জানুয়ারী মাসেই আমি জানতে পেরেছিলাম, প্রিয় ব্লগ এবং জলছবিবাতায়ণ ব্লগ থেকে পুরস্কার পাচ্ছি। জলছবিবাতায়ণ ব্লগের সঞ্চালক কবি আকম নাসিরউদ্দিন আহমেদ ( কবিদাদা) আমাকে জানিয়েছিলেন, ১লা ফেব্রুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে সকলকে পুরষ্কার দেয়া হবে। তিন চার দিন আগে কবিদাদা ফেসবুকে পুরষ্কার প্রদানের ভ্যেনু (চারুকলা ইন্সটিটিউটের কাছে) , সময় ( বিকেল ৩টা) সব কিছুই জানিয়েছিলেন, সাথে এটাও বলেছিলেন, আমার তরফ থেকে যে কেউ গিয়ে পুরষ্কার গ্রহণ করলে উনারা খুশী হবেন। জানি, আমার তরফ থেকে কেউই যেতে পারবে না, তবুও বলেছি উনাকে,
" কবিদাদা, আমার কাজিন মিত্রা ঢাকাতে আসবে, ও থাকলে আর কোন সমস্যা নেই, ও যাবে পুরস্কার আনতে। তোমার ফোন নাম্বারটা দাও, ওকে দেবো, ও তোমার সাথে যোগাযোগ করবে।"
দাদার সাথে কথা শেষ হতেই ঢাকা মামার বাসায় ফোন করলাম। ফোন ধরেছে ভাই অপু। বললাম, " ভাইরে, তোরা তো সব ভদ্র মানুষ, ফেসবুক টেসবুক করস না। তাই ফুলদিভাইয়ের খবরও রাখস না। ভাইরে আমি তো কেমনে কেমনে জানি দুইটা পুরস্কার পেয়ে গেছি"।
ভাই বলে, " অ্যাঁ, কী বলো, তাই নাকি? চাইনিজ খাওয়াবে না?"
-আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, পুরষ্কার পেয়েছি, সেজন্য কোন কনগ্র্যাচুলেশান্স পেলাম না, তার আগেই চাইনীজ খাওয়ার দাবী তুলে ফেললি?
-সরি, ফুলদিভাই, তুমি তো অলরেডি অনেক দামী লেখিকা হয়ে গেছো, আমাদের কাছে তোমার পুরষ্কার পাওয়া নতুন কিছু ব্যাপার না। কনগ্র্যাচুলেশানস!
-তোর কনগ্র্যাচুলেশান্সের ক্ষ্যাতা পুড়ি, তুই কী আমার পুরষ্কারটা গ্রহণ করতে পারবি? আগামী শুক্রবার!
-ইয়ে মানে! আমি তো আবার এমবিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছি, ক্লাস থাকে শুক্রবার। আচ্ছা দেখি, চেষ্টা করবো।
-আচ্ছা শোন, এই যে ফোন নাম্বার দেই একজনের, উনি ব্লগের সঞ্চালক, উনার সাথে কথা বলে সব ঠিক করে নিস। যাওয়ার সমস্যা থাকলে উনাকে জানাবি।
-না না, সমস্যা কিসের? দেখি, যাওয়া যাবে। অনুষ্ঠান কখন?
-বেলা তিনটায়।
-আমার ক্লাস শেষ হবে দুপুর একটায়, তারপরে বাড়ী ফিরে যেতে যেতে~~~~~~~
-ভাই রে! এত চিন্তা করিস না। ক্লাস থেকে বাসায় ফেরার দরকার নেই, কোন একটা রেস্টুরেন্টে খাবি, বিল আমি দেবো। ওখান থেকেই চলে যাবি। আরেকটা কথা, আমার খুব লজ্জা লাগছে তোদেরকে ব্যতিব্যস্ত করতে। কিন্তু পুরষ্কার বলে কথা! কষ্টের অর্জন এটা! তারপরেও বলি, জীবনের রিস্ক নিয়ে যাইস না।
-কী যে বলো, জীবনের রিস্ক আবার কি? তবে, টাকা পাওয়া গেলে ভালো হইতো। আমরা চাইনীজ খেতে পারতাম।
-না, দেশে তো এখন যখন তখন ঝামেলা লাগে, কার ঝাল কার উপর এসে পড়বে, সেই ভয় পাই। তোর বৌ-বাচ্চা আছে বাসায়, দিদির পুরষ্কার আনতে গিয়ে বিপদে পড়লে আমার খারাপ লাগবে। আর শোন, জলছবিবাতায়ণে ক্রেস্ট দিবে, সেটা আগেই জানিয়ে দিয়েছে। প্রিয় ব্লগে পাবো প্রাইজবন্ড। আর শোন, এত খারাপ হয়ে গেলি কী করে? খালি খাই খাই করছিস কেন? টাকাটাই তো বড় কথা না, তোর দিদি লিখে পুরষ্কৃত হয়েছে, সেটাই বড়।
-না, না, ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই, নিশ্চিন্ত থাকো।
-মিত্রাকে না হয় বলে দ্যাখ, বেলা তিনটার সময় কী আর সমস্যা হবে, ও গিয়ে নাহয় আমার প্রতিনিধিত্ব করুক! আমি আমার সেই দাদাকে মিত্রার নাম বলে রেখেছি।
আমার কথা শেষ না হতেই শোনা গেলো মিত্রা বলছে, " না না, আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি শুক্রবার মেসোর সাথে দেখা করতে যাব।" অপুকে বললাম, " অপু, তুই তো আবার লাজুক টাইপের ছেলে, তুই না পারলে মিত্রাকেই না হয় বল আমার ঐ দাদার সাথে কথা বলে নিতে। মনে হচ্ছে, তোদের কারোই যাওয়া সম্ভব হবে না। তার চেয়ে উনার কাছেই পুরষ্কার রেখে দিতে বলিস।
-ফুলদিভাই, তুমি যে কেনো এত তাড়াতাড়ি আপসেট হয়ে যাও! মিত্রার বর আসবে, তুমি তো জানো না, মিত্রার বর আসলে মিত্রা পুরা চেঞ্জ হয়ে যায়, আর কারো কথা মাথায় থাকে না।
মিত্রার গলা শোনা গেলো, " এটা কেমন কথা বলছো অপুদা, তুমি কী কম বউপাগলা? তোমারই তো বোন আমি, আর যার সাথে কথা বলছো, উনি কী কম বর পাগলা? এখনও এই বুড়া বয়সে 'আমার উত্তম' আমার উত্তম করতে থাকে। আর আমার বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন মাস আগে। আমি তো বর পাগল হতেই পারি।
ফোনে বিল তুলে এদের সাথে প্যাঁচাল পারার কোন অর্থই হয় না। মিত্রা বেশী বদলে গেছে, কত বড় সাহস, আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে! কথার মাঝখানেই ফোন রেখে দিয়েছি। ওরা অবশ্য জানে, আমার এই পাগলা চরিত্রের কথা।
গত পরশুদিন আমি বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে ঢোকা আমার নিয়মিত অভ্যাস। সেই সকালেও ফেসবুক অন করেছি, দেখি মেসেজ নোটিফিকেশান দেখাচ্ছে। মেসেজ বক্স খুলে দেখি সুশান্ত দাসগুপ্ত মেসেজ রেখেছে। সুশান্ত'র সাথে আমার পরিচয় ছিল না। তবে ব্লগে ঢুকলেই আমি ওদের কয়েকজনের নাম প্রায়ই দেখতে পাই। নিঝুম মজুমদার, অমি রহমান পিয়াল, সুশান্ত দাশগুপ্ত সর্বজনপরিচিত ব্লগার, এবং অমি রহমান পিয়ালকে তো ব্লগরাজ্যের অধীশ্বর বলা হয়। নিঝুম মজুমদারের লেখা প্রথম পড়েছি বিডিনিউজ২৪ ব্লগে, অন্য কেউ ট্যাগ করেছিল। '১২ সালের শেষ দিকে আমি 'আমার ব্লগে' জয়েন করি। দুই মাসেই তের চৌদ্দটি লেখা পোস্ট করেছি। শুরুর দিকে যুদ্ধাপরাধী সাঈদী'র ওয়াজ মাহফিল বন্ধ করে দিয়েছিল লন্ডনের কিছু বাংলাদেশী তরুণ। তারা মোম জ্বেলেছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেছিল। সাঈদী'র সমাবেশ বা মাহফিল বন্ধ করে দেয়া খুব সহজ কাজ নয়। সেই 'অসহজ' কাজটি যারা করেছিল, সুশান্ত দাশগুপ্ত তাদের একজন। বয়সে তরুণ ছেলেটি 'আমার ব্লগে' খুব ভালো ফীচার লিখে। ওর সম্পর্কে অতটুকুই জানি।
আমাকে মেসেজে সুশান্ত 'ব্লগ দিবস উদযাপণ' এর একটি লিঙ্ক দিয়ে বলেছে, অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলে খুব খুশী হবে সবাই। কেউ মেসেজ পাঠালে আমি সব সময় উত্তর দেই। সুশান্তকে উত্তরে জানিয়েছি, ওর মত এমন মেধাবী তরুণ আমার সাথে যোগাযোগ করেছে বলে খুব খুশী হয়েছি, নিজেকে সম্মানিত বোধ করেছি। আরও বলেছি, আমেরিকা থাকি বলে ঐ অনুষ্ঠানে যেতে পারবো না। ও বোধ হয় অনলাইনেই ছিল। আমাকে অবাক করে দিয়ে ও জানালো, সে নিজেও আমেরিকাতেই আছে এবং মিসিসিপিতেই আছে। পরের দিন সকালে ওর বস্টন যাওয়ার ফ্লাইট। মিসিসিপি শুনে তো আমি মহা খুশী। ছোটভাই বলে ডাক দিলাম। সে আমাকে দিদি বলে মেনে নিয়েছে। দুই সেকেন্ড পরে আবার জানিয়েছে, ধানমন্ডির বিলিয়া ভবনে আমারব্লগের অনুষ্ঠান হবে, কোন ভয়েস মেসেজ অথবা ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে চাইলে পাঠাতে পারি। আমি একটু অবাক হচ্ছিলাম, ছেলেটা আমাকে কেনো ভয়েস মেসেজ, ভিডিও মেসেজ পাঠানোর কথা বলছে? ও আবার লিখলো, " দিদি, প্লীজ, যে কাউকে পাঠান অনুষ্ঠানে, সিলেকশান কমিটি থেকে নির্বাচন করা হয়েছে।
জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী নির্বাচনের কথা বলছো, আমি বুঝতে পারছি না।
-দিদি, আপনি কী জানেন না যে আপনি সেরা উদীয়মান ব্লগারের পুরস্কার পাচ্ছেন?
-তাই নাকি? কী বলছো? আমি তো কিছুই জানিনা।
-প্লীজ, দিদি, কাউকে না কাউকে পাঠান। নিজ হাতে কেউ গিয়ে পুরষ্কার নিয়ে আসুক। আপনার কোন ভাই নেই ওখানে?
-ভাই আছে, কিন্তু দুই ভাই দূরে থাকে, যে ভাই ঢাকাতে থাকে, সে খুব ব্যস্ত, তারপরেও চেষ্টা করবে তিনটার সময় আরেক জায়গা থেকে পুরষ্কার আনতে। কাজেই আর কেউ নেই। দাঁড়াও, আমার আরেক ভাগ্নী আছে, ওকে বলে দেখি।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই দেখুন, প্লীজ! আপনি তো বেশ ভাল লিখেন, লেখা চালিয়ে যান, থামাবেন না। এমন ভালো একটা পুরষ্কার পেলেন, আনতে না গেলে চলে!
যে মুহূর্তে ভাবছিলাম ভাগ্নী অদিতিকে ফোন করবো, দেখি সে অনলাইনে হাজির। সাথে সাথে নক করলাম, জানালাম সব কথা। সে বললো,
কনগ্র্যাচুলেশান্স মামী। এই বছর তিন ব্লগ থেকে পুরষ্কার পেয়েছো, আর কিছুদিন পরে আমরা কয়েকজন মিলে ব্লগ খুলছি, তুমি তো হবে আমাদের বাঁধা ব্লগার, সামনের বছর আমাদের কাছ থেকে পুরষ্কার পাবে।
-মা রে! সামনের বছর আমি 'বাংলা একাডেমী' পুরস্কার পাব। কিন্তু লাভ কি? এবছরের পুরস্কার আনতে যাওয়ার মানুষ নেই, আর সামনের বছর!
-মামী, জামাতের হরতাল ছিল, তাই আমার অফিস হয় নি, কাল শুক্রবারে আমার অফিস চলবে। আমার কী দোষ বলো!
-ওকে, তাহলে রাখি। দেখি আবার অপুকে ফোন করি।
অপুকে ফোন করে পেয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আমার দেয়া নাম্বারে ফোন করেছিল কিনা। বলে, " না, এখনও করি নাই, তবে সমস্যা নাই, উনাকে ফোন করে কনফার্ম হয়ে নেবো"।
-মিত্রাও ফোন করে নাই?
- হাহাহা! ওর বর আসছে, ওর চেহারা আর দেখা যাবে না।
-ভালো, আমারই ভুল হয়েছে, তোদের কাছে বার বার ফোন করে আমার মন মেজাজ বিগড়ায়ে গেছে। বাদ দে, আমার পুরস্কার আমি সামনের বছর দেশে গিয়ে নিয়ে আসবো।
-ফুলদিভাই, আমি যাব, চিন্তা করো না।
-কিন্তু সমস্যা হয়েছে, আমি তো আরেক জায়গা থেকেও পুরস্কার পেয়েছি। সেটা হবে ধানমন্ডিতে।
-বাবারে! এত পুরস্কার পাইলে কীভাবে চলবে?
শোন, ৩টার সময় চারুকলার সামনে থেকে পুরস্কার নিয়েই সোজা ধানমন্ডি চলে যাবি। সুশান্ত ওর বন্ধুর সাথে কথা বলে রাখবে, তুই ওখানে যাওয়ার সাথে সাথেই তোর কাছে পুরস্কার দিয়ে দিবে।
-আচ্ছা, দেখি কী করা যায়। চিন্তা কইরো না। শুক্রবার তো, খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না।
-কিন্তু ১লা ফেব্রুয়ারী তো, বই মেলা উদ্বোধণ হবে তো! ভীড় থাকবে, তার মধ্যে জামাত-শিবিরের অতর্কিত হামলার ভয় তো থাকেই। একটাই ভয় লাগে, ক্রেস্ট আনতে গিয়ে না আবার কোন বিপদে পড়স!
আমার সাথে সুশান্ত'র কথা হয়েছে আমেরিকার বৃহস্পতিবারের সকালে, দেশে তখন রাত। আমেরিকার ভোর চারটা আর সকাল সাতটায় ছিল প্রোগ্রাম। বুদ্ধি করে সুশান্ত'র কাছ থেকে আয়োজকদের একজন 'ইফতি'র ফোন নাম্বার চেয়ে রেখেছিলাম। মনে পড়ে গেলো আমার 'মুশকিল আসান' ছোট মাসীর কথা! মাসী যদি ঢাকায় থাকতো, আর কারো কাছে এভাবে ধর্না দেয়া লাগতো না। সমস্যা হচ্ছে, মাসী থাকে সুনামগঞ্জে, হাওর-বাওড়ের দেশে। অতদূর থেকে তো আর মাসী আসবে না। মাসীকে ফোন করে পুরা ঘটনা বললাম, এও বললাম, ঢাকা ফোন করে 'ইফতি'র সাথে কথা বলতে। সব গুছিয়ে বলার পর অপুকে যেনো ফোন করে। মাসীর ছেলে অনিন্দ্য পড়ে নটরডেম কলেজে। বলেছি, ওর কোচিং ক্লাস শেষ হলে সরাসরি ধানমন্ডি বিলিয়া ভবনে চলে যেতে। মাসীকে বলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছি। মাসী যখন শুনেছে, আর কোন চিন্তা নেই।
পরের দিন, অর্থাৎ আমেরিকার শুক্রবার সকাল ৯টা মানেই দেশের শুক্রবার রাত ৯টা। হিসেব মিলিয়ে দেখি, আমার পুরস্কার মহাখালি মামার বাসায় চলে এসেছে। অপুকে একটা ফোন করতেই হয়, ধন্যবাদ জানাতে হবে। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, ক্রেস্ট আমার পাওয়া হচ্ছে না। আহারে! যতই বলি, লেখালেখি করাটাই বড় কথা, পুরস্কার পাওয়াটা বড় কথা নয়। তারপরেও আমি সাধারণ মানুষ, পুরস্কার পেতে ইচ্ছে করে। সেই আমি পুরস্কার পেয়েও যদি লোকবলের অভাবে পুরস্কার হাতছাড়া হয়ে যেতে দেই, সেটা নিশ্চয়ই আমার জন্য সুখকর হওয়ার কথা নয়। দিলাম অপুর নাম্বারে কল। রিং বেজে যাচ্ছে, রিং বেজে যাচ্ছে, কেউ ফোন ধরে না।
দিলাম মাসীকে ফোন। " মাসী, অপুকে ফোন দিলাম, রিং হয়, ফোন ধরে না। অপু কী নিয়ে এসেছে পুরস্কার?
-অপু ফোন ধরবে কী করে? রাত ৯টার সময় অপু বাসে। শাহবাগ থেকে আসতে হয়েছে।
-শাহবাগ কেনো? একটা অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল তো চারুকলার সামনে~~
-আজ্ঞে না, যা ঝড় গেলো ওর উপর দিয়ে!
-কেনো, কী হয়েছে?
-আরে! ও তো ক্লাস থেকে বের হয়ে হোটেলে বোধ হয় কিছু খেয়ে নিয়েই চারুকলার সামনে চলে গেছে। বেলা ৩টার সময় ওখানে কেউ ছিল না, কিছুই ছিল না। ও তখন তোর দেয়া নাম্বারে ফোন করে জেনেছে, ভ্যেনু পরিবর্তণ করে শাহবাগে্র মোড়ে নেয়া হয়েছে। শাহবাগের মোড়ে গিয়ে দেখে তখনও তেমন কেউ আসেনি। এদিকে বিকেল চারটা বেজে গেছে, যে কয়েকজন এসেছিল, তাদের কাছে তোর কথা বলেছে। কিন্তু তারাই বা কী করবে, একটা প্রোগ্রামের তো নিয়ম থাকে। ফলে অপুকে অপেক্ষা করতেই হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বই মেলা উদ্বোধণ উপলক্ষ্যে রাস্তা ঘাট জ্যাম লেগে গেছে। কোন কোন রাস্তা ব্লক করে দিয়েছে।
-হায় হায়! কী বলছো এইসব!
-শোন না, অপুর সাথে কথা বলেই টের পেয়ে গেছি, ও আজ আর ধানমন্ডি এসে পৌঁছাতে পারবে না। সাথে সাথে আমি অনিন্দ্যকে ফোন করে বলেছি, " বাবা শোন, তুই তোর বন্ধুকে নিয়ে আরামবাগ থেকে বাসে উঠে ধানমন্ডি চলে আয়। তুই যাবি বিলিয়া ভবনে, ফুলদিভাইয়ের পুরস্কার নিয়ে আসতে। আরেকটা কথা, তুই ভালো কোন রেস্টুরেন্টে খেয়ে নে, ফুলদিভাই বলেছে, তোকে খাওয়ার টাকা দিয়ে দিবে।
-হা হা হা! হ্যাঁ আমি তো আগেই বলে দিছিলাম, রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পয়সা আমি দিয়ে দেবো। তা অনিন্দ্য কি আনতে পেরেছে ক্রেস্ট?
-ঘটনা শোন, আরামবাগে যখন বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ানো ছিল, পুলিশে ধরছে। আইডি দেখতে চেয়েছে। শিবিরের হামলায় সবাই এখন ভীত হয়ে আছে। কখন কোন জায়গায় বিশৃংখলা দেখা দেয়, তার কোন ঠিক নেই। ভাগ্য ভালো যে ওর কাছে নটরডেম কলেজের আইডি ছিল। আইডি দেখার পর পুলিশ ওদের ছেড়ে দিয়েছে। অনিন্দ্য পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছিল, কিছু ঘটেছে কিনা। পুলিশ নাকি বলেছে, হ হ, বাড়িত চলে যাও, এইখানে সমস্যা হবে। পুলিশের কথা শুনে অনিন্দ্যর বন্ধু ঐখান থেকেই চলে গেছে। আর অনিন্দ্য রাস্তা বদলে অন্য রাস্তায় গিয়ে বাস ধরে ধানমন্ডি সাত নাম্বার রোডে চলে আসে। তারপরে ও বিল্ডিং বের করে ফেলে।
-এরপর?
-আরে, আমি তো ইফতি নামের ছেলেটির সাথে কথা বলেছিলাম, ও বলেছিল, কোন সমস্যা হবে না। সমস্যা হচ্ছিলও না। এমনিতেই চারটার বদলে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। আগেই তো শুনেছি, প্রধানমন্ত্রীর বইমেলায় আগমন উপলক্ষ্যে চারদিকে নিশ্ছিদ্র পাহারা ছিল, তাই চারদিকে জ্যাম লেগে গেছে। সময়ের অনুষ্ঠান সময়ে শুরু করতে পারে নাই। করবে কী করে, সবাইকেতো এসে পৌঁছাতে হবে! আমার তো কলিজা শুকায়ে গেছে। কত রাত হয়ে যাবে কে জানে। অনিন্দ্যকে বলেছি, ইফতির সাথে দেখা করে চলে আসতে। পুরস্কার অন্য সময় নেয়া যাবে। কিন্তু আমার এই ছেলে হচ্ছে নাছোড়বান্দা টাইপ। শয়তান ছেলে বসেই ছিল। ওরা নাকি ওকে খুব সমাদর করেছে। কাচ্চি বিরিয়ানীর প্যাকেট আর ক্রেস্ট দিয়ে ওকে রওনা করিয়ে দিয়েছে।
-মাসী, আমার খুবই খারাপ লাগছে শুনে। এইজন্যই আমি প্রথমে চাই নি কাউকে পাঠাতে। তার পরেও কী জানো, পুরস্কারটা হচ্ছে এক ধরণের রিকগনিশান, এক ধরণের স্বীকৃতি! আমি নিজে নিজে সেটা অর্জন করেছি। তুমি ধারণাও করতে পারবে না, মিসিসিপির এই নির্বান্ধব পরিবেশে থেকে কত পরিশ্রম করে চলেছি। পুরস্কার দুটো না আনলেও চলতো, তবে ওরা নিয়ে আসাতে আমার বুকটা ভরে গেছে।
-শোন, এরপর থেকে যে কোন ব্যাপারে আগে আমাকে ফোন করিস। বাকী ব্যবস্থা আমি করবো। চিন্তা নাই।
লজ্জা আর ভয়ের চোটে আমি দ্বিতীয়বার আর ফোন করি নাই অপু বা অনিন্দ্যকে। মিত্রাকে তো ফোন করার প্রশ্নই আসে না। স্বামী সোহাগী এখন আমাকে আর চিনতে পারলে তো কথা বলতাম!
একটু আগেই দেখি আমার ওয়ালে দুইটি ক্রেস্টের ছবি শোভা পাচ্ছে। মিত্রা আমাকে পাঠিয়েছে! তার মানে ওরা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে! ছবি পোস্ট করে তার নীচে আবার শুভেচ্ছাবাণীও দিয়েছেঃ
"ফুলদিভাই আমরা সবাই খুব খুশি এবং proud feel করছি ......এই প্রার্থনাই করি জীবনে লেখক হিসাবে আরও প্রতিষ্ঠা পাও আর সামনের বইমেলায় আমরা যেন তোমার বই দেখতে পাই বাংলা একাডেমীর কোন এক স্টলে......... তোমাকে অনেক অনেক অভিনন্দন........."
বড়দা জানিয়েছেঃ
" Amra tomar safolye gorbo bodh kori ebong awards amader swargiya maa-ke utsorgo koray tomake onek donyobad janai. Aro ashirwad kori tumi deerghojeebi hao ebong aro safolyo orjon koro."
আমার ওয়ালে আমার নতুন ভাই কবিদাদাও শুভেচ্ছা জানিয়েছে,
" দিদি তোমাকে অভিনন্দন। জলছবি বাতায়নের অনুষ্ঠানে তোমাকে মিস করেছি। অপূর্ব তোমার ক্রেস্ট নিয়েছে। আমার কবিতার বই জনারণ্যে একাকী আছে ওর কাছে তোমার জন্য। কিন্তু একটু ভুল হয়ে গেছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে লেখক হিসাবে তোমার একটি সৌজন্য সংখ্যা অপূর্বকে দেয়া হয়নি। অপূর্বকে বলো জহিরুলের কাছ থেকে সংগ্রহ করার জন্য।
" কবিদাদা, আমার কাজিন মিত্রা ঢাকাতে আসবে, ও থাকলে আর কোন সমস্যা নেই, ও যাবে পুরস্কার আনতে। তোমার ফোন নাম্বারটা দাও, ওকে দেবো, ও তোমার সাথে যোগাযোগ করবে।"
দাদার সাথে কথা শেষ হতেই ঢাকা মামার বাসায় ফোন করলাম। ফোন ধরেছে ভাই অপু। বললাম, " ভাইরে, তোরা তো সব ভদ্র মানুষ, ফেসবুক টেসবুক করস না। তাই ফুলদিভাইয়ের খবরও রাখস না। ভাইরে আমি তো কেমনে কেমনে জানি দুইটা পুরস্কার পেয়ে গেছি"।
ভাই বলে, " অ্যাঁ, কী বলো, তাই নাকি? চাইনিজ খাওয়াবে না?"
-আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, পুরষ্কার পেয়েছি, সেজন্য কোন কনগ্র্যাচুলেশান্স পেলাম না, তার আগেই চাইনীজ খাওয়ার দাবী তুলে ফেললি?
-সরি, ফুলদিভাই, তুমি তো অলরেডি অনেক দামী লেখিকা হয়ে গেছো, আমাদের কাছে তোমার পুরষ্কার পাওয়া নতুন কিছু ব্যাপার না। কনগ্র্যাচুলেশানস!
-তোর কনগ্র্যাচুলেশান্সের ক্ষ্যাতা পুড়ি, তুই কী আমার পুরষ্কারটা গ্রহণ করতে পারবি? আগামী শুক্রবার!
-ইয়ে মানে! আমি তো আবার এমবিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছি, ক্লাস থাকে শুক্রবার। আচ্ছা দেখি, চেষ্টা করবো।
-আচ্ছা শোন, এই যে ফোন নাম্বার দেই একজনের, উনি ব্লগের সঞ্চালক, উনার সাথে কথা বলে সব ঠিক করে নিস। যাওয়ার সমস্যা থাকলে উনাকে জানাবি।
-না না, সমস্যা কিসের? দেখি, যাওয়া যাবে। অনুষ্ঠান কখন?
-বেলা তিনটায়।
-আমার ক্লাস শেষ হবে দুপুর একটায়, তারপরে বাড়ী ফিরে যেতে যেতে~~~~~~~
-ভাই রে! এত চিন্তা করিস না। ক্লাস থেকে বাসায় ফেরার দরকার নেই, কোন একটা রেস্টুরেন্টে খাবি, বিল আমি দেবো। ওখান থেকেই চলে যাবি। আরেকটা কথা, আমার খুব লজ্জা লাগছে তোদেরকে ব্যতিব্যস্ত করতে। কিন্তু পুরষ্কার বলে কথা! কষ্টের অর্জন এটা! তারপরেও বলি, জীবনের রিস্ক নিয়ে যাইস না।
-কী যে বলো, জীবনের রিস্ক আবার কি? তবে, টাকা পাওয়া গেলে ভালো হইতো। আমরা চাইনীজ খেতে পারতাম।
-না, দেশে তো এখন যখন তখন ঝামেলা লাগে, কার ঝাল কার উপর এসে পড়বে, সেই ভয় পাই। তোর বৌ-বাচ্চা আছে বাসায়, দিদির পুরষ্কার আনতে গিয়ে বিপদে পড়লে আমার খারাপ লাগবে। আর শোন, জলছবিবাতায়ণে ক্রেস্ট দিবে, সেটা আগেই জানিয়ে দিয়েছে। প্রিয় ব্লগে পাবো প্রাইজবন্ড। আর শোন, এত খারাপ হয়ে গেলি কী করে? খালি খাই খাই করছিস কেন? টাকাটাই তো বড় কথা না, তোর দিদি লিখে পুরষ্কৃত হয়েছে, সেটাই বড়।
-না, না, ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই, নিশ্চিন্ত থাকো।
-মিত্রাকে না হয় বলে দ্যাখ, বেলা তিনটার সময় কী আর সমস্যা হবে, ও গিয়ে নাহয় আমার প্রতিনিধিত্ব করুক! আমি আমার সেই দাদাকে মিত্রার নাম বলে রেখেছি।
আমার কথা শেষ না হতেই শোনা গেলো মিত্রা বলছে, " না না, আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি শুক্রবার মেসোর সাথে দেখা করতে যাব।" অপুকে বললাম, " অপু, তুই তো আবার লাজুক টাইপের ছেলে, তুই না পারলে মিত্রাকেই না হয় বল আমার ঐ দাদার সাথে কথা বলে নিতে। মনে হচ্ছে, তোদের কারোই যাওয়া সম্ভব হবে না। তার চেয়ে উনার কাছেই পুরষ্কার রেখে দিতে বলিস।
-ফুলদিভাই, তুমি যে কেনো এত তাড়াতাড়ি আপসেট হয়ে যাও! মিত্রার বর আসবে, তুমি তো জানো না, মিত্রার বর আসলে মিত্রা পুরা চেঞ্জ হয়ে যায়, আর কারো কথা মাথায় থাকে না।
মিত্রার গলা শোনা গেলো, " এটা কেমন কথা বলছো অপুদা, তুমি কী কম বউপাগলা? তোমারই তো বোন আমি, আর যার সাথে কথা বলছো, উনি কী কম বর পাগলা? এখনও এই বুড়া বয়সে 'আমার উত্তম' আমার উত্তম করতে থাকে। আর আমার বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন মাস আগে। আমি তো বর পাগল হতেই পারি।
ফোনে বিল তুলে এদের সাথে প্যাঁচাল পারার কোন অর্থই হয় না। মিত্রা বেশী বদলে গেছে, কত বড় সাহস, আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে! কথার মাঝখানেই ফোন রেখে দিয়েছি। ওরা অবশ্য জানে, আমার এই পাগলা চরিত্রের কথা।
গত পরশুদিন আমি বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে ঢোকা আমার নিয়মিত অভ্যাস। সেই সকালেও ফেসবুক অন করেছি, দেখি মেসেজ নোটিফিকেশান দেখাচ্ছে। মেসেজ বক্স খুলে দেখি সুশান্ত দাসগুপ্ত মেসেজ রেখেছে। সুশান্ত'র সাথে আমার পরিচয় ছিল না। তবে ব্লগে ঢুকলেই আমি ওদের কয়েকজনের নাম প্রায়ই দেখতে পাই। নিঝুম মজুমদার, অমি রহমান পিয়াল, সুশান্ত দাশগুপ্ত সর্বজনপরিচিত ব্লগার, এবং অমি রহমান পিয়ালকে তো ব্লগরাজ্যের অধীশ্বর বলা হয়। নিঝুম মজুমদারের লেখা প্রথম পড়েছি বিডিনিউজ২৪ ব্লগে, অন্য কেউ ট্যাগ করেছিল। '১২ সালের শেষ দিকে আমি 'আমার ব্লগে' জয়েন করি। দুই মাসেই তের চৌদ্দটি লেখা পোস্ট করেছি। শুরুর দিকে যুদ্ধাপরাধী সাঈদী'র ওয়াজ মাহফিল বন্ধ করে দিয়েছিল লন্ডনের কিছু বাংলাদেশী তরুণ। তারা মোম জ্বেলেছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেছিল। সাঈদী'র সমাবেশ বা মাহফিল বন্ধ করে দেয়া খুব সহজ কাজ নয়। সেই 'অসহজ' কাজটি যারা করেছিল, সুশান্ত দাশগুপ্ত তাদের একজন। বয়সে তরুণ ছেলেটি 'আমার ব্লগে' খুব ভালো ফীচার লিখে। ওর সম্পর্কে অতটুকুই জানি।
আমাকে মেসেজে সুশান্ত 'ব্লগ দিবস উদযাপণ' এর একটি লিঙ্ক দিয়ে বলেছে, অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলে খুব খুশী হবে সবাই। কেউ মেসেজ পাঠালে আমি সব সময় উত্তর দেই। সুশান্তকে উত্তরে জানিয়েছি, ওর মত এমন মেধাবী তরুণ আমার সাথে যোগাযোগ করেছে বলে খুব খুশী হয়েছি, নিজেকে সম্মানিত বোধ করেছি। আরও বলেছি, আমেরিকা থাকি বলে ঐ অনুষ্ঠানে যেতে পারবো না। ও বোধ হয় অনলাইনেই ছিল। আমাকে অবাক করে দিয়ে ও জানালো, সে নিজেও আমেরিকাতেই আছে এবং মিসিসিপিতেই আছে। পরের দিন সকালে ওর বস্টন যাওয়ার ফ্লাইট। মিসিসিপি শুনে তো আমি মহা খুশী। ছোটভাই বলে ডাক দিলাম। সে আমাকে দিদি বলে মেনে নিয়েছে। দুই সেকেন্ড পরে আবার জানিয়েছে, ধানমন্ডির বিলিয়া ভবনে আমারব্লগের অনুষ্ঠান হবে, কোন ভয়েস মেসেজ অথবা ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে চাইলে পাঠাতে পারি। আমি একটু অবাক হচ্ছিলাম, ছেলেটা আমাকে কেনো ভয়েস মেসেজ, ভিডিও মেসেজ পাঠানোর কথা বলছে? ও আবার লিখলো, " দিদি, প্লীজ, যে কাউকে পাঠান অনুষ্ঠানে, সিলেকশান কমিটি থেকে নির্বাচন করা হয়েছে।
জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী নির্বাচনের কথা বলছো, আমি বুঝতে পারছি না।
-দিদি, আপনি কী জানেন না যে আপনি সেরা উদীয়মান ব্লগারের পুরস্কার পাচ্ছেন?
-তাই নাকি? কী বলছো? আমি তো কিছুই জানিনা।
-প্লীজ, দিদি, কাউকে না কাউকে পাঠান। নিজ হাতে কেউ গিয়ে পুরষ্কার নিয়ে আসুক। আপনার কোন ভাই নেই ওখানে?
-ভাই আছে, কিন্তু দুই ভাই দূরে থাকে, যে ভাই ঢাকাতে থাকে, সে খুব ব্যস্ত, তারপরেও চেষ্টা করবে তিনটার সময় আরেক জায়গা থেকে পুরষ্কার আনতে। কাজেই আর কেউ নেই। দাঁড়াও, আমার আরেক ভাগ্নী আছে, ওকে বলে দেখি।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই দেখুন, প্লীজ! আপনি তো বেশ ভাল লিখেন, লেখা চালিয়ে যান, থামাবেন না। এমন ভালো একটা পুরষ্কার পেলেন, আনতে না গেলে চলে!
যে মুহূর্তে ভাবছিলাম ভাগ্নী অদিতিকে ফোন করবো, দেখি সে অনলাইনে হাজির। সাথে সাথে নক করলাম, জানালাম সব কথা। সে বললো,
কনগ্র্যাচুলেশান্স মামী। এই বছর তিন ব্লগ থেকে পুরষ্কার পেয়েছো, আর কিছুদিন পরে আমরা কয়েকজন মিলে ব্লগ খুলছি, তুমি তো হবে আমাদের বাঁধা ব্লগার, সামনের বছর আমাদের কাছ থেকে পুরষ্কার পাবে।
-মা রে! সামনের বছর আমি 'বাংলা একাডেমী' পুরস্কার পাব। কিন্তু লাভ কি? এবছরের পুরস্কার আনতে যাওয়ার মানুষ নেই, আর সামনের বছর!
-মামী, জামাতের হরতাল ছিল, তাই আমার অফিস হয় নি, কাল শুক্রবারে আমার অফিস চলবে। আমার কী দোষ বলো!
-ওকে, তাহলে রাখি। দেখি আবার অপুকে ফোন করি।
অপুকে ফোন করে পেয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আমার দেয়া নাম্বারে ফোন করেছিল কিনা। বলে, " না, এখনও করি নাই, তবে সমস্যা নাই, উনাকে ফোন করে কনফার্ম হয়ে নেবো"।
-মিত্রাও ফোন করে নাই?
- হাহাহা! ওর বর আসছে, ওর চেহারা আর দেখা যাবে না।
-ভালো, আমারই ভুল হয়েছে, তোদের কাছে বার বার ফোন করে আমার মন মেজাজ বিগড়ায়ে গেছে। বাদ দে, আমার পুরস্কার আমি সামনের বছর দেশে গিয়ে নিয়ে আসবো।
-ফুলদিভাই, আমি যাব, চিন্তা করো না।
-কিন্তু সমস্যা হয়েছে, আমি তো আরেক জায়গা থেকেও পুরস্কার পেয়েছি। সেটা হবে ধানমন্ডিতে।
-বাবারে! এত পুরস্কার পাইলে কীভাবে চলবে?
শোন, ৩টার সময় চারুকলার সামনে থেকে পুরস্কার নিয়েই সোজা ধানমন্ডি চলে যাবি। সুশান্ত ওর বন্ধুর সাথে কথা বলে রাখবে, তুই ওখানে যাওয়ার সাথে সাথেই তোর কাছে পুরস্কার দিয়ে দিবে।
-আচ্ছা, দেখি কী করা যায়। চিন্তা কইরো না। শুক্রবার তো, খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না।
-কিন্তু ১লা ফেব্রুয়ারী তো, বই মেলা উদ্বোধণ হবে তো! ভীড় থাকবে, তার মধ্যে জামাত-শিবিরের অতর্কিত হামলার ভয় তো থাকেই। একটাই ভয় লাগে, ক্রেস্ট আনতে গিয়ে না আবার কোন বিপদে পড়স!
আমার সাথে সুশান্ত'র কথা হয়েছে আমেরিকার বৃহস্পতিবারের সকালে, দেশে তখন রাত। আমেরিকার ভোর চারটা আর সকাল সাতটায় ছিল প্রোগ্রাম। বুদ্ধি করে সুশান্ত'র কাছ থেকে আয়োজকদের একজন 'ইফতি'র ফোন নাম্বার চেয়ে রেখেছিলাম। মনে পড়ে গেলো আমার 'মুশকিল আসান' ছোট মাসীর কথা! মাসী যদি ঢাকায় থাকতো, আর কারো কাছে এভাবে ধর্না দেয়া লাগতো না। সমস্যা হচ্ছে, মাসী থাকে সুনামগঞ্জে, হাওর-বাওড়ের দেশে। অতদূর থেকে তো আর মাসী আসবে না। মাসীকে ফোন করে পুরা ঘটনা বললাম, এও বললাম, ঢাকা ফোন করে 'ইফতি'র সাথে কথা বলতে। সব গুছিয়ে বলার পর অপুকে যেনো ফোন করে। মাসীর ছেলে অনিন্দ্য পড়ে নটরডেম কলেজে। বলেছি, ওর কোচিং ক্লাস শেষ হলে সরাসরি ধানমন্ডি বিলিয়া ভবনে চলে যেতে। মাসীকে বলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছি। মাসী যখন শুনেছে, আর কোন চিন্তা নেই।
পরের দিন, অর্থাৎ আমেরিকার শুক্রবার সকাল ৯টা মানেই দেশের শুক্রবার রাত ৯টা। হিসেব মিলিয়ে দেখি, আমার পুরস্কার মহাখালি মামার বাসায় চলে এসেছে। অপুকে একটা ফোন করতেই হয়, ধন্যবাদ জানাতে হবে। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, ক্রেস্ট আমার পাওয়া হচ্ছে না। আহারে! যতই বলি, লেখালেখি করাটাই বড় কথা, পুরস্কার পাওয়াটা বড় কথা নয়। তারপরেও আমি সাধারণ মানুষ, পুরস্কার পেতে ইচ্ছে করে। সেই আমি পুরস্কার পেয়েও যদি লোকবলের অভাবে পুরস্কার হাতছাড়া হয়ে যেতে দেই, সেটা নিশ্চয়ই আমার জন্য সুখকর হওয়ার কথা নয়। দিলাম অপুর নাম্বারে কল। রিং বেজে যাচ্ছে, রিং বেজে যাচ্ছে, কেউ ফোন ধরে না।
দিলাম মাসীকে ফোন। " মাসী, অপুকে ফোন দিলাম, রিং হয়, ফোন ধরে না। অপু কী নিয়ে এসেছে পুরস্কার?
-অপু ফোন ধরবে কী করে? রাত ৯টার সময় অপু বাসে। শাহবাগ থেকে আসতে হয়েছে।
-শাহবাগ কেনো? একটা অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল তো চারুকলার সামনে~~
-আজ্ঞে না, যা ঝড় গেলো ওর উপর দিয়ে!
-কেনো, কী হয়েছে?
-আরে! ও তো ক্লাস থেকে বের হয়ে হোটেলে বোধ হয় কিছু খেয়ে নিয়েই চারুকলার সামনে চলে গেছে। বেলা ৩টার সময় ওখানে কেউ ছিল না, কিছুই ছিল না। ও তখন তোর দেয়া নাম্বারে ফোন করে জেনেছে, ভ্যেনু পরিবর্তণ করে শাহবাগে্র মোড়ে নেয়া হয়েছে। শাহবাগের মোড়ে গিয়ে দেখে তখনও তেমন কেউ আসেনি। এদিকে বিকেল চারটা বেজে গেছে, যে কয়েকজন এসেছিল, তাদের কাছে তোর কথা বলেছে। কিন্তু তারাই বা কী করবে, একটা প্রোগ্রামের তো নিয়ম থাকে। ফলে অপুকে অপেক্ষা করতেই হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বই মেলা উদ্বোধণ উপলক্ষ্যে রাস্তা ঘাট জ্যাম লেগে গেছে। কোন কোন রাস্তা ব্লক করে দিয়েছে।
-হায় হায়! কী বলছো এইসব!
-শোন না, অপুর সাথে কথা বলেই টের পেয়ে গেছি, ও আজ আর ধানমন্ডি এসে পৌঁছাতে পারবে না। সাথে সাথে আমি অনিন্দ্যকে ফোন করে বলেছি, " বাবা শোন, তুই তোর বন্ধুকে নিয়ে আরামবাগ থেকে বাসে উঠে ধানমন্ডি চলে আয়। তুই যাবি বিলিয়া ভবনে, ফুলদিভাইয়ের পুরস্কার নিয়ে আসতে। আরেকটা কথা, তুই ভালো কোন রেস্টুরেন্টে খেয়ে নে, ফুলদিভাই বলেছে, তোকে খাওয়ার টাকা দিয়ে দিবে।
-হা হা হা! হ্যাঁ আমি তো আগেই বলে দিছিলাম, রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পয়সা আমি দিয়ে দেবো। তা অনিন্দ্য কি আনতে পেরেছে ক্রেস্ট?
-ঘটনা শোন, আরামবাগে যখন বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ানো ছিল, পুলিশে ধরছে। আইডি দেখতে চেয়েছে। শিবিরের হামলায় সবাই এখন ভীত হয়ে আছে। কখন কোন জায়গায় বিশৃংখলা দেখা দেয়, তার কোন ঠিক নেই। ভাগ্য ভালো যে ওর কাছে নটরডেম কলেজের আইডি ছিল। আইডি দেখার পর পুলিশ ওদের ছেড়ে দিয়েছে। অনিন্দ্য পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছিল, কিছু ঘটেছে কিনা। পুলিশ নাকি বলেছে, হ হ, বাড়িত চলে যাও, এইখানে সমস্যা হবে। পুলিশের কথা শুনে অনিন্দ্যর বন্ধু ঐখান থেকেই চলে গেছে। আর অনিন্দ্য রাস্তা বদলে অন্য রাস্তায় গিয়ে বাস ধরে ধানমন্ডি সাত নাম্বার রোডে চলে আসে। তারপরে ও বিল্ডিং বের করে ফেলে।
-এরপর?
-আরে, আমি তো ইফতি নামের ছেলেটির সাথে কথা বলেছিলাম, ও বলেছিল, কোন সমস্যা হবে না। সমস্যা হচ্ছিলও না। এমনিতেই চারটার বদলে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। আগেই তো শুনেছি, প্রধানমন্ত্রীর বইমেলায় আগমন উপলক্ষ্যে চারদিকে নিশ্ছিদ্র পাহারা ছিল, তাই চারদিকে জ্যাম লেগে গেছে। সময়ের অনুষ্ঠান সময়ে শুরু করতে পারে নাই। করবে কী করে, সবাইকেতো এসে পৌঁছাতে হবে! আমার তো কলিজা শুকায়ে গেছে। কত রাত হয়ে যাবে কে জানে। অনিন্দ্যকে বলেছি, ইফতির সাথে দেখা করে চলে আসতে। পুরস্কার অন্য সময় নেয়া যাবে। কিন্তু আমার এই ছেলে হচ্ছে নাছোড়বান্দা টাইপ। শয়তান ছেলে বসেই ছিল। ওরা নাকি ওকে খুব সমাদর করেছে। কাচ্চি বিরিয়ানীর প্যাকেট আর ক্রেস্ট দিয়ে ওকে রওনা করিয়ে দিয়েছে।
-মাসী, আমার খুবই খারাপ লাগছে শুনে। এইজন্যই আমি প্রথমে চাই নি কাউকে পাঠাতে। তার পরেও কী জানো, পুরস্কারটা হচ্ছে এক ধরণের রিকগনিশান, এক ধরণের স্বীকৃতি! আমি নিজে নিজে সেটা অর্জন করেছি। তুমি ধারণাও করতে পারবে না, মিসিসিপির এই নির্বান্ধব পরিবেশে থেকে কত পরিশ্রম করে চলেছি। পুরস্কার দুটো না আনলেও চলতো, তবে ওরা নিয়ে আসাতে আমার বুকটা ভরে গেছে।
-শোন, এরপর থেকে যে কোন ব্যাপারে আগে আমাকে ফোন করিস। বাকী ব্যবস্থা আমি করবো। চিন্তা নাই।
লজ্জা আর ভয়ের চোটে আমি দ্বিতীয়বার আর ফোন করি নাই অপু বা অনিন্দ্যকে। মিত্রাকে তো ফোন করার প্রশ্নই আসে না। স্বামী সোহাগী এখন আমাকে আর চিনতে পারলে তো কথা বলতাম!
একটু আগেই দেখি আমার ওয়ালে দুইটি ক্রেস্টের ছবি শোভা পাচ্ছে। মিত্রা আমাকে পাঠিয়েছে! তার মানে ওরা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে! ছবি পোস্ট করে তার নীচে আবার শুভেচ্ছাবাণীও দিয়েছেঃ
"ফুলদিভাই আমরা সবাই খুব খুশি এবং proud feel করছি ......এই প্রার্থনাই করি জীবনে লেখক হিসাবে আরও প্রতিষ্ঠা পাও আর সামনের বইমেলায় আমরা যেন তোমার বই দেখতে পাই বাংলা একাডেমীর কোন এক স্টলে......... তোমাকে অনেক অনেক অভিনন্দন........."
বড়দা জানিয়েছেঃ
" Amra tomar safolye gorbo bodh kori ebong awards amader swargiya maa-ke utsorgo koray tomake onek donyobad janai. Aro ashirwad kori tumi deerghojeebi hao ebong aro safolyo orjon koro."
আমার ওয়ালে আমার নতুন ভাই কবিদাদাও শুভেচ্ছা জানিয়েছে,
" দিদি তোমাকে অভিনন্দন। জলছবি বাতায়নের অনুষ্ঠানে তোমাকে মিস করেছি। অপূর্ব তোমার ক্রেস্ট নিয়েছে। আমার কবিতার বই জনারণ্যে একাকী আছে ওর কাছে তোমার জন্য। কিন্তু একটু ভুল হয়ে গেছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে লেখক হিসাবে তোমার একটি সৌজন্য সংখ্যা অপূর্বকে দেয়া হয়নি। অপূর্বকে বলো জহিরুলের কাছ থেকে সংগ্রহ করার জন্য।
Friday at 7:57pm · "
আমি অতি সাধারণ হলেও আমার প্রতি সকলের ভালোবাসা সাধারণ নয়, একেবারে অ সা ধা র ণ!!!!!!!!!!
Mithu, ami tomar eto druto ero boro safolye mugdho hoyechi. Tomar puroskargulo dekhte dekhte anonde amar chokh diye jol porchilo. Tumi amader poribarer gorbo. Ei puroskargulo maa-ke utsorgo korecho. Bhobishyater-ta baba-ke utsorgo koro. Abaro obhinondon janai. Masi, Apu ebong Anindya-ke dhonyobad janai tomar safolyer ongshidar hoyar jonyo.
ReplyDeleteMithu,I am very pleased at your great achievement in a very short time. When I was looking at your prizes, my eyes were filled with joyful tears. You are the pride of our family. As you dedicated these prizes in our mom's name, please dedicate the next one in our father's name. Congratulations,once again. I also thank Masi (Aunt), Apu and Anindya as they sacrificed their valuable time to become the part of your glorious events.