আজ ছিল আমার অফ ডে, শুক্রবারে ডে অফ পাওয়াটা আমার জন্য বাড়তি কিছু পাওয়ার মত। কেননা শনিবার আমার এমনিতেই অফ। আমেরিকায় উইকএন্ড বলতে শনি আর রবি বুঝালেও আমাদের ওয়ালমার্টে উইকএন্ড বলে আলাদা কিছু নেই। সপ্তাহে দু'দিন ছুটি পাওয়া যায়, তা সেই ছুটি সপ্তাহের যে কোন দু'দিন হতে পারে। আমি শনিবার ডে অফ রেখেছি, বাকি একদিন সপ্তাহের যে কোন দিন হতে পারে। এই সপ্তাহে শুক্রবার পেয়েছি ডে অফ।
শুক্রবার অফ পেলে যে বাড়তি সুবিধা পাই, সেটা তেমন কিছু নয়। আমি সকালের ঘুম বিলাসী মানুষ, ছোটবেলা থেকেই। রাত জেগে থাকতে পারি, সারারাত চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি কিন্তু ভোরের সূর্য দেখা হয়না। অথচ যেদিন সকালে কাজের শিফট থাকে, আমাকে বিলাসী ঘুম বাদ দিয়ে বিছানা ছাড়তেই হয়। শুক্রবার ডে অফ পেলে দেরী করে ঘুম ভাঙবার সাথে সাথে মাথায় চিন্তা আসে, আগামীকাল শনিবার, কালকেও দেরী করে ঘুম থেকে উঠতে পারবো। তেপ্পান্ন বছর বয়সে দাঁড়িয়ে আজও সকালবেলাটায় ছোটবেলার 'আমি'কে খুঁজে পাই, বড্ড ভাল লাগে!
আজকের শুক্রবারটা ছিল একটু অন্যরকম। ঘুম ভেঙ্গেছে দেরীতেই, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঠাকুর প্রণাম করার আগে মিথীলাকে ডেকে বললাম, " মিথ, কিচেন থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে আসো মা"।
মিথীলার সব মুখস্থ, সকালের চা বানায় ওর বাবা। নিজের চা শেষ করে আমার চায়ের কাপ ঢাকা দিয়ে রেখে ভার্সিটিতে চলে যায়। চা ঠান্ডা হয়ে থাকে, মাইক্রোওয়েভ ওভেনে হাই পাওয়ারে দেড় মিনিট গরম করলেই চা আগুন গরম হয়ে যায়।
চা আমি আগুন গরমই খাই। যদিও চা খাই কথাটা ব্যাকরণগত দিক থেকে শুদ্ধ নয়, বদলে বলা উচিত 'চা পান করি', কিন্তু আমি চলিত ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমার এক পরিচিত শিক্ষিত মহিলা ফেসবুক স্ট্যাটাসে রাজবাড়ির আঞ্চলিক ভাষায় ' দেবানে, খাবানে' লিখলেও চায়ের প্রসঙ্গ এলেই হঠাৎ করে একশ চলিত ভাষার মাঝখানে " এখন ব্যাকইয়ার্ডে বসে চা পান করছি" লিখে। তাতে স্ট্যাটাস পড়তে পড়তে হঠাৎ হোঁচট খাই, চোখের পাতা দু'বার বেশি নড়ে।
যা বলছিলাম, চা আমি আগুন গরমই খাইনা শুধু, চায়ে লিকার দুধ চিনির পরিমান কড়ায় গন্ডায় হিসেব নিকেশ করে মিলিয়ে মিশিয়ে খাই। সকালে এক কাপ, বিকেলে এক কাপ চা, এটুকু বিলাসিতা না করলে বাঙালি রমণীর চলে!
মিথীলা কিচেনে গিয়ে ঠান্ডা চা দেড় মিনিট গরম করে নিয়ে এলো, সাথে দুটো বিস্কুট। দাঁত ব্রাশ না করে চা খেতেই কেমন লাগে, তার উপর আবার বিস্কুট! কেমন গা ঘিন ঘিনে ব্যাপার। অথচ আজকাল গা ঘিন ঘিনে ব্যাপারটাকেই গা সয়ে নিতে হচ্ছে। নাহলে এক আধ টুকরো বিলাসিতা করার সুযোগ মাঠে মারা যাবে যে! খালি পেটে চা খাওয়া আমার সহ্য হয়না, একটা বিস্কুট তো সাথে খেতেই হয়। মিথীলা দুটো বিস্কুট এনেছে কারণ এক বিস্কুট মা'কে দেয়া যায়না, মায়ের মতি গতির ঠিক থাকেনা তো। রাগ হলেই মিথীলাকে খোঁটা দিবে, " মিথীলা তোর আত্মা এত ছোট? তুই আমাকে একটা বিস্কুট কি করে দিতে পারলি! কেন, ঘরে কি বিস্কুটের আকাল পড়েছে? নাকি আমি তোদের কখনও মেপে মেপে খেতে দিয়েছি/ কাউকে খেতে দিতে হলে হাত খুলে খেতে দিবি, কিন্তু নিজে খাওয়ার সময় পেটের আন্দাজ মেপে খাবি"।
মায়ের প্যাঁচাল শুরু হলে মিথীলার অনেক যন্ত্রণা সইতে হয়, মুখের উপর বলতেও পারেনা, " মা এবার থামো", দিদিরা বলে কিন্তু মিথীলা বলতে পারেনা। মিথীলার মনের ডায়েরীতে এটা লেখা হয়ে গেছে, মা বাবাকে মুখের উপর কোন কঠিন কথা বলা যাবেনা, তাহলেই মা দুই চোখ গোল করে বলবে, " মিথীলা, তুইও আমাকে মুখের উপর এমন করে বলতে পারলি?" মিথীলা মা'কে ভয় পায়না কিন্তু মায়ের মন মেজাজকে ভয় পায়। মায়ের মেজাজ এই মেঘ, এই রোদ, এই দখিনা বাতাস। মা যখন রোদেলা মেজাজে থাকে, মিথীলাকে 'মিথীলা' বলে সম্বোধন করে, এবং 'তুমি' তুমি' করে বলে। মেঘলা মেজাজে থাকলে চোখে জল এনে কথা বলে, তখনও 'মিথীলা' বলে তবে 'তুই তুই' করে বলে। সবচে ভাল লাগে মা যখন দখিনা বাতাসের মেজাজে থাকে, মিথীলাকে কখনও মিথীলা ডাকেনা। ' মিথ, বাচ্চা, বাচ্চু মিয়া, জানকা মানকা, জনার্দন, মেরে জান, জান্নাতুল ফেরদাউস, জান্নু' আরও কত রকম নামে যে ডাকে। সেই দখিনা বাতাসের মাকেই মিথীলার সবচেয়ে বেশি আপন মনে হয়।
আজ মায়ের মেজাজা দখিনা বাতাসের মতই ছিল। গতকাল ছিল রোদেলা মেজাজ, সাথে কিছু মেঘ মেঘ ভাব। কারণ মায়ের ফেসবুক নাকি ত্রিশ দিনের জন্য ব্যানড হয়ে আছে। মা নাকি সুরে বলে চলেছে, " মিথীলারে, তুই না থাকতে অবসর সময় ফেসবুকে কাটাতাম। এখনতো আমি একদম একেলা হয়ে গেছি, তোর পাপাও বুড়ো হয়ে গেছে সারাক্ষণ টিভিতে কী সব গুরুগম্ভীর প্রোগ্রাম দেখে, আমাকে নিয়ে যে একটু ঘুরতে বেরোবে সেই ইচ্ছেটাও জাগেনা মনে হয়। বেড়ানোর ইচ্ছে জাগবেই কেমন করে, এমন এক বদখত জায়গায় থাকি আমরা, বেড়ানোর জায়গা বলতে কিছুই নেই। এখানে মানুষ বেড়াতে হলে শপিং মলে যায়, ওয়ালমার্টে যায় নাহলে কফিশপে যায়। এগুলো দিয়ে কি আমার মত ঘুরন্টির পোষায়? তাই আমি ফেসবুকেই ঘুরি বেড়াই। কিন্তু এবার তুই চলে গেলে আমার কি হবে! ফেসবুকে আমার ঘুরাফিরা বন্ধ। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমাকে কেন ফেসবুকে ঘুরাফিরা বন্ধ করে দিল? আমি কাকে কি বলবো, আমি নিজেইতো জানিনা আমাকে কেন ব্যান করছে। দুই তিন বছর আগে কি স্ট্যাটাস লিখেছিলাম, কখন লিখেছিলাম কিছুই মনে নেই, তার জন্য নাকি ফেসবুকের সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেছে!" এসব বলে মা মেঘলা চোখে অনেক কেঁদেছে, থেকে থেকেই কেঁদেছে।
আজ সকাল থেকেই মায়ের মুখে দখিনা বাতাস, কী সুন্দর করে বিছানায় বসে চুক চুক করে চা খেলো। দুটো বিস্কুট দিয়েছিল মিথীলা, কিন্তু মা একটা বিস্কুট খেলো, আরেকটা প্লেটেই রয়ে গেলো। এরপর বিছানা থেকে নেমে মায়ের বিছানার পাশের জানালার ধারে রাখা জলের জারের কাছে গেলো। কেমন আহ্লাদি সুরে ডাকতে লাগলো, " ও বর্ণময়ী, ও মনা ও সোনা, ইলি ইলি ইলি, খিদে পেয়েছে, ওলে বাবালে দিচ্ছি দাঁলাও, এক্ষুণি খাবাল দিচ্ছি"। মা কথা বলছে কড়ে আঙুলের সমান একটা 'বেইটা ফিশের' সাথে। থ্যাংকস গিভিং ছুটিতে শিখর দাদা বেড়াতে এসেছিল, মা'কে এই মাছটা গিফট করেছে। শিখর দাদা 'মি আ'র (মিশা ) বন্ধু। মা শুধু মাছ নয়, সবার সাথেই এমন আহ্লাদ করে কথা বলে, ক্রিসমাসের ছুটিতে 'মোনা' ( মৌটুসি) এসেছিল মোনার দুই কুকুর নিয়ে। কুকুরদের নাম 'মমপ্রিয়া' আর 'পিনাকি
( পিনাট)। মা কুকুর দুটোর সাথেও এমন আহ্লাদ করে কথা বলতো, পিনাকিকে ডাকতো ' পিনা, পিনু, পিনাটু, পিনাইক্কা' আর মমপ্রিয়াকে ডাকতো 'মমলা, ছমলা ঝমলা'। মা যখন দখিনা বাতাসের মেজাজে থাকে, ছোট্ট বাড়িটার চারদিকে দখিনা বাতাস খেলা করে। সেই মায়ের মন খারাপ। মিথীলা চলে গেলেই মা 'একা' হয়ে যাবে, না থাকবে মিথীলা পাশে, না থাকবে ফেসবুক!
মিথীলা সেদিন আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, " মা, ডর্মে থেকে আমি ভুলে গেছি, আমার প্রিয় খাবার কি কি ছিল?" বললাম, " শাক, বেগুন ভাজা, চিকেন কোর্মা, মিঠু''স সিগনেচারড নুডুলস, রসগোল্লা, পাটিসাপটা পিঠা,লুচি, পনির কারি----" ।
-মা, সবগুলো না, কয়েকটা কি রাঁধতে পারবে?
-পারবো।
পাটিসাপটা পিঠা, পোলাও, নুডুলস, লেডিকেনি্ লুচি খাওয়ানো হয়ে গেছে। তবুও আজ যেহেতু অফ ডে শুক্রবার, তাই দুপুরে মিঠু'স সিগনেচারড নুডুলস রান্না করতে গেলাম। রাতের জন্য রাঁধবো পনির কারি, ছানা ভেজে শাকের ঘন্ট, ফুলকপির বড়া।
ফেসবুক নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই। সেদিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছিলাম, সবাই শুধু ভার্চুয়াল বন্ধু কথাটা বলে, ফেসবুকের বন্ধুরা নাকি ভার্চুয়াল। আমি ভার্চুয়াল কথাটা বুঝিনা। আমার বন্ধুরা কি ভার্চুয়াল নাকি রিয়েল?" কমেন্টে যার যার মনের কথা লিখেছে।
প্রায় পনেরো দিনের উপর হয়ে গেলো, আমি ফেসবুকে অপ্রত্যাশিতভাবে, অন্যায়ভাবে ব্যানড হয়ে আছি। আমার আত্মসম্মানবোধ খুব তীব্র, এমন অন্যায়ের কোন প্রতিকার করতে পারছিনা অথচ অন্যায় হয়েই চলেছে। কয়েকজন বন্ধু পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা সহমর্মিতা প্রকাশ করছে, কিভাবে এই অসহ্য অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায় সে ব্যাপারে বিভিন্ন উপায় বাতলানোর চিন্তা করছে। তাদের পাশে পেয়ে আমার খুব ভাল লাগছে যেমনি, খারাপ লাগাটা তার চেয়েও বেশি।
ফেসবুক বন্ধুরা ভার্চুয়াল নাকি রিয়েল---উত্তরটা পেয়ে গেছি।
আমার স্বভাবটা হচ্ছে, একটা বিষয় নিয়ে খুব বেশিক্ষণ বিচলিত হয়ে থাকতে পারিনা। ফেসবুক বাদ, শুরু করেছি ব্লগে লেখা। এরপর হয়তো আবার পত্রিকায় লেখা শুরু করবো। তারপর অসমাপ্ত বইগুলো। কয়েক বছর আগে নূর হোসেন মাণিক নামের এক অতি চমৎকার বন্ধু আমায় বলেছিলেন, আমি নাকি খুব বেশিদিন ফেসবুকে থাকবোনা। ফেসবুক ছেড়ে লেখালেখিতে মন দেবো। তখন হেসেছি, আজ মনে হচ্ছে মাণিক ভাইয়ের কথা সত্য প্রমাণিত করার জন্যই বোধ হয় আমার ভাগ্যে এই ব্যান অপমান জুটলো।
নুডুলস যখন রান্না করছি তখন মিথীলা বোমাটা ফাটালো। " মা, আজ কি আরেকবার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যেতে পারি?"
মিথীলার কথা শুনে আমার রান্না থেমে গেলো, মুখের কথা থেমে গেলো, দখিনা হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। চেহারায় রোদও না, মেঘও না, কেমন যেন কুয়াশা কুয়াশা আলোছায়ার আসা যাওয়া শুরু হয়ে গেলো।
-কি বলছো মিথীলা? আজ আমার ছুটি, সোমবার তুমি চলে যাচ্ছো, আর আজই কিনা তুমি বন্ধুদের সাথে টাইম স্পেন্ড করতে চাইছো? অনেকদিন তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলে!
-মা, অনেকদিন কোথায়! এক মাসে মাত্র দশ দিন আড্ডা দিয়েছি। বন্ধুরা চলে যাবে যার যার ইউনিভারসিটিতে, আমি আমার ইউনিভারসিটিতে। ওদের সাথে কি আর সহজে দেখা হবে?
-মিথীলা, বন্ধুদের সাথে তোমার দেখা হবে, হয়তো আমার সাথেই দুই বছর পর আর দেখা হবেনা।
-কী বলো মা, তোমার সাথে দেখা হবেনা কেন? ছুটিতে তো আমি এই বাসাতেই আসবো, তোমাদের সাথেই থাকবো।
-মিথীলা, আমি যদি পৃথিবী ছেড়েই চলে যাই, কোন বাসাতেই আমায় পাবেনা। কিন্তু বন্ধুদের দেখা পাবে দশ বছর পরেও।
-মা, যাইনা আজকে। কাল সকালেই চলে আসবো। আমিতো ঘরে থাকলেও ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে থাকি, তোমাদের সাথে কি থাকি?
-ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে থাকলেও এই ঘরেই তো থাকিস, তোর গায়ের গন্ধ পাই, শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।
-মা, আরও দুই দিন আছিতো। যাই আজকে!
চুপ করে গেলাম। কুয়াশার চাদর সরিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম আমার 'মিথীলাবেলা'র দিন। মিথীলার বয়সে আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলনা, স্কুল, কলেজ আর বাসা। ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হওয়ার পর নতুন এক জায়গা হলো হোস্টেল, হোস্টেলে যখন প্রথম গেলাম, বাসার মধ্যে বড় হওয়া আমি প্রায় প্রায় হোস্টেলের বিছানায় শুয়ে কাঁদতাম, দম বন্ধ হয়ে আসতো। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নারায়ণগঞ্জ চলে যেতাম এক দিনের জন্য। ধীরে ধীরে ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব হয়, ছেলে মেয়েতে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়, কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা গ্রুপ তৈরী হয়। সেই বন্ধুরা মিলে কত ঘুরাঘুরি, জাহাঙ্গীরনগর থেকে প্রতি শুক্রবার বাসে চেপে ঢাকা চলে আসা, এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা,কয়েক বন্ধু মিরপুর লাভলীর বাড়িতে গিয়ে দুই দিন কাটানো---- এসবেই মন মজে যায়, দম বন্ধ ভাব ফুরিয়ে যায়, বাসায় যাওয়ার তাগিদ কমে আসা! দুই তিন সপ্তাহ পর যখন বাসায় যেতাম, মায়ের চোখে দেখতাম আজকের 'আমি মায়ের' আকুতি, আর দুটা দিন যদি থাকতে পারি।
তখন মাঝে মাঝেই এরশাদ ভ্যাকেশান পাওয়া যেতো। বর্তমানের জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট হো মো এরশাদ ছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। ছাত্র আন্দোলন দমাতে মাঝে মাঝেই ইউনিভারসিটিগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যেতো, হোস্টেল ছেড়ে বন্ধুরা বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে যে যার বাসায় চলে যেতাম। মোবাইল ফোনতো ছিলনা, বন্ধুদের কারো সাথে যোগাযোগ হতোনা।
এরশাদ ভ্যাকেশানে বাসায় এলে মায়ের মনে আনন্দের বাণ ডাকতো। মা আমার উপর রান্নার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে স্কুলে চলে যেতো। আমিও তখন মনের আনন্দে রান্নাবান্না করতাম, দুপুরে অফিস থেকে বাবা এলে বাবাকে, ভাইদেরকে খেতে দিতাম। আর উসখুস করতাম কবে ভ্যাকেশান শেষ হবে, বন্ধুদের দেখা পাবো চিন্তায়। খুব মাঝে মাঝে দুই একজন বন্ধু নারায়ণগঞ্জ আমাদের গরীবী বাসায় বেড়াতে আসতো, মা গরীবী কায়দায় কিন্তু অন্তর দিয়ে বন্ধুকে ভাত বেড়ে খাওয়াতো, ঠিক যেমনটি আমি খাওয়াই আমার মেয়েদের বন্ধুরা এলে।
সবইতো একই রকম, শুধু সেকাল আর একালের সময়ের ব্যবধান। সেকাল কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়লেও মুছেতো যায়নি, কুয়াশার চাদর সরালেই দেখতে পাওয়া যায় একালের চিত্র সেকালের ফ্রেমে বন্ধী হয়ে আছে।
মন খারাপ কতক্ষণ থাকতো কে জানে! হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পেলাম, মিশা মেয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে।
" মা, তুমি কিচ্ছু ভেবোনা। একদম মন খারাপ করোনা। তোমার ব্লগটাকে আমি খুব সুন্দর করে তৈরী করে দেবো। ফেসবুকে তোমার ৩০ হাজার ফলোয়ার, ৫ হাজার বন্ধু, তাদেরকে মিস করছো! ব্লগে তোমার এক লাখ পাঠক পাবে, সেভাবেই ব্লগ তৈরী করে দেবো। তুমি লিখে যাও, লেখা থামিওনা। সব সময় অন্ধকার থাকেনা, রাত কি সব সময় থাকে বলো? রাত শেষে দিন শুরু হয়, তোমারও দিন শুরু হবে। আমরা সবাই তোমাকে ভালোবাসি"।
ওমা, কখন কোন ফাঁকে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। এত ভাবের ঘোরে থাকার মাঝেই রান্না করে ফেলেছি মটর পনির কারি, ছানা দিয়ে শাকের ঘন্ট, ফুলকপির বড়া। মিথীলাও নিত্য পূজো সেরে তৃপ্তি করে ভাত খেয়ে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার জন্য রেডি। আজ বাইরে অনেক ঠান্ডা, বন্ধু নিতে আসবে মিথীলাকে। আমিই বললাম, বন্ধুকে আসতে হবেনা, তোমার পাপা তোমাকে পৌঁছে দিবে"।
মিথীলা বলল, " পাপা আমাকে নিয়ে গেলে তুমি ঘরে একা থাকবে কিভাবে? ভূতের ভয় পাওতো তুমি"
-থাক, এতই যদি চিন্তা করবে আমার জন্য, তাহলে তো মা'কে ফেলে বন্ধুর বাড়ি যেতে চাইতেনা। বাইরে আবহাওয়া খারাপ, তোমাকে নিতে এসে পরের বাড়ির মেয়ে যদি পথে ঘাটে কোন বিপদে পড়ে, তার চেয়ে তোমার পাপা দিয়ে আসুক তোমাকে"।
মিথীলা চলে গেলো বন্ধুর বাড়ি, যাওয়ার সময় কেমন অপরাধী কন্ঠে শুধু বলে গেলো, " মা, আজকের খাওয়াটা খুব ভাল হয়েছে আমার। সব রান্না খুব ভাল হয়েছে। থ্যাংক ইউ মা"।
আজ রাতে মিথীলাকে নিয়ে নয়, স্বপ্ন দেখছি মিশার দেখানো আশার আলো মেখে। সাত বছর আগে মিশার বয়স ছিল কুড়ি বছর, আমার বয়স ছেচল্লিশ। মিথীলা এগারো বছরের ফুটফুটে বালিকা। তখন আমি একাকীত্বে ভুগিনা, একাকীত্ব আমার বাড়ির ত্রিসীমানাতেও ছিলনা। মৌটুসি মিশা কলেজে পড়তো তাই দূরে থাকতো, কিন্তু আমাদের স্টেট ইউনিভারসিটিতে প্রচুর বাঙালি স্টুডেন্ট ছিল তখন। তাদের সাথে ছিল আমাদের ভাব ভালোবাসা। আসা যাওয়া, খানাপিনা আড্ডাতেই ভরা থাকতো আমাদের শনি রবি। তখন ফেসবুক নতুন নতুন বিস্ময়, ভালোলাগা উন্মাদনার শুরু শুরু ধাপ। মিশা আমাকে জোর করে ফেসবুক একাউন্ট খুলে বসিয়ে দিয়েছিল।
সেই থেকে শুরু, মিশা ধারণা করতে পারেনি ওর মা একদিন ফেসবুকেই দ্বিতীয় পৃথিবীর সুখ খুঁজে পাবে। মিশা দেখেছে কিভাবে তিলে তিলে, নিজের চেষ্টায় ওর মা ফেসবুকে নিজের জন্য আলাদা এক জগত সৃষ্টি করেছে যে জগতে মিশা মিথীলা মৌটুসি অচেনা হয়েও মায়ের বন্ধুদের কাছে অনেক বেশি চেনা, অনেক বেশি আপন। মায়ের সেই ভুবন আজ লন্ডভন্ড করে দিয়েছে কিছু দানব। মিশা তো সেই দানবের সাথে লড়াই করতে পারবেনা, মিশা শিখেছে সুস্থ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার মন্ত্র, অন্যকে বাঁচতে দেয়ার মন্ত্র। কারো ক্ষতি করার শিক্ষা মিশা পায়নি বলেই আজ মায়ের লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া ফেসবুক জগতটাকে মায়ের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার কায়দা পাচ্ছেনা। তাই মা'কে ব্লগে ১০০ হাজার পাঠকের ভীড়ে দেখতে চাইছে। মিশা জানেনা ব্লগ নিয়ে মা কতদূর যেতে পারবে, মিশাতো এটাও জানতোনা ফেসবুকে অজ্ঞ মা ফেসবুকে কতদূর যেতে পারবে!
১২ই জানুয়ারী, ২০১৮
শুক্রবার অফ পেলে যে বাড়তি সুবিধা পাই, সেটা তেমন কিছু নয়। আমি সকালের ঘুম বিলাসী মানুষ, ছোটবেলা থেকেই। রাত জেগে থাকতে পারি, সারারাত চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি কিন্তু ভোরের সূর্য দেখা হয়না। অথচ যেদিন সকালে কাজের শিফট থাকে, আমাকে বিলাসী ঘুম বাদ দিয়ে বিছানা ছাড়তেই হয়। শুক্রবার ডে অফ পেলে দেরী করে ঘুম ভাঙবার সাথে সাথে মাথায় চিন্তা আসে, আগামীকাল শনিবার, কালকেও দেরী করে ঘুম থেকে উঠতে পারবো। তেপ্পান্ন বছর বয়সে দাঁড়িয়ে আজও সকালবেলাটায় ছোটবেলার 'আমি'কে খুঁজে পাই, বড্ড ভাল লাগে!
আজকের শুক্রবারটা ছিল একটু অন্যরকম। ঘুম ভেঙ্গেছে দেরীতেই, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঠাকুর প্রণাম করার আগে মিথীলাকে ডেকে বললাম, " মিথ, কিচেন থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে আসো মা"।
মিথীলার সব মুখস্থ, সকালের চা বানায় ওর বাবা। নিজের চা শেষ করে আমার চায়ের কাপ ঢাকা দিয়ে রেখে ভার্সিটিতে চলে যায়। চা ঠান্ডা হয়ে থাকে, মাইক্রোওয়েভ ওভেনে হাই পাওয়ারে দেড় মিনিট গরম করলেই চা আগুন গরম হয়ে যায়।
চা আমি আগুন গরমই খাই। যদিও চা খাই কথাটা ব্যাকরণগত দিক থেকে শুদ্ধ নয়, বদলে বলা উচিত 'চা পান করি', কিন্তু আমি চলিত ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমার এক পরিচিত শিক্ষিত মহিলা ফেসবুক স্ট্যাটাসে রাজবাড়ির আঞ্চলিক ভাষায় ' দেবানে, খাবানে' লিখলেও চায়ের প্রসঙ্গ এলেই হঠাৎ করে একশ চলিত ভাষার মাঝখানে " এখন ব্যাকইয়ার্ডে বসে চা পান করছি" লিখে। তাতে স্ট্যাটাস পড়তে পড়তে হঠাৎ হোঁচট খাই, চোখের পাতা দু'বার বেশি নড়ে।
যা বলছিলাম, চা আমি আগুন গরমই খাইনা শুধু, চায়ে লিকার দুধ চিনির পরিমান কড়ায় গন্ডায় হিসেব নিকেশ করে মিলিয়ে মিশিয়ে খাই। সকালে এক কাপ, বিকেলে এক কাপ চা, এটুকু বিলাসিতা না করলে বাঙালি রমণীর চলে!
মিথীলা কিচেনে গিয়ে ঠান্ডা চা দেড় মিনিট গরম করে নিয়ে এলো, সাথে দুটো বিস্কুট। দাঁত ব্রাশ না করে চা খেতেই কেমন লাগে, তার উপর আবার বিস্কুট! কেমন গা ঘিন ঘিনে ব্যাপার। অথচ আজকাল গা ঘিন ঘিনে ব্যাপারটাকেই গা সয়ে নিতে হচ্ছে। নাহলে এক আধ টুকরো বিলাসিতা করার সুযোগ মাঠে মারা যাবে যে! খালি পেটে চা খাওয়া আমার সহ্য হয়না, একটা বিস্কুট তো সাথে খেতেই হয়। মিথীলা দুটো বিস্কুট এনেছে কারণ এক বিস্কুট মা'কে দেয়া যায়না, মায়ের মতি গতির ঠিক থাকেনা তো। রাগ হলেই মিথীলাকে খোঁটা দিবে, " মিথীলা তোর আত্মা এত ছোট? তুই আমাকে একটা বিস্কুট কি করে দিতে পারলি! কেন, ঘরে কি বিস্কুটের আকাল পড়েছে? নাকি আমি তোদের কখনও মেপে মেপে খেতে দিয়েছি/ কাউকে খেতে দিতে হলে হাত খুলে খেতে দিবি, কিন্তু নিজে খাওয়ার সময় পেটের আন্দাজ মেপে খাবি"।
মায়ের প্যাঁচাল শুরু হলে মিথীলার অনেক যন্ত্রণা সইতে হয়, মুখের উপর বলতেও পারেনা, " মা এবার থামো", দিদিরা বলে কিন্তু মিথীলা বলতে পারেনা। মিথীলার মনের ডায়েরীতে এটা লেখা হয়ে গেছে, মা বাবাকে মুখের উপর কোন কঠিন কথা বলা যাবেনা, তাহলেই মা দুই চোখ গোল করে বলবে, " মিথীলা, তুইও আমাকে মুখের উপর এমন করে বলতে পারলি?" মিথীলা মা'কে ভয় পায়না কিন্তু মায়ের মন মেজাজকে ভয় পায়। মায়ের মেজাজ এই মেঘ, এই রোদ, এই দখিনা বাতাস। মা যখন রোদেলা মেজাজে থাকে, মিথীলাকে 'মিথীলা' বলে সম্বোধন করে, এবং 'তুমি' তুমি' করে বলে। মেঘলা মেজাজে থাকলে চোখে জল এনে কথা বলে, তখনও 'মিথীলা' বলে তবে 'তুই তুই' করে বলে। সবচে ভাল লাগে মা যখন দখিনা বাতাসের মেজাজে থাকে, মিথীলাকে কখনও মিথীলা ডাকেনা। ' মিথ, বাচ্চা, বাচ্চু মিয়া, জানকা মানকা, জনার্দন, মেরে জান, জান্নাতুল ফেরদাউস, জান্নু' আরও কত রকম নামে যে ডাকে। সেই দখিনা বাতাসের মাকেই মিথীলার সবচেয়ে বেশি আপন মনে হয়।
আজ মায়ের মেজাজা দখিনা বাতাসের মতই ছিল। গতকাল ছিল রোদেলা মেজাজ, সাথে কিছু মেঘ মেঘ ভাব। কারণ মায়ের ফেসবুক নাকি ত্রিশ দিনের জন্য ব্যানড হয়ে আছে। মা নাকি সুরে বলে চলেছে, " মিথীলারে, তুই না থাকতে অবসর সময় ফেসবুকে কাটাতাম। এখনতো আমি একদম একেলা হয়ে গেছি, তোর পাপাও বুড়ো হয়ে গেছে সারাক্ষণ টিভিতে কী সব গুরুগম্ভীর প্রোগ্রাম দেখে, আমাকে নিয়ে যে একটু ঘুরতে বেরোবে সেই ইচ্ছেটাও জাগেনা মনে হয়। বেড়ানোর ইচ্ছে জাগবেই কেমন করে, এমন এক বদখত জায়গায় থাকি আমরা, বেড়ানোর জায়গা বলতে কিছুই নেই। এখানে মানুষ বেড়াতে হলে শপিং মলে যায়, ওয়ালমার্টে যায় নাহলে কফিশপে যায়। এগুলো দিয়ে কি আমার মত ঘুরন্টির পোষায়? তাই আমি ফেসবুকেই ঘুরি বেড়াই। কিন্তু এবার তুই চলে গেলে আমার কি হবে! ফেসবুকে আমার ঘুরাফিরা বন্ধ। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমাকে কেন ফেসবুকে ঘুরাফিরা বন্ধ করে দিল? আমি কাকে কি বলবো, আমি নিজেইতো জানিনা আমাকে কেন ব্যান করছে। দুই তিন বছর আগে কি স্ট্যাটাস লিখেছিলাম, কখন লিখেছিলাম কিছুই মনে নেই, তার জন্য নাকি ফেসবুকের সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেছে!" এসব বলে মা মেঘলা চোখে অনেক কেঁদেছে, থেকে থেকেই কেঁদেছে।
আজ সকাল থেকেই মায়ের মুখে দখিনা বাতাস, কী সুন্দর করে বিছানায় বসে চুক চুক করে চা খেলো। দুটো বিস্কুট দিয়েছিল মিথীলা, কিন্তু মা একটা বিস্কুট খেলো, আরেকটা প্লেটেই রয়ে গেলো। এরপর বিছানা থেকে নেমে মায়ের বিছানার পাশের জানালার ধারে রাখা জলের জারের কাছে গেলো। কেমন আহ্লাদি সুরে ডাকতে লাগলো, " ও বর্ণময়ী, ও মনা ও সোনা, ইলি ইলি ইলি, খিদে পেয়েছে, ওলে বাবালে দিচ্ছি দাঁলাও, এক্ষুণি খাবাল দিচ্ছি"। মা কথা বলছে কড়ে আঙুলের সমান একটা 'বেইটা ফিশের' সাথে। থ্যাংকস গিভিং ছুটিতে শিখর দাদা বেড়াতে এসেছিল, মা'কে এই মাছটা গিফট করেছে। শিখর দাদা 'মি আ'র (মিশা ) বন্ধু। মা শুধু মাছ নয়, সবার সাথেই এমন আহ্লাদ করে কথা বলে, ক্রিসমাসের ছুটিতে 'মোনা' ( মৌটুসি) এসেছিল মোনার দুই কুকুর নিয়ে। কুকুরদের নাম 'মমপ্রিয়া' আর 'পিনাকি
( পিনাট)। মা কুকুর দুটোর সাথেও এমন আহ্লাদ করে কথা বলতো, পিনাকিকে ডাকতো ' পিনা, পিনু, পিনাটু, পিনাইক্কা' আর মমপ্রিয়াকে ডাকতো 'মমলা, ছমলা ঝমলা'। মা যখন দখিনা বাতাসের মেজাজে থাকে, ছোট্ট বাড়িটার চারদিকে দখিনা বাতাস খেলা করে। সেই মায়ের মন খারাপ। মিথীলা চলে গেলেই মা 'একা' হয়ে যাবে, না থাকবে মিথীলা পাশে, না থাকবে ফেসবুক!
মিথীলা সেদিন আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, " মা, ডর্মে থেকে আমি ভুলে গেছি, আমার প্রিয় খাবার কি কি ছিল?" বললাম, " শাক, বেগুন ভাজা, চিকেন কোর্মা, মিঠু''স সিগনেচারড নুডুলস, রসগোল্লা, পাটিসাপটা পিঠা,লুচি, পনির কারি----" ।
-মা, সবগুলো না, কয়েকটা কি রাঁধতে পারবে?
-পারবো।
পাটিসাপটা পিঠা, পোলাও, নুডুলস, লেডিকেনি্ লুচি খাওয়ানো হয়ে গেছে। তবুও আজ যেহেতু অফ ডে শুক্রবার, তাই দুপুরে মিঠু'স সিগনেচারড নুডুলস রান্না করতে গেলাম। রাতের জন্য রাঁধবো পনির কারি, ছানা ভেজে শাকের ঘন্ট, ফুলকপির বড়া।
ফেসবুক নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই। সেদিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছিলাম, সবাই শুধু ভার্চুয়াল বন্ধু কথাটা বলে, ফেসবুকের বন্ধুরা নাকি ভার্চুয়াল। আমি ভার্চুয়াল কথাটা বুঝিনা। আমার বন্ধুরা কি ভার্চুয়াল নাকি রিয়েল?" কমেন্টে যার যার মনের কথা লিখেছে।
প্রায় পনেরো দিনের উপর হয়ে গেলো, আমি ফেসবুকে অপ্রত্যাশিতভাবে, অন্যায়ভাবে ব্যানড হয়ে আছি। আমার আত্মসম্মানবোধ খুব তীব্র, এমন অন্যায়ের কোন প্রতিকার করতে পারছিনা অথচ অন্যায় হয়েই চলেছে। কয়েকজন বন্ধু পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা সহমর্মিতা প্রকাশ করছে, কিভাবে এই অসহ্য অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায় সে ব্যাপারে বিভিন্ন উপায় বাতলানোর চিন্তা করছে। তাদের পাশে পেয়ে আমার খুব ভাল লাগছে যেমনি, খারাপ লাগাটা তার চেয়েও বেশি।
ফেসবুক বন্ধুরা ভার্চুয়াল নাকি রিয়েল---উত্তরটা পেয়ে গেছি।
আমার স্বভাবটা হচ্ছে, একটা বিষয় নিয়ে খুব বেশিক্ষণ বিচলিত হয়ে থাকতে পারিনা। ফেসবুক বাদ, শুরু করেছি ব্লগে লেখা। এরপর হয়তো আবার পত্রিকায় লেখা শুরু করবো। তারপর অসমাপ্ত বইগুলো। কয়েক বছর আগে নূর হোসেন মাণিক নামের এক অতি চমৎকার বন্ধু আমায় বলেছিলেন, আমি নাকি খুব বেশিদিন ফেসবুকে থাকবোনা। ফেসবুক ছেড়ে লেখালেখিতে মন দেবো। তখন হেসেছি, আজ মনে হচ্ছে মাণিক ভাইয়ের কথা সত্য প্রমাণিত করার জন্যই বোধ হয় আমার ভাগ্যে এই ব্যান অপমান জুটলো।
নুডুলস যখন রান্না করছি তখন মিথীলা বোমাটা ফাটালো। " মা, আজ কি আরেকবার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যেতে পারি?"
মিথীলার কথা শুনে আমার রান্না থেমে গেলো, মুখের কথা থেমে গেলো, দখিনা হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। চেহারায় রোদও না, মেঘও না, কেমন যেন কুয়াশা কুয়াশা আলোছায়ার আসা যাওয়া শুরু হয়ে গেলো।
-কি বলছো মিথীলা? আজ আমার ছুটি, সোমবার তুমি চলে যাচ্ছো, আর আজই কিনা তুমি বন্ধুদের সাথে টাইম স্পেন্ড করতে চাইছো? অনেকদিন তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলে!
-মা, অনেকদিন কোথায়! এক মাসে মাত্র দশ দিন আড্ডা দিয়েছি। বন্ধুরা চলে যাবে যার যার ইউনিভারসিটিতে, আমি আমার ইউনিভারসিটিতে। ওদের সাথে কি আর সহজে দেখা হবে?
-মিথীলা, বন্ধুদের সাথে তোমার দেখা হবে, হয়তো আমার সাথেই দুই বছর পর আর দেখা হবেনা।
-কী বলো মা, তোমার সাথে দেখা হবেনা কেন? ছুটিতে তো আমি এই বাসাতেই আসবো, তোমাদের সাথেই থাকবো।
-মিথীলা, আমি যদি পৃথিবী ছেড়েই চলে যাই, কোন বাসাতেই আমায় পাবেনা। কিন্তু বন্ধুদের দেখা পাবে দশ বছর পরেও।
-মা, যাইনা আজকে। কাল সকালেই চলে আসবো। আমিতো ঘরে থাকলেও ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে থাকি, তোমাদের সাথে কি থাকি?
-ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে থাকলেও এই ঘরেই তো থাকিস, তোর গায়ের গন্ধ পাই, শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।
-মা, আরও দুই দিন আছিতো। যাই আজকে!
চুপ করে গেলাম। কুয়াশার চাদর সরিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম আমার 'মিথীলাবেলা'র দিন। মিথীলার বয়সে আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলনা, স্কুল, কলেজ আর বাসা। ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হওয়ার পর নতুন এক জায়গা হলো হোস্টেল, হোস্টেলে যখন প্রথম গেলাম, বাসার মধ্যে বড় হওয়া আমি প্রায় প্রায় হোস্টেলের বিছানায় শুয়ে কাঁদতাম, দম বন্ধ হয়ে আসতো। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নারায়ণগঞ্জ চলে যেতাম এক দিনের জন্য। ধীরে ধীরে ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব হয়, ছেলে মেয়েতে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়, কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা গ্রুপ তৈরী হয়। সেই বন্ধুরা মিলে কত ঘুরাঘুরি, জাহাঙ্গীরনগর থেকে প্রতি শুক্রবার বাসে চেপে ঢাকা চলে আসা, এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা,কয়েক বন্ধু মিরপুর লাভলীর বাড়িতে গিয়ে দুই দিন কাটানো---- এসবেই মন মজে যায়, দম বন্ধ ভাব ফুরিয়ে যায়, বাসায় যাওয়ার তাগিদ কমে আসা! দুই তিন সপ্তাহ পর যখন বাসায় যেতাম, মায়ের চোখে দেখতাম আজকের 'আমি মায়ের' আকুতি, আর দুটা দিন যদি থাকতে পারি।
তখন মাঝে মাঝেই এরশাদ ভ্যাকেশান পাওয়া যেতো। বর্তমানের জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট হো মো এরশাদ ছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। ছাত্র আন্দোলন দমাতে মাঝে মাঝেই ইউনিভারসিটিগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যেতো, হোস্টেল ছেড়ে বন্ধুরা বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে যে যার বাসায় চলে যেতাম। মোবাইল ফোনতো ছিলনা, বন্ধুদের কারো সাথে যোগাযোগ হতোনা।
এরশাদ ভ্যাকেশানে বাসায় এলে মায়ের মনে আনন্দের বাণ ডাকতো। মা আমার উপর রান্নার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে স্কুলে চলে যেতো। আমিও তখন মনের আনন্দে রান্নাবান্না করতাম, দুপুরে অফিস থেকে বাবা এলে বাবাকে, ভাইদেরকে খেতে দিতাম। আর উসখুস করতাম কবে ভ্যাকেশান শেষ হবে, বন্ধুদের দেখা পাবো চিন্তায়। খুব মাঝে মাঝে দুই একজন বন্ধু নারায়ণগঞ্জ আমাদের গরীবী বাসায় বেড়াতে আসতো, মা গরীবী কায়দায় কিন্তু অন্তর দিয়ে বন্ধুকে ভাত বেড়ে খাওয়াতো, ঠিক যেমনটি আমি খাওয়াই আমার মেয়েদের বন্ধুরা এলে।
সবইতো একই রকম, শুধু সেকাল আর একালের সময়ের ব্যবধান। সেকাল কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়লেও মুছেতো যায়নি, কুয়াশার চাদর সরালেই দেখতে পাওয়া যায় একালের চিত্র সেকালের ফ্রেমে বন্ধী হয়ে আছে।
মন খারাপ কতক্ষণ থাকতো কে জানে! হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পেলাম, মিশা মেয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে।
" মা, তুমি কিচ্ছু ভেবোনা। একদম মন খারাপ করোনা। তোমার ব্লগটাকে আমি খুব সুন্দর করে তৈরী করে দেবো। ফেসবুকে তোমার ৩০ হাজার ফলোয়ার, ৫ হাজার বন্ধু, তাদেরকে মিস করছো! ব্লগে তোমার এক লাখ পাঠক পাবে, সেভাবেই ব্লগ তৈরী করে দেবো। তুমি লিখে যাও, লেখা থামিওনা। সব সময় অন্ধকার থাকেনা, রাত কি সব সময় থাকে বলো? রাত শেষে দিন শুরু হয়, তোমারও দিন শুরু হবে। আমরা সবাই তোমাকে ভালোবাসি"।
ওমা, কখন কোন ফাঁকে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। এত ভাবের ঘোরে থাকার মাঝেই রান্না করে ফেলেছি মটর পনির কারি, ছানা দিয়ে শাকের ঘন্ট, ফুলকপির বড়া। মিথীলাও নিত্য পূজো সেরে তৃপ্তি করে ভাত খেয়ে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার জন্য রেডি। আজ বাইরে অনেক ঠান্ডা, বন্ধু নিতে আসবে মিথীলাকে। আমিই বললাম, বন্ধুকে আসতে হবেনা, তোমার পাপা তোমাকে পৌঁছে দিবে"।
মিথীলা বলল, " পাপা আমাকে নিয়ে গেলে তুমি ঘরে একা থাকবে কিভাবে? ভূতের ভয় পাওতো তুমি"
-থাক, এতই যদি চিন্তা করবে আমার জন্য, তাহলে তো মা'কে ফেলে বন্ধুর বাড়ি যেতে চাইতেনা। বাইরে আবহাওয়া খারাপ, তোমাকে নিতে এসে পরের বাড়ির মেয়ে যদি পথে ঘাটে কোন বিপদে পড়ে, তার চেয়ে তোমার পাপা দিয়ে আসুক তোমাকে"।
মিথীলা চলে গেলো বন্ধুর বাড়ি, যাওয়ার সময় কেমন অপরাধী কন্ঠে শুধু বলে গেলো, " মা, আজকের খাওয়াটা খুব ভাল হয়েছে আমার। সব রান্না খুব ভাল হয়েছে। থ্যাংক ইউ মা"।
আজ রাতে মিথীলাকে নিয়ে নয়, স্বপ্ন দেখছি মিশার দেখানো আশার আলো মেখে। সাত বছর আগে মিশার বয়স ছিল কুড়ি বছর, আমার বয়স ছেচল্লিশ। মিথীলা এগারো বছরের ফুটফুটে বালিকা। তখন আমি একাকীত্বে ভুগিনা, একাকীত্ব আমার বাড়ির ত্রিসীমানাতেও ছিলনা। মৌটুসি মিশা কলেজে পড়তো তাই দূরে থাকতো, কিন্তু আমাদের স্টেট ইউনিভারসিটিতে প্রচুর বাঙালি স্টুডেন্ট ছিল তখন। তাদের সাথে ছিল আমাদের ভাব ভালোবাসা। আসা যাওয়া, খানাপিনা আড্ডাতেই ভরা থাকতো আমাদের শনি রবি। তখন ফেসবুক নতুন নতুন বিস্ময়, ভালোলাগা উন্মাদনার শুরু শুরু ধাপ। মিশা আমাকে জোর করে ফেসবুক একাউন্ট খুলে বসিয়ে দিয়েছিল।
সেই থেকে শুরু, মিশা ধারণা করতে পারেনি ওর মা একদিন ফেসবুকেই দ্বিতীয় পৃথিবীর সুখ খুঁজে পাবে। মিশা দেখেছে কিভাবে তিলে তিলে, নিজের চেষ্টায় ওর মা ফেসবুকে নিজের জন্য আলাদা এক জগত সৃষ্টি করেছে যে জগতে মিশা মিথীলা মৌটুসি অচেনা হয়েও মায়ের বন্ধুদের কাছে অনেক বেশি চেনা, অনেক বেশি আপন। মায়ের সেই ভুবন আজ লন্ডভন্ড করে দিয়েছে কিছু দানব। মিশা তো সেই দানবের সাথে লড়াই করতে পারবেনা, মিশা শিখেছে সুস্থ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার মন্ত্র, অন্যকে বাঁচতে দেয়ার মন্ত্র। কারো ক্ষতি করার শিক্ষা মিশা পায়নি বলেই আজ মায়ের লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া ফেসবুক জগতটাকে মায়ের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার কায়দা পাচ্ছেনা। তাই মা'কে ব্লগে ১০০ হাজার পাঠকের ভীড়ে দেখতে চাইছে। মিশা জানেনা ব্লগ নিয়ে মা কতদূর যেতে পারবে, মিশাতো এটাও জানতোনা ফেসবুকে অজ্ঞ মা ফেসবুকে কতদূর যেতে পারবে!
১২ই জানুয়ারী, ২০১৮
অসাধারণ লেখা দিদি। তুমি লিখে যাও, একদিন সত্যিই তোমার ব্লগের পাঠক ১০০ হাজার হবে। তোমার লেখা আমি আমার পেজে শেয়ার করছি।
ReplyDelete