজন মিঠু আর অন্যজন বিনীত জীবেন।'

আমাদের বিয়ের দিন হুমায়ুন ভাই (বিয়ের পর থেকে ভাই ডাকতে শুরু করেছি) আসতে পারেননি, কোথাও ভাইবা পরীক্ষা নিতে গেছিলেন সেদিন। কিনতু বৌভাতে এসেছিলেন, চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট ‘ম্যাগডোনাল্ডস’ এ। আমার বয়স তখন অনেক কম ছিল বলে সব কিছুতেই বিস্মিত হতাম। লাল শার্ট পড়ে হুমায়ুন ভাই এসেছিলেন, এসেই আমাকে বললেন, ‘ কেমন আছো মিঠু, তোমাকেতো রাজেন্দ্রাণীর মত লাগছে’।আমি একটু হাসি ছাড়া কিছুই করিনি, কারণ আমার বিস্ময়ের সীমা ছিলোনা বলে কথা আসেনি মুখে।

এরপর নতুন অবস্থায় হুমায়ুন ভাইয়ের আজিমপুরের বাড়ীতে গিয়েছিলাম, কি সাধারন মধ্যবিত্তের সংসার। হুমায়ুন ভাইয়ের মা, গুলতেকিন ভাবী, নোভা, শীলা আর একেবারে ছোট ২ বছরের মেয়ে বিপাশা। আমার কোন জড়তা ছিলনা ওদের সাথে কথাবার্তা বলায়। দেখেছি আমাদের মত অতি সাধারণ পরিবারের চিত্র।

দেড় বছর পরে আমাদের মেয়ে মৌটুসী যখন জন্মালো, তৃতীয় দিনে হুমায়ুন ভাই আর গুলতেকিন ভাবী এসেছিলেন ক্লিনিকে, ফুল আর উনার নিজের লেখা তিনটি বই নিয়ে। নন্দিত নরকে, অচিনপুর, সৌরভ বই তিনটির প্রথম পাতায় নিজের হাতে লিখেছিলেন ‘নতুন মা-কে’। গুলতেকিন ভাবী যখন বলেছিলেন যে বাবা-মা দুজনেই সুন্দর তাই মেয়েও সুন্দর হয়েছে, হুমায়ুন ভাই বলেছিলেন যে উনার কাছে পৃথিবীর সকল নবজাতকের চেহারা একরকম মনে হয়। ঐদিন উনি তাদের মেজোমেয়ে শীলার জন্মের কথা গল্প করলেন। আমেরিকাতে মেয়ে জন্মের সাথে সাথে উনি এমন বিকট আওয়াজে আজান দিয়েছিলেন যে লেবার রুমের ডাক্তার নার্স সবাই নাকি হতভম্ব হয়ে গেছিল।

এরপর আবার গিয়েছিলাম উনার শহীদুল্লা হলের বাসায়। কয়েকবার গিয়েছিলাম। একবার উনি ঈদের উপন্যাস লেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন বলে সবাইকে নাকি বলতে বলেছিলেন, কেউ আসলে যেন বলে উনি বাড়ী নেই। কিনতু আমাদের বেলাতে আর তা হয়নি। গুলতেকিন ভাবী আমাদেরকে পছন্দ করতেন (আমার স্বামী একজন সর্বজন প্রিয় মানুষ), তাই আনন্দের সাথে ভেতরে ঢুকিয়ে হুমায়ুন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন। গুলতেকিন ভাবী আমাকে ভেতর নিয়ে গিয়ে যখন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো বাড়ীটা দেখাচ্ছিলেন, তখনই দেখলাম, বারান্দায় একটা জলচৌকি পাতা, তার উপর উনার কাগজ কলম শোভা পাচ্ছে। আরেকদিন উনার সাথে আমরা গল্প করছি, কি একটা জিজ্ঞেস করেছিলাম উনাকে, উনি বললেন যদি কোন কৌতুহল থাকে উনাকে জিজ্ঞেস করতে। আমি জানতে চেয়েছিয়াম সব গল্পে ‘জরী’ নামটা থাকে, এটা কার নাম।উনি বলেছিলেন উনি গুলতেকিন ভাবীর নাম দিয়েছিলেন জরী। আরও অনেক মজার ঘটনা, কত গল্প শুনেছি উনার মুখে। উনার সাথে আড্ডায় বসলে উনি একাই একশ যে কোন আড্ডাকে আনন্দময় করে তুলতে।

এরপর ’৯১ সালের প্রথম দিকে আমার স্বামী আমাকে আর আমার মেয়ে মৌটুসীকে নিয়ে গেছিলেন উনার শহীদুল্লা হলের বাড়ীতে। ‘’অয়োময়’ নাটকের শ্যুটিং দেখাবে বলে। ঐ সময় দুটি ঘটনা ঘটে। হুমায়ুন ভাই ও গুলতেকিন ভাবীর প্রথম ছেলে বাচ্চাটা জন্মের পরেই মারা যায়, আবার ঠিক তখনই ভাবীর দেহে আগমন ঘটে দ্বিতীয় ছেলে নুহাশের। আরেকটা ঘটনা হলো হুমায়ুন ভাই বড়লোক হতে শুরু করেন। পাবলিশার থেকে উনাকে লাল টুকটুকে একটা গাড়ী দেয়া হয়। ঐ গাড়ীতে করেই আমাদের টিভি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয় নাটকের শ্যুটিং দেখানোর জন্য। সুবর্না মোস্তফা, বিপাশা হায়াত, সারা যাকের, আসাদুজ্জামান নূর সহ সবাইকে দেখে এত ভাল লাগছিল! সুবর্না মোস্তফার মনে পড়েনি ১৫/১৬ বছর আগে আমার স্বামী তার গৃহশিক্ষক ছিলেন। অথচ ২০০০ সালে আড়ং এ একবার দেখা হয়েছিল গোলাম মোস্তফার সাথে। গোলাম মোস্তফা কিনতু ঠিক আমার স্বামীর ডাকনাম ধরেই ডাকলেন, নিজের স্ত্রীকে মনে করিয়ে দিলেন যে এই দুলাল উনার মেয়ের শিক্ষক ছিল। আমরা আমেরিকা চলে আসার আগে হুমায়ুন ভাইয়ের সাথে শেষবার দেখা হয়েছিল ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহীদ মিনার অথবা বইমেলা থেকে ফেরার পথে। আমাদের ছোট্ট মিথীলা ছিল তার বাবার কাঁধে, আর দুই মেয়ে মৌটুসী ও মিশা ছিল আমার পাশে। হঠাৎ করেই দেখতে পেলাম হুমায়ুন ভাই আর প্রয়াত অভিনেতা মোজাম্মেল হোসেন কে খুব তাড়াতাড়ি করে ভীড় ঠেলে পার হতে। আমার স্বামী হুমায়ুন ভাই বলে ডাক দিতেই উনি থেমে ছোট মেয়েকে দেখিয়ে শুধু বললেন, ভালই চালিয়ে যাচ্ছ! আমিও কথাটা লুফে নিয়ে বললাম, আপনার পথ অনুসরন করছে! ব্যস! খুব একদফা হাসাহাসি হলো, যে যার পথে চলে গেলাম।

হুমায়ুন ভাইয়ের সাথে এর পরেও আমার বরের দেখা হয়েছিল, কি একটা ডকুমেন্টারী শিক্ষামূলক ফিলম করার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান মনে হয় আমার স্বামীকে ধরেছিল যেন হুমায়ুন ভাইকে দিয়ে স্ক্রিপ্টটা লিখিয়ে দেয়। আমার স্বামী আবার সেবামূলক কাজ খুব আনন্দের সাথে করে দেয়, তাই সাথে সাথে হুমায়ুন ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব করেছিল স্বল্প পারিশ্রমিকে কাজটা করে দিতে। কি জানি কি মনে হয়েছিল হুমায়ুন ভাইয়ের, অনেক পারিশ্রমিক চেয়ে বসেছিলেন। ফলে ওটা আর করা হয়নি, আমার বরের মনেও ভীষন ধাক্কা লেগেছিল। এরপর আর কোনদিন হুমায়ুন ভাইয়ের বাড়ীতে যাওয়া হয়নি।ইগোতে লেগেছে আমার বরের। তারপরেও ২০০০ সালের নভেম্বারের ১৮ তারিখে হুমায়ুন ভাইকে ফোন করে আমার বর বলেছিল, ‘হুমায়ুন ভাই আজ আমাদের বড় মেয়ের জন্মদিন, ওকে একটু আশীর্বাদ করে দিন’। হুমায়ুন ভাই আমার মেয়েটাকে আশীর্বাদ করলেন।

এরপর আমরা আমেরিকা চলে এসেছি ২০০১ সালে, কত নতুন নতুন খবর শুনতাম। মনটা খারাপ হতো, গুলতেকিন ভাবীর কথা মনে পড়তো। তাদের দুইজনের জন্যই আমার কষ্ট হতো, আমি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি আজ পর্যন্ত। তাই যে কোন আলোচনাতে আমি বা আমার স্বামী কোন মন্তব্য করিনা। অন্যের মুখে যখন হুমায়ুন ভাইয়ে নিন্দা শুনি খুব কষ্ট পাই, আবার গুলতেকীন ভাবীর পক্ষে যখন কেউ কিছু বলে সেটাও খুব সত্যি বলে বিশ্বাস করি। মানুষের মন, কখন কোন দিকে বাঁক নেয়, কেউ বলতে পারেনা। আমি গুনী মানুষের গুনটুকুই দেখি, ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে যাইনা। যে যেখানে আছে, যেভাবে আছে, সুখে থাকুক ভালো থাকুক।

আমার মনটা আজ খুব বেশী খারাপ হয়ে গেছে। হুমায়ুন ভাইয়ের এই কঠিন রোগ যেন আমেরিকার ডাক্তারের কাছে পরাস্ত হয়, অনেক আশা নিয়ে হুমায়ুন ভাইকে এদেশে আনা হয়েছে, আশাপূর্ণ করে যেন হুমায়ুন ভাই হাসতে হাসতে দেশের ছেলে দেশে ফিরতে পারেন, মায়ের ছেলে যেন মায়ের কাছে ফিরতে পারেন, ছোট্ট ছোট্ট দুইটা ফুলের মত শিশুর বাবা যেন তাদের কাছে হাত ভর্তি বেলুন নিয়ে ফিরতে পারেন, এই শুভ কামনা করে যাব যতক্ষ্ণণ প্রয়োজন হয় ততক্ষণ"।


আমরা দেশে এসে দুইমাস থেকে এখন আমেরিকা ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি দেশে যতদিন থেকেছি, সংবাদপত্র, টিভি থেকে শতহাত দূরে থেকেছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন সংবাদ এর ওর মুখ থেকে শুনে নিয়েছি। হুমায়ুন ভাইয়ের আমেরিকা ফিরে যাওয়া, সেখানে দুইবার সফল অস্ত্রোপচার হওয়ার কথাও শুনেছি। আজকেই হঠাৎ করে আমার স্বামী ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এর একখানা কপি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “ হুমায়ুন ভাইয়ের অবস্থা খুবই খারাপ”। আমি খবরের হেডলাইনটুকু দেখে কাগজটি সরিয়ে রেখেছি। পড়তে চাইনি, কারন আমার মনে হয়েছে এগুলো সবই অতিরঞ্জিত খবর। হুমায়ুন আহমেদের খারাপ কিছু হতে পারেনা, উনি ক্যান্সারের রুগী, গায়ে জ্বর এলেও পত্রিকাওয়ালারা এটা নিয়ে হৈ চৈ শুরু করে দেয়। এবারও নিশ্চয়ই তাই হয়েছে। দাদার বাসা থেকে বেরিয়ে রাত সাড়ে এগারোটায় ঘরে ফিরেছি। আমেরিকাতে ফিরে যাব আর দুই দিন পরেই। মন খারাপ করে একটু চোখ বন্ধ করে শুয়েছি, মেজ মেয়ে জোরে জোরে ডাকছিল আর সমানে বলে চলছিল, “ মা, হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছেন”। হঠাৎ করেই আমার হার্ট বিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এ এক অসহ্য অনুভূতি!

আমার মেজো মেয়ে গল্পের বই পড়েনা। বাংলা গল্পের বই পড়ার প্রশ্নই উঠেনা। তবু ওর ২১ বছরের জীবনে একমাত্র বাংলা বই সে পড়েছে, হুমায়ুন আহমেদের ‘কুটু মিয়া’। আমার এই মেয়ে আমার মতই ইমোশনাল। হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুতে সে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। আমেরিকার মাটিতে বড় হওয়া মিশা এক মুহূর্তে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে যার সারমর্ম, ‘ আমি গল্পের বই পড়িনা। একটামাত্র বাংলা গল্পের বই পড়েছি হুমায়ুন আহমেদের ‘কুটুমিয়া’। কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, আমার বাবা আমাকে ডাকেন ‘কুটু’ আর আমার ছোটবোন আমাকে ডাকে ‘মিয়া’।  হুমায়ুন আহমেদ এভাবেই আমার নামের মধ্যে বেঁচে থাকবেন’।
আমরা দেশে এসেছি মে মাসের শেষে। হুমায়ুন আহমেদ বোধ হয় মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এসেছিলেন। আমেরিকাতে থেকেই হুমায়ুন আহমেদের দেশে ফেরার সংবাদে অত্যন্ত খুশী হয়েছিলাম। আমার স্বামী আমেরিকার অনেক গুনগান করেন, আমি সব সময় উলটো গীত গাই। কিনতু এবার আমি স্বামীর সাথে একসুরে বলেছিলাম, আমেরিকার চিকিৎসা ব্যবস্থা আসলেই অদ্ভূত রকমের ভালো। হুমায়ুন ভাই পর্যন্ত সুস্থ দেহে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। যাই হোক আমেরিকাতে থাকতেই পত্রিকান্তরেই জেনেছিলাম যে উনারা জুনের ১২ তারিখে আমেরিকা ফিরে আসবেন। আমার বড় মেয়ের জন্মের তৃতীয় দিনে উনি গুলতেকীন ভাবীকে নিয়ে ক্লিনিকে গেছিলেন, এরপরেও কতবার বড় মেয়েকে নিয়ে উনার শহীদুল্লাহ হলের কোয়ার্টারে বেড়াতে গেছি। আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলো জুনের প্রথম সপ্তাহে। আমার একটু ইচ্ছে হচ্ছিল মেয়েকে নিয়ে ‘নুহাশ পল্লী’তে যাই। বিয়ের আগে মেয়েটা এমন একজন জ্ঞানী-গুনী মানুষের আশীর্বাদ পেলে আমার ভালো লাগতো।। কিনতু চিকিৎসকের নিষেধ ছিল রোগী যেন বেশী মানুষের কাছাকাছি না যায়। আমেরিকার চিকিৎসকের এই সাবধানবাণী মাথায় রেখে মনের ইচ্ছে মনেই রেখে দিয়েছিলাম। যাওয়া হয়নি। আমার স্বামী খুব শান্ত, ধীর স্থির মানুষ। বন্ধুর অসুস্থতার খবরে কষ্ট পেয়েছিলেন, অভিমান ভুলে বন্ধুর ভাল যে কোন সংবাদের জন্য উৎসুক হয়ে থাকতেন। আর আজকে মেয়ের মুখে বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ শুনে একেবারেই চুপ হয়ে গেছেন। টিভি অন করে আরেকটিবার বন্ধুর মৃত্যুসংবাদ শুনে নিশ্চিত হলেন, মেয়ে ভুল বলেনি। টিভি অফ করে ঘরের বাতিটি নিভিয়ে দিয়ে শান্ত মানুষটি আরও বেশী শান্ত হয়ে গেলেন।


আর আমি? আবার হুমায়ুন আহমেদের জন্য প্রার্থণায় বসে গেলাম। এমন একজন কিংবদন্তী লেখককে নিয়ে দু’চারটি কথা লিখতে পারছি এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কিছু নেই। উনার আত্মার শান্তি কামনা করি। ছোট্ট নিষাদ ও ছোট্ট নিনিতের মধ্যেই যেনো পরমপ্রিয়কে খুঁজে পায় মেহের আফরোজ শাওন।

No comments:

Post a Comment